টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ-২১ প্রোফাইল : তাসকিন আহাম্মেদ

ডেস্ক নিউজ
  • প্রকাশিত সময় : রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১
  • শেয়ার করুন

  • Facebook

১৬ এপ্রিল, ২০১৯

“আমি কিছু বলতে চাচ্ছিনা, সবাই যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই করেছে। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন, আমি চেষ্টা করবো আরও ভালো করে ন্যাশনাল টিমে ফিরে আসার”

২৮ জুন, ২০২০

“আমি আমার রুটিন সম্পর্কে এখন অনেক বেশি সচেতন। ফুড, নিউট্রিশন, মাইন্ড ট্রেনিংয়ের সাথে নেট প্র্যাকটিস ; এটাই প্রসেস। আমি পারফরম্যান্স ভালো কিংবা খারাপ করি, প্রসেসটা এখন একই থাকবে। হ্যাঁ অবশ্যই, ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই এই প্রসেসটা মেনে চলা উচিৎ ছিলো”

দুটোর কথাকে এক শব্দে বর্ণনা করলে কি দাঁড়ায়? প্রথমটায় ‘অসহায়ত্ব’ আর দ্বিতীয়টায় ‘আত্মবিশ্বাস’ !! জ্বি, ক্যারিয়ারের শুরুর বেলার তাসকিন আর করোনা পরবর্তী সময়কালের তাসকিনের পার্থক্যটাও এই জায়গায়।

মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডের তাজিম থেকে বাংলাদেশের তাসকিন হওয়ার পেছনের গল্পে আছে ডিসকাভারি ক্লাব থেকে আবাহনী মাঠের রোজকার প্র্যাকটিস, ২০১১ ঢাকা মেট্রোর হয়ে বয়সভিত্তিকে অভিষেক, ‘১২ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে দলের হয়ে সর্বাধিক উইকেট (১১) শিকারের মতো ছোট ছোট অধ্যায়। লামলাইটে আসাটা তার পরের বছর ই, নেট বোলার থেকে সরাসরি কিংসের শিবিরে! সেমিতে রাজশাহীর বিপক্ষে ৩১ রান দিয়ে ৪ উইকেট ও ফাইনালে ২৮ রানে ২ উইকেট ; দৈহিক উচ্চতা আর বলের গতি দেখে ক্রিকেটবোদ্ধারা বললেন, মাশরাফি রুবেলের পরে আরেকটা জাত পেসার পেলো বাংলাদেশ।

‘১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অজি ম্যাচের আগেরদিন এলো প্রথমবার দেশের জার্সি গায়ে জড়ানোর সুযোগ, আইডল মাশরাফির ইঞ্জুরি স্ট্যান্ডবাই তাসকিন খেলবেন পরের ম্যাচ! মিডিয়ার মুখোমুখি হতেই লক্ষ্যটা চেপে রাখলেন না, জানালেন সুযোগ পেলে নিতে চান ম্যাক্সওয়েল ও ওয়াটসনের উইকেট। ওয়াটসন খেলেন নি সেই ম্যাচ, তাতে কি? ম্যাক্সওয়েল তো আছেন! তাইতো বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে তাসকিন নিজের অভিষেক ম্যাচে উইকেটের খাতা খুলেছিলেন তার স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলেই, বোলিং ফিগারটা ছিলো ৪-০-২৪-১

একই বছরের ১৭ জুন ভারতের বিপক্ষে স্বপ্নের মতো ওয়ানডে অভিষেক, ৮ অভারে ২৮ রান দিয়ে ৫ উইকেট। দল হারলেও ঐ পারফরম্যান্সে আনকোরা তাসকিনকে বিশ্বকাপের জন্য বেছে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি নির্বাচকদের। টিম বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল বিশ্বকাপ মিশনে তাসকিনও ছিলেন সফল, যুব বিশ্বকাপের মতো সেবার মূল দলের বিশ্বকাপেও দলের সর্বোচ্চ উইকেট টেকার ; ৬ ম্যাচে তাসকিনের শিকার ৯. সেবছর মোট ১১ ওয়ানডে খেলে তাসকিনের শিকার ১৪ উইকেট।

২০১৬ সালটাও মন্দ কাটেনি, রঙিন জার্সিতে ১৯ ম্যাচে ২১ উইকেট ; তবে বিশ্বকাপের মাঝপথে অবৈধ বোলিং এ্যাকশনের দায়ে নিষিদ্ধ হয়ে দেখেছিলেন মুদ্রার উল্টোপিঠও। কঠোর পরিশ্রমে ফিরে এসে খেলেছিলেন আফগান, ইংল্যান্ড ও কিউইদের বিপক্ষের সিরিজ। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে বছরটা ছিলো ২০১৭ সালে, সাদা পোশাকে অভিষেক হলেও পারফরম্যান্সে ছিলেন মলীন! ঐ বছর খেলা ৫ টেস্টে উইকেট মাত্র ৭টা, রঙিন পোশাকেও লঙ্কানদের বিপক্ষে হ্যাট্রিকের ম্যাচ বাদ দিলে বাকি ১২ ম্যাচের কোনটাতেই পারফরম্যান্স ছিলোনা বলার মতো। টি-টোয়েন্টিতে ইকোনমি ১০’র উপরে, ওয়ানডেতেও সেটা ৭ ছুঁই ছুঁই! ফলাফল দল থেকে বাদ! ২০১৮ সালে ২ টি-টোয়েন্টি খেললেও কোনটাতেই বোলিং কোটা পূরণ করানোর সাহস করেননি ক্যাপ্টেন, ইকোনমি ১১! গড়, স্ট্রাইক রেট কিংবা ইকোনমি রেট, প্যারামিটারে তর তর করে বাড়ছিলো বলে নির্বাচকরা সব ধরণের বিবেচনা থেকে বাদ দিলেন তাসকিনকে। তবে তাসকিন ফিরেছিলেন, ১৮/১৯ সিজনের বিপিএলে বল হাতে আগুনের ফুল্কিও ঝেড়েছেন। ১২ ম্যাচে ২২ উইকেট, সিক্সারসের হয়ে টপ/মিডল বা ডেথ অভার, সবখানেই তুলেছেন উইকেট। তাসকিন যখন স্বপ্ন দেখছেন আবার দেশের হয়ে খেলার, তখনি গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে ইঞ্জুরি ; যে ইঞ্জুরি বহুবার ক্যারিয়ারের গতিরোধ করেছে তাসকিনের।

ইঞ্জুরি থেকে ফিরলেও ফিটনেস ঘাটতিতে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়লেন। মিরপুরে সেদিন ই হয়তো তাসকিন তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ডিসিশন টা নিয়েছিলেন, ফিরতে হলে ফর্ম-ফিটনেস-মেন্টাল স্ট্রেন্থ সবকিছুতে শতভাগ নিয়েই ফিরতে হবে। করোনাকালীন সময়টাকেই তাই বেছে নিলেন নিজেকে প্রস্তুতের মঞ্চ হিসেবে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটালেন জিমে। বাড়ির গ্যারেজকে বানালেন পিচ, সিড়িতে দৌড়ে বাড়িয়েছেন ফিটনেস। মনোবিদের অধীনে রুটিন মাফিক কাজ করে বাড়ালেন মেন্টাল স্ট্রেন্থ, যাতে পারফরম্যান্স কখনো মনোবলে চিড় না ধরাতে পারে। সবগুলোর সমন্বয়ে তাসকিন করোনা পরবর্তী ক্রিকেটে ফিরলেন ভার্সন টু হয়ে!

প্রেসিডেন্টস কাপ ও বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে তাসকিনের বোলিং দেখে ক্রিকেটপাড়ায় বিষ্ময়! ধারাবাহিকতা বজায় থাকলো কিউই ও লঙ্কানদের বিপক্ষে। পরিসংখ্যান হয়তো বলবে খুব গড়পড়তা, কিন্তু যারা ম্যাচ দেখেছেন তারাই বুঝতে পেরেছেন তাসকিনের পরিবর্তন টা। পারফেক্ট লাইন-লেন্থের সাথে, সুইং, বাউন্সের মিশেলে গতির আগ্রাসন। মুড়ি মুড়কির মতো ক্যাচ না ছাড়লে পরিসংখ্যানের পাতার ২ কিংবা ৩ গুণ উইকেট বেশি থাকতো এই ম্যাচগুলোতে। অথচ, এই তাসকিনকেই নিন্দুকরা দলের সবচেয়ে ‘ব্রেইনলেস’ ক্রিকেটার বলে খোঁচা দিতো একটা সময়।

বিশ্বকাপটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের, তাই শুধু শুধু ফরম্যালিটির খাতিরে অন্য ২ ফরম্যাটের পরিসংখ্যান আনতে চাচ্ছিনা। তাসকিন আহমেদের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার :

ম্যাচ – ২৪
ইনিংস- ২২
অভার- ৭১.৪
রান – ৬০১
উইকেট – ১৫
সেরা ফিগার – ৩২ রানে ২ উইকেট
ইকোনমি- ৮.৩৮

২ বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতাও আছে, পরিসংখ্যানটাও টোটাল ক্যারিয়ারের চেয়ে উজ্জল! ৫ ম্যাচের ৪ ইনিংসে বল করে ৬ ইকোনমিতে ৪ উইকেট।

বিশ্বকাপ সম্ভাবনা ও প্রত্যাশাঃ

স্ট্যান্ডবাই রুবেলকে বাদ দিলে অভিষেকের হিসেবে পেস লাইনআপের সবচেয়ে অভিজ্ঞ নামটা তাসকিন। তবে আইপিএল দেখে স্লো পিচের আভাস, দলের স্পিন নির্ভরতা ও ফিজ/শরিফুল/সাইফদের চেয়ে ভ্যারিয়েশনে পিছিয়ে থাকায় স্কোয়াডে সুযোগ পাওয়াটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাসকিনের।

চ্যালেঞ্জ উতরালে?

হ্যাঁ, আশাবাদী হওয়াই যায়। লঙ্কায় ফ্লাটপিচেও গতি দিয়ে নাভিশ্বাস করার চিত্রটা তো এখনো পুরনো হয়নি, তাসকিন দেখিয়েছেন সাফল্যের জন্য এখন সব পিচে সমীহ আদায় করে নিতে প্রস্তুত তিনি। তাছাড়া দলে তাসকিনের রুলও বরাবর এটাই, গতিময় বোলিংয়ে ব্রেকথ্রু এনে দেওয়া। রান আটকানোর কাজটা বাকি বোলারদের।

‘রানমেশিন’ ট্যাগ পাওয়া তাসকিন আগে অভারে অন্তত ২/৩ টি লুজ বল গিফট করতেন, ছিলো বারবার নো বলের বিরক্তিকর অভ্যাসও। দলে ফেরার পর ‘নো বলের অভ্যেস’ টা নেমেছে শূণ্যের কোটায়, লুজ বল কিংবা গিফট বলও সহসাই পাচ্ছেন না ব্যাটসম্যানরা। আগে যেখানে করতেন ‘ফ্রন্ট অন’ বোলিং, সেখানে এখন স্ট্যাম্পের অনেক কাছে ফুট ল্যান্ডিং করিয়ে এনেছেন নিয়ন্ত্রণ। আগে যেখানে ল্যান্ডিংয়ের সময় শরীর ঝুঁকে যেতো, সেখানে এখন বাম হাত বডির পাশাপাশি রেখেই করছেন সাইড বন বোলিং। ফলে এই ল্যান্ডিং মোমেন্টামটা যেমন বাড়িয়েছে বলের গতি, তেমনি সুইং বাউন্সেও এনেছে নিয়ন্ত্রণ।

তাইতো পরিসংখ্যানের “বোবা বই” থেকে বেরিয়ে এসে পরিশ্রমী আর ক্রিকেট এওয়ারনেসে নিজেকে বদলে ফেলা তাসকিনকে নিয়ে বিশ্বমঞ্চে বহুদূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখাই যায়।

 

মন্তব্য করুন

এই বিভাগের আরো খবর