টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ-২১ প্রোফাইল: নাইম শেখ

ডেস্ক নিউজ
  • প্রকাশিত সময় : রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১
  • শেয়ার করুন

  • Facebook

বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে একটা কমন প্রশ্ন হলো, তামিমের ব্যাটিং পার্টনার কে হবে? ২০০৭ সাল থেকে এই পর্যন্ত তামিম ইকবাল খান বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপের ওপেনিং স্লটের একটা জায়গা দখল করে রাখলেও তার অপর পাশে কে শুরু করবে তা নিয়ে থাকে নানান কথাবার্তা। কখনো ইমরুল কায়েস, কখনো জুনায়েদ সিদ্দিকী, এদের পরে এনামুল হক বিজয়, সৌম্য সরকার, লিটন দাস কিংবা হালের সাদমান ইসলাম বা নাইম শেখ। তাদের মধ্যে কেউই তামিম ইকবালের নির্ভরযোগ্য ওপেনিং পার্টনার হতে পারে নি।

তবে এদের মধ্যে নাইম শেখ একধাপ এগিয়ে থাকবে। তার খেলা দুটি ওয়ানডের মধ্যে একটিতে এবং টি-টোয়েন্টিতে তিনটি ম্যাচে তামিমের সাথে ব্যাটিংয়ের সূচনা করেন। তামিমের নির্ভরযোগ্য ব্যাটিং পার্টনারের বেলায় তার নাম-ডাক শুনা গেলেও তিনি আলোচনায় থাকবেন কিছুটা ভিন্ন কারণে।২০১৯ সালে ভারতের বিপক্ষে তার অভিষেক হয়েছে তামিমের ইনজু রির বদৌলতে, ২০২০ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি টি-টোয়েন্টিতে তামিম এর বদলে খেলেছেন এবং সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের খেলা ১৬ টি টি-টোয়েন্টিতে তিনি ওপেন করেন, এই ম্যাচগুলোতে তামিম থাকলে হয়তো তার খেলার সুযোগ হয়ে উঠতো না। সবমিলিয়ে বলাই যায়, সে তামিমের বদলে আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে।

নাইম শেখ, ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করা এই ক্রিকেটার এই পর্যন্ত ২ টি ওয়ানডে এবং ২২ টি টি-টোয়েন্টি আই খেলেছে। তার সমান টি-টোয়েন্টি খেলে কোন বাংলাদেশী ব্যাটার তার চেয়ে বেশী রান করতে পারেন নি। টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ এভারেজের তালিকায় তার অবস্থান তিন নম্বরে, তার উপরে থাকা দুই জনের একজন আবু হায়দার করেছেন মোটে ৫৮ রান আর এনামুল হকের সংগ্রহ তার প্রায় অর্ধেক রান। শুধু তাই না এই বছর বাংলাদেশের হয়ে টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ রান করা ব্যাটার তিনি এবং সব মিলিয়ে তার অবস্থান সেরা পাঁচে। এত সবকিছু অর্জনের পরও ভক্ত-সমর্থকদের আতশি কাঁচের নিচে তাকে পড়তে হয়। আর হবেই না কেন?টি-টোয়েন্টিকে যেখানে বলা হয় রানের খেলা সেখানে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তার স্ট্রাইক রেট ১০৬, এই বছরের হিসেব করলে তা ১০০ এর কমে গিয়ে ঠেকে। বল বেশী খেলেও টি-টোয়েন্টির প্রয়োজন অনুসারে তার রান না করা এইবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটারকে নিয়েও বাংলাদেশ শিবিরে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।

স্পিনার কিংবা পেসার, তাদের বাজে বলে সজোরে মাঠ ছাড়া করতে, অফ সাইডের সামান্য স্পেস কাজে লাগিয়ে বাউন্ডারি পাড় করতে কিংবা ফিল্ড রেস্ট্রিকশনের সময় ফিল্ডারদের মাথার উপর দিয়ে পিঞ্চ হিটিং এই কাজগুলোতে সিদ্ধহস্ত নাইম শেখ। তার গুণাগুণ যদি এগুলো হয়ে থাকে তাহলে তার ব্যর্থতার কথা বলা যাক। বড় শট খেলার সাহস থাকলেও শরীরের শক্তির অভাব, ফুটওয়ার্কে সমস্যা আর সফট হ্যান্ডে বল খেলা, বলতে গেলে একবারেই পারেননা। সবকিছুকে ছাপিয়ে তার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নিজের দুর্বলতার জায়গায় তিনি বেশ দুর্বল।

এত সমস্যার থাকার পরেও তার উপর ভরসা করতে হবে বাংলাদেশ ম্যানেজম্যান্টকে। একে তার বিকল্প তেমন কেউ নেই আর দ্বিতীয়ত হলো স্ট্রাইক রেটে তার যে সমস্যা তার জন্য মিরপুরের পিচও দায়ী। মিরপুরের পিচে শুধু সেই টি-টোয়েন্টির প্রয়োজন অনুসারে ব্যাট করতে পারেননি এমনটা নয়, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে সবাই একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। যদিও তার সিংগেল বের করার অক্ষমতা এবং বিশ্বকাপে যেই ভেন্যুতে খেলা হবে সেই ভেন্যুগুলোর উইকেটের অবস্থা মিরপুরের মতোই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে তার অবস্থার কতটুকু উন্নতি হবে তা নিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকেই যায়।

১৯৯৯ সালের ২২ শে আগস্ট জন্মগ্রহন করা নাইম শেখের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঢুকার আগের জীবন নানা রকম অভিজ্ঞতা দিয়ে গেছে। ২০১৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে নাইম শেখ যোগ দেন ফরিদপুরের একটি ক্রিকেট কোচিং ক্লাবে।

২০১৭ সালে নারায়ণগঞ্জের সাথে একশো করার পর ম্যান অফ দা সিরিজ হয়, এরপর নাইম ডিভিশনাল দলে সুযোগ পায়।

শুরুতে নাইমের পরিবার পড়ালেখা করানোর প্রতি বেশি আগ্রহী থাকলেও কিন্তু মাধ্যমিকে যখন ব্যর্থ হন নাইম, এরপর আরো একাগ্রতার সাথে ক্রিকেটে মনোযোগী হন।

ফরিদপুর জেলার হয়ে সর্বোচ্চ রান করার এক বছর পর ঢাকা বিভাগের হয়ে খেলে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন।

২০১৬ সালে চ্যালেঞ্জ কাপে অংশ নিয়ে টুর্নামেন্টের সেরা ব্যাটসম্যান হওয়ার পর সরাসরি সুযোগ আসে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে।

২০১৮ সালে নিউজিল্যান্ডে যান বিশ্বকাপ খেলতে। এর আগে ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে নিজের জাত চিনান। বিশ্বকাপে তার উপর যে আশা করা হয়েছিল তা পূরণ করতে তিনি ব্যর্থ হন।

ঘরোয়া লিগে টানা দুই মৌসুম ৫৫৬ ও ৮০৭ রান করার পর হাই-পারফরম্যান্স দলে ও বাংলাদেশ ‘এ’ দলে সুযোগ পান তিনি।আফগানদের বিপক্ষে ‘এ’ দলের সিরিজে শেষ ওয়ানডেতে খেলেন ১২৬ রানের ইনিংস।

আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম পর্বের পর তাকে দলে নেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকরা। ত্রিদেশীয় সিরিজের আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রস্তুতি টি-টোয়েন্টিতে বিসিবি একাদশের হয়ে ১৪ বলে ২৩ রান করেছিলেন নাঈম।

২০১৯ সালে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে টি-টোয়েন্টিতে তার অভিষেক হয়। প্রথম দুই ম্যাচে ভালো শুরু করেও শেষ পর্যন্ত আর বড় ইনিংস খেলতে পারেননি। তৃতীয় ম্যাচে ভারতের ১৭৫ রানের টার্গেটে ওপেন করতে নেমে খেলেন ৪৮ বলে ৮১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস, সেখানে ছিলো ১০ টি চার এবং ২ টি ছয়ের মার। আইপিএল এর মত আসরে নিয়মিত খেলা বোলারদের বিপক্ষে তরুণ একজন ব্যাটারের এমন একটা ইনিংস ক্রিকেট বিশ্বে নতুন আলোচনার জন্ম দেয়।

এর পরে পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজেও অব্যাহত রাখেন রানের ধারা। করোনা মহামারীর কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বন্ধ থাকার পর প্রায় ১ বছর পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আবারো টি-টোয়েন্টিতে মাঠে নামেন। মাঝখানে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট লীগের ম্যাচে করেন সেঞ্চুরি। সেই টুর্নামেন্টে সাকিব আল হাসানের এক ওভারে চার ছয় মেরেও হন আলোচনার বিষয়বস্তু।

এক নজরে নাইম শেখের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার

ম্যাচঃ ২২
ইনিংসঃ ২২
অপরাজিতঃ ০
রানঃ ৫৭০
বলঃ ৫৩৮
গড়ঃ ২৭.১৪
স্ট্রাইক রেটঃ ১০৫.৯৪
৫০/১০০ঃ ২/০
৪/৬ঃ ৫৬/১১
সর্বোচ্চঃ ৮১
ক্যাচঃ ০৯

টি-টোয়েন্টিতে এখন পর্যন্ত তার ক্যারিয়ার ঠিক টি-টোয়েন্টি সুলভ দেখায় না। তবে, স্টাটাস দেখে তাকে বিবেচনা করাটা কিছুটা হলেও বোকামি হবে। তার ক্যারিয়ারের অর্ধেক ম্যাচ তিনি খেলেছেন মিরপুরের স্লো এবং লো উইকেটে। সেই ১১ ম্যাচে ২০.৮২ গড়ে তার সংগ্রহ ২২৯ রান, স্ট্রাইক রেট ৮৯.১১। বাকি ১১ ম্যাচে ৩৪.১০ গড়ে তার সংগ্রহ ৩৪১ রান, স্ট্রাইক রেট ১২২। এই থেকে তার ক্যারিয়ারের সামগ্রিক গড় খারাপ হওয়ার কারণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

২২ বছর বয়সী নাইম শেখকে প্রতিভাবান, ফিউচার স্টার অথবা অভিধান থেকে আরো বেশ কিছু শব্দ দিয়ে বিশেষণ করা যায়। তবে বিশ্বকাপে যখন খেলতে নামবেন তখন তিনি ১৮ কোটি বাংলাদেশীর প্রতিনিধি, ১৫ জনের মধ্যে একজন স্বপ্নের সারথি। ভবিষ্যতে সে অনেক কিছুই করতে পারে তবে বিশ্বকাপের মতো একটা বড় মঞ্চে সে যদি ভালো কিছু দলকে উপহার দেয় তার সেই অনেক কিছুর আগেই সে সবার মুখে চর্চিত হবেন। এভাবে যদি সে না ভেবে থাকেন, তাহলে এইভাবেও ভাবতে পারেন। নিজের ব্যাংক ব্যালেন্স সমৃদ্ধ করার জন্য, ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক ক্রিকেটে নিজেকে উপস্থিত করাতে হলেও বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে তার উইলো থেকে ঝড় তুলতে হবে।

আরব অঞ্চলের মানুষের জনপ্রিয় পদবী হলো শেখ। আরবীয় শেখদের উঠোনে কি বাংলাদেশী শেখ পারবে তার পরিচয় বানাতে?

 

মন্তব্য করুন

এই বিভাগের আরো খবর