শিকড় টু শিকড় ভায়া শেখরঃ সৌম্য সরকার!

Arfin Rupok
  • প্রকাশিত সময় : বৃহস্পতিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
  • শেয়ার করুন

  • Facebook
HAMILTON, NEW ZEALAND - MARCH 13: Soumya Sarkar of Bangladesh bats during the 2015 ICC Cricket World Cup match between Bangladesh and New Zealand at Seddon Park on March 13, 2015 in Hamilton, New Zealand. (Photo by Anthony Au-Yeung/Getty Images)

এলাম; খেললাম; জয় করলাম! ঠিক এমনই ছিলো সৌম্যর ক্যারিয়ারের সূচনালগ্ন। শিকড় থেকে শেখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন অল্প সময়েই। আলোর ঝলকানিতে মন জয় করলেও সেই আলো স্হায়ী করতে পারেননি, আবারো নেমেছেন সেই শিকড়েই। সম্ভাবনীয় আশাগুলো আজ রূপ নিয়েছে হতাশায়; তীব্র হতাশায়। শিকড় থেকে শেখরে পৌঁছা সৌম্য এখন ফিরেছেন সেই শিকড়েই।

সৌম্য এসেছিলেন যেনো ক্রিকেট পাড়ায় দ্রুতি ছড়াতেই। মানুষ কখনো কখনো তার স্বপ্নের চেয়েও বড় হয়! সেটির বাস্তব উদাহরণ হয়ে থাকতেই পারেন মাত্র এক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেওয়া সৌম্য সরকার! উপমহাদেশের মাটিতে পেস – সুইংয়কে কাবু করে একের পর এক কাভার ড্রাইভ, হুক শট কিংবা কাট শটে মুগ্ধ করা সৌম্য যেনো বাংলাদেশকে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলার অনুপ্রেরণাই জুগিয়েছিলেন!

সেই অনুপ্রেরণাতেই কি বদলে গিয়েছিলো বিশ্বকাপ পরবর্তী বাংলাদেশ ক্রিকেট? হয়তো তাই! অস্ট্রেলিয়া – নিউজিল্যান্ডের বাইশ গজে পেস-সুইংয়ে অবলীলায় সীমানা ছাড়া সৌম্য দেশে ফিরে কাঁপিয়েছিলেন পাকিস্তান, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর একজন সৌম্যর ব্যাটে লেখা হয়েছিলো কাব্য, রচিত হয়েছিলো বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সফলতম অধ্যায়!

এরপরের গল্পটা অজানা হবার কথা নয় কারো কাছেই! টানা ব্যর্থতা ঘিরে ধরেছিলো অবলীলায় সীমনা ছাড়া করা সৌম্যকে, হারিয়েছিলেন লাল-সবুজের জার্সিটিও। এরপর লাল-সবুজ কিংবা সাদা পোশাকের জার্সিতে ফিরলেও হারাতে হয়েছে নিজের প্রিয় পজিশন। সৌম্য এখন হয়ে ওঠেছে প্রয়োজনে প্রিয়জনের মতোই! শিকড় থেকে শেখরে পৌঁছা সৌম্য ফিরেছেন সেই শিকড়েই। তবে আশার আলো জ্বালিয়ে গেছেন সেই কবেই! তাইতো এখনো প্রতিটা মূহুর্তেই মনে হয় এই যেনো ‘১৫-এর সৌম্য ফিরে এলো; ফিরে এলো!

বর্তমান সময়ে আলোচনার তুঙ্গে থাকা সৌম্যর সমালোচনাও কম হয়না! আলোচনা সেই প্রতিভা নিয়েই; যেই প্রতিভার জের ধরে সৌম্য সুযোগ পাচ্ছেন টানা ব্যর্থ হবার পরেও! দিনশেষে সৌম্য কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে সেটি জানতে গেলে আরো কিছুটা পথ পাড়ি দিতে হবে নিশ্চয়ই। তবে; সমালোচিত সৌম্য বারবার পুরোনো স্মৃতিগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়, ফিরিয়ে নিয়ে যায় সোনালী অতীতে। যেখানে সৌম্য বিপক্ষের কাছে ছিলো এক আতঙ্কের নাম। এবার ফিরে যাবো সোনালী অতীতেই!

পহেলা ডিসেম্বর ২০১৪;
মিরপুরের বাইশ গজে ৩০ মিনিট স্হায়ী হলেও ততক্ষণে ড্রেসিংরুমে বসা হাথুরাসিংহের মন জয় করেছিলেন নিশ্চয়ই! নয়তো বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া – নিউজিল্যান্ডের মতো বাউন্স কন্ডিশনে মাত্র এক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ সৌম্যর জায়গা হবার কথা ছিলোনা! হ্যা, সেদিন মাত্র ১৮ বলেই সৌম্য জানান দিয়েছিলেন তিনি লাল-সবুজের জার্সিতে রাজত্ব করতেই এসেছে; অন্তত সেদিনের নয়নাভিরাম ব্যাটিং কারিশমায় হাঁকানো চারগুলো সেটির-ই সাক্ষী দেয়।

অভিষেক ম্যাচে সৌম্য সরকার!
  • এই যা! মাত্র ১৮ বলের জন্যই এতো গুনগান গাইলে বাকিগুলো নিয়ে বলবো কখন?
  • আচ্ছা এবার বাকিগুলো বলতে থাকি!

সৌম্যর ক্যারিয়ার উত্থান পতনের হলেও লিখেছেন কাব্য! সৌম্যতে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে যুক্ত হয়েছে বেশকিছু সোনালী অধ্যায়। শিকড় থেকে শেখরে পৌঁছা সৌম্যর জন্য ২০১৫ সালটি ছিলো গৌরবময় সময়। এই সময়টা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যও সোনালী ছিলো বটেই। আর সবকিছু মধ্যমণি কখনো সৌম্য আবার কখনো দ্য ফিজ! মজার বিষয় হলো, এই দুইজন-ই ছিলেন সাতক্ষীরার গৌরব। আজকের গল্পটি ফিজকে নিয়ে নয় শুধুই সৌম্যকে ঘিরে। যাকগে এবার মূল গল্পে ফিরি।

লাল-সবুজের দেশ ততক্ষণে পাড়ি জমিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। দলের সাথে মাত্র এক ম্যাচ খেলা সৌম্যও রয়েছে, শুধু দলেই নয়! মূল একাদশেও জায়গা পাকা। বাহ; মাস তিনেক আগেও যে জাতীয় দলের বাহিরে, সেই কি-না বিশ্বকাপের মূল দলে জায়গা পেয়েছে। হয়তো কোচ হাথুরাসিংহে কিছু একটা খুঁজে পেয়েছিলো সৌম্যর মাঝে। হ্যাঁ, তাই।

অচেনা কন্ডিশন আর চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিশ্বমঞ্চে নিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা সৌম্যর শুরুটা মন্দ ছিলোনা; ছিলোনা ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতোও! যতক্ষনে ক্রিজে নেমেছিলেন ততক্ষণে তামিম ফিরেছে সাজঘরে, ক্রিজ আঁকড়ে বসে থাকা বিজয়ও ধুঁকছে। সেখানে সৌম্যর বা কি করার! করার ছিলো অনেক কিছুই। বাংলাদেশ দল যখন আফগানিস্তানের বোলারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ধুঁকছিলো ঠিক তখনি ব্যাট হাতে তাণ্ডব শুরু হয়েছিলো এক তরুণের। ড্রেসিংরুমে বসা হাথুরাসিংহে হয়তো ততক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো! সৌম্য সেদিনের ইনিংসটি বেশীক্ষণ স্হায়ী করতে না পারলেও ৩ চার আর ১ ছয়ে আগমনী বার্তা দিয়েছিলো বটে।

দ্বিতীয় ম্যাচে সৌম্যর শুরুটা ছিলো ভয়ংকর! কিন্তু আক্ষেপ রয়েই গেলো, এবারো ৩০ এর ঘরে পৌঁছা হলোনা তার। তবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৫ বলের মোকাবিলায় ৫ চারে নিশ্চয়ই ভালো কিছুর আভাস দিয়েছিলো! এভাবে কেটে গেলো আরো একটি ম্যাচ, সৌম্যর ইনিংস বড় করা হলোনা তবুও। তবে কি, শিকড় থেকে শেখরে পৌঁছা হবেনা তার?

৯-ই মার্চ ২০১৫;
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ, জিতলেই কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ! সেটিও প্রথম বারের মতো। ১৩ বলের মাঝেই দুই ওপেনারের বিদায়। চাপকে জয় করতে পারবে কি সৌম্য? পারবে কি খোলাসা হতে? এমন প্রশ্ন যখন সৌম্যকে ঘিরে তখনি সৌম্য লর ব্যাট হয়েছিলো খোলাসা। এন্ডারসন – ব্রডদের বিরুদ্ধে সাবলীল ব্যাটিং কি কিঞ্চিৎ পরিমাণেও ভাবায়নি লাল-সবুজের দর্শকদের? হয়তো ভাবিয়েছে। জায়গায় দাঁড়িয়ে মঈন আলীকে সীমানা ছাড়া করার দৃশ্যটি আমাকে এখনো সৌম্যকে মনে করিয়ে দেয়, ফিরিয়ে নিয়ে যায় সোনালী অতীতে। হ্যা, সোনালী অতীতে সেদিন সৌম্য উপহার দিয়েছিলো ৪০ রানের দারুণ এক ইনিংস; রুবেলের হিরো হবার দিনে বাংলাদেশও জিতেছিলো, পৌঁছেছিলো স্বপ্নের কোয়ার্টারে!

মঈন আলীকে উড়িয়ে সীমানা ছাড়া করেছিলেন সৌম্য!
(Photo by Shaun Botterill/Getty Images)

হ্যামিল্টনে সৌম্য ঝলক!
এবারো ২৭ রানে বাংলাদেশের দুই ওপেনার সাজঘরে। ওয়ান ডাউনে নামা সৌম্যকে সাথে নিয়ে রিয়াদ এগিয়ে নিচ্ছিলেন দলকে। তবে, এখানে খোলাসা ছিলো সৌম্য-ই ব্যাট! বোল্ট – সাউদিদের গতি আর সুইয়ের সামনে সৌম্য যেনো এক পরিপক্ব ব্যাটসম্যান! আহ; এ যে রূপকথাকেও হার মানিয়ে দেয়। হ্যাঁ, সেদিন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধ-শতকের দেখা পাওয়া সৌম্য খেলেছিলো ৫১ রানে ভয়ডরহীন এক ইনিংস।

নিউজিল্যান্ডে বিপক্ষে প্রথম বিশ্বকাপ ফিফটির দিনে সৌম্যর ব্যাটে দারুণ এক শট!
(Photo by Phil Walter/Getty Images)

ভারতের বিপক্ষে স্বপ্নভঙ্গ হওয়া বাংলাদেশ ফিরেছে দেশে। ঘরের মাঠে পাড়ি জমিয়েছে পাকিস্তান। সৌম্য স্কোয়াডে পাকা, শুধু পাকা নয়; তামিমের পার্টনার হিসেবে দেখা যাবে সৌম্যকে। এ যেনো সৌম্যর কল্পনাকেও হার মানিয়ে দেয়! কোচ হাথুরাসিংহের বাজিতে বাজিমাৎ করতে সময় নেননি সৌম্য। পাকিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয় ম্যাচেই করে বসেছিলেন সেঞ্চুরি! গুল, রিয়াজদের বিরুদ্ধে সৌম্য হয়ে ওঠেছিলো ভয়ংকর এক নাম। সেদিন সৌম্যর ব্যাটেই পাকিস্তানকে প্রথমবারের মতো বাংলা ওয়াশের স্বাধ দিয়েছিলো টিম টাইগার। আহ; তৃপ্তিদায়ক।

এর পরের গল্পেও সৌম্য ছিলেন সাবলীল। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই ফিফটি করে উল্লাসে মাতা সৌম্য বুক চাপড়িয়ে যখন ড্রেসিংরুমে তাকিয়েছিলেন তখন হয়তো কোচ হাথুরাসিংহে মুচকি হেসে নিজেকে বলেছিলেন, “ইয়েস হাথুরু; ইউ উইন!”

হাথুরাসিংহের প্রিয় ছাত্র ততক্ষণে ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছে!

ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষেও সিরিজ জয় ততক্ষণে শেষ! পাকিস্তান – ভারতের পর ঘরের মাঠে আগমন দক্ষিণ আফ্রিকার। প্রথম ম্যাচে নামের প্রতি সুবিচার করতে না পারা সৌম্য পরের দুই ম্যাচে হয়ে ওঠেছিলো ক্ষেপাটে বাঘ। জ্বী হ্যাঁ! মরকেল – রাবাদাদের বিরুদ্ধে সৌম্যর একেকটি শট ছিলো চোখে পড়ার মতো। ইমরান তাহিরও সৌম্যর বিরুদ্ধে বল করতে গিয়ে দৌড়ের উদযাপন করতে পারেননি। প্রথম ম্যাচে অপরাজিত ৮৮ রানের পর দ্বিতীয় ম্যাচে ৯০ রানের ঝলকানিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেও করেছিলো সিরিজ জয়ের উদযাপন! ম্যাচ এবং সিরিজ সেরার ট্রফিটিও নিজের আলমারিতে তুলেছিলেন সৌম্য। ঠিক যেনো শিকড় থেকে শেখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি।

ভারতের বিপক্ষে পাওয়ার প্লে কাজে লাগিয়ে ফিফটির দেখা পেয়েছিলেন সৌম্য। ফিফটির পর এভাবেই উদযাপন করেন তিনি।

পাওয়ার প্লেতে কিভাবে ব্যাটিং করতে হয়! সেটি সৌম্য আয়ত্তে নিয়েছিল ততোদিনে। ক্রিজে একবার দাঁড়িয়ে গেলে সৌম্যর সামনে সবাই যেনো নিজেদের হারিয়ে খুঁজতো! দারুণ সব শটে মুগ্ধ করা সৌম্য পেরিস্কোপে মন জয় করেছিলো হাজারো ভক্তের। তবে, পরবর্তী কয়েকটা ম্যাচে সৌম্য জন্ম দিয়েছিলো হতাশার। চারপাশে কেমন জানি একটা সমালোচনাও শুরু হয়েছিলো। ঠিক তখনি নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ব্যাক টু ব্যাক ফিফটি করে সৌম্য জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি হারিয়ে যাননি।

ততোদিনে সাদা পোশাকেও অভিষেক হয়েছে সৌম্যর; টি-২০ তেও ছিলেন না পিছিয়ে। কিন্তু সমালোচনা নামক শব্দটি তখন সৌম্যর সাথে পরিচিত হতে শুরু করেছিলো। ভাঙ্গাগড়া চরিত্রের মতো ধারণ করেছিলো সৌম্য। মাঝে মাঝে প্রিয় ব্যাটটি আলোর দ্রুতি ছড়িয়ে সমালোচনার জবাবও দিয়েছিলো। কোচ হাথুরাসিংহেও ওঠেছিলো জনতার কাঠগড়ায়! এমন দৃশ্য দেখে সৌম্যর ভক্তরা যখন আফসোস করছিলো তখনি নিউজিল্যান্ডে মাটিতে আবারো চড়াও হয়েছিলো সৌম্যর ব্যাট। এবার রঙ্গিন পোশাকে নয়; সাদা পোশাকে দ্রুতি ছড়িয়েছিলো সৌম্য।

হ্যামিল্টনে সৌম্যর লড়াই!
এবারো সেই হ্যামিল্টন; মাঝে চার বছরের গ্যাপ! সাদা পোশাকে ১২ টি ম্যাচ খেলা শেষ হলেও স্বপ্নের সেঞ্চুরির উদযাপন করা হয়নি তখনো। প্রথম ইনিংসে সতীর্থ তামিম আর ফিল্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে লাথাম – উইলিয়ামসনদের ব্যাটিং দেখে হয়তো কিছুটা জেদ হয়েছিলো সৌম্যর! নয়তো বোল্ট – সাউদি – ওয়াগনারদের বিরুদ্ধে অমন ক্ষেপা হবার কথা নয়। তৃতীয় ইনিংসে সৌম্যর ব্যাট যেনো কথা বলছিলো। সাউদির সুইং আর বোল্টের গতির সাথে ওয়াগনারের একেকটি বাউন্স কতো সাবলীলভাবেই না মোকাবিলা করেছিলেন সৌম্য। খেলেছিল ১৪৯ রানের লড়াকু ইনিংস। তার থেকেও তার নিখুঁত টাইমিং আর প্লেসমেন্টের সাথে ওয়াগনারের শরীর বরাবর বাউন্সার গুলো সামলানোয় যেনো সবার চোখে পড়েছিলো। সেদিনের সৌম্যকে দেখে হয়তো হাথুরাসিংহে মুচকি হেসেছিলো!

চিরচেনা হ্যামিল্টনে আবারো জ্বলে উঠেছিলো সৌম্যর ব্যাট। তবে এবার সাদা পোশাকে।
(Photo by Hannah Peters/Getty Images)

চাওয়া ছিলো সৌম্য সেই ১৫ তেই ফিরবে! কিন্তু সেটি আর হলো কই? ঐ এক ইনিংস দিয়ে আর কতোটাই বা সমালোচনার জবাব দিবেন? কতোদিনই বা মুখ বন্ধ রাখতে পারবেন সমালোচকদের! এর মাঝে টানা ব্যর্থতা যখন সৌম্যকে ঘিরে ধরেছিলো তখন রঙ্গিন পোশাকে স্বস্তির হাওয়া দিয়েছিলেন সৌম্য। কিন্তু সেটিও হয়নি স্হায়ী! ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পর ২০১৯ এ এসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক ফিফটিতে আবারো আশার আলো দেখিয়েছিলেন সৌম্য। এরই মাঝে হাজির হলো ওয়ানডে বিশ্বকাপ। আয়ারল্যান্ডের মাঠে ভয়ডরহীন ব্যাটিং উপহার দেওয়া সৌম্য ইংল্যান্ডের মাটিতে ভালো করবেন সেটিরও যেনো আগাম বার্তা দিয়ে রেখেছিলো। কিন্তু, পরের গল্পগুলো কি রাজকীয় ছিলো? ছিলো কি সৌম্যময়? গল্পের মাঝেই জেনে নিই।

দ্য ওভাল;
২০১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ। টস হেরে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ পাওয়া বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিলো ৩০০ রানের গন্ডি পেরুনোর। আর সৌম্যর লক্ষ্য ছিলো নিজেকে প্রমাণের পালা; ছিলো পুরনো হিসেব চুকিয়ে দেয়ার পালা! সেই লক্ষ্যে খেলতে নামা সৌম্যর শুরুটা ছিলো বেশ! লুঙ্গি – রাবাদের বিপক্ষে শর্ট বলে সৌম্যর সাবলীল ব্যাটিং ততক্ষণে বেশকিছু হিসেব চুকিয়েও দিয়েছিলো। কিন্তু সেটি বড় হয়নি, পারেননি পুরোটা হিসেব চুকিয়ে দিতে! ৩০ বলে ৪২ রানে যখন সৌম্য সাজঘরে রওনা দিলেন ততক্ষণে ওপেনারের দায়িত্বটা বেশ ভালোভাবেই পালন করেছিলেন তিনি।

২০১৯ বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ম্যাচের দারুণ ব্যাটিং উপহার দেওয়া সৌম্যর ব্যাটে অসাধারণ এক শট!
(Photo by Andy Kearns/Getty Images)

এরপর আবারো ব্যর্থতা ঘিরে ধরেছিলো সৌম্যকে! টানা ৯ টি ম্যাচে ৪০ এর ঘরে পৌঁছাতে পারেননি একবারও! শেষবার যখন ফিফটির দেখা পেলেন ততোদিনে সৌম্য এক আক্ষেপের নাম হয়ে ওঠেছিলো! সেই আক্ষেপ আরো তীব্র হয়েছিলো ২০২১ এ এসে ৩ ম্যাচে মাত্র ৭ রানের মধ্য দিয়ে। সমালোচনা আর অফফর্ম; এর মাঝে প্রিয় পজিশনটিও হারাতে হয়েছে সৌম্যকে, সৌম্য এখন হয়ে ওঠেছে প্রয়োজনে প্রিয়জন! হ্যাঁ, সৌম্য এখন বিসিবির তাসের ঘরের রাজা! কখনো ওপেনিং, কখনোবা ওয়ান ডাউন! মিডল অর্ডারের পর আবার ফিনিশিংয়েও বাজিয়ে দেখা হয়েছে সৌম্যকে, কিন্তু সৌম্য আর শিকড় থেকে শেখরে পৌঁছাতে পারেননি; পারেননি নিজেকে মেলে ধরতে। সৌম্য ফিরেছেন সেই শিকড়েই! এ যে হৃদয়বিদারক; এ যেনো তীব্র বেদনাদায়ক মূহুর্ত একজন সৌম্যর কাছে।

  • আচ্ছা, শুধুই কি ব্যাটিংয়ে নজর কেড়েছেন সৌম্য? না কি বোলিংয়ে ছড়িয়েছেন দ্রুতি?

ব্যাটসম্যান হিসেবে সৌম্যর আগমন হলেও দলের প্রয়োজনহলে হাত ঘুরাতেও পারেন সৌম্য। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্রেকথ্রু এনে দেওয়ারও নজির রয়েছে; রয়েছে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ২০ টি উইকেট নেওয়ার অভিজ্ঞতা। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ২০১৯ এ যখন ব্যাট হাতে হতাশ করেছিলো সৌম্য! তখন অধিনায়ক মাশরাফি শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সৌম্যকে বোলিংয়ে দেখেছিলো বাজিয়ে! সৌম্যও করেনি হতাশ। অস্ট্রেলিয়ার টপ তিন ব্যাটসম্যানকে পুড়েছিলেন পকেটে। দিনশেষে অস্ট্রেলিয়া জয় পেলেও সৌম্যর উদযাপন এখনো ভেসে ওঠে।

বিশ্বমঞ্চে ফিঞ্চের উইকেট শিকারের পর উল্লাসে মেতে ওঠেন সৌম্য!
(Photo by Clive Mason/Getty Images)

ব্যাটিং কিংবা বোলিংয়ে দ্রুতি ছড়ানো সৌম্য পিছিয়ে নেই ফিল্ডিংয়েও! দলের প্রয়োজনে কখনো বাউন্ডারি লাইনে, কখনো গালী অঞ্চল আবার কখনোবা গুরুত্বপূর্ণ পজিশন স্লিপে দেখা যায় তাকে। স্লিপে বেশকিছু ক্যাচ নিয়ে জয়ে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তালুবন্দি করেছে ৮৩ টি ক্যাচ।

ফিল্ডার সৌম্য!
(Photo by Alex Davidson/Getty Images)

অনেকতো হলো! এবার পরিসংখ্যানে একজন সৌম্যকে জানতে গেলে কেমন দেখাবে? সেদিকে না হয় নজর দেওয়া যাক। আচ্ছা আসুন…

২০১৪ থেকে ২০২১; বাংলাদেশের হয়ে ১২৪ ম্যাচে দেখা গিয়েছে সৌম্যকে। সাদা কিংবা রঙ্গিন পোশাক; সবমিলিয়ে সৌম্যর ঝুলিতে ৩৪৫১ রান, ৩ সেঞ্চুরির সাথে ১৭ ফিফটি; রয়েছে ১৫ টি শূন্যেরও ইনিংস। এর মাঝে টি-২০ ক্রিকেটে সবচেয়ে বেমানান সৌম্যর ব্যাট! ৫০ ম্যাচে মাত্র ২ ফিফটির ফরম্যাটে রয়েছে ৮ টি ডাক!

বছরের পরিসংখ্যান সৌম্যর বিষয়ে কি জানান দেয়! সেটি দেখে নেওয়া যাক এবার!

 সাল   ম্যাচ    রান     গড়
২০১৪   ০১     ২০    ২০.০০
২০১৫   ২১     ৮২৩   ৩৯.১৯
২০১৬   ২০     ২৮৭   ১৪.৩৫
২০১৭   ২৬     ৯২৯   ২৯.৯৬
২০১৮   ২৩     ৪৬৯   ১৯.৩৪
২০১৯   ২৫     ৮০৯   ২৮.৮৯
২০২০   ০৪     ৯৪    ৯৪.০০
২০২১   ০৪     ২০    ০৬.০০

পরিসংখ্যান বলে ২০১৫ সালটি ছিলো সৌম্যর জন্য সোনালী অতীত। পিছিয়ে ছিলেন না ২০১৭, ২০১৯ সালেও! এর মাঝে ২০১৬ সালটি ছিলো হতাশার! ২০২১ এ সেটি রূপ নিয়েছে তীব্র হতাশায়।

  • হোম না কি অ্যাওয়ে! কোথায় সফল সৌম্যর ব্যাট?

পরিসংখ্যান বলে সবচেয়ে বেশী ম্যাচ খেলেছেন ঘরের মাঠেই! তবে পিছিয়ে নেই ঘরের বাহিরেও। আচ্ছা পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক!

ফ্যাক্ট      ম্যাচ      রান       গড় 
হোম       ৫০      ১৪৩১     ২৮.০৫ 
অ্যাওয়ে     ৩৯      ১৩৩২     ৩০.৯৭
নিউট্রাল     ৩৫      ৬৮৮      ১৯.৬৫

পরিসংখ্যানে ঘরের সবচেয়ে বেশী ম্যাচ এবং রান করলেও গড়ের দিকে এগিয়ে ঘরের বাহিরেই। নিরপেক্ষ মাঠে সৌম্যর ব্যাট বেমানান; বড্ড বেমানান।

  • জয়-পরাজয়ের ম্যাচে কেমন ছিলো সৌম্যর পারফরম্যান্স?

সৌম্য খেলেছে এমন ৫২ ম্যাচে জয়ের দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ! ৬৬ হারের সাথে ২ টি ড্রয়ের সাক্ষী হয়ে থাকা সৌম্যকে রেজাল্ট দেয়নি ৪ টি ম্যাচ। এই ম্যাচগুলোতে সৌম্যর পারফরম্যান্সে নজর দেওয়া যাক।

 ফ্যাক্ট      ম্যাচ     রান       গড় 
 জয়       ৫২     ১৬৩৫     ৩৪.০৬
পরাজয়     ৬৬     ১৬৮৫     ২২.৪৬
  ড্র       ০২      ১০৩     ৩৪.৩৩
নো রেজাল্ট  ০৪      ২৮      ০৯.৩৩

পরিসংখ্যানে জয়ী ম্যাচে সৌম্যর ব্যাটিং গড় চোখে পড়ার মতোই। শুধু গড় নয়, ক্যারিয়ারে ৩ সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া সৌম্য ২ সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছে জয়ী ম্যাচেই। হারের ম্যাচে সেঞ্চুরির ইনিংসটি সৌম্যর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস!

  • দিন/রাত; কোথায় সফল সৌম্য?

দিনের আলোতে সৌম্য উপহার দিয়েছে ক্যারিরের সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটি! ডে-নাইট ম্যাচে ২ সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া সৌম্য নাইট ম্যাচে হতাশার এক নাম। আসুন পরিসংখ্যানেই দেখে নেওয়া যাক!

   ফ্যাক্ট      ম্যাচ     রান     গড় 
  ডে ম্যাচ     ৫৬     ১৭৩২   ২৬.২৪
 নাইট ম্যাচ    ৩১      ৪৬৯    ১৫.১২
ডে নাইট ম্যাচ   ৩৭     ১২৫০   ৩৯.০৬
 

এমনটাই সৌম্যর পারফরম্যান্স! এইসবের বাহিরে বলতে গেলে আরো অনেক বিষয়ে বলতে হয়। এখন পর্যন্ত সৌম্য৷ ব্যাটিং করেছে ৫ টি মহাদেশে। যেখানে এশিয়া মহাদেশে রয়েছে ২ হাজারের বেশী রান! এছাড়াও আরো দুইটি মহাদেশে ৫০০+ রানের দেখা পেয়েছেন এই ব্যাটসম্যান।

এখানেই শেষ নয়! নিউজিল্যান্ডের মাটিতে দারুণ ব্যাটিং করা সৌম্য বাংলাদেশের পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করেছেন সবচেয়ে বেশী রান। এছাড়াও ৬ অধিনায়কের অধিনে মাঠে নামা সৌম্য মাশরাফির নেতৃত্বে ছিলেন বেশ সফল! রয়েছে ঠিক ২০০০ রান।

মাশরাফির নেতৃত্বে সৌম্য!

বিশ্বকাপ কিংবা আইসিসির ইভেন্টে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টে সৌম্য এক হতাশার নাম। ওয়ানডে বিশ্বকাপে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও চ্যাম্পিয়নস ট্রফি কিংবা টি-২০ বিশ্বকাপ! এমনকি এশিয়া কাপেও সৌম্যর ব্যাটিং গড় ২০ এর নিচে। যেটি সৌম্যকে সমালোচিত করতে বাধ্য করে। তবুও দিনশেষে কোথাও একটা ভরসা খুঁজতে থাকেন সৌম্য এবং তার ভক্তরা। নির্বাচক প্যানেলও বাজিয়ে দেখতে চায় সৌম্যকে, দিনের পর দিন খারাপ খেলেও সৌম্য পেয়ে থাকেন সুযোগ! কিন্তু কিন্তু সৌম্য তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ বেশকিছুদিন ধরেই। বলা যায় ধারাবাহিক ব্যর্থ। টেকনিকে ব্যর্থার ছাপ, মাইন্ডসেটে রয়েছে গ্যাপ! ব্যাট বলেনা কথা, সৌম্যর মাথায় সমালোচনার বোঝা। এই চাপ আর সমালোচনার জবাব কি দিতে পারবেন সৌম্য? হয়তো পারবে!

বিশ্বকাপে হতাশাজনক পারফরম্যান্স!

বোল্ট কিংবা সাউদি; ওয়াগনার কিংবা রাবাদা! নিজের দিনে সৌম্য এখনো ভয়ংকর এক নাম। বাইশ গজে পুল, হুক কিংবা পেরিস্কোপে এখনো দর্শক মাতানোর সামর্থ্য রয়েছে সৌম্যর! কিন্তু নেই ধারাবাহিকতা, নেই নিজের উপর বিশ্বাস! হয়তো সমালোচনা তীব্র ঝড়ে হারিয়ে ফেলেছেন শক্তি! কিন্তু সৌম্য তো ফুরিতে যেতে পারেনা, যে মানুষ সাবলীল ভাবে মোকাবিলা করেছেন সাউদি – বোল্ট – রাবাদাদের, সেই ব্যাটসম্যান কি৷ এতো তাড়াতাড়ি নিভে যাবে? হয়তো না। কোনো এক অমাবশ্যাতে হয়তো সৌম্য ফিরে পাবে সোনালী অতীত, ফিরে পাবে সোনালী ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা মূহুর্তগুলো। সেটা হয়তো ঘুমোতে যাওয়ার আগে সৌম্য নিজেও একবার কল্পনা করেন!

সৌম্যর প্রিয় শট; পেরিস্কোপ!
(Photo by Quinn Rooney/Getty Images)

অথচ কতো সুন্দর-ই না ছিলো সৌম্যর শুরুর দিনগুলো! কতোই না সুন্দর ছিলো হুক কিংবা পেরিস্কোপগুলো। এখন সময়টা বদলে গেছে, হারিয়ে গেছে সৌম্য, হারিয়ে গেছে সোনালী অধ্যায়! যেখানে ভবিষ্যৎ তারকা সৌম্য এখন সমালোচনার মধ্যমণি। কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে সৌম্য হয়তো নিজের পুরোনো দিনের ব্যাটিং হাইলাইটস গুলো দেখে এখন আফসোস করে বলে, “দেখ সৌম্য; সোনালী অতীতগুলো কতোই না মধুর ছিলো!”

  • সৌম্যর জন্ম কবে এবং কোথায়?

বর্তমান সময়ের আলোচিত সৌম্যর জন্ম হয়েছিলো ১৯৯৩ সালে খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরায়। সেটিও ঠিক ২৫ ফেব্রুয়ারি মানে আজকের দিনেই। শিকড় টু শিকড় ভায়া শেখরে পৌঁছা সৌম্য শান্ত সরকারকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

শুভ জন্মদিন সোম্য!

 

, , ,

মন্তব্য করুন

এই বিভাগের আরো খবর