গর্ডন শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ত্রিকোণ আকৃতির পাহাড়। গর্ডন গ্রিনিজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের জন্য ছিলেন পাহাড়ের মতোই। পরিসংখ্যান ঘাটলে তাকে হয়তো গ্রেটদের কাতারে রাখা যাবে না। কিন্তু, গাধা পরিসংখ্যানকে পাশ কাটালে দেখা যাবে, তিনি তার সময়ের অন্যতম সেরা।
১৯৮৪ সালের ২৮ জুন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল তখন ইংল্যান্ড সফরে। ক্রিকেটের মক্কায় ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার সিরিজের ২য় টেস্ট। এর আগে ১ম টেস্টে স্বাগতিকদের ইনিংস এবং ১৮০ রানে হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ শিবির ফুরফুরে মেজাজে। তাইতো টেস্টে টস জিতে ব্যাটিং নেওয়ার চিরস্থায়ী নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উইন্ডিজ কাপ্তান ক্লাইভ লয়েড ইংল্যান্ডকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানালেন। ম্যালকম মার্শালের বোলিং তোপে ইংল্যান্ড অলআউট হলো ২৮৬ রানে। জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে স্যার ভিভ রিচার্ডসের ঝড়ো ৭২ রান ম্লান হলো আরেক গ্রেট স্যার ইয়ান বোথামের বোলিং ভেলকিতে। বোথামের ৮ উইকেট শিকারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অলআউট হয় ২৪৫ রানে। ২য় ইনিংসে ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ে নামলে, অ্যালান ল্যাম্বের সেঞ্চুরি আর বোথামের ৯১ রানে, ৯ উইকেটে ৩০০ করে ইনিংস ঘোষণা করে।
১ম ইনিংসে ৪১ রানের লিড আর ২য় ইনিংসের ৩০০ রান মিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে টার্গেট দাড়ায় ৩৪২ রানের। শেষ দিনে ৭৮ ওভারে তাদের এই রান সংগ্রহ করতে হবে। টেস্টের শেষ দিনে প্রায় ৪.৫০ রানরেটে টার্গেট তাড়া করা টি-টোয়েন্টির এই যুগেও কঠিন। এর সাথে ক্লাইভ লয়েডের মতো অধিনায়ক যদি টস জিতে বোলিং নেয় তাহলে বুঝতে হবে উইকেটে বোলারদের জন্য অনুকূলে ছিলো। সাথে যদি আগের ইনিংসে ইয়ান বোথামের ৮ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব ধরা হয় তাহলে ৩৪২ রানের টার্গেট তাড়া করার চেয়ে উইকেটে পড়ে থেকে টেস্ট বাঁচানোর দিকেই মনোযোগ দিবেন ব্যাটসম্যানেরা। তবে দলটা ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আশির দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভিভ রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ! তাই তারা যেকোন অসাধ্যকেই খুব সহজে সাধন করতে পারতো। এটা কারো মুখের কথা না, সেই সময়কার দলটাই এমন ছিলো তাদের। সেদিনও তারা সেই টার্গেট ৬৬.১ ওভারে পূরণ করে, তাও ৯ উইকেট হাতে রেখে। আসলে ভিভ রিচার্ডস থাকলে যে কোন কিছুই সম্ভব কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো সেদিন ভিভ রিচার্ডস ব্যাটিংয়ে নামেনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সর্বজয়ী দলের নাম নিলেই আমরা হয় তাদের পেসারদের নয়তো ভিভ রিচার্ডসের নাম নেই। ভিভ রিচার্ডস ছাড়াও তাদের আরেকজন রুদ্রমূর্তি আছেন তার নাম আমরা বলি না বা বলা যায় ভিভ রিচার্ডসের মতো মহারথীর জন্য আড়ালে পড়ে যান তিনি। গর্ডন গ্রিনিজ ছিলেন সেদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের নায়ক।
২৯ চার আর ২ ছয়ে ২৪২ বলে ২১৪ রানের অসাধারণ এক ইনিংসের ফলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের পক্ষে সেদিন ঐ অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হয়। ২১৬.২ রেটিং পেয়ে গর্ডন গ্রিনিজের বিখ্যাত ঐ ইনিংসটি উইজডেনের করা সেরা ১০০ টেস্ট ইনিংসের লিস্টে ২১ নম্বরে জায়গা করে নেয়। স্যার গ্রিনিজের বদৌলতে সেদিনের সেই রান চেজটি এখনো টেস্টে সফল রান তাড়া করে জয়ের তালিকায় ১৪ নম্বরে আছে। ১৯৮৪ সালের উইজডেন সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইংল্যান্ডকে ৫-০ তে হোয়াইটওয়াশ করে। এর আগে বা পরে পাঁচ ম্যাচ টেস্ট সিরিজ খেলতে গিয়ে কোন সফরকারী দল স্বাগতিকদের সবগুলো ম্যাচে হারায়নি। সেই সিরিজে ৮ ইনিংসে ৮১.৭১ গড়ে ৫৭২ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ। এর আগে ভারতের বিপক্ষে তিন ম্যাচ জিতে তারপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন আটটি ম্যাচে জয় লাভ করে। তারপর আরো তিন ম্যাচ জিতে এগারোটি টেস্ট জয়ের কৃতিত্ব দেখায়।
১৯৮৩ সালের ৩০ শে এপ্রিল, চলছে ভারতের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পঞ্চম টেস্ট। এন্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে ভারত ৪৫৭ রানে অলআউট হয়। জবাবে, দুই বিখ্যাত ওপেনিং পার্টনার ডেসমন্ড হেইন্স আর গর্ডন গ্রিনিজ ২৯৬ রান তুলে ফেলেন ওপেনিং পার্টনারশিপে। ২৯৬ রানে১৩৬ করা হেইন্স আউট হন। দলীয় যখন ৩০১ রান তখন গ্রিনিজ অপরাজিত ১৫৪ রানে। ব্যাটিংয়ে থাকা গর্ডন খবর পান তার মেয়ে অসুস্থ। ব্যাটিং রেখেই চলে যান মেয়ের কাছে, দুই দিন পর সেই মেয়ে মারা যায়। মানবতার খাতিরে গর্ডন গ্রিনিজের সেই ইনিংসের পাশে রিটায়ার্ড নট আউট লেখা আছে এখনো। ক্রিকেটের নিয়মে ব্যাটসম্যান স্বেচ্ছায় ব্যাটিং করতে না চাইলে তার নামের পাশে রিটায়ার্ড আউট লেখা থাকে। তবে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে গ্রিনিজের সেই ইনিংসটির পাশে রিটায়ার্ড নট আউট লেখা আছে। ক্রিকেট ইতিহাসের তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই রিটায়ার্ড নট আউট হন। তবে ব্যাপারটা তার জন্য অত্যন্ত কষ্টের। ড্র হওয়া সেই টেস্টের ম্যাব অব দ্যা ম্যাচও হন তিনি। ১৯৮৩ সালে এই বেদনাদায়ক মুহুর্তের সাক্ষী হলেও বছরটা ছিলো তার ক্যারিয়ারের সেরা বছর। ১৭ ইনিংসে ৬১ গড়ে সেবছর তিনি রান করেন ৮০৪। পরের বছর ৫৮ গড়ে করেন ১১৭৯ রান।
১৯৫১ সাল, তখন ক্রিকেট বিশ্ব শুনছে থ্রি ডব্লুস আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিজয়গাঁথা। সেই থ্রি ডব্লুসের শুধুমাত্র নামের অাধ্যক্ষর এক ছিলো না, তাদের মধ্যে আরো বেশকিছু জিনিসের মিল ছিলো। এই যেমন তারা তিনজনই বার্বাডোস এর। বার্বাডোসে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হলো ক্রিকেট, ক্রিকেট বিশ্বে অন্যতম সেরা ক্রিকেটার এবং সেরা অলরাউন্ডার যাকে মানা হয়, সেই স্যার গ্যারি সোবার্সও কিন্তু বার্বডোসের। বার্বাডোসে জন্ম নেওয়াদের যদি সেরা একাদশ করা হয় তাহলে এই চারজন ৩ থেকে ৬ নম্বরে ব্যাট করবে। বোলিংয়ে নেতৃত্ব দিবে ম্যালকম মার্শাল আর জুয়েল গার্নার। আর ওপেনিংয়ে ডেসমণ্ড হেইন্স থাকবে। এখন যেহেতু ডেসমণ্ড হেইন্স থাকবে তাহলে গর্ডন গ্রিনিজকে সেই একাদশে রাখা যেতেই পারে। রাখা যেতে পারে না বলা যায় রাখতেই হবে। ১ মে ১৯৫১ সালে বার্বাডোসের সেইন্ট পিটারে জন্মগ্রহণ করেন কুথবার্ট গর্ডন গ্রিনিজ।
জন্ম বার্বাডোসে হলেও গ্রিনিজের বয়স যখন ১২ তখন তিনি তার বাবা-মায়ের সাথে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। ১৯৬৫ সালে রিডিং শহরের একটি স্কুলে তিনি ভর্তি হন এবং সেই স্কুলের হয়ে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে থাকেন। ১৯৬৭ সালে স্কুলের হয়ে একম্যাচে তিনি ১৩৫ রানে অপরাজিত থাকেন। ঐ ম্যাচে ভালো খেলার সুবাদে হ্যাম্পশায়ার এবং ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টি দল থেকে তার জন্য প্রস্তাব আসে। গ্রিনিজ শেষ পর্যন্ত হ্যাম্পশায়ারকে পছন্দ করে এবং হ্যাম্পশায়ার কতৃপক্ষ ১৯৬৮ সালে তার সাথে চুক্তি করেন। প্রথম দুই বছর হ্যাম্পশায়ার দ্বিতীয় একাদশের হয়ে অল্পবিস্তর সাফল্য পান এবং ১৯৭০ সালে মূল একাদশে জায়গা করে নেন।
হ্যাম্পশায়ার মূল একাদশে গ্রিনিজ প্রথমবার যেদিন তার থেকে ৬ বছরের বড় দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ব্যারী রিচার্ডসের সাথে জুটি বাঁধেন, সেই ইনিংসে তারা ২০১ রানের ওপেনিং পার্টনারশিপ করেন। এর পর থেকে তারা দুজন তাদের জোড়কে কাউন্টি ক্রিকেটের সবচেয়ে ভয়ংকর জুটিতে পরিণত করেন। আস্তে আস্তে গ্রিনিজ নিজেকে ইংল্যান্ড টেস্ট দলের জন্য যোগ্য করে তুলতে থাকেন। যদিও প্রথম দিকে তিনি শুধু তার ব্যাটিংয়ের দিকেই নজর দিতেন। তবে যখন বুঝতে পারলেন শুধু ব্যাটিং দিয়ে বেশীদূর আগানো যাবে না তখন থেকে তিনি ফিল্ডিংয়েও সময় দিতে থাকেন। গ্রিনিজ ছিলেন সলিড টেকনিকের অধিকারী। তিনি যে কোন ধরনের শট খেলতে পারতেন। তার ডিফেন্স ছিলো খুব ভালো। ইংল্যান্ডের সুইংগিং কন্ডিশনে থেকে তিনি নতুন বলে সুইং সামলানো শিখেছেন, তারপর বার্বাডোসের বাউন্সি পিচে খেলে বাউন্সে অনায়াসে হুক কিংবা পুল করার পান্ডিত্য অর্জন করেন। হুক বা পুলের পাশাপাশি তিনি খুব ভালো স্কয়ার কাট খেলতে পারতেন।
যখন ইংল্যান্ড দলে তাকে নেওয়ার কথা হচ্ছিলো তখনই তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজে চলে যান এবং সিদ্ধান্ত নেন মাতৃভূমি ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়েই তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেন। তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম শ্রেণির লীগে বার্বাডোসের হয়ে খেলতে থাকেন এবং সফরকারী বিভিন্ন দলের সাথে ভালো খেলার সুবাদে ১৯৭৪ সালে ভারতের বিপক্ষে বেঙ্গালুরু টেস্টে তার টেস্ট অভিষেক হয়। সেই ম্যাচে অভিষেক হয় আরেক গ্রেট স্যার আইজাক ভিভিয়ান রিচার্ডসের। রিচার্ডস সেই ম্যাচে স্মরনীয় কিছু করতে না পারলেও গ্রিনিজ প্রথম ইনিংসে ৯৩ রান করে রান আউটের শিকার হন এবং দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ১০৭ রান।
১৯৭৫ সালের ১১ জুন পাকিস্তানের বিপক্ষে তার ওয়ানডে অভিষেক হয়। ১৯৭৫ সালের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জয়লাভ করলেও গ্রিনিজ সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৫ রান করেন, যা তার ঐ বিশ্বকাপে উল্লেখ করার মতো একমাত্র পারফরম্যান্স। বিশ্বকাপের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল অস্ট্রেলিয়া সফরে যায়। সেই সফরে গ্রিনিজ ৪ ইনিংসে করেন মাত্র ১১ রান। এই সম্পর্কে তিনি বলেন,
personal nightmare so painful that I have spent my life since trying to erase it from my memory
প্রতিটি সফল মানুষের সফল হওয়ার পিছনে কোন বড় ধরনের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়া বড় একটা ভূমিকা পালন করে। গ্রিনিজের জন্য অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই ব্যর্থতা ছিলো ভবিষ্যতে সফলতা আনার জন্য একটি বার্তা। তারপর তিনি তার শট সিলেকশন নিয়ে আরো কাজ করতে থাকেন। ১৯৭৬ সালে গ্রিনিজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে যান। সেই সফরে গ্রিনিজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১০০০ এর উপরে রান করেন। এর মধ্যে এক ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মোট ২১১ রানের মধ্যে তিনি ১৩৪ রান করেন এবং দ্বিতীয় ইনিংসে আরেকটি সেঞ্চুরি করেন। ওল্ড ট্রাফোর্ড টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দলীয় ১৮২ রানের মধ্যে তিনি করেন ৮৪ রান। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত গ্রিনিজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সুপার টেস্টে অংশ নেন
সুপার টেস্টে তিনি পঞ্চম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন। ১৯৭৯ বিশ্বকাপে তিনি বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন। তিনি সেই টুর্নামেন্টে ২৫৩ রান করেন যার মধ্যে ছিলো একটি সেঞ্চুরি এবং সেমিফাইনালে করেন ৭৩ রান।
১৯৮০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি দুই ইনিংসেই ৯০ রানের উপরে করে আউট হন। ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সাবাইনা পার্কে ১০০ করার পর ১৯৮৩ সালে তিনি ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন। প্রায় ছয় বছর পর টেস্টে সেঞ্চুরি করলেও তার সেই সেঞ্চুরির স্মৃতিটি মধুর ছিলো না। ১৫৪ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় তিনি খবর পান তার মেয়ে অসুস্থ। তিনি সেখানেই তার মেয়েকে দেখতে যান, দুইদিন পর তার মেয়ে মারা যায়। মানবতার খাতিরে সেই ইনিংসে তার নামের পাশে রিটায়ার্ড নট আউট লেখা আছে। এর আগে ১৯৮৩ বিশ্বকাপে তিনি সেঞ্চুরি করেন। যদিও ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ১৮৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে তিনি এক রানে আউট হয়ে যান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ টানা তিন বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ হারায়। ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ দিনে ৩৪২ রানের টার্গেটে তিনি অপরাজিত ২১৪ রান করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান। ১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার এডিলেড ওভালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডেতে গ্রিনিজ ১২৮ বলে অপরাজিত ১১০ রানের ইনিংস খেলেন। সেই বছর গ্রিনিজ ৮ ওয়ানডেতে ৫২ গড়ে ৩৬৭ রান করেন। তবে ১৯৮৬ সালে তিনি তার নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। ১৯৮৭ সালে গ্রিনিজ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি করেন এবং ওয়ানডেতে গাবায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেন সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারের শেষ সময়গুলোতে তিনি গড়পরতা পারফরম্যান্স করে গেছেন। ১৯৯১ সালে তার শেষ টেস্টের আগের টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২২৬ রান করেন। ১৯৯১ সালের ২৭ শে এপ্রিল গ্রিনিজ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তার প্রিয় অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেন৷ ঐ বছরের ২৫ শে মে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডে তথা আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
গর্ডন গ্রিনিজ ১২৮ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন। সেখানে ১২৭ ইনিংসে ৪৫.০৪ গড়ে করেন ৫১৩৪ রান। ৩১ টি ফিফটির পাশাপাশি তিনি ১১ টি সেঞ্চুরি করেন। ১৯৮৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ১৩৩ রান তার সর্বোচ্চ। তার ক্যারিয়ারের মোট রান করতে তিনি ৪৬৬ টি চার এবং ৮১ টি ছয় মারেন। তিনি ওয়ানডেতে ৪৫ টি ক্যাচ ধরেন এবং ৮ টি ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেন, যেখানে ৬ ম্যাচে জয়লাভ করেন। গ্রিনিজ ১০৮ টি টেস্ট খেলে ১৮৫ ইনিংসে ৪৪.৭২ গড়ে ৭৫৫৮ রান করেন। সর্বোচ্চ স্কোর ২২৬, টেস্টে ৩৪ টি ফিফটির পাশাপাশি করেন ১৯ টি সেঞ্চুরি যার মধ্যে ৪ টিকে ডাবলে রূপান্তরিত করেন৷ টেস্টে তিনি মোট ৯৬ টি ক্যাচ ধরেন এবং ১ ম্যাচ অধিনায়কত্ব করেন আর সেই ম্যাচে পরাজয় বরণ করেন।
গর্ডন গ্রিনিজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বার্বাডোস এবং ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ার ও স্কটল্যান্ডের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেন। তিনি মোট ৫২৩ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেন। সেখানে ৮৮৯ ইনিংসে ৪৫.৮৮ গড়ে ৩৭৩৫৪ রান করেন। সর্বোচ্চ স্কোর অপরাজিত ২৭৩ রান, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি ৯৩ টি সেঞ্চুরি এবং ১৮২ টি ফিফটি করেন।
লিস্ট ‘এ’ তে তিনি ৪৪০ টি ম্যাচ খেলেন। সেখানে ৩৩ টি সেঞ্চুরি এবং ৯৪ টি ফিফটিতে ৪০.৫৬ গড়ে করেন ১৬৩৪৯ রান, সর্বোচ্চ স্কোর অপরাজিত ১৮৬ রান।
ক্রিকেট বিষয়ক স্বনামধন্য ওয়েবসাইটে গর্ডন গ্রিনিজকে নিয়ে লিখতে গিয়ে শিরোনাম দেয়,গর্ডন গ্রিনিজের সেরা ইনিংস ক্রিকেটের সেরা ইনিংস। কথাটা মোটেই বাড়িয়ে বলা নয়, তিনি যেদিন ব্যাট চালানো শুরু করতেন সেদিন উইকেটের চারপাশে নানা ধরনের শটের ফুলঝুরি বসতো। দারুণ সব স্কোয়ার কাট, মোহময়ী পুল কিংবা হুকে দর্শকদের মুগ্ধ করতেন। দেখে নেওয়া যাক গর্ডন গ্রিনিজের ক্যারিয়ারের কিছু সেরা ইনিংসের তালিকাঃ
( ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিশ্বকাপের ফাইনালে নিতে এই ইনিংসটি বড় ভূমিকা পালন করে।)
( গাবাতে অস্ট্রেলিয়ান পেসারদের তুলোধুনো করে তুলে নেন এই সেঞ্চুরি। গাবার মতো ফাস্ট, বাউন্সি পিচে এই সেঞ্চুরি তাই বিশেষ কিছু।)
( ১৯৮৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের কাছে বিশ্বকাপ হারার পর ভারতে গিয়ে এই ইনিংসটি খেলেন। সেই বিশ্বকাপ ফাইনালে ১ রান করে আউট হওয়ার বদলাও বলা যায় এই ইনিংসটাকে।)
ক্যারিয়ারের একদম শুরুতে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান থেকে ওপেনার বনে যাওয়া গ্রিনিজকে ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ওপেনার বলা যায়। কাউন্টি ক্রিকেটে ব্যারি রিচার্ডস আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডেসমণ্ড হেইন্সের সাথে তার ওপেনিং জুটি ছিলো সমাদৃত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ডেসমণ্ড হেইন্সের সাথে তার ওপেনিং জুটি ছিলো বোলারদের ত্রাস। ওয়ানডেতে তারা ১০৩ ইনিংস একত্রে ব্যাটিং করেন। সেখানে ৫২০৬ রান করেন দুজনে মিলে, ছিলো ১৫ টি সেঞ্চুরি এবং ২৫ টি ফিফটি পার্টনারশিপ। যা এখনো সবচেয়ে বেশী পার্টনারশিপ করার ক্ষেত্রে ৬ নম্বরে আছে। আর টেস্টে তারা ১৪৮ ইনিংসে যোগ করেন ৬৪৮২ রান, যেখানে ১৬ টি সেঞ্চুরির সাথে আছে ২৬ টি ফিফটির পার্টনারশিপ। রাহুল দ্রাবিড় – শচীন টেন্ডুলকার এবং মাহেলা জয়াবর্ধনে – কুমার সাঙ্গাকারা, এই দুই জুটি টেস্টে তাদের চেয়ে বেশী রান করেছে৷
১৯৯১ সালে গর্ডন গ্রিনিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার পাঁচ বছর পর বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হন। সেসময় ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ নামটি পরিচিত ছিলো না। ১৯৯৪ সালে আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালে হেরে বাংলাদেশ দল ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ খেলার জন্য কোয়ালিফাই করতে পারেনি। সেই সময়ের সেরা দল নিয়েও এই ব্যর্থতা ছিলো বেদনাদায়ক। ১৯৯৬ সালে এসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ দল জয়লাভ করলে বোর্ড কর্মকর্তারা আবারো বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখে। তারই ধারাবাহিকতায় দুই বারের বিশ্বকাপজয়ী গর্ডন গ্রিনিজকে দেওয়া হয় বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব। দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রথমে পুরো পঞ্চাশ ওভার খেলে যাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেন। এছাড়াও তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতেন।
১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির আসর বসে মালেশিয়ায়। শুরু থেকেই একের পর এক দারুণ পারফরম্যান্স এর মাধ্যমে বাংলাদেশ দল আবারো সেমিফাইনালের টিকিট পায়। সেমিফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিলো হল্যান্ড (নেদারল্যান্ডস)। তারা বাংলাদেশ দলকে ১৭১ রানের ছোট লক্ষ্য দিলেও ১৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে সহজ লক্ষকে কঠিন করে ফেলে। তারপর বৃষ্টির হানাতে ম্যাচ পরিত্যক্ত হবার উপক্রম হয়। শেষ পর্যন্ত মালেয়শিয়া প্রবাসীদের সাহায্যে ম্যাচ মাঠে গড়ায়, তখন বাংলাদেশ দলের সামনে ৩৩ ওভারে ১৪১ রানের টার্গেট দেওয়া হয়। অধিনায়ক আকরাম খানের ৬৭ রানের অবিস্মরণীয় ইনিংসে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফির ফাইনালে চলে যায় এবং প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
“Gordon Greenidge crying. Just imagine a win that makes Greenidge cry; a man who had come from a different country, a different culture. The owner of one of the fiercest square-cuts ever seen, the man with the double-century on one leg, the man whose image first comes to mind when the words “beware the wounded batsman” are said; Greenidge cried after that win. That’s how much it meant to the team.”
তারপর, ফাইনালে আরেক শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে কেনিয়াকে শেষ বলে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি জয় করে বাংলাদেশ দল। বিশ্বকাপের টিকিট নিশ্চিত হলেও আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ান হওয়ার ফলে বাংলাদেশে ক্রিকেটের প্রতি অন্য রকম এক উন্মাদনা সৃষ্টি হয়। আইসিসি ট্রফি জয়ের পর জয়ী দল বাংলাদেশে ফিরলে তাদের জাতীয়ভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বাদ যাননি পর্দার পিছনের কারিগর গর্ডন গ্রিনিজও। তাকে দেওয়া বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব, আমেরিকার জগৎবিখ্যাত রেসলার মোহম্মদ আলী ক্লের পর তিনি দ্বিতীয় ক্রীড়া ব্যাক্তিত্ব যিনি বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব পান।
আইসিসি ট্রফিতে জয়ের পরের বছর বাংলাদেশ দল কেনিয়াকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে ম্যাচে জয়লাভ করে ১৯৯৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ তার কোচিংয়ে খেলতে যায়, সেখানে তারা স্কটল্যান্ড এবং পাকিস্তানকে পরাজিত করে। বিশ্বকাপে নিজেদের শেষ ম্যাচে সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ান এবং সেই বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট পাকিস্তানকে পরাজিত করলেও কোচ গ্রিনিজের জন্য সেই দিনটি সুখকর ছিলো না। কেননা, সেদিনই তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ইস্তফার কাগজ। অথচ তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে বাকি ছিলো মাত্র একদিন। বিশ্ব ক্রিকেটের বড় নাম গর্ডন গ্রিনিজের জন্য যা ছিলো চরম অপমানজনক।
আসলে, ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ের পর বাংলাদেশের বোর্ড কর্মকর্তারা টেস্ট স্টাটাস পাওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করছিলো। কিন্তু, গর্ডন গ্রিনিজ সেই সময় টেস্ট স্টাটাসের বিপক্ষে ছিলেন। তার মত ছিলো বাংলাদেশের টেস্ট স্টাটাস পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত কাঠামো তখন গড়ে উঠেনি। সবমিলিয়ে তাকে কোচিং থেকে বরখাস্ত করা হয়। এতকিছুর পরও বাংলাদেশ যখন ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলতে নামে সেই টেস্ট দেখার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রিয় ছাত্রদের অভিজাত ফর্মেটের খেলা দেখতে পাওয়ার আমন্ত্রনে সাড়া দেন গ্রিনিজ। অভিষেকে সেঞ্চুরি পাওয়া আমিনুল ইসলামকে সেঞ্চুরির পর তিনি আলিঙ্গন করেন এবং বলেন,
Well played, but why did you get out? You should have kept your patience. After all it is not every day that you get a chance to make a real big score.
এরপরও গর্ডন গ্রিনিজ বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেট সম্পর্কে তার ভাবনাগুলো বলেন। তিনি অবাক হন, বাংলাদেশের মানুষ এখনো তার সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করে।
পরবর্তী সময়ে গর্ডন গ্রিনিজ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের অন্যতম নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে তাকে আইসিসির হল অফ ফেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়াও, ব্রিটিশ রাজপরিবার থেকে তিনি সম্মানজনক স্যার উপাধি পান।
গর্ডন গ্রিনিজ তার ক্যারিয়ার জুড়ে ভিভ রিচার্ডস নামক এক মহাতারকার আড়ালে পড়েছিলো। বর্তমান সময়ে ওয়ানডেতে প্রতিটা দলের ওপেনারদের ঝড়ো শুরু এনে দিতে হয়। টেস্টেও ওপেনারদেরকে এই কাজটি করতে হয়। গর্ডন গ্রিনিজের আগেও হয়তো ওপেনারদের এই কাজটিই করতে হতো। তবে একজন ওপেনার হিসেবে গর্ডন গ্রিনিজ দলকে যেই ধরনের শুরু এনে দিতেন আর প্রতিপক্ষ শিবিরকে যেই ভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করতেন, সবমিলিয়ে গর্ডন গ্রিনিজ হয়ে থাকবেন ধ্বংসাত্মক ওপেনারদের ট্রেডমার্ক।