স্যার ডোনাল্ড ব্র‍্যাডম্যান: নামটাই যখন একটা ব্র‍্যান্ড

ডেস্ক নিউজ
  • প্রকাশিত সময় : বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০২০
  • শেয়ার করুন

  • Facebook

১.
একটা গল্প পাড়বো। একজন মানুষের গল্প। যিনি শুরুতে ব্যর্থ ছিলেন, শেষেও ব্যর্থ ছিলেন। তবে এর মাঝে যা করেছেন, লক্ষ-কোটি মানুষ আজ সংযুক্ত সেসবের কীর্তি-বর্ণনে। তাঁকে নিয়ে গল্প পাড়া মানে ভয়ে ভয়ে থাকা, তাঁর স্তুতি ঠিকঠাক হলো তো! তাঁকে ঠিকমতো তুলে ধরা গেলো তো! এই লেখা তাঁকে যুতমতো তুলে ধরতে পারছে তো!

তা আমরা কোন ছাড়, টনি গ্রেগ আর হিলটন অ্যাকারম্যানই কি তাঁকে ঠিকমতো ধরতে পেরেছিলেন? আচ্ছা, গল্পটা বহুল প্রচলিত হলেও, আরেকবার হয়ে যাক না-হয়!

২.
১৯৩০ সালে অবিভক্ত ও বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে বেড়াতে এসেছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়ান ট্যুরিস্ট। স্থানীয় এক ক্রিকেট দল তাকে আহ্বান জানাল প্রীতি এক ম্যাচে অংশ নেয়ার জন্য। ট্যুরিস্ট ভদ্রলোক সে আহ্বানে সানন্দে সাড়া দিলেন। খেলতে নেমে বেচারা প্রথম বলেই শূন্য রানে আউট হয়ে গেলেন। স্থানীয়রাও তাকে আর মনে রাখলেন না। প্রথম বলে শূণ্য রানে আউট হওয়াটা নিশ্চয় মনে রাখার কারণের মধ্যে পড়ে না! তাছাড়া এই পৃথিবী তো কেবল সফলদেরই কথা বলে, ব্যর্থদের জায়গা কোথায় সেখানে?

তো গল্পে ফিরি। স্থানীয়রা ধরেই নিলেন, এই লোক ক্রিকেট খেলতে পারেন না। সুতরাং সবাই তাকে ভুলে গেলেন।

মাঝে কেটে গেছে বহু বছর। ঠিকমতো হিসেবে করলে প্রায় ৪২ বছর!

১৯৭১-৭২ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে খেলতে এলো অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশ। টনি গ্রেগ আর হিলটন অ্যাকারম্যান এসে পৌঁছলেন অ্যাডিলেইডের বিমানবন্দরে। তাদের রিসিভ করতে এলেন গল্পের সেই টুরিস্ট, যিনি বেড়াতে গিয়ে ডাব্বা মেরেছিলেন। প্রথম বলেই শূণ্য নিয়ে ফিরেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই এতদিনে বুড়ো হয়ে পড়েছেন তিনি।

ক্রিকেট নিয়ে তার প্রশ্নের শেষ নেই, একটার পর একটা জিজ্ঞাসা করেই চলেছেন। তাঁর এটা-ওটা-সেটা সহ, এত এত প্রশ্ন শুনে তিতিবিরক্ত হয়ে টনি বা অ্যাকারম্যানের কেউ একজন (কে, তা অবশ্য আজ পর্যন্ত কেউ স্বীকার করেননি) উলটো প্রশ্ন করে বসলেন- ‘তা মশাই আপনি কি ক্রিকেট খেলতেন নাকি কোনো এককালে?’

তিনি সবিনয়ে ও সহাস্য জবাব দিলেন- ‘তা, খেলতাম বৈকি! এককালে টুকটাক।’

ওই প্রশ্নকর্তা ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন- ‘তো আপনার নাম-টা কী?’

এবারও গাইড ভদ্রলোক বিনয়ের সঙ্গে মুচকে হেসে জবাব দিলেন- ‘ডন ব্র্যাডম্যান!’

৩.
বুঝুন অবস্থা! আচ্ছা, টনি গ্রেগ বা হিলটন অ্যাকারম্যানের শোচনীয় অবস্থা আন্দাজ করতে পারছেন তো? কে কোনদিকে পালিয়ে বাঁচবেন, সেই পথ খুঁজছিলেন নিশ্চয়!

সে যাই হোক, আমাদের গল্পে ফিরি। জলজ্যান্ত মানুষটাকে দেখেও তাঁরা চিনতে পারেননি। তাঁর খেলা দেখা, তাঁকে দেখা মানুষেরা তাঁকে কখনো বর্ণনার দুঃসাহস করেননি, তাঁর আগাগোড়া চেনা লোকেরা তাঁকে নিয়ে দু’ছত্র লেখার চেষ্টা করেননি- সেখানে আমি এক নগণ্য বঙ্গ-সন্তান আজ এসেছি, আপনাদের তাঁর গল্প শোনাতে!

বলুন তো, আমাকে কী করা উচিৎ? পেঁদিয়ে বৃন্দাবন পাঠাবেন? নাকি পিটিয়ে ছাল তুলবেন?
সে আপনি কি করবেন না-করবেন, আপনার ব্যাপার। আমি আপাতত আমার কাজ সেরেই পালাই!

৪.
তাঁর অনেকগুলো জনপ্রিয় উক্তির একটা হচ্ছে- “আমার কোনো কোচ ছিল না, এমনকি কীভাবে ব্যাট ধরতে হয় তাও কেউ আমাকে শেখায়নি!”

ভদ্রলোকের জন্মদিন আজ। ভদ্রলোকের জন্ম নিউ সাউথ ওয়েলসের বোওরাল। ১৯০৮ সালের ২৭শে আগস্টের কোনো এক শুভ তিথিতে এই নশ্বর ধরাধামে আগমণ করেন তিনি। জর্জ এবং এমিলি ব্র্যাডম্যানের পাঁচ সন্তানদের মধ্যে সব থেকে ছোট সন্তান ছিলেন ডোনাল্ড, মানে ডন ব্র্যাডম্যান।

ব্র্যাডম্যান পরিবার ছিলো ইতালি থেকে অস্ট্রেলিয়াতে আসা প্রথম পরিবার গুলোর মধ্যে একটি।

ব্র্যাডম্যান ছেলেবেলা থেকে ঘরের পেছনে একা একা ব্যাটিং প্র্যাকটিস করতেন। ব্যাট হিসাবে থাকতো একটা স্ট্যাম্প এবং সাথে থাকতো একট ছোট্ট গলফ বল। সেই নিয়ে ঘরের পেছনে একা একা প্র্যাকটিস করতেন তিনি। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট-অনুরক্ত ডন, দুর্দান্ত খেলতেন স্কুল ক্রিকেটেই।

স্কুলে পড়াকালীন সময়ে তিনি ক্রিকেট সম্পর্কে যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করেন। তবে ক্রিকেট কীভাবে খেলতে হয়, এই রকম শিক্ষা কোথাও পাননি তিনি। ১২ বছর বয়সে স্কুলের পক্ষে খেলতে নেমে তিনি প্রথম শতক করেছিলেন। ১১৫ রানের ইনিংস ছিলো সেটি। যেখানে তার দলের মোট রান ছিলো ১৫৬!

এরপর তাঁকে আর কোনোদিন পেছন ফিরে থাকাতে হয়নি। ১৯২২ সালে ব্র্যাডম্যানের স্কুল জীবনের ইতি ঘটে।

৫.
১৯ বছর বয়সে ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটে অভিষেকের পর নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে ব্যাট হাতে ম্যাচের পর ম্যাচ পারফর্ম করে যাচ্ছিলেন। অবশেষে পুরস্কার মিললো, সুযোগ হলো জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামার। ডাক পেলেন সফরকারী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে। ব্রিসবেনে সে টেস্টে অস্ট্রেলিয়া ৬৭৫ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়। যা এখনো সবচেয়ে বড় ব্যবধানে পরাজয়ের রেকর্ড হয়ে টিকে আছে।
ডন দুই ইনিংসে করতে পারলেন ১৮ ও ১ রান। জায়গা হারালেন দ্বিতীয় টেস্টের দল থেকে। সেই প্রথম এবং সেই শেষ! তৃতীয় টেস্টের দলে ডাক পেয়ে করলেন ৭৯ এবং ১১২! শুরু হলো ব্র্যাডম্যান-যুগ।

ব্যাট হাতে নামলেই যেনো ব্র্যাডম্যান হয়ে যান নির্দয়, নিষ্ঠুর। যেনো ব্রাডমান একজন খুনী, বোলারদের স্বপ্ন খুন করেন তিনি! পিটিয়ে ছাল তুলেন বলের। ডনের ক্লান্তি বলতে বুঝি কিছু নেই। অন্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে ৫০ রান করে ব্যাট দেখাতেন, সেখানে স্যার ডন ১৫০ রানের আগে নাকি ব্যাটই তুলতেন না! প্রতি তিন ইনিংসে প্রায় ১টি করে শতক, ১২টি ডাবল, ২টি ট্রিপল- কেবল পরিসংখ্যানই যথেষ্ট ডনের গ্রেটনেস বোঝাতে!

৬.
স্যার ব্র্যাডম্যানের কথা হবে আর বডিলাইন আসবে না, তা কী হয়? ডনের কথা উঠলেই অবধারিতভাবে ‘বডিলাইন সিরিজ’ প্রসঙ্গও উঠে আসবে। ১৯৩০-৩১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং দক্ষিন আফ্রিকা অস্ট্রলিয়াতে এলে তিনি সেখানেও রানবন্যা বইয়ে দেন। তাঁর আগ্রাসী ও রান ফোয়ারাকে আটকানোর জন্য ইংল্যান্ড স্বদেশ থেকে ‘বডিলাইন’ নামের এক কৌশল (নাকি অপকৌশল?) সাজিয়ে আনে। যা চাতুর্য্যের সঙ্গে ব্যবহারের দায়িত্ব বর্তায়, ইংলিশ-দলপতি ডগলাস জার্ডিনের কাঁধে। তাঁর দ্রুত বোলিংয়ের দুই অস্ত্র- হ্যারল্ড লারউড ও বিল ভোস তাঁরা দুজনই, শরীর তাক করে শর্টপিচ বল করে কাঁধ বরাবর বাউন্স দিতে শুরু করেন। হ্যাঁ, এই অপকৌশল কার্যকরের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়, ভোস ও লারউডের উপরই।

বডি বরাবর বোলিং ছিল বলে একে ‘বডিলাইন’ নামে ইতিহাস স্বীকৃতি দেয়। অবশ্য এই ‘বডি লাইন’ শব্দগুচ্ছের উৎপত্তিরও এক ভিন্ন গল্প আছে। সে আরেকদিন হবে না-হয়!

১৯৩০ অ্যাশেজে ৭ ইনিংসে স্যার ব্রাডম্যান রান তুলেছিলেন ৯৭৪। অ্যাশেজ ফিরিয়ে আনতে ডগলাস জার্ডিনের নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ড হ্যারল্ড লারউড ও বিল ভোসের গতির সাহায্যে নিয়েছিল। আর আশ্রয় নিয়েছিল ‘বডিলাইন’ নামক এক অপকৌশলের! ক্রিকেটের ইতিহাস এর তুল্য বিতর্কিত কিছু আর দেখেনি কখনো।

কল্পনা করুন, লারউডের রানআপের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে এমসিসির ৩৩ হাজার দর্শক চ্যাঁচাচ্ছে, “বাস্টার্ড! বাস্টার্ড!” বলে চিৎকার করছে।
জার্ডিন ও ইংলিশ ক্রিকেট স্যার ব্রাডম্যানকে এই অপকৌশলে দমাতে পেরেছিলেন বটে! এই কুখ্যাত সিরিজে তার রানের গড় ছিলো মাত্র ৫৬.১৪!

৭.
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪০ সালে বিখ্যাত ক্রিকেটার ‘ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান’ রয়াল অস্ট্রেলিয়ান এয়ার ফোর্সে জয়েন করেন। পরে তাঁকে ‘রয়াল অস্ট্রেলিয়ান আর্মি’-তে বদলি করা হয়। ১৯৪১ সালের জুন মাসে রুটিন চেকআপের সময় তাঁর দৃষ্টি শক্তিতে সমস্যা ধরা পড়লে সেনা থেকে অবসর দেওয়া হয়।

১৯৪৫ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনি আবার নিজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৪৭-৪৮ সালে স্বাধীন ভারত প্রথমবার অস্ট্রেলিয়া ট্যুরে গেলে প্র্যাকটিস ম্যাচে, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে নিজের শততম শতকটি করেন তিনি। অব্রিটিশ হিসাবে তিনিই প্রথম যিনি এই বিরল কৃতিত্বের অধিকারী।

ভারতীয় টিমের বিরুদ্ধে পাঁচ টেস্টের সেই সিরিজে তিনি জীবনের শেষ ডাবল সহ সোট ৭১৫ রান করেছিলেন। ঐ সিরিজের শেষ টেস্ট ছিলো, তাঁর জীবনে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে খেলা শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

এরপর তিনি ইংল্যান্ডের লন্ডনে, দ্য ওভাল মাঠে নিজের জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলা শুরু করেন- ১০১.৩৯ গড় নিয়ে। যদিও সেই ম্যাচে ০ রানে তিনি আউট হয়ে যান। ফলে তাঁর রানের গড় হয়ে যায় ৯৯.৯৪! ঐ ম্যাচে যদি তিনি আর মাত্র ৪টি রান করতে পারতেন, তাহলে এই গড় হয়ে যেতো ঠিক ১০০!

৫২ টেস্ট ম্যাচের ক্যারিয়ার শেষে তাঁর মোট রান ৬৯৯৬, এবং গড় ৯৯.৯৪!

৮.
ক্রিকেট-জীবনে বহু শতক হাঁকালেও আয়ুর শতক করা করা হয়নি তাঁর। ৯২ বছর বয়সে জীবনের শতক পূরণের আগেই, নার্ভাস নাইন্টিজে ব্র্যাডম্যান দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার কিংস্টন পার্কে মারা যান।

এর আগে ১৯৪৯ সালে অর্জন করেছিলেন সম্মানসূচক ‘নাইটহুড’ উপাধি। উইজডেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটারের পুরস্কারটি দশ-দশবার উঠেছিল তাঁর হাতে, স্যার গ্যারি সোবার্সর আটবার বাদ দিলে আর কোনো ক্রিকেটার এটি তিনবারের বেশি লাভ করতে পারেননি।

বৃদ্ধ ডন ব্র্যাডম্যানকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এই সময় ক্রিকেট খেললে তিনি কেমন করতেন?
জবাবে বলেছিলেন, ‘হয়তো ৭০ গড় থাকতো আমার।’
কেন? ৯৯ নয় কেন?

‘এই বৃদ্ধ বয়সে ৭০ গড় নিশ্চয় খুব একটা কম নয়, মাই ডিয়ার চাইল্ড!’ প্রশ্নকর্তার দিকে সহাস্য তাকিয়ে বলেছিলেন স্যার ডন।

চিরটাকাল এমনই ইস্পাত-কঠিন মনোবল ছিল তাঁর। সেজন্যেই কোনো কোচ ছাড়াই হয়তো উঠতে পেরেছিলেন অমন এক চূড়ায়। কোনো ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদ হতে পেরেছিলেন।

স্যার ডন, আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা!

 

মন্তব্য করুন

এই বিভাগের আরো খবর