ভ্রান্তিবিলাসের সীমানায় ক্রিকেটের বরপুত্রের উপহার

Saidor Shanto
  • প্রকাশিত সময় : সোমবার, ২২ জুন, ২০২০
  • ৩৫ ভিউ
  • শেয়ার করুন

বহু খেলোয়াড়েরই বিশ্বজোড়া পরিচিতি থাকে, আছে। নিজস্ব সময়ে পৃথিবী মাতিয়ে কাল প্রবাহে বিস্মৃতির অতলে হারিয়েও যান কেউ কেউ। কারও কারও ক্ষেত্রে আবার দাঁত বসাতে পারে না মহাকাল। তাদের কর্মের সোনার তরী নামটিকে তরতরিয়ে নিয়ে যায়, কাল কালান্তর। এমনই একজনের গল্প বলবো আজ। গল্পটি ঠিক গল্প নয়, ক্রিকেটের নন্দিত ইতিকথার এক খন্ডিত অধ্যায়। স্নায়ু টেনে ধরা এক চোয়াল চাপা সংগ্রামের অমৃত বিবরণ।

ত্রিনিদাদের এক কৃষি খামার কর্মকর্তার এগারো সন্তানের কনিষ্ঠজন লারা। ইতিহাসের পাতায় সোনালি অক্ষরে নিজের নামটা সেঁটে দিতেই যেনো তার জন্ম। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওডিআই ও টেস্ট অভিষেক। অবশ্য এর আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাকে নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে।

কেনই বা হবে না?

১৯৮৯ তে ত্রিনিদাদের হয়ে সফরকারী ভারতের বিপক্ষে খেলেন ১৮২ রানের ইনিংস। পরের বছর ত্রিনিদাদের অধিনায়ক হিসেবে ২০ বছর বয়সী তরুণ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলেন ১৩৪ রানের ঝলমলে ইনিংস। তিনি যেনো বিশ্বকে জানিয়ে দীপ্ত পদে ইতিহাসের পাতায় প্রবেশ করলেন, অতঃপর জয় করলেন! নিজের পঞ্চম টেস্টই দেখা পেলেন প্রথম শতকের। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচে থেমে ছিলেন ২৭৭ রানে। আসলে থেমে ছিলেন বললে ভুল হবে। তাকে থামতে হয়েছিলো, রান আউটের বিষফোঁড়ায়। ব্যাথিত, বিষাদাক্রান্ত লারা টলমলে চোখ নিয়ে বসে আছেন। ২৭৭ আর কটা রান হলেই সোবার্সের ১৯৫৮ সালে করা অপরাজিত ৩৬৫ রানের ইনিংসটা টপকাতে পারতেন। তা আর হলো না।

দাঁতে দাঁত চেপে দৃঢ় প্রত্যয়ে আবার শুরু করলেন। আবার, আবার পিছিয়ে পড়া, আবার শুরু। খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। সন্ধ্যার আবেশে দিগন্তরে লুকিয়ে থাকা সাফল্য অবশেষে স্বচ্ছ প্রতিয়মান হলো। উনিশে এপ্রিল ১৯৯৪। দাঁতে দাঁত চেপে উইকেটে টিকে থাকা। চোখ সোবার্সের ব্যক্তিগত ৩৬৫ তে। দর্শকদের মধ্যে স্যার গারফিল্ড সোবার্স। বিস্ময় সহযোগে দেখছেন এ কৃষ্ণাঙ্গ তরুণের ধ্রুপদী নির্মাণ। আঠারো এপ্রিল ৩২০ রান নিয়ে অপরাজিত লারার নির্ঘুম চোখে আজ ক্লান্তির লেশমাত্র নেই। ইতিহাসের যাত্রা পথ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় কমতি নেই ইংল্যান্ড বলারদের। আট ঘন্টার অধিক বিস্তৃত স্নায়ু টেনে ধরা চোয়াল চাপা সংগ্রামের ইতি টানেন ক্রিস লুইসকে পুল করে নিজের ইনিংসের ৪৪ তম চারের সাহায্যে। ছাড়িয়ে যান স্যার গারফিল্ড সোবার্সকে। তারপরই রাজ্যের ক্লান্তি। সোবার্সের ৩৬৫ টপকে ৩৭৫ এ থামেন তিনি। ক্যাডিকের আউট সুইঙ্গার বলটা লারার ব্যাটের কানা ছুয়ে চলে যায় রাসেলের গ্লাভসে। তারপর দর্শকদের অভিনন্দন। মাঠে সোবার্সের আলিঙ্গন।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর উষ্ণ বার্তা, তার নামে রাস্তার নাম, রাষ্ট্রীয় সম্মান। দেশবাসীর পাগলপারায় লারা তার ভক্তদের কথা দেন, তিনি তার নিজের করা রেকর্ডটি আবার ভাঙবেন। বাইশ গজের ক্রিকেটে আবারও মহাকাব্য রচনা করবেন। যা তার নামকে অমরত্ব দিবে, যুগ যুগান্তর। পাঠক হয়ত এখন একটা হোঁচট খেতেই পারেন। আপনার ভ্রু কুঞ্চিত হতে পারে, কপালে ভাজ পড়তে পারে। এই ছেলে বলে কি?

আবারও এপ্রিল মাস। কথা দিয়েছেন প্রায় ১০ বছর পূর্ণ হবে। ১৯৯৪ থেকে ২০০৪। কাউন্টি লীগে সেই ‘৯৪ তেই ছুয়ে ছিলেন ৫০০ রানের মাইল ফলক। কিন্তু এই দশ বছরে দেশবাসী ও ভক্তদের দেওয়া কথা পুরণ হয়নি স্মরণে ছিলো হয়ত লারার। কিন্তু একসময় জাদুর কাঠি হয়ে সঙ্গ দেয়া ব্যাটটি হাসছে না ঠিক মত। তাহলে কি আর হবে না। এমনই সংশয় আর হতাশার টুটি চেপে ধরলেন ২০০৪ এর ১২ ই এপ্রিল। অ্যান্টিগাতে উইজডন ট্রফির প্রথম দিন ৮২ রানে অপরাজিত লারা। প্রতিপক্ষ সেই ইংল্যান্ড। আবারও হয়ত শয়নে-স্বপনে ধ্রুপদী বিনির্মাণের সুপ্ত বাসনা। মাঠের খেলায় তা স্পষ্ট হলো দ্বিতীয় দিনই। তুলে নেন ট্রিপল সেঞ্চুরী। অ্যান্টিগাতে দ্বিতীয় ট্রিপল। এই অ্যান্টিগাতেই তো সেবার রচনা হয়েছিলো নতুন ইতিহাস। তবে এবার কেন নয়! দ্বিতীয় দিনের সমাপ্তিতে ৩১৩ রানে অপরাজিত লারা।

নিজের প্রথম টেস্ট শতকের দিন ২৬৫ করার পর থেকেই নাকি সোবার্সের করা ৩৬৫ টপকাতে আর কত করতে হবে গুনতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু ২৭৭ রানে রান আউট যেনো আগুনে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছিলো। দুর্দমনীয় রান ক্ষুধাই সোবার্সকে ছাড়িয়ে যেতে সাহায্য করেছিলো। আজ সোবার্সকে ছাড়িয়ে যাবার তাড়া নেই। নিজেকে নিজে ছাড়িয়ে যাবার অদম্য ইচ্ছা। কথা রাখার প্রয়াস। ঘড়ির কাটার হিসেবে ঠিক ৭৭৮ মিনিট। প্রতিপক্ষের ছোঁড়া ৫৮২ টি বল। ধৈর্য্যের পরিক্ষায় ষোলআনা নম্বর। ৪৩ টি চার ও ৪ টি ছয়। গ্যারেথ ব্যাটির অফস্পিনের মায়াজালে আগের বলে পরাস্ত হলেও পরের বলে সুইপ শটে পূর্ণ করেন ৪০০* রানের মাইল ফলক। এবার আর কেউ তাকে থামাতে পারলো না। তিনি থামলেন। ইতিহাসে নিজের নামটা সোনালি অক্ষরে সেটে দিলেন। এই নাম যেন অমর অক্ষয়।

পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতার এই কৃষ্ণাঙ্গ লোকটির কীর্তি এভারেস্টের উচ্চতা ছাড়ানো। একাল থেকে সেকাল ভক্তকুল আবেগাপ্লুত। ইতিহাসের পুরানো পাতা আজও উল্টানো হয়। কিন্তু সেখানে কোন আক্ষেপ নেই। অ্যান্টিগুয়া থেকে অ্যান্টিগা। মাঝে শুধু দশ বছরের অপেক্ষা। ব্রায়ান লারা ততদিনে প্রমাণ করলেন যে, ক্রিকেট তোমাকে বার বার সুযোগ দেবে, যদি তুমি চাও। ভ্রান্তিবিলাসের সীমানা ডিঙিয়ে ক্রিকেটের বরপুত্র অবসরের চিঠি দেওয়ার পূর্বেই কথা রেখেছিলেন।

মতামত লিখুন :

এই বিভাগের আরো খবর