সবুজ পিচের এক বিস্ময়কর যাদুকর; ছিলেন মন্থর উইকেটে গতির মিশলে তাণ্ডব চালানো এক বোলার। কেউবা তাকে ডাকে স্টেইন রিমোভার আবার কেউবা দ্য ফালাবোরা এক্সপ্রেস নামে। অনেকের কাছে তো দ্য স্টেইন গান নামে পরিচিত। যেই তিনি অভিষেকের পর থেকেই পেস বোলিংয়ে ছড়িয়ে গেছেন ত্রাস। ছিলেন গত এক যুগের সেরা গতি দানবও। তিনি ডেল উইলেম স্টেইন।
উদ্যমী স্টেইন ক্রীড়ামোদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন সেই শৈশবকালেই। ছিলেন মাছ ধরা এবং নৌকা চালাতেও সিদ্ধহস্তের অধিকারী। এইসবের পাশাপাশি ক্রিকেট নামক নেশায় জড়িয়েছিলেন নিজেকে। স্কুল ক্রিকেটে বল হাতে গতির ঝড়ে মুগ্ধ করা স্টেইন উদীয়মান পেসার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন সেই ছোট্ট বেলাতেই, পেয়েছিলেন বড়দিনের উপহার হিসেবে হানসি ক্রনিয়ের কাছ থেকে ক্রিকেট সেটও! সেই স্টেইন পরবর্তী সময়ে বাইশ গজে তুলেছেন গতির ঝড়, গড়েছেন ষষ্ঠ দ্রুততম বোলার হিসেবে টেস্টে ২০০ উইকেট শিকারের মাইলফলক। যেই স্টেইনের কথা ছিলো বাইশ গজে আরও কিছুদিন রাজত্ব করার, সেই স্টেইন হার মেনেছিলো ইনজুরি বাঁধায়। স্বপ্নকে তাড়া করে এগিয়ে যাওয়া হয়নি আর নতুন করে, তাইতো মাত্র ৯৩ টেস্ট খেলেই বিদায় বলেছেন রাজকীয় ফরম্যাটকে। পাওয়া – না পাওয়ার গল্পে স্টেইন যেটুকু পেয়েছেন সেটিই বা কম কিসে?
কন্ডিশন কিংবা উইকেট যেমন’ই হোক স্টেইন বাইশ গজে ঠিকই চালাতেন স্টেইন গান! ছিলেন ব্যাটসম্যান জন্য এক আতঙ্কের নামও। মন্থর উইকেটেও কখনো ইনসুইং আবার কখনোবা আউট সুইংয়ে উইকেট করেছেন ছত্রখান। পুরোনো বলে রিভার্সসুইং করে তাক লাগানো স্টেইন রাজকীয় ফরম্যাটে মাত্র ৮০ ম্যাচেই স্পর্শ করেছিলেন ৪০০ উইকেটের মাইলফলকও! দারুণ লাইন-লেন্থের সাথে দূর্দান্ত বাউন্সারে কাবু করা স্টেইন ছিলেন আগ্রাসনও বটে। ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে এসেও তিনি ছিলেন সময়ের সেরা পেসার।
রঙিন ক্যারিয়ারে হাসি-কান্নার গল্পে স্টেইন ঠিকই সাফল্যের মহাকাব্য রচনা করেছেন, নিজেকে নিয়েছেন সেরাদের কাতারে। এর পেছনে রয়েছে ইনজুরির সাথে লড়াই করার গল্প, রয়েছে পরিশ্রম আর সাধনাও। পাওয়া – না পাওয়া ক্যারিয়ারে কখনো হাসিয়েছেন দলকে আবার কখনোবা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন ঐ বাইশ গজেই। তবুও হয়নি পিছুপা, উঠে দাঁড়িয়েছেন অদম্য মনোবলকে সঙ্গী করে। আহ স্টেইন, তুমি নিছক এক স্বপ্নবাজ!
ব্রিটিশ মুলুকে স্বপ্নপূরণ; মার্কাস ট্রেসকোথিককে সরাসরি বোল্ড করে উদযাপনের শুরু! সময়ের সাথে সাথে সাক্ষী হয়েছেন বেশকিছু অভিজ্ঞতার। নিয়মিত গতিতে বল করে ধ্বসিয়ে দিয়েছেন বিপক্ষের ব্যাটিং লাইনআপ! এর মাঝে নিজে দেশের হিউ টেফিল্ডের গড়া রেকর্ডকে দিয়েছেন দুমড়েমুচড়ে। এখানেই শেষ নয়, সাদা পোশাকে ভিন্ন ভিন্ন ৯ টি দেশের বিপক্ষে ইনিংসে ৫ উইকেট শিকারী চার বোলারের একজন এই ডেল স্টেইন। সাদা পোশাকের ইতিহাসে সর্বনিম্ন ৩০০ উইকেট শিকারী বোলারদের মাঝে সেরা স্ট্রাইকরেট এই স্টেইন গানের দখলে। রয়েছে একই ম্যাচে ফিফটি ও পাঁচ উইকেট শিকারের রেকর্ডও!
ক্রিকেট ইতিহাসে বেশকিছু পেসার রয়েছে যারা এশিয়ার উইকেট খুব বেশী সফল নয়, সেখানে ভিন্ন স্টেইন। টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগার ভারতের মন্থর উইকেটেই! টেস্ট ক্যারিয়ারে ২৬ বার ইনিংসে ৫ বা তার বেশী উইকেটের দেখা পাওয়া স্টেইন অ্যাওয়ে ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়েছে ১০ বার! যেখানে এশিয়ার মাটিতেই ৫ উইকেট নিয়েছে ৫ বার।
স্টেইন যে শুধু ব্যাটেই দলকে দিয়েছেন সেরাটা এমন নয়, ব্যাট হাতেও প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে গেছেন বাইশ গজে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম টেস্ট জয়ে তাঁর ব্যাটে এসেছিলো ৭৬ রানের ইনিংস! স্টেইন যে শুধু সাদা পোশাকেই সেরা ছিলেন এমন না, রঙিন পোশাকেও ছড়িয়েছেন দ্রুতি। গতির মিশলে গড়া রঙ্গিন পোশাকে রয়েছে ২৬০ উইকেট।
এই স্টেইনকে চোটের কাছে হার মেনে থেমে যেতে হয়েছে ৯৩ টেস্ট আর ৪৩৯ উইকেটেই। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অবসর না নিলেও খেলছেন না-খেলার মতোই! সাদা পোশাকে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলারদের মাঝে সেরা আটে থেকেই বিদায় জানিয়েছেন ক্রিকেটকে।