২০১০ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যখন টি টুয়েন্টি আই দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন তখন বয়স ছিল ২০। সেসময় থেকে মাত্র দুই বছর আগে কুয়ালালামপুরে অ-১৯ বিশ্বকাপ খেলা এক তরুনের জন্য এত কম বয়সে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করা এক বিশাল বড় ব্যাপার ছিল। মারাত্মক স্পেশাল না হলে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে এই বয়সের কেউ সুযোগ পায়না। শুরুর দিন গুলোতে নাদুসনুদুস ছেলেটাকে পছন্দ করে টমেটো ডাকতাম। সময়ের পরিক্রমায় সেই টমেটো আজ বিশ্বের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান। স্মিথের ৩১তম জন্মদিনে আজ তার টেস্ট ক্যারিয়ারের নানান দিকে নিয়ে লিখবো।
২০১০ এর ১৩ই জুলাই টেস্ট অভিষেক হলেও প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করেন ২০১৩ সালের অগাস্ট মাসে। মানে ৩ বছরেরও বেশি সময় লাগে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করতে। এই সেঞ্চুরি করার আগে তার পরিসংখ্যান ছিল অনেকটা এরকম:
ম্যাচ: ১১
ইনিংস: ২২
রান: ৬২০
গড়: ২৯.৫২
১০০/৫০: ০/৫টি
সর্বোচ্চ: ৯২ রান
আবার প্রথম সেঞ্চুরি করার পর থেকে আজ অবধি যদি তার পরিসংখ্যান দেখি তাহলে হয় এরকম:
ম্যাচ: ৬২
ইনিংস: ১০৯
রান: ৬৬০৭
গড়: ৭০.২৮
১০০/৫০: ২৬/২৪
সর্বোচ্চ: ২৩৯ (তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি)।
অর্থাৎ মাঝের পাঁচ বছরে সাড়ে ৬ হাজারের উপরে রান। নিজের ব্যান ও করোনার জন্য দেড় বছর নষ্ট না হলে “হয়তো” রান আরো দুই হাজার ও সেঞ্চুরি ৬/৭ টি বেশি থাকতো। তার ক্যারিয়ার যদি আরো ছয়/সাত বছর লম্বা হয় তাহলে “হয়তো” টেস্ট ক্রিকেটের প্রায় সব ব্যাটিং রেকর্ড নিজের করে নিতে পারেন তিনি।
মুশফিক, বাবার অথবা কোহলি দের জন্য SENA দেশ গুলোয় রান করা যেমন বড় চ্যালেঞ্জ, রান করলে পাওয়া যায় বেশি সম্মান ঠিক তেমনি স্মিথদের জন্য এশিয়াতে রান করা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের। চলুন দেখে আসি নন এশিয়ানদের মধ্যে এশিয়ার মাঠে ভাল করা ব্যাটসম্যান দের তালিকা।
১) এলিস্টার কুক:- ম্যাচ (২৮) রান (২৭১০) গড় (৫৩.১৩)
২) জ্যাক ক্যালিস:- ম্যাচ (২৫) রান (২০৫৮) গড় (৫৫.৬২)
৩) রিকি পন্টিং:- ম্যাচ (২৮) রান (১৮৮৯) গড় (৪১.৯৭)
অপরদিকে স্মিথের পরিসংখ্যান যদি দেখি:
ম্যাচ খেলেছেন ১৩ টি রান করেছেন ১২০০ ও তার গড় ৪৮.০০ সেই সাথে সেঞ্চুরি করেছেন ৪ টি। পরিসংখ্যান বলছে তিনি এশিয়ার মাটিতে শুধু সফলই না সবচেয়ে সফলদের মধ্যে একজন হওয়ার যোগ্যতা রাখেন যদি পর্যাপ্ত ম্যাচ খেলতে পারেন।
ভারতের মাটিতে তার একটি বিখ্যাত সেঞ্চুরি আছে চলুন সেটা একটু মনে করি। সময়কাল ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭। অস্ট্রেলিয়া-ভারত টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচ। ভেন্যু পুনে। আমার মনে হয় পিচ কিউরেটর ম্যাচের দুই সপ্তাহ আগে থেকে পিচে পানি দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। ১ম দিনেই পুনের পিচ ৫ম দিনের চেয়েও বেশি টার্ন করছিলো।
সেই ম্যাচে দুই দলের চার ইনিংস মিলিয়ে রান হয়েছিল মাত্র ৭৫৭ যার মধ্যে স্মিথ একাই করেন ১৩৬। মানে পুরো ম্যাচে ২২ জনের মোট রানের ১৮% স্মিথ একাই করেছিলেন। অথচ স্বাগতিক ভারত তাদের দুই ইনিংস মিলিয়ে (১০৫ ও ১০৭) করেন মাত্র ২১২ রান। ভারতীয় বোলিং লাইনাপে ছিলেন আশ্বীন ও জাদেজা। এমন ধুলাবালির উইকেটে এই স্পিন জুটি কতটা ভয়ানক তা বিগত বছরগুলোয় ঘরের মাঠে ভারতীয়দের দাপট দেখলেই স্পষ্ট।
ম্যাচের ৩য় ইনিংসে স্মিথ যখন ১০৯ রানের ইনিংস খেলেন তখন মনে হচ্ছিলো এখানে ১০ বল টেকাই দায়। সেই ম্যাচে ম্যাট র্যানশো ছাড়া আর কেউ ফিফটিও করতে পারেনি। র্যানশো তবু প্রথম দিনের উইকেটে করেছিলেন সেই ফিফটি। এই ইনিংসটা শুধু স্মিথের সেরা ইনিংসই না কোন নন এশিয়ান ব্যাটসম্যানের পক্ষে এশিয়া মাঠে খেলা সর্বকালের ইনিংস গুলোর মধ্যেও একটি। যা ইতিহাস হয়ে থাকবে শতবছর।
স্মিথের আরো একটা গ্রেট ইনিংসের কথা তার ৩১তম জন্মদিনে স্মরণ করতে চাই। গতছরের প্রথম এশেজ টেস্ট। প্রায় ১৭ মাস পরে টেস্ট ক্রিকেটে আবারো মাঠে নামেন টেস্ট ক্রিকেটের রাজা স্টিভ স্মিথ।
প্রথম ইনিংসে যখন ব্যাট করতে নামেন তখন দলের স্কোর ১৭/২ এবং একটা সময় স্কোর হয়ে পরে ১২২/৮। সেখান থেকে পিটার সিডল ও ন্যাথান লায়নকে নিয়ে আরো ১৬২ রান যোগ করেন স্মিথ। যার মধ্যে স্মিথ একাই আরো ১০২ রান করেন। প্রথম ইনিংসে প্রায় ৫১% রান তিনি একাই করেন।
প্রথম ইনিংসে ইংলিশরা ৯০ রানের লিড নিলে আবারো চাপে পরে অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে যখন আবারো ব্যাট করতে নামেন দলের স্কোর তখন ২৭/২। সেখান থেকে আবারো খেলেন ১৪২ রানের ইনিংস। সেই ম্যাচ অস্ট্রেলিয়াকে ২৫১ রানে জিতিয়ে অন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বীরের মতো ফিরে আসেন তিনি।
এশেজের কথা যখন উঠলোই চলুন দেখে আসি স্মিথের এশেজ রেকর্ড। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এই টেস্ট সিরিজে মাত্র ২৭ ম্যাচ খেলে ২৮০০ রান করেছেন স্মিথ। গড় অবিশ্বাস্য ৬৫.১১ (যা কেবল ব্র্যাডম্যানের ৮৯.৭৮ থেকে কম)। ব্র্যাডম্যানের পরে এই সিরিজে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি জ্যাক হবসের ১২টি। অথচ হবস থেকে ২৩ ইনিংস কম খেলে মাত্র একটি সেঞ্চুরি কম স্মিথের। হয়তো এশেজে ব্র্যাডম্যানের ১৯ সেঞ্চুরির রেকর্ডও ভেঙ্গে দিবেন তিনি। বর্তমানে ৪ ইনিংস পর পর একটি পরে এশেজ সেঞ্চুরি হাকাচ্ছেন তিনি।
অধিনায়ক হিসেবে মাত্র ৩৪ ম্যাচে করেছেন ৩৬৫৯ রান, গড় ৭০.৩৬ ও মাত্র ৬০ বার ব্যাট করে ১৫টি সেঞ্চুরি। অধিনায়ক হিসেবে ‘অস্ট্রেলিয়ার হয়ে’ সর্বোচ্চ রানের মালিকের তালিকায় ৬ষ্ট স্থানে আছেন তিনি। যদিও উপরের ৫ জন থেকে তার ম্যাচ ও ইনিংস অনেক কম। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক হিসেবে তার ৭০.৩৬ গড় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আবার ১৫ টি সেঞ্চুরিও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (যৌথভাবে)।
ঘরের মাঠে স্মিথের গড় ৭১.১৪ হলেও ঘরের বাইরে তার ব্যাটিং গড় ৬০.১৫। তাই তাকে হোম ট্র্যাক বুলিও বলা যাবেনা। তার ২৬ টেস্ট সেঞ্চুরির মধ্যে মাত্র ২টি সেঞ্চুরিতে অস্ট্রেলিয়া হেরেছে। অস্ট্রেলিয়া জয়ী হয়েছে এমন ম্যাচ গুলোতে স্মিথের ব্যাটিং গড় ৮১। তিনি শুধু খেলেননা তিনি জেতানও। তার ম্যাচ ইম্প্যাক্ট নিয়ে আরো গভীরভাবে লিখতে গেলে হয়তো ছয় মাস লেগে যাবে তাই আরো ভিতরে যাবনা।
প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারতকে পেলে সবসময় হাসে স্মিথের ব্যাট। ভারতের সবচেয়ে বড় যম স্মিথ তা অনায়াসে বলে দিতে পারেন। ভারতের বিপক্ষে মাত্র ১০ ম্যাচে ১৪২৯ রান, গড় ৮৪.০৫। মাত্র ২০ ইনিংসে ৭টি সেঞ্চুরি। যেখানে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি করা পন্টিং ৫১ ইনিংস খেলে করেছেন ৮টি। ভারতের সাথে সর্বোচ্চ রানও (২৫৫৫) পন্টিং এর কিন্তু ম্যাচ খেলেছেন স্মিথের প্রায় ৩ গুণ।
বাংলাদেশ ছাড়া সব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তার গড় ৪০+ (উইন্ডিজের সাথে ১৬৫.৬৬)। বাংলাদেশ ও আরব আমিরাত ছাড়া সব দেশে টেস্টে সেঞ্চুরিও হাকিয়েছেন তিনি। এই জুনে বাংলাদেশ সফরে আসলে ‘হয়তো’ এই নাম্বার গুলাও একটু পরিবর্তন হয়ে যেত।
টেস্ট ব্যাটিং রেটিং অনুযায়ী যদি স্মিথকে দেখতে যাই তাহলে ২০১৭ সালের ৩০শে ডিসেম্বর ৯৪৭ রেটিং নিয়ে এক নাম্বারে উঠেছিলেন স্মিথ যা ইতিহাসে ব্র্যাডম্যানের (৯৬১) পরের দ্বিতীয় সেরা। স্মিথ বর্তমানের টেস্ট র্যাংকিং এর ১ নাম্বার ব্যাটসম্যান তবে বর্তমান রেটিং ৯১১।
স্মিথেরও ব্যর্থতার যায়গা আছে। তা হলো টেস্টের ৪র্থ ইনিংস। এখানে ২১ বার ব্যাট করেও নেই কোন সেঞ্চুরি গড় মাত্র ৩০.৬৮ (যা ক্যারিয়ার গড় থেকে
অর্ধেকের কম)।
এখনো পর্যন্ত স্মিথের রেকর্ড সমূহ:
১)মাত্র ১২৬ ইনিংসে ৭ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন তিনি। দ্বিতীয় স্থানে থাকা হ্যামন্ডের ১৩১ ইনিংস লেগেছিল।
২)মিনিমাম ৭ হাজার রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যাটিং গড় ৬২.৮৪ স্মিথের।
৩)গড়ে প্রতি ৫ ইনিংস পর পর একটি সেঞ্চুরি হাকান যা ব্র্যাডম্যানের পরে সবচেয়ে কম।
আরো শ খানেক রেকর্ড স্মিথ ইতিমধ্যে নিজের করেছেন বা করবে। হয়তো আগামী জন্মদিনে আরো অনেক কিছু নতুন যোগ হবে লেখার জন্য।
One last para before finishing this long post. He is the best current test batsman in the world & one of the best in the history of test cricket. If you think he isn’t give me a name I will rectify you through my analysis.