আমরা ক্রিকেট পাগল জাতি। ক্রিকেটটা আমাদের রক্তে মিশে গেছে। আর জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এই ক্রিকেট সবার উর্ধ্বে। শহরের কথা না হয় বাদই দিলাম, বাংলাদেশের খেলা হলে গ্রামের প্রত্যেকটা চা’য়ের দোকানে গেলে বুঝা যায় এই ক্রিকেটের সাথে আমাদের সম্পর্কটা কেমন। পিচ্চি থেকে শুরু করে মুরুব্বীরা পর্যন্ত সবসময় এই ক্রিকেট নেশায় মেতে উঠে, টিম টাইগার্সরা জিতলে তারা মিছিল বের করে, আর হেরে গেলে মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরে এসে মুখ লুকিয়ে কান্না করে। এই ক্রিকেটের জন্য কতো যুবক বাবার হাতে মার খায়, স্কুল/কলেজ পালায় তারপরও তারা ক্রিকেট ছাড়েনা। এই ব্যাট বলের লড়াইটা বাঙ্গালীদের আবেগের সাথে মিশে গেছে।
ক্রিকেট খেলার অনেক ইতিহাস আছে। আমরা অনেকেই অনেককিছু জানিনা, কিন্তু জানার আগ্রহ কিন্তু কারো চেয়ে কারো কম নয়। ক্রিকেটের অনেক ইতিহাসের মাঝে অন্যতম ইতিহাসের প্রথম টেস্ট নিয়েই আমাদের এই আর্টিকেল।
ক্রিকেটের সবচেয়ে লম্বা ও আদিম ফরমেটের নাম হচ্ছে টেস্ট ক্রিকেট। যাকে ক্রিকেটের দীর্ঘতম সংস্করণ বলা হয়। টেস্ট খেলাকে সর্বোচ্চ মানদণ্ডরূপেও বিবেচনা করা হয়। ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে প্রকৃত ক্রিকেট হিসেবে এই টেস্ট ক্রিকেটই পরিচিত। খেলোয়াড়দের সক্ষমতা যাচাইয়ের প্রধান মানদণ্ডরূপে বিবেচনায় আনতে এই টেস্ট ক্রিকেটের কোনো বিকল্প নেই।
আজ থেকে প্রায় ১৪২ বছর আগের কথা। ১৮৭৭ সালের ১৫ ই মার্চ ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচ দিয়ে এই দীর্ঘতম সংস্করণের যাত্রা শুরু হয়। এই ম্যাচ খেলতে ইংল্যান্ড জাতীয় দল জাহাজে করে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল। খেলা হয়েছিলো অস্ট্রেলিয়ার মেরিলিবোন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। মেরিলিবোন ক্রিকেট গ্রাউন্ড বললে অনেকেই আবার নাও চিনতে পারেন, তবে বিখ্যাত এমসিজি চিনেন তো?? এই এমসিজি’ই হচ্ছে মেরিলিবোন ক্রিকেট গ্রাউন্ড।
দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচে টস জিতে ব্যাটিং নেয় অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেন ডেভ গ্রেগরি। ব্যানারম্যানের ২৮৫ বলে ১৬৫ রানে ভর করে ১৬৯.৩ ওভারে সবকয়টি উইকেট হারিয়ে অজিদের ১ম ইনিংসে সংগ্রহ গিয়ে দাঁড়ায় ২৪৫ রান। আর ইংরেজদের প্রথম ইনিংস গুটিয়ে যায় ১৯৬ রানে। দলের পক্ষে ওপেনিং ব্যাটসম্যান জুপ ২৪১ বলে মাত্র ২ বাউন্ডারিতে করেন ৬৩ রান।
৪৯ রানে এগিয়ে থেকে ব্যাট করতে নামেন অজিরা, কিন্তু মাত্র ১০৪ রানেই গুটিয়ে যায় অজিদের ইনিংস। আর ইংল্যান্ডের টার্গেট গিয়ে দাঁড়ায় ১৫৩ রান। ১৫৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ১০৮ রানেই অল আউট হয়ে যায় ইংলিশরা। যার ফলে ইতিহাসের প্রথম টেস্টে ৪৫ রান জয় তুলে নেয় অজিরা।
অবাক হওয়ার মতো কথা হলেও টেস্ট ক্রিকেটের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ১৯৭৭ সালের ১২ই মার্চ মেরিলিবোনে অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়, আর সেই ম্যাচেও অস্ট্রেলিয়া ৪৫ রান জয়ী হয়।
ইতিহাসের প্রথম টেস্ট পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন- রিচার্ড টেরি ও কুর্টিস রেড।
খেলা শেষ হতে লেগেছিলো ৫ দিন। ভাবছেন, টেস্ট ম্যাচ তো ৫ দিনই হয়। নতুন করে আর বলার কি আছে। কিন্তু না, আগে টেস্ট ম্যাচের নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা ছিলোনা। ৪ ইনিংস শেষ হতে যতোদিন লাগতো, খেলাও ততোদিন চলতো। ওই ম্যাচের কিন্তু মজার একটা তথ্য আপনাদের বলা হয়নি। সেইসময় কিন্তু এক ওভার ৬ বলে হতো না, হতো ৪ বলে।
আচ্ছা আপনারা কি জানেন ক্রিকেটের জন্ম কোথায়? তবে এইটা নিয়ে কিন্তু এখনো অনেক দ্বন্দ্ব বিরাজমান। তবে আধুনিক ক্রিকেটের বিকাশ কিন্তু ইংরেজদের হাত ধরেই ঘটেছে এইটা নিয়ে কারো বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমি যদি বলি প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ ইংল্যান্ড খেলেনি!! আপনি কি তাহলে মেনে নিবেন?? আপনাকে এইটা মেনে নিতেই হবে, কারণ এইটাই সত্য। তবে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ যারা খেলেছে তারা কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বের সদস্যও নয়। সময়টা ১৮৪৪ সাল, আর এই বছরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যকার প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ নিউইয়র্কের সেন্ট জর্জ ক্রিকেট ক্লাবের মাঠে অনুষ্ঠিত হয়।
যখন ইংরেজ পেশাদার খেলোয়াড়রা উত্তর আমেরিকায় খেলতে যায় তখন সময়টা ছিলো ১৮৫৯ সাল। এটাই ছিলো ক্রিকেটাঙ্গণে প্রথম বিদেশ সফর। তারপর ১৮৬২ সালে ইংরেজরা প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ায় যায়, আর অস্ট্রেলিয়ানরা ১৮৬৮ সালে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডে যায়। এরপর ১৮৭৭ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে যায় ইংল্যান্ড। খেলে ২ ম্যাচ সিরিজ, সেই সফরের প্রথম ম্যাচটিকে টেস্টের প্রথম শুরু বলে গণ্য করা হয়। একই বছর অজিরা ইংল্যান্ড সফরে যায়, এইভাবেই আন্তর্জাতিক টেস্টের যাত্রা শুরু হয়। এর পরের বছর ১৮৭৮ সালে কোনো টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়নি।
১৮৮৯ সালে তৃতীয় দল হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা। এর ঠিক ৩৯ বছর পর ১৯২৮ সালে ৪র্থ দল হিসেবে উইন্ডিজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা শুরু করে। এর ২ বছর পর ১৯৩০ সাল থেকে নিউজিল্যান্ড আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা শুরু করে। ভারত ২৫ জুন ১৯৩২, পাকিস্তান ১৬ অক্টোবর ১৯৫২, শ্রীলঙ্কা ১৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৮২, জিম্বাবুয়ে ১৮ অক্টোবর ১৯৯২, বাংলাদেশ ১০ নভেম্বর ২০০০, আয়ারল্যান্ড ১১ মে ২০১৮, আফগানিস্তান ১৪ জুন ২০১৮ সালে টেস্ট ক্রিকেট খেলা শুরু করেন।
১৮৮৯ সালের দিকে প্রথমে ৪, তারপর ৫ ও পরে ১৯০০ সালে ৬ বলের ওভার শুরু হয়। তবে অনেক দেশেই ৮ বলে ওভারেও খেলা হতো। ১৯২২ সালে অজিরা ৮ বলে ওভার দিয়ে খেলা শুরু করে। এইটা দেখে নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকাও ৮ বলের ওভারে খেলা শুরু করে। এরমাঝে ২য় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অনেকদিন খেলা বন্ধ ছিলো। পরে ইংল্যান্ড খেলা শুরু করে ৬ বলের ওভার দিয়ে। এরপর ১৯৭৯-৮০ সালের দিকে সবাই ৬ বলের ওভার দিয়ে খেলতে থাকে। আর ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) ৬ বলের ওভারেই সিলমোহর দিয়ে দেয়।