চৌদ্দপাড়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী এক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছে। “ক্রেজি ক্রিকেট প্রিমিয়ার লীগ” নামক এই টুর্নামেন্টের এটি ১৪ তম আসর। “সাতঘর ইউনাইটেড” এবং “আলুদিয়া একাদশ” এর মধ্যকার ম্যাচটি দিয়ে টুর্নামেন্টের শুভ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে।
টুর্নামেন্ট ঘিরে গ্রামের সকলের যতো আগ্রহ এবং আনন্দ, মিশু এবং তার বন্ধুদের এর ঠিক ততোটাই মন খারাপ। তারা প্রত্যেকেই ক্লাস ৯ এ পড়ে। কারণটাও খুব ছোটখাটো নয় বৈকি। আতহার চাচা যে এবার থাকছেন না। না, আতহার চাচা কোনো খেলোয়াড় নন। তবে তিনিই এই টুর্নামেন্টের প্রাণ ছিলেন।
টুর্নামেন্ট শুরু পূর্বে গ্রামের চেয়ারম্যান ও তার বক্তৃতার মাঝে বলে উঠলেন “এবার আতহার ভাই অসুস্থতার জন্য আমাদের মাঝে থাকতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন। তাঁকে ছাড়ায় আমাদের সব শুরু করতে হচ্ছে।” তাঁর জায়গায় নতুন কেউ বসতে চায় কিনা জিজ্ঞাস করতেই মিশু হাত তুলে জানালো সে বসতে চায়।
মিশুর বন্ধুরা তো বটেই, এলাকার সবাই পর্যন্ত চমকে উঠলো। “মিশু ধারাভাষ্য দিতে পারবে?” সবার মনে তখন এই চিন্তা। তবে হাই স্কুলের হেডমাস্টার এগিয়ে এসে বললো “পারলে মিশুই পারবে। তাকে সুযোগ দিয়ে দেখুন। ঠকবেন না আশা করি।” সব শুনে চেয়ারম্যান সাহেব ও সায় দিলেন।
অতঃপর শুরু হলো টুর্নামেন্ট। চারিদিকে মিশুর নামডাক পড়ে গেলো খুব। তার বন্ধুরা প্রথম দিকে ভয় পেলেও এখন খুব ই গর্বিত মিশুকে নিয়ে। এর মাঝে একদিন দুপুরে ভাত খেতে বসে মিশুর চাচা বলে উঠলেন,
“কিরে মিশু তুই কি নাসের হুসেইন কে অনুকরণ করিস নাকি? মাইক হাতে পেলে তো মনে হয় পুরো নাসের হুসেইন হয়ে যাস।”
“নাসের হুসেইন কে চাচা? আমি তো শুধু আতহার চাচার মতো বলার চেষ্টা করি।”
“সে কি রে, তুই নাসের হুসেইন কে চিনিস না? মনে নেই ১৫’ এর বিশ্বকাপে বাংলাদেশ – ইংল্যান্ড ম্যাচের রুবেলের শেষ দুইটি বোল্ডের কথা? সে সময় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে যেই মানুষটি বলেছিলো,
“Goes for hero. Bowled him! Full & straight. The Bangladesh Tigers have knocked the England Lions out of the world cup! One of the greatest days in Bangladesh cricket history, one of the lowest points in English history”
তিনিই ছিলেন নাসের হুসেইন।
নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে আট হাজারের উপরে রান আছে তার। এছাড়া তিনি ১৯৯৯-২০০৩ বিশ্বকাপ পর্যন্ত ছিলেন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের অধিনায়ক। ২০০৪ সালের মে মাসে ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর পর “স্কাই স্পোর্টস”এ টেলিভিশন ধারাভাষ্যকার হিসেবে যোগদান করেন। সেসময় তার সহকর্মী হিসেবে উক্ত প্যানেলে ছিলেন বব উইলস, ডেভিড গাওয়ার, ইয়ান বোথাম এবং ডেভিড লয়েডের মতো ধারাভাষ্যকারেরা।
২০০৪ সালের তিনি নিজের আত্মজীবনী নিয়ে একটি বই বের করেন এবং বইটি ২০০৫ সালে সেরা ব্রিটিশ স্পোর্টস বই হিসেবে পুরস্কৃত হয়। এখনো তিনি বহু ক্রিকেট ম্যাচ এবং টুর্নামেন্টের পরিচিত মুখ।”
” চাচা তুমি আমাকে রাতে অন্য কোনো ধারাভাষ্যকার এর গল্প শুনিও। আমি তাদের কে চিনতে চাই।
” আচ্ছা বাবা শোনাবো তোকে। রাতে আমরা ইয়ান বিশপ এর গল্প শুনবো। তুই এখন একটু ঘুমিয়ে নে। সারাদিন দৌড়ঝাঁপ করিস। শরীরটা একটু বিশ্রাম ও তো চায় নাকি?”
সন্ধ্যায় বই নিয়ে পড়তে বসলেও মিশুর চোখজোড়া শুধু ঘড়ির কাটার দিকেই তাকিয়ে আছে। কখন ৮ টা বাজবে আর ছোটচাচা বাড়ি ফিরবে।
বলতে না বলতেই ছোটচাচা চলে এসেছেন। কিন্তু মিশুর মন আবার খারাপ হয়ে গেলো। কারণ চাচা বলেছেন যে রাতের খাওয়া শেষ হওয়ার পর গল্প। তার আগে কোনো গল্প শোনা চলবে না। কি আর করা, মিশু বই নিয়ে আবার নাড়াচাড়া শুরু করে।
–
” চাচা দ্রুত তোমার গল্প শুরু করো। আমি কখন থেকে অপেক্ষা করছি।”
” আহা শুরু করছি দাড়া। আচ্ছা শোন আজকে ইয়ান বিশপের গল্প বাদ দেই। তার গল্প পরে অন্য একদিন করবো। আজ আর একজন ইংলিশ অধিনায়ক টনি গ্রেগ এর গল্প শোন।
টনি গ্রেগ এর নাম বললেই সকলের চোখের সামনে ভেসে উঠে ১৯৯৮ সালে শারজাহ কাপের ফাইনাল আর শচীন টেন্ডুলকারের অজি বোলারদের ওপর অমানবিক অত্যাচার। ফ্লেমিং কে ডাউন দ্যা উইকেটে এসে শচীন বাউন্ডারির বাইরে আছড়ে ফেলতেই কমেন্ট্রিবক্স থেকে ভেসে এলো অমরত্ব লাভ করা বিখ্যাত সেই কথা,
“Oh! He has hit this one miles… Oh It’s a biggie, straight over the top… What a player! What a wonderful Player!”
ক্রিকেট ধারাভাষ্যকে রীতিমত শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া কিছু মানুষের ভেতর রয়েছেন দেশের হয়ে ২২টি ওয়ানডে এবং ৫৮ টি টেস্ট খেলা এই ইংলিশম্যান।
খেলোয়াড় জীবন থেকে অবসর নেয়ার পর ধারাভাষ্যকার হিসেবে নাম লেখান তিনি। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত “চ্যানেল নাইন” দিয়েই তার ধারাভাষ্য ক্যারিয়ার এর সূচনা হয়। ক্রিকেট বিশ্বের সব বড় বড় ইভেন্টের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন তিনি।
১৯৯৮ সালের মিনি বিশ্বকাপে ধারাভাষ্য দিতে বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। বুঝলি? তখন তো তোর জন্ম ও হয় নি।
ক্রিকেটার হিসেবে সফল না হতে পারলেও মাইক্রোফোন হাতে ছিলেন সফলতা এবং জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ২০১২ সালে মাত্র ৬৬ বছর বয়সে ফুসফুসের ক্যান্সারে হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
চাচা মাথা ঘুরিয়ে দেখে মিশু ঘুমিয়ে পড়েছে। চাচাও মিশুকে কোলের ভেতরে নিয়ে ঘুমিয়ে যায়।
–
মিশু বসে আছে তার বাড়ির পাশের পুকুরপাড়ে। তার পাশেই বসে আছে এলাকার পরিচিত এক বড় ভাই সুমন। তার সাথে মিশুর বেশ ভালো সখ্যতা। এদিকে সুমন অনেক বড় ক্রিকেট ভক্ত।
“সুমন ভাই তুমি কি আমাকে কোনো ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার এর গল্প শোনাবে?”
“তুই শুনতে চাইলে কেনো শোনাবো না। আচ্ছা মিশু তোর কি ‘১৬ সালের টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালের কথা মনে আছে?”
” হ্যা সুমন ভাই। কেনো কনে থাকবে না? সেই যে কার্লোস ব্র্যাথওয়েট টানা ৪ বলে ৪ টা ছক্কা মারলো বেন স্টোকস এর শেষ ওভারে। জানো সুমন ভাই বেন স্টোকস কান্না করছিলো দেখে আমার খুব খারাপ লাগছিলো।”
” ক্রিকেট খেলা এমন ই রে। আবার দেখ এই বেন স্টোকস ই কিন্তু ‘১৯ সালে কিভাবে দল কে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতিয়ে দিলো। তো যে কথা বলছিলাম। ওই ম্যাচের শেষ বলে ছক্কা মারার পর টিভি তে শুনেছিলি?
“Carlos brathwaite! Remember the name.”
এই মানুষটার নাম ইয়ান বিশপ। ছিলেন এক সময়ের টেস্টে দ্রুততম ১০০ উইকেট শিকারি বোলার। ইঞ্জুরির কারণে নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ার খুব বেশী লম্বা করতে পারেন নি এই ক্যারিবিয়ান পেসার।
তবে অদ্ভুত বিষয় হলো তিনি কখনোই একজন ধারাভাষ্যকার হতে চান নি। এই কথা তিনি প্রায়শই বলে থাকে। তার ভরাট কণ্ঠ এবং কাব্যিক কথোপকথন এবং বিস্তর ক্রিকেটজ্ঞান ই মূলত তাকে ধারাভাষ্যের জগৎে এক অন্য স্থান দিয়েছে।
অনেকের মতেই একজন ধারাভাষ্যকার এবং বিশ্লেষক হিসেবে তাঁকে যতোটা মূল্য দেয়া উচিৎ তা ক্রিকেট বিশ্ব তাকে দিতে পারে নি। তবে তাঁর কন্ঠ ঠিক ই অমরত্ব লাভ করেছে টেলিভিশন দর্শকদের মনে।
” শেষ বলে ছক্কা পেটানোর কথা তো বললি। তার আগের ৩ বলের ছক্কার সময় যে গলা ফাটালো। তার খবর ও একটু বল।” পেছন থেকে সুমনের বন্ধু শাওন বলে উঠলো।
” বাম্বলের গল্প বলতে বলছিস?”
” হ্যা, বেচারা কি দোষ করলো? তাকেও একটু সুযোগ দিবি না। আচ্ছা তার গল্প না হয় আমিই বলি। কিরে মিশু শুনবি তো?”
“শুনবো শাওন ভাই। তুমি বলো।”
” ক্রিকেট পাড়ায় ডাকনাম বাম্বল হলেও তার ভালো নাম ডেভিড লয়েড। তিনি একাধারে ক্রিকেটার কোচ এবং এরপর ধারাভাষ্যকার ও হয়েছেন। “ডাম্বল” শব্দের অর্থ হলো ঠেকে ঠেকে কথা বলা। তার এই নাম দিয়েছিলেন ডেভিড গ্রিন নামক এক সাবেক ল্যাঙ্কাশায়ার ক্রিকেটার।
শুদ্ধ ব্রিটিশ উচ্চারণভঙ্গি এবং দারুণ বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার মাধ্যমে নিজেকে অন্যতম সম্মানীয় একজন ধারাভাষ্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তাকে টি২০ ক্রিকেটের ভয়েস ও বলা হতো।
১৯৯৯ সাল থেকেই তিনি স্কাই স্পোর্টস এর হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তার ধারাভাষ্যের অন্যতম সেরা ব্যাপার হলো তিনি প্রায়শই “হাফ ম্যান হাফ বিস্কুট” নামক এক ব্রিটিশ ব্যান্ডের গানের লাইন নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করে থাকেন।”
–
পরদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মিশুর মনে হলো আতহার চাচার সাথে একটু দেখা করে যাওয়া উচিৎ। চাচার বাড়ি স্কুল মাঠের সাথেই। বাড়িতে ঢুকতেই মিশু দেখতে পেলো আতহার চাচা উঠোনে একটা ছোট টুলের ওপর বসে আছেন। মিশু গিয়ে আগে আতহার চাচাকে সালাম দিয়ে তার পাশের টুলে বসে পড়লো।
” মিশু তুই আমার মন ভালো করে দিয়েছিস বাবা। তুই যে আমার পাশে বসে বসে এতো সুন্দর ধারাভাষ্য দেয়া শিখে গেছিস বুঝতেই পারিনি। মাঠ খেলা যখন হয়, মাইকে তোর কথা শুনে কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। আমার আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। এখন থেকে তুই হবি আমার সহকারী ধারাভাষ্যকার।”
” চাচা আপনার কাছ থেকেই শেখা সব। আচ্ছা চাচা আপনার প্রিয় ধারাভাষ্যকার কে? নাসের হুসেইন নাক টনি গ্রেগ?”
” না, তারা কেউ না। আমার প্রিয় ধারাভাষ্যকার ছিলো রিচি বেনো। সবসময় তিনিই থাকবেন।”
“তার গল্প কি আমাকে বলবেন চাচা?”
“সময় আছে তোর? তাহলে শোন।
ডন ব্রাডম্যানের নাম শুনেছিস না? ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান বলা হয় যাকে। রিচি বেনো ছিলেন ধারাভাষ্যের জগৎের ব্রাডম্যান। তাকে ‘ ভয়েস অফ ক্রিকেট’ ও বলা হয়।
ক্রিকেট মাঠে তিনি ছিলেন বেশ সফল একজন ক্রিকেটার। ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে টেস্টে ২০০০ রান এবং ২০০ উইকেটের ডাবল নেয়ার গৌরব অর্জন করেন। ক্রিকেটকে তিনি অনেক দিয়েছেন।
তবে ধারাভাষ্যকার রিচি বেনোর পরিচয়ের কাছে এসব খুব ই নগণ্য। তার বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন ও বিশ্লেষণ করার সংমিশ্রণে একটি ম্যাড়মেড়ে ম্যাচেও যেন প্রাণ ফিরে পেতো। মাঠে দর্শক ফেরত আনার পেছনে তার অবদান প্রচুর।
১৯৬০ সালে বিবিসি রেডিও দিয়ে তার যাত্রা শুরু। আর টেলিভিশন ধারাভাষ্যকার হিসেবে ১৯৬৩ সাল থেকে মাইক্রোফোন হাতে তুলে নেন তিনি। অনেক চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি। কোথায় রিচি বেনো ছিলেন না তখন সেইটাই ছিলো বড় প্রশ্ন। তাকে না পেলে টিভি সম্প্রচার হবে না এমন অবস্থা ও তৈরি হয়েছিলো। ২০১৫ সালের দিকে সবার মুখের হাসি কেড়ে নিয়ে মারা যান এই কিংবদন্তি।
–
ক্রিকেট মাঠে হয়তো উইলোর টুকরো আর চর্মগোলক কথা বলে। তবে টেলিভিশন বা রেডিও সামনে বসে থাকা দর্শকদের কাছে ব্যাট বলের সেই ভাষাগুলো পৌছে দেয়ার দায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে তুলে নেন এই সমস্ত শব্দের জাদুকরেরা। মাইক্রোফোন হাতে ধারাভাষ্যকে যেন এক নিদারুণ শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তারা, ধারাভাষ্যের মান কে করেছেন উচ্চ থেকে উচ্চতর। আবার হয়তো এমন কিছু শব্দ জাদুকরদের গল্প নিয়ে হাজির হবো আপনাদের সামনে।