সেঞ্চুরি তো সবাই করতে পারে, কিন্তু সেঞ্চুরি’র সেঞ্চুরি কয়জন করতে পারে? শুধু তাই নয় নিজের সেঞ্চুরির রেকর্ডকে ডাবল সেঞ্চুরি বানাতে চেয়েছিলেন তিনি!
ক্রিকেট! শব্দটার মাঝেই যেন রেকর্ড রেকর্ড গন্ধ। রেকর্ড গড়ার জন্য-ই কি তবে তার জন্ম? নাকি আছে এর পেছনে লুকায়িত কোন ইতিহাস! অথবা অব্যক্ত কোন গল্প। প্রতিটি সুন্দরের পেছনে লুকায়িত থাকে এক অজানা রহস্য। দ্য রেকর্ড মাস্টারের জীবনেও হয়তো রয়েছে অজানা কোন গল্প।
“দরিদ্রতা” শব্দটা ছোট হলেও গভীরতা অনেক। যা হয়তো সকলের বোঝার সাধ্যের বাইরে। এই শব্দের গভীরতা একমাত্র তারাই বুঝবে যারা কিনা শব্দটাকে উপেক্ষা করে জীবনকে বদলে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। দারিদ্রতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো এক যোদ্ধার গল্প বলবো। নিজের বিকাশকে কেন্দ্র করে মাটিতে দাঁড়িয়ে ছুঁয়েছে আকাশ। স্বপ্ন কেবল চোখ বন্ধ করে নয়, কিছু স্বপ্ন দেখতে হয় চোখ খুলে। বাস্তবায়ন করার জন্য এই খোলা চোখের স্বপ্ন গুলোই পাশে আসে।
সাল ১৮৮২, ডিসেম্বর ১৬ দিনটি ছিল শনিবার। এটা কোন শনির দশা নয়, বরং আশীর্বাদ। কেমব্রিজের এক কাঠুরের পরিবারে তৃতীয় সদস্যের আগমন। তৃতীয় বলছি তার কারন, জনৈক কাঠুরে জন কুপার ও ফ্লোরা মাটিল্ডা বেরির ঘরে নতুন সদস্য হিসেবে আগমন ঘটে এক পুত্র সন্তানের। টোনাটুনির সংসারে প্রথম থেকেই ছিল দারিদ্রতার ছাপ। একে একে ১৪ সদস্যে পরিণত হলো পরিবার টি। ১২টি ভাই বোনের মাঝে জ্যেষ্ঠ ছিলেন জ্যাক হবস। দারিদ্র্যের ছাপ যেন এ পরিবারে কাটছিলই না। শৈশবকালের অধিকাংশ সময়ই হবস প্রায়-দারিদ্রতার সঙ্গে অতিবাহিত হয়।
শৈশবকাল থেকেই ক্রিকেটের সাথে জড়িত ছিলেন দরিদ্র পরিবারের এই সন্তান হবস। একটা সময় পর ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। আর এটাই যেন হয়ে ওঠে তার জীবনের এক অন্য তম সিদ্ধান্ত। হবসের বাবা জন কুপার ছিলেন একজন গ্রাউন্ডসম্যান। তিনি স্থানীয় ক্রিকেটে ক্লাবে আম্পায়ারিংও করতেন মাঝেমধ্যে। মাত্র ৯ বছর বয়সে, বাবার হাত ধরেই হবসের হাতেখড়ি হয় ক্রিকেটের। ছেলেবেলা থেকে খেলার প্রতি আগ্রহ টা যেন একটু বেশি ই ছিল। রাস্তার ধারে খোলা ময়দানে স্টাম্প আর পুরনো টেনিস বল দিয়েই খেলতেন তিনি। পরবর্তীতে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর সেন্ট ম্যাথুস চার্চ এবং ইয়র্ক স্ট্রিট বয়েজের হয়ে খেলতেন। ক্রিকেট এমন একটা খেলা যেখানে প্রতি নিয়ত প্রয়োজন অনুশীলনের। তবে হবসকে কেউ কোনদিন কোন কোচিং বা অনুশীলন করায় নি, যা কিছু শিখেছেন সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়।
হঠাৎ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান হবসের বাবা। দরিদ্র এই পরিবারটি যেন ছাদ থাকতেও ছাদ হারা হয়ে পরলেন। বাবা মারা যাওয়ায় পরিবারে নেমে আসে চরম আর্থিক সংকট। লেখাপড়া করা আর হয়ে উঠলো না। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে যোগ দেন কলেজ সার্ভেন্ট হিসেবে। কাঁধে তুলে নেন সংসারের দায়িত্ব। কেসাস কলেজে চাকরি নিয়েছিলেন, সেখানে তাঁর কাজও ছিল ক্রিকেট নিয়েই। মাঠ কর্মী হিসেবে নিযুক্ত হন। কলেজের ক্রিকেট দলের ফুট ফরমায়েশ খাটতেন, পাশাপাশি গ্রাউন্ডসম্যান ও নেট বোলারের ভূমিকাও পালন করতেন তিনি।
১৯০১ সালে হবস যোগ দেন কেমব্রিজের একটি আধা-পেশাদার ক্লাবে। হাতে নেন ব্যাট, লড়াই করেন বৃত্তাকার বলটির সাথে। প্রথম দিকে ব্যাটিং তেমন আশানুরূপ না হলেও পরবর্তীতে আকস্মিক উন্নতি ঘটে। ব্যাটে বলে যেন তার কপাল খুলে যায়। তার ব্যাট ঘোরানির কৌশল দেখার জন্য যেন স্থানীয় দলগুলোর দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ হয়।
সাল ১৯০৩, এপ্রিলের শুরু দিকে কাউন্টি দল সারের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তিবদ্ধ হলেও ফার্স্ট ক্লাস অভিষেকের জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় আরও দুই বছর। ১৯০৫ সালে প্রথম বারের মত সারের মূল একাদশে খেলার সুযোগ পান তিনি। স্থানীয় সারে দলের হয়ে তার অভিষেক হয়। অভিষেক ম্যাচের দুই ইনিংসে হবস করেছিলেন যথাক্রমে ১৮ ও ৮৮ রান। পরবর্তী ম্যাচে এসেক্সের বিপক্ষে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি (রান ১৫৫) করে বসেন। ভালো পারফর্ম করার সুবাদে এক বছরের মাথাতেই নাম লেখান পেশাদার ক্রিকেটারের খাতায়। পরবর্তী মৌসুমগুলোয় নিজেকে অন্যতম সফলতম কাউন্টি খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। কথিত আছে, হবসের খেলা কিছুক্ষণ দেখার পরই নাকি গ্রেস সাহেব ভবিষৎবাণী করেছিলেন, “এই ছেলে একদিন বড় কিছু হবে!”
অ্যাশেজ খেলতে ইংল্যান্ড সফরে আসা অস্ট্রেলিয়ান একাদশের বিরুদ্ধে করলেন ৯৪ রান! শুরু থেকে যে ছন্দের তালে তালে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সেটা বেশি দিন ধরে রাখতে পারেন নি তিনি। ক্যারিয়ারের প্রথম ফার্স্ট ক্লাস সিজনে হবসের সংগ্রহ ছিল ২৫.৮২ গড়ে ১৩১৭ রান, যেখানে সেঞ্চুরি মাত্র দুটি। পরবর্তী দুই মৌসুমে অবশ্য ব্যাট হাতে ছিলেন বেশ ধারাবাহিক। ১৯০৬ ও ১৯০৭ কাউন্টি সিজনে হবসের ব্যাটিং গড় ছিল যথাক্রমে ৪০.৭০ এবং ৩৭.৪৫।

সাল ১৯০৮ -ব্যাটিং উপযোগী পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও তুলনামূলক ভাবে তেমন কোন ফলন দিতে পারেন নি। তবুও ঐ মৌসুমের প্রথম-শ্রেণীর খেলা গুলো তে তিনি ৩৭.৩৩ গড়ে তুলে নেন ১,৯০৪ রান। যেখানে আনুমানিক ৬টি সেঞ্চুরি ছিল। পরবর্তীতে স্বীকৃতিস্বরূপ উইজডেন কর্তৃক অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটার মনোনীত হন তিনি। এ প্রেক্ষিতে উইজডেন মন্তব্য করে যে, “বর্তমান সময়ে টম হেওয়ার্ড ও জনি টিল্ডসলে ছাড়া ইংল্যান্ডে জ্যাক হবসের তুলনায় অন্য কোন ভালোমানের পেশাদার ব্যাটসম্যান নেই”
ব্যাট হাতে ধারাবাহিকতার পারফরম্যান্সের পুরস্কারটা তিনি পেয়েছিলেন হাতেনাতেই। ১৯০৭-০৮ অ্যাশেজের স্কোয়াড ঘোষণার সময় ডাকা হয়েছিল হবসের নামটাও। কিছু স্বপ্নের রূপ বাস্তব অব্দি গড়ায় না, ঠিক তেমনি হবসের স্বপ্ন গুলোও বাধাগ্রস্ত হয়ে থমকে রইলো। ভালো মন্দ, উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একটা সময় কর্মজীবন পড়ে হুমকির সম্মুখে। অ্যাপেনডিসাইটিসের কারণে তার স্বপ্নে আসে একরাস বাধা। ক্রিকেটীয় জীবনে তিনি ১৯০৯ ও ১৯২৬ সালে দুইবার বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে মনোনীত হন।
ডানহাতি মিডিয়াম পেস এই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যানকে বলা হতো “দ্য মাস্টার”! এক নজরে তার ক্যারিয়ার সংগ্রহঃ-
টেস্ট ক্রিকেটে ৬১ ম্যাচে ৫৬.৯৪ গড়ে সংগ্রহ করেন ৫৪১০ রান। সর্বোচ্চ ২১১ রান, শতক ১৫টি অর্ধশতক ২৮ টি।
ফাস্ট ক্লাস ক্রিকেটে ৮৩৪ ম্যাচে ৫০.৭০ গড়ে সংগ্রহ করেন ৬১৭৬০ রান। সর্বোচ্চ ৩১৬* রান, শতক ১৯৯টি অর্ধশতক ২৭৩টি।
জন্ম ও মৃত্যু যেন একই সুতায় বাধা। জন্ম মাসেই মারা যান তিনি। ১৯৬৩ সালের ২১শে ডিসেম্বর ৮১ বছর বয়সে তার জীবনের সমাপ্তি ঘটে।