১৩ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

এক জিমে’র মৃত্যুবাণ থেকে অন্য জিমে’র বেঁচে যাওয়ার গল্প

প্রতিবেদক
ডেস্ক নিউজ
সোমবার, ২৯ জুন , ২০২০ ৯:৫২

” কিরে মিশু তোর মন খারাপ কেনো? “

” না চাচা তেমন কিছু না। এমনিই বসে আছি এখানে। “

” তুই ঠিক দুইটা কারণে পুকুরপাড়ে এসে বসে থাকিস। যখন খুব খুশি হস, আর যখন তোর মন খারাপ থাকে।

তোর মুখ দেখে মন হচ্ছে না তুই এখন খুশি। তাহলে বল মন খারাপ কেনো?”

” পাশের গ্রামের ছেলেদের সাথে ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করেছিলাম আমরা। সেই খেলায় রাফি নামের এক ছেলে একাই আমাদের ৯ উইকেট নিয়ে গেছে।

এই পর্যন্ত ঠিক ছিলো, কিন্তু তার পরের ম্যাচে তো ১০ উইকেটের সবগুলোই সেই ছেলের নামে। আমরা যেন চেয়ে চেয়ে দেখলাম আর তাকে উইকেট দিয়ে চলে আসলাম। এই জন্য আমার মন খারাপ চাচা, তাই পুকুরপাড়ে এসে বসে আছি। “

” তোর মন ভালো করার একটা চেষ্টা অবশ্য আমি করতে পারি। গল্প শুনবি? “

” চাচা আমি জানি তুমি আমাকে কোন গল্প শোনাবে। “

” না, জানিস না তুই। তাও বল শুনি, কোন গল্পের কথা চিন্তা করেছিস তুই? “

” তুমি এখন আমাকে জিমের এক টেস্টে ১৯ উইকেট পাওয়ার গল্প শোনাবে। কারণ রাফির ১৯ উইকেট পাওয়ার সাথে এই ঘটনার মিল আছে। “

” মিশু, তুই অনেক চালাক হয়ে গেছিস দেখছি। হ্যা ঠিক ধরেছিস আমি তোকে জিমের গল্প ই শোনাবো। তবে সেই গল্প জিম লেকারের না, গল্পটা অন্য এক ‘জিম’ এর।

তারিখটা ২৬ জুলাই, ১৯৫৬। অস্ট্রেলিয়া দল তখন ইংল্যান্ড সফরের চতুর্থ টেস্ট খেলতে মাঠে নেমে পড়েছে। প্রথম দিনেই পিটার রিচার্ডসনের সেঞ্চুরি এবং ডেভিড শেপার্ডের অপরাজিত ৫৯ রানের কল্যাণে ৩০৭ রানের বিশাল এক পাহাড় দাড়া করায়।

ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে শেপার্ড ও সেঞ্চুরি করে ফেলেন এবং ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসের সমাপ্তি হয় ৪৫৯ রানে যেয়ে।

ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে উদ্বোধনী জুটিতে ৪৮ রান তুলতেই প্রথম উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া। ওই ৪৮ রানেই দ্বিতীয় উইকেটের ও পতন হয়। বোলারের নাম ‘জিম লেকার’।

ইতিহাস ঘটে তৃতীয় উইকেটের বেলায় যেয়ে। উইকেট টি নেয় ‘টনি লক’। যদিও তখন কেউ জানতো না যে লক সাহেব ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছেন। তৃতীয় উইকেট টি না পাওয়ার ক্ষোভেই কিনা কে জানে, ৬২ রানে ৩ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়া দলকে মাত্র ৮৪ রানে ধসিয়ে দেয় লেকার একাই। ফলো অনে পড়ে একই দিনে দুইবার ব্যাটে নামে অস্ট্রেলিয়া। এবং এরপরের ইতিহাস তো সবাই জানে। সিডনি বার্নস এর ম্যাচে ১৭ উইকেটের রেকর্ড ভেঙে জিম লেকার নিজের ঝুলিতে ভরেন ১৯টি উইকেট।

কিন্তু যেই ব্যাপারটি অনেকেই জানেন না বা সেভাবে খেয়াল করেন না তা হলো, প্রথম ইনিংসে জিম লেকারের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যাটসম্যানের নাম ও কিন্তু জিম! ব্যাপারটি নিতান্তই কাকতালীয়। তার নাম জিম বার্ক

১৯৩০ সালের ১২ জুন নিউ সাউথ ওয়েলস এর মোসম্যান এলাকায় জন্ম হয় জিম বার্কের। তার বড় মামা পার্সি বার্ক ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার রাজ্য দল কেন্টে’র উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। তার মা ছিলেন অসাধারণ একজন গল্ফার।

ছোট থেকেই ক্রিকেট এবং গল্ফ খুব ভালো খেলতেন বার্ক। বয়স কম থাকায় ১২ বছর বয়সে বালগোলা গল্ফ ক্লাব থেকে সদস্যপদ দেয়া হয় না তাকে। এদিকে ৭ বছর বয়স থেকেই ম্যানলি ওভালে ক্রিকেটের প্রশিক্ষণ নিতেন তিনি।

১৪ বছর বয়সে অধ্যয়নরত সিডনি গ্রামার স্কুলের একাদশে খেলার সুযোগ পান তিনি। ১৫ বছর বয়সে ম্যানলি ওভালের তৃতীয় একাদশ থেকে পদোন্নতি হয়ে প্রথম একাদশে সুযোগ পান তিনি। এবং ১৬ বছর বয়সে সিডনি গ্রামারে থাকাকালীন তার ব্যাটিং গড় ছিলো ৯৪!

১৯৪৮-৪৯ ক্রিকেট মৌসুমে নিউ সাউথ ওয়েলস কোল্টের সদস্য হিসেবে কুইন্সল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩৪ রান এবং বোলিংয়ে ৮ রানে ২ উইকেট নিয়ে উপরমহলের নজরের আসেন তিনি। এবং এই কারণে মাত্র আঠারো বছর বয়সেই অনেক আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় কে টপকে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে শেফিল্ড শিল্ড খেলার আমন্ত্রণ পেয়ে যান বার্ক।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে শুরুতে নিজেকে সেভাবে প্রমাণ করতে না পারলেও ১৯৫০-৫১ মৌসুমে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যাশেজের চতুর্থ টেস্টে তার টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়।

অভিষেক ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১২ রানে আউট হয়ে গেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে অপরাজিত ১০১ রানের ইনিংস খেলে নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদান দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পরবর্তী টেস্টে ওপেনিংয়ে ব্যাট করতে নেমে দুই ইনিংস মিলে তার সংগ্রহ মাত্র ১২ রান।

এরপর দুই মৌসুমে জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েন তিনি। তখন তার এতো বাজে সময় যাচ্ছিলো যে রাজ্যদলেও তাকে অনেক ম্যাচে একাদশের বাইরে রাখা হয়।

১৯৫৪ সালে তিনি ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ার লীগে টডমর্ডেন এর হয়ে খেলতে যান। লীগে ২৩ ম্যাচে মাত্র ৫ টি অর্ধশত রানের ইনিংস ছিলো তার। এর ভেতর এক ম্যাচে অপরাজিত ৯৭ এবং ১৪ রানে ৮ উইকেট তুলে নেয়ার মাধ্যমে দলের জয়ে বড় ভূমিকা রাখেন।

১৯৫৪-৫৫ মৌসুমে ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে রাজ্য দলের হয়ে খেলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনা বার্ক। ফল প্রথম টেস্টে তার জায়গা হয় না।
কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে কিথ মিলারের আঘাতজনিত কারণে তার জায়গায় সুযোগ পায় বার্ক। সে খেলায় যথাক্রমে ৪৪ ও ১৪ রান তুলেন তিনি। পরের টেস্টে আবার বাদ পড়েন।

দলে আসা যাওয়া বার্কের জন্য একদম স্বাভাবিক একটা ব্যাপার হয়ে যায়। ১৯৫৫ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সময়কালে বার্ককে পঞ্চমবারের মতো দল থেকে বাদ দেয়া হয়।

এরপর থেকেই তিনি সম্পূর্ণ ঝুঁকিহীন রক্ষণাত্মক খেলা খেলতে শুরু করেন। এরফলে অনেকসময় দর্শকদের দুয়ো শুনতে হয় তাকে। কিন্তু তার এই ধৈর্যের ফল তিনি পেতে শুরু করেন। ১৯৫৫-৫৬ মৌসুমের তৃতীয় ম্যাচের প্রথম ইনিংস ১৮৯ রানের একটি ইনিংস খেলেন। তখন ডন ব্রাডম্যান তাকে হাতের শট বাড়ানোর পরামর্শ দেন। এবং ব্রাডম্যানের কথা রাখতেই কিনা, বার্ক দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫০ রানের একটি ইনিংস খেলে দলকে ইনিংস ব্যাবধানে জয়লাভে সাহায্য করেন।

১৯৫৬ মৌসুমে ইংল্যান্ড সফরের জন্য দলে সুযোগ পান বার্ক। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। উদ্যোম গতিতে তিনি এগিয়ে যান।

১৯৫৬-৫৭ মৌসুমে উপমহাদেশ সফর খুব একটা ভালো যায় না তার। ওই মৌসুমে আর কোনো টেস্ট না থাকলেও শেফিল শিল্ডে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দ্বি-শতক তুলে নেন তিনি। শেফিল শিল্ডের
প্রথম টাই হওয়া ম্যাচের সাথেও তার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবং ওই মৌসুমে তার দারুণ ব্যাটিং প্রদর্শনীর মাধ্যমে নিউ সাউথ ওয়েলস এর চতুর্থ শিরোপা জয়ে বড় ভূমিকা রাখেন বার্ক।

পরের মৌসুমে জাতীয় দলের হয়ে দঃআফ্রিকা সফরে অজিদের ভেতর তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ৬৫.০৬ গড়ে ১,০৪১ রান তুলেন এবং একমাত্র অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে সহস্রাধিক রান তুলতে সক্ষম হন তিনি।

১৯৫৮-৫৯ মৌসুমে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে অংশ নেন তিনি। ওই ম্যাচে ইংলিশ ব্যাটসম্যান ট্রেভর বেইলি প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে ধীরগতির অর্ধশতক তুলে নেন ৩৫৭ মিনিট ব্যায় করে। ম্যাচের শেষ দিনে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের জন্য ১৪৭ রান প্রয়োজন হলে বেইলি’র দেখানো পথ অবলম্বন করে বার্ক ২৫০ মিনিট ব্যায় করে ২৮ রানে অপরাজিত থাকেন এবং ঠিক ই দল কে ৮ উইকেটের জয় এনে দেন।

এই সিরিজ শেষে তিনি হুট করেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। কারণ হিসেবে ছিলো ধীরগতির ব্যাটিংয়ে সমালোচনা এবং পেস বোলিংয়ে শর্ট পিচ ডেলিভারি তে ভয়। ১৯৫৯ সালে আন্তর্জাতিক টেস্ট থেকে অবসর নেয় জিম বার্ক।

যদিও এরপর আরো দুই মৌসুম শেফিল্ড শিল্ড এবং আরো তেরো মৌসুম গ্রেড ক্রিকেট খেলেন তিনি।

★১৯৫৭ সালে অসাধারণ ক্রীড়া প্রদর্শনীর জন্য উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন তিনি।

★আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪৪ ইনিংস ব্যাটিং করেও কখনো শুন্য রানে আউট না হওয়ার রেকর্ড আছে তার।

★ তিনি মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের আজীবন সম্মানিত সদস্য ছিলেন।

১৯৭৯ সালে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে নিজের কেনা শটগান দিয়ে আত্মহত্যা করেন জিম বার্ক।

” আচ্ছা মিশু প্রথম ম্যাচে রাফির হাত থেকে বেচে যাওয়া ব্যাটসম্যানের নাম কি রে? “

মিশু কিছুক্ষণ বিস্ফোরিত চোখে তার চাচার দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলো
রাফি!

, , , , ,

মতামত জানান :