১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বের ম্যাচে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি ভারত ও শ্রীলঙ্কা। টসে হেরে ব্যাটিং করতে নেমে শচীন টেন্ডুলকারের ১৩৭ রানের উপর ভর করে ভারত যখন ২৭১ রানের সংগ্রহ দাঁড় করলো, ভারতের জয়টা তখন সময়ের অপেক্ষাই মনে হচ্ছিলো। কারণ সেই সময় ২৫০ রান টপকানো একপ্রকার দুঃসাধ্যই বলা যায়। কিন্তু নাটকের মূল অংশ তখনো বাকি রয়ে গিয়েছিলো। এই বিশাল স্কোর তাড়া করতে নেমে শুরুতেই ভারতীয় বোলারদের উপর তাণ্ডবলীলা চালাতে শুরু করলেন সনাথ জয়াসুরিয়া । তার বেধড়ক পিটুনির কারণে মাত্র ৩ ওভারেই ৪২ রান তুলে ফেলে শ্রীলঙ্কা! প্রথম ৩ ওভারে ৪২ রান সেই যুগ তো বটেই এই যুগেও বলা চলে অকল্পনীয়। জয়াসুরিয়া সেদিন এমন আক্রমণত্বক ব্যাটিং করছিল যে তাকে থামানো অসম্ভব মনে হচ্ছিল। এক সময় দেখা গেল যে ভারতীয় অলরাউন্ডার মনোজ প্রভাকর স্পিন বাদ দিয়ে মিডিয়াম পেস করা শুরু করল। ব্যক্তিগত ৭৯ রানে যখন জয়াসুরিয়া ফিরে যান তখন ২০ ওভার শেষে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ১৩৭/৩! জয়াসুরিয়ার এই দাপুটে ইনিংসের কল্যাণে ৬ উইকেটে ম্যাচটি জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা। জয়াসুরিয়ার ঐ একটা ইনিংস পুরো লঙ্কান দলের আত্মবিশ্বাসকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। এর ফলাফল হিসেবে বিশ্বকাপ জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা।
—
শ্রীলংকার দক্ষিণাঞ্চলের মাতারা শহরে জন্মগ্রহণ করেন সনাথ জয়াসুরিয়া । বাল্যকাল থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তার প্রবল নেশা ছিল। তার ভাই চন্দানা জয়াসুরিয়া তাকে সব সময় অনুপ্রাণিত করত। ১৯৮৮ সালে আন্তঃকলেজ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে জয়াসুরিয়া তার কলেজকে নেতৃত্ব দেন। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে চমৎকার খেলা উপহার দেন জয়াসুরিয়া। ফলাফল হিসেবে নির্বাচিত হন টুর্নামেন্টের সেরা ব্যাটসম্যান ও অলরাউন্ডার হিসেবে। তার অসাধারণ নৈপুণ্যের কারণে তিনি শ্রীলংকা অনূর্ধ্ব ১৯ দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হয়। একই বছর তার নেতৃত্বে শ্রীলংকা অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে অংশগ্রহন করে। বিশ্বকাপে ভালো পারফরম্যান্স এর পাশাপাশি ঘরোয়া লীগেও ধারাবাহিক পারফরম্যান্স এর ফলস্বরূপ পরের বছর শ্রীলংকা বি টিমের সদস্য হিসেবে পাকিস্তান সফর করে। এই সফরে টানা দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করেন জয়াসুরিয়া। তার এই অনবদ্য ফর্ম নির্বাচকদের মনযোগ আর্কষণ করতে সক্ষম হয়।
—
২৬ শে ডিসেম্বর ১৯৮৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বক্সিং ডে ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনালে শ্রীলঙ্কার হয়ে তার অভিষেক হয়।কিন্তু অভিষেকটা একদমই সুবিধার হয়নি, ম্যাচে এক ওভার বোলিং করার সুযোগও পাননি। আর ব্যাট হাতে পাঁচ নম্বরে নেমে মাত্র ৩ রানেই সাজঘরে ফিরে যান। ১৯৯১ সালের ১লা ডিসেম্বর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তার অভিষেক হয় টেস্টে। শ্রীলঙ্কা সেই টেস্ট ড্র করে।
—
শুরুর দিকে জয়াসুরিয়া মূলত একজন বোলার ও মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে দলে সুযোগ পেত। তার কাজ ছিল শেষের দিকে দ্রুত রান তোলা আর বোলার হিসেবে পঞ্চম বোলারের দায়িত্ব পালন করা। হিসেবে জয়াসুরিয়ার অবদান বেশ ভালোই ছিল। বলতে গেলে তখন ব্যাটিংয়ের চেয়ে বোলিংয়েই বেশী সফল ছিলেন তিনি। আর শেষের দিকে দ্রুত রান তোলার সামথ্যের জন্য সীমিত ওভারের ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কা দলে নিয়মিত সদস্যে পরিণত হন তিনি। ব্যাটিংয়ে কাট শট আর পুল শটে ছিলেন দারুন দক্ষ। এছাড়াও আরেকটি শট ‘লফটেড কাট ‘ এ তিনি ছিলেন এক কথায় অসাধারণ। এই শট খেলতে গিয়ে তিনি প্রায়শই বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ হয়ে আউট হয়ে যান। শ্রীলঙ্কা দলের ম্যানেজম্যান্ট গবেষনা করে দেখল যে এই শট শেষের দিকে তেমন কার্যকর না হলেও পাওয়াপ্লেতে ভীষণ কার্যকর হতে পারে। আর ফিল্ড রেস্ট্রিকশন এর সময়ে বেশী খেললে রানও আসবে অনেক। এই কারনেই ১৯৯৪ সাল থেকে জয়াসুরিয়াকে মিডল অর্ডারের পরিবর্তে ওপেনিং এ খেলানো হয়। এর ফলও পাওয়া যায় হাতে নাতে। শুরু থেকে ব্যাটিংয়ে অধারাবাহিক সনাথ ব্যাটিংয়ে ধারাবাহিক হতে থাকেন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে ডিসেম্বর মাসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ১৪৩ বলে ১৪০ রানের ইনিংস। এটিই ছিল তার প্রথম কোন আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি। যদিও ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এর পরের বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেন টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। এরপরেই যেন তার ব্যাটিংয়ে শুরু হয় হাহাকার! ১৯৯৬ বিশ্বকাপ শুরুর আগে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে তার ফর্ম চূড়ান্ত পর্যায়ের খারাপ হয়ে যায়। দশ ম্যাচে কোন ফিফটি করেননি, সর্বোচ্চ ৩০ রানের ইনিংস।
—
বিশ্বকাপের আগের সিরিজে এমন বাজে ফর্ম সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের বিশ্বকাপ পরিকল্পনার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে জয়াসুরিয়াকে রাখা হলো! আসলে শ্রীলঙ্কার টিম ম্যানেজমেন্ট পিঞ্চ হিটার তত্ত্ব ব্যবহার করে সেই বিশ্বকাপে বড় কিছু করার পরিকল্পনা করছিলো। প্রথম ১৫ ওভারে ত্রিশ গজের বাইরের বৃত্তে মাত্র দুজন খেলোয়াড় থাকলেও সেই যুগে প্রথম দশ ওভারে কোনো দলই সেভাবে মেরে খেলত না। কারণ তখন বৃত্তের বাইরে কম খেলোয়াড় থাকার সুবিধা নেওয়ার চেয়ে নতুন বলে টিকে থাকাটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হতো। শুরুর দিকে এই ফিল্ডিং রেস্ট্রিকশন কাজে লাগানোর জন্য লঙ্কান টিম ম্যানেজমেন্ট সনাথ জয়াসুরিয়া ও রমেশ কালুভিথারানাকে ওপেনার হিসেবে বিশ্বকাপে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেয়।আর তাতেই বাজিমাত হয়ে যায়। মূলত ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড দল পিন্চ হিটিং এর জন্ম দিলেও এর সফল ব্যবহার করেন শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার কালুভিতারানা ও জয়াসুরিয়া। সেই আসরে জয়াসুরিয়া একটু বেশিই ভয়ঙ্কর ছিলেন। বিশেষ করে ভারতের বিপক্ষে উপরে উল্লিখিত ৭৯ রানের ইনিংসটি শ্রীলঙ্কা দলের মনোবল অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। জয়াসুরিয়ার এই ব্যাটিং তান্ডব দেখে তাকে অনেকেই মাতারা হারিকেন বলে ডাকা শুরু করে। গ্রুপের বাকি দুই দল অস্ট্রেলিয়া ও উইন্ডিজ শ্রীলঙ্কাকে ওয়াকওভার দেওয়ায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তীর্ণ হয় শ্রীলঙ্কা, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড।
—
ফয়াসালাবাদে আগে ব্যাট করতে নেমে ৮ উইকেটে ২৩৫ রান সংগ্রহ করে ইংল্যান্ড। ২৩৬ রানের টার্গেটে শ্রীলঙ্কা ব্যাট করতে নামলে, ৪৪ বলে ৮২ রানের এক ঝড়ো ইনিংসে ইংলিশ বোলিং লাইনআপকে গুঁড়িয়ে দেন জয়াসুরিয়া। তার এই অসাধারণ ইনিংসে ভর করে ৯ ওভার হাতে রেখেই ৬ উইকেটের জয় তুলে নেয় শ্রীলঙ্কা। ব্যাট হাতে ৮২ রানের এক টর্নেডো ইনিংসের সাথে বল হাতে ২ উইকেট নেওয়ায় ম্যাচসেরার পুরস্কারটা জয়াসুরিয়ার হাতেই উঠে।
—
সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ১ রানে আউট হন তিনি। শ্রীলঙ্কার ২৫১ রানের জবাবে ভারত ব্যাটিং করতে নামলে সেই বিশ্বকাপের আরেক আবিষ্কার শচীন টেন্ডুলকারের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে সেই রান মামুলি মনে হচ্ছিল। কিন্তু জয়াসুরিয়া বল হাতে শচীনকে আউট করলে ম্যাচ শ্রীলঙ্কার টেবিলে ঘুরে যায়। তারপর ১২০ রানে ৮ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ইডেনে ভারতীয় দর্শকরা মারমুখী হতে শুরু করেন। ম্যাচ সেখানে সমাপ্ত হয় এবং শ্রীলঙ্কা ফাইনালে চলে যায়। ১২ রানে ৩ উইকেট নিয়ে সেই ম্যাচ জয়ে অপরীসিম ভূমিকা রাখেন তিনি।
—
ফাইনালে বোলিং, ব্যাটিং দুই বিভাগেই তেমন সুবিধা করতে পারেননি জয়াসুরিয়া। বল হাতে ৮ ওভারে ৪১ রানে নেন ১ উইকেট। ব্যাটিংয়ে নেমে ৭ বলে ৯ রান করে দুর্ভাগ্যজনকভাবে রান আউটের শিকার হন তিনি। জয়াসুরিয়া জ্বলে না উঠলেও অরবিন্দ ডি সিলভার অনবদ্য এক সেঞ্চুরিতে অস্ট্রেলিয়াকে ৭ উইকেটে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় শ্রীলঙ্কা। লঙ্কানদের এ সাফল্যে জয়াসুরিয়ার অলরাউন্ড নৈপুন্য অবশ্যই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। ব্যাট হাতে ৬ ম্যাচে ১৩১.৫৫ স্ট্রাইক রেটে ২২১ রানের সাথে বল হাতে ৬ ম্যাচে জয়াসুরিয়া নিয়েছিলেন ৭ উইকেট। এই পারফর্মেন্স এর কারণে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে সনাথ জয়াসুরিয়াকে নির্বাচিত করা হয়।
—
সমালোচকরা শ্রীলঙ্কার এই বিশ্বকাপ জয়কে ফ্লুক হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু সমালোচকদের তুড়ি মেরে শ্রীলঙ্কা করতে থাকেন একের পর এক দারুণ পারফর্মেন্স। আর সেই শ্রীলঙ্কা দলের মূল পারফর্মার ছিলেন সনাথ জয়াসুরিয়া। পাকিস্তানের বিপক্ষে করেন ১৭ বলে ফিফটি। যা ছিল সেইসময়ের দ্রুততম ফিফটি এবং এই রেকর্ড ১৯ বছর পর্যন্ত অক্ষত ছিল। সেই বছর তিনি ভারত এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করেন।

—
১৯৯৭ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে করেন ৩৪০ রান। সেই ইনিংসে শ্রীলঙ্কা করে ৬ উইকেটে ৯৫২ রান, যা এখন পর্যন্ত টেস্টে যে কোন দলের জন্য এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান। রোশান মহানামার সাথে মিলে সেই টেস্টে ৫৭৬ রানের পাটনারশিপ করেন জয়াসুরিয়া। সেই সিরিজে ভারতের বিপক্ষে পরের ম্যাচে আবারও খেলেন ১৯৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস।
—
১৯৯৮ সালে ইংল্যান্ড সফরে ইংলিশ বোলারদের তুলোধুনো করে করেন ডাবল সেঞ্চুরি। যার ফলে ইংল্যান্ডের মাটিতে শ্রীলঙ্কা ১০ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে জয়ী হন। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের পর থেকে ধারাবাহিক সাফল্যের ফলে সবাই ধারনা করে হয়ত শ্রীলঙ্কা এবারও দারুন কিছু করবে। কিন্তু গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে যায় শ্রীলঙ্কা। জয়াসুরিয়াও সেই বিশ্বকাপে তেমন কিছু করতে পারেননি। তারপরও বিশ্বকাপের পরে তাকে শ্রীলঙ্কা দলের অধিনায়ক ঘোষণা করা হয় এবং মাহেলা জয়াবর্ধনেকে তার ডেপুটি।
—
অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর ২০০০ সালে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে গল টেস্টে করেন ১৫৬ বলে ১৪৮। তার অসাধারণ ইনিংসের ফলে শ্রীলঙ্কা ম্যাচটি ইনিংস ও ১৫ রানের ব্যবধানে জিতে নেন। এছাড়া পাকিস্তানের বিপক্ষে গল টেস্টে মারভান আতাপাত্তুকে নিয়ে ওপেনিংয়ে ৩৩৫ রানের পাটনারশিপ করেন। তারপর কোকাকোলা কাপের ফাইনালে শারজায় ভারতের বিপক্ষে করেন ১৮৯ রান। অনেকে ধারণা করেছিল যে ঐ ইনিংসটাই হয়ত ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি হবে, কিন্তু ১৮৯ রানের মাথায় তিনি আউট হয়ে যান। ইনিংসটা আজও পর্যন্ত ওয়ানডেতে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস হয়ে আছে। ২০০২ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা ফাইনালে যায় জয়াসুরিয়ার নেতৃত্বে। ফাইনাল বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয় এবং ভারত ও শ্রীলঙ্কা উভয় দলকে বিজয়ী ঘোষনা করা হয়। ১৯৯৬ সালের পর আবারও কোন আইসিসির টুর্নামেন্ট জিতে শ্রীলঙ্কা।
—
২০০৩ সালের ভিবি সিরিজে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন জয়াসুরিয়া। বিশ্বকাপেও এই ভালো ফর্ম ধরে রাখেন তিনি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দলের প্রথম ম্যাচে ১২৫ বলে ১২০ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলেন। জয়াসুরিয়ার নেতৃত্বে সেবার বেশ ভালো শুরু করলেও অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে সেমিফাইনালে বিদায় নেয় লঙ্কানরা। বিশ্বকাপের ঠিক পরেই শারজাহ কাপে জিম্বাবুয়ের কাছে অপ্রত্যাশিত এক হারে সেই টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। সেই হারের পরেই অধিনায়কের পদ থেকে সরে যান জয়াসুরিয়া। একজন অধিনায়ক হিসেবে জয়াসুরিয়া ছিলেন বেশ সফল। মোট ৩৮ টি টেস্টে নেতৃত্ব দেন তিনি। যেখানে ১৮ টি জয়ের বিপরীতে ছিল ১২ টি হার। আর ড্র করেছেন ৮ টি ম্যাচ। আর ১১৭ ম্যাচে ৬৫ ম্যাচ জিতেন, হারেন ৪৭ টি ম্যাচ। ৩ টি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয় এবং টাই হয় ২ টি ম্যাচ।
—
অধিনায়কত্ব থেকে বাদ পড়লেও তার কোন প্রভাব জয়াসুরিয়ার পারফর্মেন্সে পরে নি। ২০০৪ সালের এশিয়া কাপে তার দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের ফলে শ্রীলঙ্কা জিতে যায় টুর্নামেন্টটি। ৭৩.২৫ গড়ে সেই টুর্নামেন্টে জয়াসুরিয়া করেন ২৯৩ রান। একই বছর ফয়সালাবাদে পাকিস্তানের বিপক্ষে করেন টেস্টে তার তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি। ২য় ইনিংসে ২৫৩ রান করে দলকে বিশাল জয় এনে দিতে ভূমিকা রাখেন, পাশাপাশি হন ম্যাচসেরা। এর পর ২০০৫ সালে টেস্ট ওয়ানডে কোন ফ্যরমেটেই সুবিধা করতে পারেননি তিনি।
*২০০৫ সালে ১৩ ওয়ানডেতে করেন ৩২৩ রান আর ৬ টেস্টে ১০ ইনিংস খেলে করেন ১৯২ রান। ছিল না কোন সেঞ্চুরি। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের পর ক্যারিয়ারে এত খারাপ সময় যায় নি তার।

২০০৬ সালে আবারও ফিরে আসেন সমহিমায়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাঠে তাদেরকে ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করতে অগ্রনী ভূমিকা রাখেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে তার ১২২ রানের উপর ভর করে বড় সংগ্রহ গড়ে শ্রীলঙ্কা এবং ম্যাচটি জিতে যায়। তারপর পঞ্চম ও শেষ ম্যাচে ইংল্যান্ড দল শ্রীলঙ্কাকে ৩২১ রানের টার্গেট দেয়। সেই টার্গেট তাড়া করতে নেমে উপুল থারাঙ্গাকে সাথে নিয়ে মাত্র ৩১.৫ বলে ২৮৬ রান করেন। শেষ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা ৩ উইকেট হারিয়ে ৩৮ ওভারে ৩২২ রান করে এবং ৭ উইকেটের ব্যবধানে জয় পায়। সেই ম্যাচে জয়াসুরিয়া ৯৯ বলে ১৫২ রান করেন। এর তিনদিন পরে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে খেলেন আরও একটি দেড় শতাধিক রানের ইনিংস। তার এ ইনিংসের উপর ভর করেই শ্রীলঙ্কা করে ৯ উইকেটে ৪৪৩ রান। যা প্রায় ১০ বছর ধরে ছিল ওয়ানডে ইতিহাসে এক ইনিংসে দলীয় সর্বোচ্চ রান।
—
২০০৭ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কাকে ফাইনালে নিয়ে যেতে জয়াসুরিয়া ভাল পারফর্ম করেন। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৬৩ রানের ইনিংস খেললেও অস্ট্রেলিয়ার উইকেটকিপার এডাম গিলক্রিস্টের অতি মানবীয় ১৪৯ রানের কাছে শ্রীলঙ্কা দল হেরে যায়। ফলে তাদের রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এরপর সেবছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেন তিনি। সেই বিশ্বকাপে তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার ছিলেন যার অভিষেক হয় ৮০ র দশকে। এত কিছুর পরও সেই টুর্নামেন্টে দুটি ফিফটি করেন তিনি। যদিও তার দল সুপার এইট থেকে বাদ পড়ে যায়। গ্রুপ পর্বের ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কা দল করে ২৬৩ রান। যা ছিল সেই সময়কার আন্তজার্তিক টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান। তিন ফরমটেই সেইসময়কার সর্বোচ্চ দলীয় স্কোরের সময় তিনি ব্যাটিং করেছেন। যা একটি বিরল কীর্তি। সেই বছর ডিসেম্বর মাসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গল টেস্ট খেলে, টেস্ট থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নেন। শেষ ম্যাচেও তার স্বভাবসুলভ ব্যাটিংয়ে করেন ১০৬ বলে ৭৮ রান। একজন মারকুটে ব্যাটসম্যান হয়েও ১১০ টেস্ট খেলে তিনি করেন ৬৯৭৩ রান।
—
টেস্ট থেকে অবসর নিলেও সীমিত ওভারের খেলায় আগের মত পারফরম্যান্স করে যান। ২০০৮ সালের এশিয়া কাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে করেন ১১৪ বলে ১২৫ রান। ফাইনালে ভারতের বিপক্ষেও ভালো করেন তিনি। যার ফলে টানা দুইবারের মত এশিয়া কাপ জিতে শ্রীলঙ্কা। ২০০৯ সালে ডাম্বুলায় ভারতের বিপক্ষে করেন সেঞ্চুরি। ৪০ বছর বয়সে সেঞ্চুরি করে হয়ে যান ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাটসম্যান। তারপর ২০০৯ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তার এবং দিলশানের ভাল ব্যাটিংয়ের কারণেই ফাইনালে উঠে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু ফাইনালে দিলশান এবং তিনি কেউই ভালো না করলে পাকিস্তান শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নেয় পাকিস্তান।
—
এই টুর্নামেন্ট থেকেই শুরু হয়ে যায় তার শেষের শুরু। এরপর আর নিয়মিত ভাবে ধারাবাহিক সাফল্য পাননি তিনি। একসময় ওপেনিংয়ে নেমে টানা ব্যর্থতার ফলে তাকে আবার মিডল অর্ডারে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তার পরও রান খরা কাটেনি। অনেকে তাকে অবসরের পরামর্শ দিলেও তিনি চেয়েছেন ২০১১ বিশ্বকাপ খেলার পর অবসর নিতে। কিন্তু ২০১১ বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাননি তিনি। তাই শ্রীলঙ্কার ফাইনাল খেলা তাকে দেখতে হয়েছে মাঠের বাইরে থেকেই।
—
তারপর ২০১১ বিশ্বকাপের পরে তাকে শ্রীলঙ্কা দলের নির্বাচক হওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি জুনে ইংল্যান্ডের সাথে তার ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজটি খেলেন। ২৫ জুন শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে করেন ৮ রান আর ২৮ জুন শেষ ওয়ানডে ম্যাচে করেন মাত্র ২ রান। শেষটা ঠিকমত রাঙ্গাতে না পারলেও ২২ বছরের এক রঙ্গিন ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি। শ্রীলঙ্কা দলে তিনি যখন ডাক পান তখন শ্রীলঙ্কা ছিল এক নতুন দল। আর অবসরের সময় শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে দেখে যান।
টেস্টে তিনি ১১০ ম্যাচে ১৮৮ টি ইনিংসে ৪০.০৭ গড়ে করেন ৬৯৭৩ রান। ১৮৮ টি ইনিংসের মধ্যে অপরাজিত ছিলেন ১৪ বার। এর মধ্যে ৫০ রানের ইনিংস রয়েছে ৩১ টি, সেঞ্চুরি ১৪ টি। এই ১৪ সেঞ্চুরির মধ্যে ৩ টিকে দ্বিশতকে রুপ দিয়েছেন এবং একটিকে ট্রিপলে। এছাড়াও ০ রানে আউট হন ১৫ ইনিংসে। তার টেস্ট ক্যারিয়ারের মোট ১৪ টি সেঞ্চুরির ১৩ টিই এসেছে ইনিংস ওপেন করার সময়। আর ৬ নম্বরে করেন একটি সেঞ্চুরি। টেস্টে জয়াসুরিয়ার প্রিয় প্রতিপক্ষ ছিল ভারত। তাদের বিপক্ষে ১৬ ইনিংসে ৬৭ গড়ে করেন ৯৩৮ রান। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩০ ইনিংসে ৫১.৩৮ গড়ে করেন ১৪৯০ রান। বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনে নেন ৯৮ টি উইকেট, যার মধ্যে দুইবার ৫ উইকেট নেন।
ওয়ানডে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৪৫ ম্যাচ খেলে ৪৪৩ ইনিংসে ৩২.৩৬ গড়ে করেন ১৩৪৩০ রান। যার মধ্যে ছিল ৬৮ টি ফিফটি এবং ২৮ সেঞ্চুরি। এর মধ্যে ৩৪ টি ইনিংসে ডাক করেন। চার মারেন ১৫০৩ টি এবং ছয় ২৭০ টি। ওপেনিংয়ে ৩৮৩ ইনিংসে ৩৪.৬২ গড় আর ৯২.৪৮ স্ট্রাইক রেটে করেন ১২৭৪০ রান। তার সবকটি সেঞ্চুরিই এসেছে ওপেনিং পজিশন থেকে। বল হাতে নেন ৩২৩ উইকেট আর ক্যাচ ধরেন ১২৩ টি।
টেস্ট ওয়ানডের মত টি-টোয়েন্টিতে অত ম্যাচ খেলতে পারেননি। ৩১ ম্যাচে প্রায় ১২৯ স্ট্রাইকরেটে করেন ৬২৯ রান আর ১৯ টি উইকেট নেন।
বর্তমান সময়ের মত ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট তার সময়ে না হলেও জয়াসুরিয়াকে বেশ কয়েক মৌসুম ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট খেলতে দেখা গেছে। তিনি ল্যাংকারশায়ার, সামারসেট এবং ওয়ারওয়েকশায়ারোর মত দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০০৮ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে খেলেন। যেখানে তার টিমমেট ছিল তার একসময়কার প্রতিদ্বন্দ্বী শচীন টেন্ডুলকার। এছাড়াও ২০১২ সালে তিনি বিপিএলে খেলতে আসেন খুলনা রয়েল বেঙ্গলের হয়ে।
—
আন্তর্জাতিক খেলা চালিয়ে যাবার সময় তিনি শ্রীলঙ্কার সাধারণ নির্বাচনে মাতারা থেকে ভোটে দাড়ান এবং প্রায় ৭৪০০০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। সে দায়িত্বে ছিলেন ৫ বছর। ২০১৫ সালে জয়াসুরিয়াকে স্থানীয় সরকার এবং পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী করা হয়। ক্রিকেট থেকে অবসরের পর তিনি ২০১২ সালে একটি ভারতীয় সেলিব্রিটি শোতে অংশ নেন। তারপর ২০১৩ সালে তিনি শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের নির্বাচক নিয়োজিত হন। তার অধীনে শ্রীলঙ্কা ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয় করে।২০১৬ তিনি সেই পদ থেকে ইস্তফা দেন।
—
চাঁদের যেমন কলঙ্ক থাকে তেমনি জয়াসুরিয়াও জীবনে কলঙ্ক লেপন করেছে ফিক্সিং। যদিও এটা তার অবসরের পরে। ফিক্সিং নিয়ে তদন্তকারী সংস্থা আকসুকে তথ্য গোপন করার অভিযোগে কোড অব কনডাক্ট ভঙ্গ করার দায়ে ২০১৯ সালে তাকে সকল ধরনের ক্রিকেট থেকে ২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।
তার সম্পর্কে কিছু গ্রেট প্লেয়ারদের মন্তব্য ছিল এরকম,
*অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়ী পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রা তার সম্পর্কে বলেছেন,
“It is always a massive compliment to someone to say they changed the game, and his performance in the 1996 World Cup changed everyone’s thinking about how to start an innings.”
*শচীন টেন্ডুলকার তার একসময়কার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্ধী জয়াসুরিয়া সম্পর্কে বলেছিল, “ আমি ডন ব্র্যাডম্যানকে দেখি নাই কিন্তু আমি জয়াসুরিয়াকে দেখেছি। আমার দেখা সেরা ব্যাটসম্যানের মধ্যে সে অন্যতম”।
*সর্বকালের অন্যতম সেরা পেসার ওয়াসিম আকরাম তার সম্পর্কে বলেছিল – “ আমাকে যে অল্প কজন ব্যাটসম্যান সব সময় সীমানা ছাড়া করত, তাদের মধ্যে জয়াসুরিয়া অন্যতম।সে অনেক বেশি বিপদজনক ছিল”।
ক্রিকেটে প্রতিটা জেনারেশন থেকে বেশ কয়েক জন গ্রেট বা লিজেন্ডারি প্লেয়ার আসে। কিন্তু পুরো খেলার ধরন পাল্টে দেওয়া ক্রিকেটারের সংখ্যা খুব কম। তাইতো ওয়ানডেতে মাত্র ৩২ গড় আর টেস্টে ৪০ গড়ের অধিকারী জয়াসুরিয়াকে সবাই এক বাক্যে লিজেন্ড বলে দেয়। কারন তিনি যে ওয়ানডেতে ওপেনিংয়ের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছেন। তাছাড়া ওয়ানডে ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করার পেছনে তার অবদান অপরিসীম।একটা সময় ছিল যখন জয়াসুরিয়া ব্যাটিং করতেন তখন সবকিছু ভুলে টিভিতে ম্যাচ দেখা হত। বাড়ির ছোট ছেলেটা মাত্র নতুন খেলা বুঝতে শুরু করেছে, আর তখন টেন ক্রিকেটে জয়াসুরিয়ার ব্যাটিংয়ের হাইলাইটস তাকে ক্রিকেট পোকা বানিয়ে দেয়। তাইতো শ্রীলঙ্কার অখ্যাত মাতারা জেলা থেকে উঠে আসা টাক মাথার এই লোক টাকে ক্রিকেট কোনদিনই ভুলবে না।