১৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

রায়ান টেন ডেসকাট- দ্যা ফ্লাইং ডাচম্যান !

প্রতিবেদক
ডেস্ক নিউজ
মঙ্গলবার, ৩০ জুন , ২০২০ ১০:১৯

মানুষ স্বপ্নবাজ, স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকতে ভালোবাসে। কখনো কখনো আলিঙ্গন করে ছুঁয়ে দেয় সেই লালিত স্বপ্নকে! আবার কখনোবা স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কাতর হয়। তবে এই ধরণীতে স্বপ্নভঙ্গের অনেক গল্প রয়েছে। হতভাগ্য মানুষদের তালিকাটাও বেশ দীর্ঘ!

ফুটবলে ডি স্টেফানো রিয়াল মাদ্রিদ এর হয়ে টানা পাঁচবার ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জয়ের সর্বনায়ক ছিলেন। ক্লাব পর্যায়ে দলীয় এবং ব্যক্তিগত যত পুরস্কার ছিল সবই তিনি জয় করেছেন। তবুও এই লিজেন্ডের নাম হতভাগাদের তালিকায় সবার উর্ধ্বে! কারণ একটাই! তিনি বিশ্বকাপের মূল আসরে খেলতে পারেনি। যেই বিশ্বকাপের কারণেই পেলে আজ সর্বকালের সেরা ফুটবলার! ১৯৮৬ সালে এক বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেই ম্যারাডোনা ফুটবলের ইশ্বর! ডি স্টেফানো তিনটি ভিন্ন ভিন্ন দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেও অধরা বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারিনি!

হয়তো একেই বলে দূর্ভাগা!

আপনি হয়ত স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ গড়ের আলোচনা শুনেছেন; পড়েছেন ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে বহু লিখনী! কিন্তু আপনি জানেন কি? ওয়ানডে ক্রিকেটে মিনিমাম ১০০০ রান সংগ্রাহক ক্রিকেটারের মধ্যে কোন ব্যাটসম্যানের গড় সবচেয়ে বেশি? উত্তরটি খুঁজতে গেলে আপনাকে অনেকটা বেগ পেতে হবে! আপনার ক্রিকেট মস্তিষ্ক সব লিজেন্ড খেলোয়াড়দের নাম মনে করতে লাগবে। তালাশে নেমে পড়বে ক্রিকেটখোরদের মন! কিন্তু ক্রিকেটের নেশায় আসক্ত মেধায় সেই অখ্যাত ব্যক্তির নামটা খুব কম মানুষই বলতে পারবে!

ওয়ানডে ক্রিকেটের সেই সর্বোচ্চ গড়ের মালিক এক দূর্ভাগা। যার জীবনেও রিয়াল মাদ্রিদের লিজেন্ড ডি স্টেফানোর মত ৫ সংখ্যার একটা মিল রয়েছে! ৫ টি সেঞ্চুরি করেছেন তার অনুজ্জ্বল ক্যারিয়ারে। সেই অভাগা ক্রিকেটারও ক্রিকেটে তার গন্ডির মধ্যে প্রাপ্ত সব শ্রেষ্ঠত্বই অর্জন করেছে। ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা আইসিসির তিনবারের বর্ষসেরা ক্রিকেটের খেতাব জয়ী! যে পুরস্কার সে ব্যতীত আর কেউ একাধিক বার জিততে পারেনি! হয়েছেন নিজ দেশের সর্বাধিক সংখ্যকবার বর্ষসেরা ক্রিকেটার। ক্রিকেট দুনিয়ায় আয়োজিত সব লীগেই খেলেছেন স্বমহিমায়। আইপিএলে কলকাতার ঘরের ছেলে হয়ে গিয়েছিল৷ শাহরুখ খানের কলকাতাকে দুইবারের শিরোপা জেতার পথে তার বড় অবদান রয়েছে! ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে তিনি ছোট্ট দেশের বড় তারকা নামে সুখ্যাতি অর্জন করেছে! ২০১১ সালের বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে করেছেন দুইটি সেঞ্চুরি। বিশ্বকাপ মঞ্চে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১১৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সাদা পোশাকে সংগ্রহ করেছেন দশ হাজারেরও অধিক রান। তার নেতৃত্বে কাউন্টি ক্রিকেটে এসেক্স হয়েছে চ্যাম্পিয়ন।

এতসব অর্জনের পরও এই ক্রিকেটারের একটিই আক্ষেপ, একটিই বেদনা! যা তাকে বহুকাল কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে! শেষ বয়সে কেবল রঙিন পোশাকের সব বর্নিল স্মৃতিগুলো নাতিদের বলতে পারবে। তার নাতিদের শুনাতে পারবে না দেশের হয়ে ক্রিকেট আভিজাত্যের সাদা পোশাকের ময়দানি লড়াইয়ের কোনো গল্প! ফুটবল কিংবদন্তি ডি স্টেফানোর বিশ্বকাপ খেলতে না পাওয়ার ন্যায় তার টেস্টের রাজকীয় ফরম্যাটে খেলতে না পারার আক্ষেপ বয়ে বেড়াবে আমৃত্যু! নেদারল্যান্ডসের বিখ্যাত অরেঞ্জ রংয়ের জার্সিতেই দুঃখ ভুলার ব্যর্থ চেষ্টা করবেন হয়ত! তখন ভারী কাঁচের চশমা চোখে দিয়ে হলরুমে নাতি-নাতনিদের সাথে নিয়ে টিভিতে নেদারল্যান্ডস বনাম ইংল্যান্ডের ম্যাচ দেখবে! লর্ডসের অনার্স বোর্ডে স্বদেশী খেলোয়াড়ের নাম উঠেছে বলে গর্বে একটু অশ্রু ঝরবে গণ্ডদেশ বেয়ে! আর তাতে আরো একবার বেদনায় নীল হবে তার অতৃপ্ত মন! সংগোপন মনে বলবে ‘আমি টেস্ট খেলার সুযোগ পেলে হয়ত এই সম্মানের জায়গায় অামার নামটা থাকলেও থাকতে পারত!” আচ্ছা যাকে নিয়ে এতো কিছু সেই ক্রিকেটারটি কে?

সেই ছোট্ট দেশের ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ খ্যাত ব্যক্তির নাম রায়ান নিল টেন ডেসকাটে। আর বর্নাঢময় ক্যারিয়ারে এই একটিই অপূর্ণতা। মাথায় চাপাতে পারেননি টেস্ট ক্যাপ! নেদারল্যান্ডসকে আইসিসি টেস্ট স্টাটাস এখনো দেয়নি! আর অদুর ভবিষৎতে দিলেও টেন ডেসকাটে খেলতেও পারবে না হয়ত।

২০১৮ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে প্রাইম দোলেশ্বরে খেলতে এসে অকপটেই নিজের সেই মনের বাসনার কথা স্বীকার করেছেন। দুঃখের কথা সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ কেন! যেকোনো টেষ্ট খেলুড়ে দেশের হয়ে খেলতে আমি ইচ্ছুক! এতেও যদি টেস্ট ক্রিকেটে অংশ নেওয়া যায়!’

নেদারল্যান্ডসের ফুটবল বিশ্বে যেমন এক হতাশার নাম। ক্রিকেটেও রায়ান টেন ডেসকাটেও তেমনি এক আক্ষেপের নাম! রেকর্ড ৬৭ গড়ে ৩৩ ম্যাচে ৫ টি সেঞ্চুরিতে করেছেন ১৫৪৫ রান। ৮৭+ স্ট্রাইক রেটও ঈর্ষণীয়। সাথে এই অলরাউন্ডার এর ঝুলিতে আছে ৫৫ টি উইকেট। খুব সহজেই তাকে আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর অন্যতম সেরা ক্রিকেটার বলা যায়!

তাইতো ২০০৮, ২০১০ ও ২০১১ সালে রেকর্ড তিনবার জিতেছেন এসোসিয়েট অফ ক্রিকেট বা সহযোগী দেশের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের এওয়ার্ড। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচ ৬১.৪০ গড়ে ৩০৭ রান সংগ্রহ করেছেন, প্রতিবেশী দুই দেশ ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেন, আর স্বাগতিক বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলেন অপরাজিত ৫৩ রানের ইনিংস! সাথে টুর্নামেন্টে উইকেট শিকার করেছেন ৭ টি। ঐ ২০১১ সালের বিশ্বকাপের পরপরই ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় বলেছিলেন।

রায়ান টেন ডেসকাটে; নেদারল্যান্ডসের পক্ষে কমলা পোশাক পরে খেললেও তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার পোর্ট এলিজাবেথ শহরে। শৈশবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত ফ্যাবিয়ান কলেজে পড়াশোনা করেন। তখন কলেজের ক্রিকেটের সাথে রাগবি দলেও খেলতেন। ক্রিকেটের টানেই দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। এসেক্স হয়ে খেলা শুরু করেন ২০০৩ সাল থেকে। সেখানে ভালো পারফরম্যান্স করে ডাক পান নেদারল্যান্ডসের দলে। ২০০৬ সাল থেকে এখনো খেলে যাচ্ছে কমলা রঙ্গিন ২৭ নাম্বার জার্সিতে! ২০২০ সালের টি টুয়েন্টি বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডসকে পাইয়ে দিয়েছেন বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া টিকেট! রায়ান টেন ডেসকাটে টি টুয়েন্টির এই যুগে ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের বিশ্বব্যাপী সুখ্যাতির পাশাপাশি দেশের জার্সিতেও বেশ সফল ২২ টি আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি খেলে ৪৬ গড়ে রান করে ৫৫৬ রান সাথে উইকেট ১৩ টি! বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রিমিয়ার লীগ বিপিএলেও দেখা গিয়েছে তাকে।

‘দুঃখ ও আক্ষেপ’ গল্পের হিরো রায়ান টেন ডেসকাটে!

আজ এই দুঃখী ক্রিকেটাররের ৪০ তম জন্মদিন। আজকের এই শুভ দিনে তাকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা। সেই সাথে
শুভ কামনা রইল এই দুঃসাহসী ক্রিকেটারের জন্য। যিনি বাস্তব জীবনেও বেশ নম্র ও শান্ত। ক্যারিয়ারের শেষটা যেন আরো বর্নিল হোক সেই কামনা রইল।

ক্রিকেটে বহু সফলতার মাঝে টেন ডেসকাটে অনন্য। ক্রিকেট ইতিহাসে বাসিল ডি অলিভেইরা ও গ্রায়েম পোলক এর মত হতভাগ্যদের তালিকায় রায়ান টেন ডেসকাটেও অমর হয়ে থাকবে। মেসি, রোনালদো, ডি স্টেফানোর মত সব পেয়েও অর্জনের খাতাটা অপূর্ণ থাকলেও, ক্রিকেটের প্রকৃত সমর্থকদের মনের মনিকোঠায় রায়ান টেন ডেসকাটে থাকবে ‘দ্যা ফ্লাইং ডাচম্যান’ হিসেবে যুগ যুগান্তে।

মতামত জানান :