একটি ‘নো-বল’ বলতে আমরা সাধারণত কি বুঝি?বোলার কর্তৃক বোলিং করার সময় অবৈধভাবে(ক্রিকেট নিয়মের বাহিরে) ব্যাটসম্যানের সম্মুখে নিক্ষেপ করা যেকোনো বল। যার ফলে ব্যাটিং দলের স্কোরে অতিরিক্ত একটি রান যোগ হয়ে থাকে। অনেকের কাছে এই একটি রান সামান্য হলেও, ফিল্ডিং-এ থাকা দলের জন্য অনেকটা কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা হতে পারে যদি সেটা ম্যাচের ফলাফল নির্ধারনী ওভার বা ম্যাচের শেষ দিকে হয়। আম্পায়ার ডান হাত প্রসারিত করে ‘নো’ ডাক দেওয়ায়, শুধু আরেকটি বল বেশি খেলা বা একটি রান বেশি পাওয়াই নয়, বরং এর সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে পুরো ম্যাচের পট পরিবর্তনের আশঙ্কা। ফাস্ট বোলারদের অনেক সতর্কের পরও এই নো-বল করা অস্বাভাবিক নয় কারণ তাদেরকে দ্রুত গতিতে লম্বা রান আপ নিয়ে বল করতে হয়। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কখনোই নো-বলের করে নাই এমন ও কিছু পেস বোলার রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন “ইয়ান বোথাম”।
১৬ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে নো-বল না করা বোলারদের মাঝে একজন অলরাউন্ডার ইয়ান বোথাম। শুধু বোলিংয়েই নয়, ব্যাটিং – বোলিং উভয়েই অসাধারণ ক্রীড়ানৈপুণ্য প্রদর্শন করে বিশ্বের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রকৃত অলরাউন্ডারের মর্যাদা পেয়েছেন তিনি। ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট লাভের বিরল কৃতিত্ব প্রথম দেখায় ইয়ান বোথাম। সেই সাথে টেস্ট ক্রিকেটে ৩৫০+ উইকেট শিকারি হিসেবে নিজের নাম লেখান। ইংলিশ ক্রিকেটারদের মধ্যে বোথামই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি সর্বাধিক ৫টি অ্যাশেজ জয়ের কীর্তি দেখিয়েছেন।
হার্বার্ট লেসলি বোথাম ও ভায়োলেট ম্যারি এই দম্পতি খেলেছিলেন আধা-পেশাদার লেভেলে ক্রিকেট। সে সূত্রে বলা যায় তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রক্তে মিশে থাকবে ক্রিকেট। ২৪শে নভেম্বর, সাল ১৯৫৫ যুক্তরাজ্যের চেশায়ারে এই দম্পতির কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। যার নাম দেওয়া হয় ইয়ান টেরেন্স বোথাম। ডাক নাম হিসেবে কেউ ডাকতেন বোথ, কেউ আবার বিফি। বাবা হার্বার্ট লেসলি বোথাম কাজ করতেন ওয়েস্টল্যান্ড এয়ারক্রাফটে। আর মা ভায়োলেট ম্যারি ছিলেন পেশায় একজন নার্স। ছোটবেলা থেকেই ক্রীড়া জগতের সাথে বেশ মেতে ছিলেন বিফি। ছেলেবেলা থেকেই অনেকের মাঝে অনেক প্রতিভা থাকে। কেউ ক্রিকেট, কেউ ফুটবল, কেউ আবার বাস্কেটবল নিয়ে মেতে থাকে। তবে যেকোনো একটিকেই সাধারণত বেছে নেয়। তবে বিফি স্কুলে থাকা কালীন সময় থেকেই ক্রিকেট ও ফুটবল দুই খেলাতেই ছিলেন রীতিমত অলরাউন্ডার। ক্রিকেট ও ফুটবল দুটোতেই ছিলো অসাধারণ দক্ষতা। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি ডাক পান ইংল্যান্ডের সমারসেট অনূর্ধ্ব-১৫ যুব ক্রিকেট দলে। জুনিয়র কাউন্টির অভিষেক ইনিংসেই করেন ৮০ রান। এরই মাঝে কিছুদিন পর ক্রিস্টাল প্যালেস ক্লাব থেকে প্রস্তাব পান প্রথম বিভাগ ফুটবলে খেলার। তবে বিফির বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ক্রিকেটেই ক্যারিয়ার গড়ুক। বাবার এই চাওয়া পূর্ণ করতে গিয়েই ক্রিকেটকে বেছে নেন তিনি।
অর্থোডক্স স্টাইলে সোজা ব্যাটে খেলতে পছন্দ করতেন। পুল এবং স্কয়ার কাটও ভাল খেলতেন বোথাম। বোথামের ‘স্ট্রেইট হিটিং’ সম্পর্কে আলাদাভাবে প্রশংসা করা হয়েছে উইজডেনেও। লফটেড ড্রাইভ এবং হুক শটে ছক্কা হাঁকানোয় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন বিফি। ওয়ানডেতে পিঞ্চ হিটার রোলেও সফলতা পেয়েছেন তিনি। ব্যাটিং-বোলিংয়ের পাশাপাশি ফিল্ডিংয়েও দুর্দান্ত ছিলেন বোথাম। একজন বিশ্বস্ত ফিল্ডার হিসেবে তাঁর আলাদা পরিচিতি ছিল। টেস্ট-ওয়ানডে মিলিয়ে সর্বমোট ক্যাচ নিয়েছেন ১৫৬টি।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালে সমারসেটের হয়ে বিফির ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক হয়। যেখানে প্রতিপক্ষ ছিল ক্লাইভ লয়েডের ল্যাঙ্কাশায়ার। পরবর্তী একই বছরের ১২ই জুন, হ্যাম্পাশায়ারের মুখোমুখি হয় সমারসেট। প্রথমে ব্যাটিং-এ নেমে হ্যাম্পশায়ার ১৮৩ রানের টার্গেট দেয়। ২য় ইনিংসে ১৮৩ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে ১১৩ রানেই ৮ উইকেট হারিয়ে বসে সমারসেট। জয়ের জন্য প্রয়োজন ৭০ রান। সেখান থেকে দলের ১ উইকেট হাতে রেখেই দুর্দান্ত একটি জয় এনে দেন বিফি। সেদিন তিনি অপরাজিত ৫৪ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস খেলেন, ৫৪ রান সংখ্যায় নেহাত হলেও লোয়ার অর্ডারদের নিয়ে ম্যাচ জেতানো ছিল কঠিন কাজ।
সেদিন ব্যাটিংয়ের সময় কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার অ্যান্ডি রবার্টসের বাউন্সারে আঘাত পেয়ে ঘটনাস্থলেই চারটি দাঁত হারিয়েছিলেন বোথাম! মুখ এবং ঠোঁট কেটে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল কিন্তু তবুও মাঠ ছাড়েননি! পরে রবার্টসকে দুটো ছক্কাও মেরেছিলেন ওই অবস্থাতেই!
ফাস্ট ক্লাস ক্রিকেটে ব্যাট হাতে ৪০২ ম্যাচের ৬১৭ ইনিংসে ৩৩.৯৭ গড়ে সংগ্রহ করেন ১৯৩৯৯ রান। সর্বোচ্চ ২২৮ রান। সেঞ্চুরি ছিল ৩৮টি ও হাফ সেঞ্চুরি ছিল ৯৭টি। বল হাতে ২৭.২২ গড়ে ১১২৭টি উইকেট শিকার করেন। বোলিং সেরা ৩৪ রানে ৮ উইকেট।
২৬শে আগস্ট, ১৯৭৬ ইংল্যান্ডের হয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হয় ইয়ান বোথামের। বিপক্ষ দল ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অ্যালান নটের অধীনে সেদিন বোথামের ব্যাটে তেমন কোন রানের দেখা না পাওয়া গেলেও বল হাতে ৩ ওভার বোলিং করে ২৬ রানের বিনিময়ে তুলে নেন একটি উইকেট। এই ম্যাচটিতে ইয়ান বোথামের সাথে সাথে অভিষেক হয় ইংল্যান্ডের আরও ৪জন ক্রিকেটারের। তাদের মধ্যে আছেন ডেভিড স্টিল, গ্রাহাম বার্লো, ইংল্যান্ডের আরেক কিংবদন্তি গ্রাহাম গুচ ও জন লিভার।
ক্যারিয়ারের শেষ একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন ২৪শে আগস্ট ১৯৯২ সালে ম্যানচেস্টারে পাকিস্তানের বিপক্ষে। টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাকিস্তান। নির্দিষ্ট ৫০ ওভার শেষে ৫ উইকেট হারিয়ে ২৫৪ রান সংগ্রহ করে। ২৫৫ রানের টার্গেটে ব্যাটিংয়ে নামে ইংল্যান্ড দল। রবিন স্মিথের অপরাজিত ৮৫ ও স্টুয়ার্ড এর অর্ধশতক বেশ ভূমিকা রাখে এই জয়ের। ৪৩ ওভারের চতুর্থ বলে চার উইকেট হারিয়ে টার্গেট পূর্ণ করে ইংল্যান্ড। ১১ ওভার বোলিং করে ৪৩ রানের বিনিময়ে কোন উইকেট তুলতে পায়নি বোথাম। সেদিন ইংল্যান্ড ৬ উইকেটে জিতে যাওয়ায় ব্যাটিংয়ে নামার সুযোগই হয় নি। ওডিআই ক্যারিয়ারের শুরু ও শেষ ম্যাচে তেমন ভূমিকা রাখতে না পারলেও অসামান্য কিছু অর্জন ছিল পুরো ওডিয়াই ক্যারিয়ারে।

১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত ম্যাচসেরা হবার গৌরব অর্জন করেন বোথাম। বিফির অলরাউন্ড নৈপুণ্যে ৫১ বলে অপরাজিত ৬০ রান এবং ৪৫ রানে ২ উইকেট। সেদিন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ৫ রানের শ্বাসরুদ্ধকর এক জয় তুলে নেয় ইংল্যান্ড।
১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত চারজাতি ওয়ানডে সিরিজ ‘বেনসন এন্ড হেজেস’ কাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলেন ৩৯ বলে ৬৮ রানের যেখানে ৭টি বাউন্ডারি ও ৩টি ওভার বাউন্ডারি ছিল। বলে রাখা ভালো ওঁই সময়ে বলের চেয়ে রান খুব বেশি দেখা যেত না। মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটি ‘ম্যাচ উইনিং নক’ উপহার দেন বিফি। পিঞ্চ হিটিং ওপেনারের ভূমিকায় খেলতে নেমে করেন ৫১ বলে ৭২ রান যেখানে বাউন্ডারি ১১টি ও ওভার বাউন্ডারি ১টি।

১৯৭৯, ১৯৮৩ এবং ১৯৯২ সালে ক্যারিয়ারের মোট তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছেন বোথাম। দুবার ফাইনাল খেললেও শিরোপা জিততে পারেননি একবারও। তাঁর বিশ্বকাপ রেকর্ড ততটা সমৃদ্ধ না হলেও ১৯৯২ বিশ্বকাপে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ম্যাচ জিতিয়েছেন তিনি।
২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২ সালে পার্থে ভারতের বিপক্ষে জয় পাওয়া ম্যাচে ব্যাট হাতে মাত্র ৯ রান তুললেও বল হাতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন বোথাম। ১০ ওভার বোলিং করে ২৭ রানের বিনিময়ে তুলে নেন ২টি উইকেট। নিয়েছিলেন শচীন টেন্ডুলকার ও বিনোদ কাম্বলির উইকেট। এরপর ৫ই মার্চ সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৮ উইকেটের জয় পাওয়া ম্যাচেও দু’দলের মাঝে ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল বিফির অনবদ্য অলরাউন্ড নৈপুণ্য। বল হাতে ১০ ওভার বোলিং করে, ক্যারিয়ার সেরা ৩১ রানে ৪ উইকেট শিকারের পর ইনিংস উদ্বোধন করতে নেমে তিনি খেলেছিলেন ৭৭ বলে ৫৩ রানের দায়িত্বশীল একটি ইনিংস।
১৯৯২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ওপেন করতে নেমে খেলেন ৭৩ বলে ৭৯ রানের আরও একটি ম্যাচ জেতানো ইনিংস। পরে বল হাতেও নেন ১ উইকেট, জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। ৭৯ রানেই এই ইনিংসটিই তার ওডিয়াই ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ছিল।
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যাট হাতে ১১৬ ম্যাচের ১০৬ ইনিংসে ২৩.২১ গড়ে ২১১৩ রান সংগ্রহ করেন তিনি। সর্বোচ্চ রান ৭৯, স্ট্রাইক রেট ৭৯.২৬, অর্ধশতক ছিল ৯টি। বল হাতে তুলে নেন ১৪৫টি উইকেট। যেখানে তার গড় ছিল ২৮.৫৪। ইনিংসে ৪ উইকেট নিয়েছেন ৩ বার। ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ৩১ রানে ৪ উইকেট।
২৮ জুলাই, ১৯৭৭ সালে পাঁচ দিনের টেস্ট ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া দল সফর করে ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামের ট্রেন্টব্রিজে। টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় অস্ট্রেলিয়া। ১ম ইনিংস শেষে দেখা যায়, বোথাম ২০ ওভার বোলিং করে ৭৮ রানের বিনিময়ে তুলে নেন ৫টি উইকেট। অভিষেকেই ৫ উইকেট নিয়ে দলকে জেতাতে বেশ বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। একই বছরে ১১ই আগস্ট অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পরবর্তী টেস্ট ম্যাচে হেডিংলিতেও শিকার করেন ৫ উইকেট। সেবারের অ্যাশেজ সিরিজটা ইংল্যান্ড জিতেছিল ৩-০ ব্যবধানে। মাত্র দুটি ম্যাচ খেললেও অভিষেক সিরিজেই বোথাম পেয়ে যান প্রথম অ্যাশেজ জয়ের স্বাদ।
১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৩ ম্যাচের সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ড দল যায় রিচার্ড হ্যাডলির নিউজিল্যান্ডে। টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সিরিজেও অসাধারণ বাজিমাত দেখিয়ে দেয় বোথাম। এই সিরিজে বল হাতে ১৮.২৯ গড়ে তুলে নেন নেন ১৭ উইকেট। যেখানে ইনিংসে দুবার ৫ উইকেট সংগ্রহ করেছিলেন। এছাড়া ব্যাট হাতে তাঁর সংগ্রহ ছিল ৫৩.০ গড়ে ২১২ রান। এই সিরিজের ২য় ম্যাচে ক্রাইস্টচার্চে টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথম শতরানের দেখা পান। ব্যাট হাতে ১০৩ ও ৩০* রান সংগ্রহ করবন। সেদিনই বল হাতে তুলে নেন ৮ উইকেট (৫/৭৩ ও ৩/৩৮)।
একই বছর জুনে পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজে পরপর দুই টেস্টে সেঞ্চুরি তুলে নেন বোথাম। প্রথম ম্যাচে সেঞ্চুরি করেন নিয়েছিলেন ১টি উইকেট । ২য় ম্যাচে লর্ডসে ৮ উইকেট তুলে নেন। বোথামের ক্যারিয়ার সেরা বোলিংটাও এসেছিল এই সিরিজেই। ৩৪ রানের বিনিময়ে ৮ উইকেট। এই সিরিজে ২১২ রানের সাথে সংগ্রহ করেন ১৩টি উইকেট।
ওই বছরই নিউজিল্যান্ড সিরিজে ২৪ টি উইকেট শিকার করেন ওই সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হয়েছিলেন বোথাম। ৩-০ ব্যবধানে নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইট ওয়াশ করে ইংল্যান্ড।
১৯৭৮-৭৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যাশেজ জয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বোথাম। ব্যাট হাতে ২৯১ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ২৩ উইকেট।
১৬ই আগস্ট, ১৯৭৯ সাল ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের চতুর্থ টেস্ট সেঞ্চুরি হাঁকান বোথাম। সে ম্যাচে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় ইংল্যান্ড। ৫ উইকেট খোয়ানোর পর ৬ষ্ট উইকেটের হাল ধরেন বোথাম। হেডিংলির এই টেস্টে ৯০.১৩ স্ট্রাইক রেটে ১৫২ বলে সংগ্রহ করেন ১৩৭ রান। যেখানে ১০টি বাউন্ডারি ও ৫টি ওভার বাউন্ডারি ছিল। এই ইনিংসটি উইজডেনের ভাষায়, “one of the finest Test innings in the last twenty years.”
এই সিরিজেই ২য় ও টেস্ট ক্যারিয়ারের ১৯ তম ম্যাচে বোথাম ১০০ তম উইকেট শিকার করেন। ২১ তম ম্যাচে ১০৩৫ রান সংগ্রহ করে। টেস্ট ইতিহাসের দ্রুততম খেলোয়াড় হিসেবে ১০০০ রান এবং ১০০ উইকেটের অলরাউন্ডার’স ডাবল অর্জন করেন বোথাম। এই রেকর্ড করতে তার লেগেছিল মাত্র ২১ টেস্ট ম্যাচ।
১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮০ সাল। ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয় এক ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচের। ঘরের মাঠে ভারত মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড দলের। ১১৪ রান ও ১৩ উইকেটের সৌজন্যে স্বাগতিক ভারতের বিরুদ্ধে ১০ উইকেটের এক অনায়াস জয় তুলে নেয় সফরকারী ইংল্যান্ড। টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নামে ভারত। প্রথম ইনিংসে বোলিং করে ২৩ ওভারে ৫৮ রানের বিনিময়ে তুলে নেন ৬ টি উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে ২৬ ওভারে ৪৮ রানের বিনিময়ে তুলেন ৭টি উইকেট। প্রথম ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে বোথাম ১৪৪ বলে সংগ্রহ করেন ১১৪ রান। ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট লাভের বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন ইয়ান বোথাম। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে এই কৃতি অর্জন কররেন পাকিস্তানের ইমরান খান। ইমরান খানের পর টেস্ট ক্রিকেটে দীর্ঘ ৩০ বছর এই কৃতি আর দেখা যায় নি। পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ৩রা নভেম্বর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশ দলের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ব্যাট হাতে ১৩৭ রান ও বল হাতে উভয় ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করে ৩য় এবং এখন অব্দি সর্বশেষ খেলোয়াড় হিসেবে একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট লাভ করেন।
সাল ১৯৮১, অ্যাশেজ সিরিজ! এ যেন এক ঐতিহাসিক সিরিজে পরিণত হয়। নটিংহ্যাম থেকে ওভাল এ সিরিজ যেন বোথামের জন্য জয়জয় গান। ব্যাট হাতে ৩৯৯ রান করার পাশাপাশি বল হাতে ৩ বার ইনিংসে ৫ উইকেট ও ১ বার ম্যাচে ১০ উইকেটসহ মোট ৩৪ উইকেট শিকার করেন বোথাম। উক্ত অ্যাশেজকে আখ্যায়িত করা হয় ‘বোথামের অ্যাশেজ’ নামে।
১৯৮১-৮২ সালের ভারত সফরে ব্যাট হাতে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন বোথাম। ১ সেঞ্চুরি ও ৪ ফিফটিতে করেন ৪৪০ রান! এছাড়া বল হাতে তাঁর শিকার ছিল ১৭ উইকেট। একই বছরের জুন-জুলাইতে ভারতের বিপক্ষে আয়োজিত হোম সিরিজে তিনি পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি (২০৮)। তিন ম্যাচের সিরিজে বিফির ব্যাট থেকে এসেছিল ১৩৪.৩৩ গড়ে ৪০৩ রান। এছাড়া বল হাতে ১০টি উইকেটও লাভ করেন তিনি।
১৯৮৪ সালের বিখ্যাত ‘ব্ল্যাকওয়াশ’ সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৫-০ ব্যবধানে পরাজিত হয় স্বাগতিক ইংল্যান্ড। উক্ত সিরিজে ইংল্যান্ডের হয়ে সেভাবে কেউ কিছু করে দেখাতে পারেনি এক বোথাম বাদে। ওই সিরিজে দু’বার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ নিয়েছিলেন ১৯ উইকেট আর ৩ অর্ধশতকে বোথামের ব্যাট থেকে এসেছিল ৩৪৭ রান। উক্ত সিরিজের ২য় ম্যাচে লর্ডসে ব্যাট হাতে ১১১ রান এবং বল হাতে এক ইনিংসে ১০৩ রানের বিনিময়ে ৮ উইকেট নিয়েও দলকে পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারেন নি বিফি! পরবর্তী বছরের অ্যাশেজটা ৩-১ ব্যবধানে জিতে নেয় স্বাগতিক ইংল্যান্ড। যে জয়ে বল হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বোথাম। ২৫.৫৮ গড়ে ৩১ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। এছাড়া তিনি ব্যাট হাতে করেছিলেন ৩ ফিফটিসহ ২৫৬ রান।
১৯৮৬-৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত অ্যাশেজে ২-১ এ জয়ী হয়েছিল ইংল্যান্ড। ব্রিসবেনে সিরিজের প্রথম ম্যাচে বোথাম খেলেছিলেন ১৫৭ বলে ১৩৮ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস, জিতেছিলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। ইংলিশ ক্রিকেটারদের মধ্যে একমাত্র বোথামেরই রয়েছে সর্বাধিক ৫টি অ্যাশেজ জয়ের কীর্তি।
একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ক্যারিয়ারের প্রথমভাগে বোথাম ছিলেন একজন জেনুইন উইকেট টেকার বোলার, একজন কমপ্লিট ফাস্ট বোলার যাকে বলা যায়। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষভাগে এসে টেস্ট দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন বোথাম। ব্যাটে-বলে সেই চিরচেনা ছন্দটাও হারিয়ে ফেলেন। অবিশ্বাস্য এই ছন্দপতনের আসল কারণ হচ্ছে ইঞ্জুরি। ১৯৮২ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার কাঁধ এবং পিঠের ইনজুরিতে ভুগতে হয়েছে তাঁকে। ফলে সময়ের সাথে বলের গতি এবং সুইং করানোর ক্ষমতা দুটোই হারিয়ে ফেলতে থাকেন বোথাম। সাল ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ এই ৫ বছরে মাত্র ১৪টি টেস্ট খেলে বোথামের সংগ্রহ ছিল ২০.৫৭ গড়ে ৩৯১ রান। যেখানে ফিফটি মাত্র ১টি। অন্যদিকে বল হাতে পারফরম্যান্স টাও ছিল আরও সাদামাটা। ১৪ টেস্টে ৫৭.৫৩ গড়ে উইকেট পেয়েছিলেন মাত্র ১৭টি।
টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট হাতে ১০২ ম্যাচের ১৬১ ইনিংসে ৩৩.৫৪ গড়ে করেছেন ৫২০০ রান। যেখানে ১৪টি সেঞ্চুরির সঙ্গে হাফ সেঞ্চুরি আছে ২২টি। ক্যারিয়ার সেরা ২০৮ রান। বল হাতে ২৮.৪০ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ৩৮৩টি। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ২৭ বার, ম্যাচে ১০ উইকেট ৪ বার। সেরা বোলিং ৩৪ রানে ৮ উইকেট।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো, ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে বোথামের শুরু এবং শেষের গল্পটা ভিন্ন। প্রথম ৫১ টেস্ট শেষে যেখানে বোথামের ব্যাটিং গড় ছিল ৩৮.৮০। শেষ ৫১ টেস্টে সেটা মাত্র ২৮.৮৭! বোথামকে ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন অনেকেই। বোথামকে নিয়ে অনেকেই অনেক মন্তব্যই রয়েছে। ২০০৭ সালে নাইট পদবীতে ভূষিত হয় স্যার ইয়ান বোথাম। ইংল্যান্ডের হয়ে এর পূর্বে আরও দুজন এই উপাধি পেয়েছিলেন। তারা হলেন, স্যার ফ্রান্সিস স্ট্যানলি জ্যাকসন (১৯৩২) ও স্যার চার্লি স্মিথ (১৯৪৪)।
উইজডেনের সাবেক চীফ এডিটর ম্যাথু এঞ্জেলের মতে, “No Englishman since WG Grace not even Jack Hobbs, Wally Hammond, or Kevin Pietersen, had captured the imagination of cricket supporters the way Botham had.”
সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক গ্রাহাম গুচের মতে, “English sport has never produced a superhero like him.”
উইজডেনের ভাষায়, “In the late 1970s and early 1980s, Botham was the world’s leading miracle worker. His comical, unprecedented self-belief was combined with exquisite skill: as a swing-bowling artist, a genius in the slips and either a classical hitter or a beery slogger.”
বোথাম গল্পের শেষ দিকে এসে আবার ক্রিকেটের বাহিরে চলুন যাই!!
প্রথমেই বলেছিলাম, ক্রিকেটের পাশাপাশি ফুটবলটাও বেশ ভালো খেলতেন বোথাম। তিনি চাইলে ক্রিকেট বাদ দিয়ে পেশাদার ফুটবলেও ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন। কিন্তু বাবার ইচ্ছেয় ক্রিকেট টাকে পেশা বানালেও, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার থাকা অবস্থাতেই ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ডেনিস কম্পটন, জিম কাম্বস ও আর্নল্ড সাইডবটমের ন্যায় তিনিও ফুটবল লীগের অন্যতম ফুটবলার হিসেবে ১১টি খেলায় অংশগ্রহণ করেছেন বোথাম।