১৪ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

রথগামা গ্রামের একজন মালিঙ্গার গল্প

প্রতিবেদক
Nayan
শুক্রবার, ২৮ আগস্ট , ২০২০ ৭:১৯

শ্রীলংকার গল শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে রথগামা গ্রামে আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করেন একটি শিশু । পর্যটকদের স্বর্গ গলে অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম এই রথগামা।

গ্রামের পরিবেশে শৈশব কেটেছে দুরন্তপনায়। যা অনেকটা আমাদের মাশরাফির মতই। সকালে ঘুম থেকে উঠে নদীতে সাঁতার কাটা, নদী পার হয়ে পাশের এলাকায় খালার বাড়ি যাওয়া। সাঁতার কেটে ওপারে যাওয়া আবার সাঁতার কেটে বাড়ি ফেরা। স্কুল ছুটি হত দুপুর দুইটায়। আবার দুপুরের খাবার খেয়ে শুরু হয় নদীর পাড়ে ক্রিকেট খেলা গ্রামের মানুষদের সাথে। এমন একটি গ্রাম, যেখানে সব মানুষই ক্রিকেটের প্রতি আসক্ত। সময়টাও শ্রীলংকার সেরা সময় ছিল ৯৬ বিশ্বকাপ যে তাদের ঘরে গিয়েছিল তখন।

টেনিস বলে পাশের গ্রামের সাথে ম্যাচ খেলা ছিল প্রতিদিনের রুটিন ওই গ্রামের মানুষের। তাদের মধ্য একজন লাসিথ মালিঙ্গা । প্রচুর বৃষ্টি হয় বলে, তার জন্যও ব্যবস্থা রেখেছিল গ্রামের মানুষরা। বড় বড় নারিকেল গাছের পাতা বিছিয়ে এবং কাঠের ফ্রেম বানিয়ে বৃষ্টির মাঝে খেলা হত।

অদ্ভুত বোলিং অ্যাকশনের জন্য কোটি ক্রিকেট ভক্তদের কৌতূহলের কারন মালিঙ্গা। এই ক্রিকেট পাগল রথগামা গ্রামের অবদান।

নদীর পাড়ে খেলা হত। নদীর পাশে বাতাস থাকত প্রচণ্ড ভারী, কিন্তু টেনিস বল ছিল পাতলা। বল করতে হত দ্রুত এসে প্রচণ্ড গতিতে। আর ব্যাটসম্যানকে রান করতে না দেওয়ার জন্য সহজ ট্যাকনিক হল সঠিকভাবে ইয়র্কার দেওয়া। মালিঙ্গা এই কাজটা করতে চাইতেন প্রতি বলে।

গ্রামের এই ছেলে কখনও কল্পনাও করেন নাই জাতীয় দলে খেলবে। কিন্তু হ্যাঁ, গ্রামের এই ছেলে আজকের ক্রিকেট বিশ্বের বিস্ময় মালিঙ্গা।

বাবা ছিলেন একজন মোটর মেকানিক, আর মা ব্যাংকার। রথগামা গ্রামের দেবপাথিরাজা কলেজে শিক্ষাজীবন শুরু হয় মালিঙ্গার। এরপর গলে অবস্থিত বিদ্যালোকা কলেজে চলে যায়। আবার গলের মাহিন্দ কলেজে স্থানান্তরিত হন কিছুদিন পর। পড়াশুনায় ও অনেক ভাল ছাত্র ছিলেন। দেবাপাথিরাজা কলেজ থেকে বিদ্যালোকা কলেজে অধ্যয়নকালীন প্রথম ক্রিকেট বল হাতে নেন মালিঙ্গা। বয়স ছিল মাত্র ১৭। এতদিন টেনিস বলে খেলা ছেলেটা ক্রিকেট বল যেন হাতেই নিতে পারতেছিলেন না ওজনের জন্য। কিন্তু ক্রিকেট বল যে তাকে ধরতেই হবে ধরণী হয়ত জানত এই ছেলে হবে শ্রীলংকার ক্রিকেটের পরবর্তী প্রজন্ম এবং ক্রিকেট বিশ্বের সব ব্যাটসম্যান এর আতঙ্ক।

তাইত ক্রিকেট বলে কলেজের হয়ে ২য় ম্যাচে নিলেন ৬ উইকেট। ওই ম্যাচের আবার আম্পায়ার ছিলেন মাহিন্দার কলেজের শিক্ষক ধর্নাপ্রিয়া। পারফরমেন্সে মুগ্ধ হয়ে মাহিন্দার কলেজে পড়ার আমন্ত্রণ পেলেন। এক প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে মালিঙ্গা প্রথমবারের মত নজরে আসেন তৎকালীন শ্রীলঙ্কান সাবেক পেসার চম্পকা রমানায়েকে (তিনি বাংলাদেশের সাবেক বোলিং কোচ এবং সাবেক শ্রীলংকা দলের বোলিং কোচ)। চম্পাকা তাকে গল ক্রিকেট ক্লাবে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান।

চম্পাকা রামানায়েকের পরামর্শে শ্রীলংকা অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ট্রায়াল দিয়েছিলেন। ৩ উইকেট নিয়েও সুযোগ হয় নাই মালিঙ্গার। হতাশ হয়ে ফিরলেও পাশে ছিলেন চম্পকা রমানায়েকে।

গল ক্লাবের কোচ কাম প্লেয়ার চম্পকা রমানায়েকের ইনজুরির কল্যাণে ২০০১ সালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যায় রথগামা গ্রামের মালিঙ্গার । অভিষেকে ম্যাচে ৬ উইকেট ।

ওই বছরই জাতীয় দলের নেটে বোলিং করতে নিয়ে যানচম্পকা রমানায়েকে। মজার বিষয় তার অদ্ভুত বোলিংয়ে কয়েক জন আহত হয়। আবার কয়েকজন তার বল খেলতে নারাজ হয়।

২০০৪ সাল আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচে অভিষেক হয় মালিঙ্গার। তাও অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়ায় বিপক্ষে। ড্যারেন লেহম্যান আউট করে নিজের প্রথম উইকেট তুলে নেন। প্রথম ইনিংসে ২ উইকেট নিলেও ২য় ইনিংসে ৪২ রানে ৪ উইকেট তুলে নেন। যদিও ম্যাচে শ্রীলংকা হেরে যায়। তবে অভিষেক ম্যাচে নিখুঁত ইয়র্কার, স্লোয়ার ও বাউন্সার দিয়ে অস্ট্রেলিয়া শিবিরের আতংক হয়ে যান মালিঙ্গা। ম্যাচ শেষে অ্যাডাম গিলক্রিস্টের কাছ থেকে প্রশংসা ও সমর্থন পান মালিঙ্গা। শ্রীলংকার ড্রেসিং রুমে গিয়ে তাঁকে একটি স্মারক স্ট্যাম্পও দিয়ে আসেন গিলক্রিস্ট।

২০০৪ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক ঘটে হয় মালিঙ্গার। তারপর থেকে দলে নিয়মিত হয়ে যান।

তবে শুধু কি এই অ্যাকশন বা ক্রিকেট? না ! মালিঙ্গা ফ্যাশন-সচেতনতার দিক থেকেও অন্য সব ক্রিকেটার থেকে এগিয়ে। এমনও ছিল প্রতি সিরিজেই চুলের স্টাইল পরিবর্তন করতেন কালার করে। এখনও কেশ-সজ্জায় প্রচুর সময় ব্যয় করেন মালিঙ্গা। একটা তথ্য দেয়া যায়। ২০০৭ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বারবাডোজের এক ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের সবচেয়ে আবেদনময়ী ক্রিকেটার হয়েছিলেন।

অদ্ভুতুড়ে অ্যাকশন, কখনো কখনও প্রশ্ন ওঠলেও ,অফিশিয়ালি কখনও এই অ্যাকশন নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়নি তাকে। মূলত তার অ্যাকশনের জন্যই তাঁকে খেলা দুরূহ হয়ে যায় যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্য।

২৮ মার্চ ২০০৭ সালে বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রভিডেন্স স্টেডিয়াম, গায়ানায় হ্যাট্রিক অর্জনের মাধ্যমে ক্রিকেট বিশ্বের নজর কাড়েন। ঐদিন তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে হ্যাট্রিকসহ পরপর চারটি বলে চারজন ব্যাটসম্যানকে আউট করেন। আউট গুলো ছিল শন পোলক বোল্ড, অ্যান্ড্রু হল কট উপুল থারাঙ্গা, জ্যাক ক্যালিস কট কুমার সাঙ্গাকারা, মাখায়া এনটিনি বোল্ড।

২০১১ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে আবারও হ্যাট্রিক করেন মালিঙ্গা এবার কেনিয়ার বিপক্ষে আর. প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম, কলম্বোতে হ্যাট্রিক করেন। আউট হয়েছিল তন্ময় মিশ্র এলবিডব্লিউ পিটার ওগোন্ডো বোল্ড শেন এনগোচে বোল্ড।

তারপর একই বছর ২০১১ সালে ওয়ানডেতে আবারও হ্যাট্রিক এবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, আর. প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম, কলম্বোতে হ্যাট্রিক করেন মালিঙ্গা। আউট করেছিলেন মিচেল জনসন বোল্ড, জন হেস্টিং এলবিডব্লিউ, জাভিয়ের ডোহার্টি বোল্ড।

অসাধারণ কীর্তি অর্জনকারী এই বোলার ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ থেকে অবসর নেন। টেস্ট ক্রিকেটে ৩ বার ৫ উইকেট নিয়েছিলেন। ৫/৮০ বিপক্ষ নিউজিল্যান্ড মাঠ ম্যাকলিন পার্ক নেপিয়ার নিউজিল্যান্ড সাল ২০০৫।

৫/৬৮ বিপক্ষ দল নিউজিল্যান্ড, মাঠ বেসিন রিজার্ভ ওয়েলিংটন, নিউজিল্যান্ড, সাল ২০০৬ ।

৫/৫০, বিপক্ষ দল ভারত, গল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম শ্রীলংকা, সাল ২০১০।

টেস্টে দুইবার ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ নির্বাচিত হল মালিঙ্গা । টেস্টে ৩০ ম্যাচে ১০১ উইকেট নেন । সাথে একটি অর্ধশত রানের ইনিংস আছে তার । প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৮৪ ম্যাচে ২৫৭ উইকেট নেন মালিঙ্গা।

২০১৪ সালে টি২০ বিশ্বকাপের অধিনায়ক হয়ে শ্রীলংকাকে চ্যাম্পিয়ন করেন মালিঙ্গা।

২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচে ১২ উইকেট লাভ করেন । এরপর ইনজুরি সমস্যা কারনে ২০১৬ সালে টি২০ বিশ্বকাপে অধিনায়ক পদ থেকে সরে দাঁড়ান ।

ওয়ানডে ক্রিকেটে ২২৬ ম্যাচে ম্যাচে ৩৩৮ উইকেট লাভ করেন। গড় ২৮.৮৭ । ইকোনমিক ৫.৩৫। ১৯ বার ইনিংসে ৪ উইকেট এবং ৮ বার ইনিংসে ৫ উইকেট লাভ করেন । ওয়ানডে বিশ্বকাপের মত বড় মঞ্চে ৪ বিশ্বকাপে ৫৬ উইকেট নেয় । বিশ্বকাপে রয়েছে ২ টা হ্যাট্রিক। শেষ বিশ্বকাপে এসে ও ওয়েস্টইন্ডিজ, আফগানিস্তান ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০ উইকেট নিয়ে দলকে জেতান।

লিস্ট “এ” ম্যাচে ২৯১ ম্যাচ খেলে ৪৪৬ উইকেট নেন মালিঙ্গা।

আন্তর্জাতিক টি-২০তে ৮৪ ম্যাচে ১০৭ উইকেট নেন মালিঙ্গা। সর্বোচ্চ ৬/৫ উইকেট । ১ বার ইনিংসে ৪ উইকেট নেন মালিঙ্গা। ২ বার ৫ উইকেট শিকার করেন।

টি২০ বিশ্বকাপে ৩১ ম্যাচে ৩৮ উইকেট নেন মালিঙ্গা।

বাংলাদেশের বিপক্ষে ৬ ম্যাচে আছে ১১ উইকেট ।

মালিঙ্গার স্লোয়ার ডেলিভারি বল গুলো বুঝা এতই কষ্ট সাধ্য যে খেলা কঠিন হয়ে যায় । তারই শিকার বাংলাদেশ। মাশরাফির টি-২০ বিদায় ম্যাচে প্রথম ৩ ওভার কোন উইকেট নিতে না পারলে শেষ ওভারে এসে হ্যাট্রিক করেন। মুশফিক রহিমকে স্লোয়ার অফ কাটারে বোল্ড করেন । বিদায়ী ম্যাচে মাশরাফিকে গোল্ডেন ডাকের সাথে বোল্ড করেন । এবং মেহেদী মিরাজকে এলবি ডব্লিউ আউট করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪র্থ হ্যাট্রিক করেন মালিঙ্গা । তারপরও ম্যাচে বাংলাদেশ ৪৫ রানে জয় লাভ করে।

টেস্ট , ওয়ানডে থেকে অবসর নিলেও টি২০ লীগ গুলোতে নিয়মিত দেখা যায় + দেখা যেত এই আগ্রাসী, কোঁকড়া চুলের বোলারকে । শ্রীলংকা ছাড়াও নিজের দেশের টি২০ সহ অন্য সব দেশের টি-২০ লীগে খেলেন নিয়মিত। আইপিএলের সর্বোচ্চ১৭০ উইকেট শিকারি বোলার ও মালিঙ্গা । আইপিএলে সবচেয়ে বেশি ৪ উইকেট শিকার করেন মালিঙ্গা। তার খেলা ক্লাব গুলো বিসিসিএসএল একাডেমী একাদশ, গল ক্রিকেট ক্লাব, গায়ানা অ্যামাজন ওয়ারিয়র্স, জ্যামাইকা তালাওয়াহ, কেন্ট, মেলবোর্ন স্টার, মন্ট্রিল টাইগার্স, মুম্বাই ইন্ডিয়ানস, রুহুনা, রুহুনা রেডস, রুহুনা রয়্যালস, সাউদার্ন এক্সপ্রেস।

ঘরোয়া টি-২০ লীগ গুলোর সব চেয়ে দামী ঘোড়া মালিঙ্গা । ২৯৫ ম্যাচে ৩৯০ উইকেট নেন । ৫ বার ইনিংসে ৫ উইকেট নেন এবং ১০ বার ইনিংসে ৪ উইকেট নেন। সর্বোচ্চ ৬/৭ উইকেট ।

২৬ জুলাই ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেলেই আন্তর্জাতিক একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেয় এই শ্রীলঙ্কার ফাস্ট বোলার লাসিথ মালিঙ্গা। এবং শেষ ম্যাচের শেষ ওভারে শেষ বলে শেষ বলে মোস্তাফিজের উইকেট নিয়ে স্পেল শেষ করেন ৯.৪-২-৩৮-৩।

এত ক্ষণ যার কথা বলতেছিলাম তিনি লাসিথ মালিঙ্গা। সেই রথগামা গ্রামের এই মানুষটার আজ ৩৭ তম জন্মদিন ।

ভাল থাকুন মালিঙ্গা । শুভ কামনা জন্মদিনে। আপনার আগামী জীবন ভাল কাটুক এই কামনায় আমরা ক্রিকেটখোর।

, ,

মতামত জানান :