১৮ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

বিংশ শতাব্দীতে এ যুগের ব্যাটসম্যান

প্রতিবেদক
Marajul Islam
সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর , ২০২০ ১:১৪

১.
হ্যামিলনের বাশিওয়ালা গল্পটি সবাই জানলেও আরেকবার নতুন করে শুনাই।

হ্যামিলন নামক ছোট একটা শহর। হঠাৎ পুরো শহর জুড়ে দেখা গেল হাজার হাজার ইঁদুর। যেখানে যায় সেখানেই ইঁদুর। কোন বাচ্চা স্কুলে গিয়ে ব্যাগ খুলল। সেই ব্যাগেও গোটা পাঁচেক ইদুরছানা।

এমনই ইদুরেসময়ে সেই শহরে দেখা মিলল আজিব এক লোকের। পরনে খাটো নানান রঙ্গের আলখেল্লা, মাথায় চোঙ্গার মতো উপরে ঝুলে পড়া টুপি। হাতে লম্বা এক বাশি। আহা! কি সুন্দর সেই আাশির সুর।

ইদুঁরের সমস্যার জন্য বসা গনমান্য ব্যক্তিদের সভায় লোকটি গিয়ে বলল, সে ইদুঁর তাড়াতে সাহায্য করবে। সবাই এতে খুশি হল এবং ইঁদুর তাড়ানোর বিনিময়ে সে যা চায় তাই তারা দিবে বলে ওয়াদা করল। বাঁশিওয়ালা কিছু চাইল না।

তারপর সে তার বাঁশি বাজানো শুরু করল। আর শহর প্রতিটি গলি থেকে শুরু করে বাড়ি সব জায়গা থেকে ইঁদুর বেরিয়ে আসতে লাগল। এভাবে তার বাঁশির সুরে সব ইঁদুর বেরিয়ে গেল এবং ইদুরগুলো শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে পড়তে লাগল।

বাশিওয়ালা হ্যামিলনকে ইঁদুর মুক্ত করে শহরের মূল ফটকে আসেন এবং তাকে যারা বিভিন্ন কিছু দেবার ওয়াদা করল, তাদের কাছে তিনি তার সম্মানী চাইলেন। কিন্তু, তারা বাশিওয়ালাকে প্রত্যাখান করল। যা বাঁশিওয়ালাকে অনেক কষ্ট দিল এবং তিনি দুঃখ নিয়ে শহর ত্যাগ করল।

কিছুদিন পর বাশিওয়ালা আবার ফিরে এল হ্যামিলনে। তবে এবার তার পোষাক আগের চেয়ে লম্বা এবং টুপিটাও ভিন্ন। সে তার পকেট থেকে ছোট বাঁশিটি বের করল। আর আগের চেয়ে অন্যরকম সুর বের করতে লাগল। সেই সুরে হ্যামিলন শহরের সব বাচ্চারা ঘর থেকে বের হতে লাগল। বাঁশি ওয়ালা বাঁশি বাজাতে লাগল আর বাচ্চারা তার পিছু নিল। এভাবে তিনি সব বাচ্চাকে নিয়ে হ্যামিলন থেকে অনেক দূরে চলে গেলেন। এরপর বাচ্চারা আর বাঁশিওয়ালা কাউকেই আর হ্যামিলনে দেখা যায় নি।

প্রতীকী অর্থে যদি বাচ্চাগুলোকে রান ধরি তাহলে সাঈদ আনোয়ার হলেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। বাঁশিওয়ালা যেমন বাচ্চা গুলোকে হ্যামিলন শহর থেকে দূরে নিয়ে গেছে তার প্রাপ্য সম্মানী না পাওয়ায়। ঠিক একই ভাবে পাকিস্তান বোর্ড থেকে প্রাপ্য সম্মান না পাওয়ায় সাঈদ আনোয়ার বিদায় জানান ক্রিকেটকে। ঠিক যেমন ভাবে বাঁশিওয়ালা হ্যামিলন শহর থেকে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে গেছেন। সাঈদ আনোয়ারের অবসরের পর একই ভাবে পাকিস্তান দল ধারাবাহিক ভাবে ব্যাটিংয়ে ভালো সূচনা করতে পারে না। তারপর থেকে ওপেনিংয়ে পাকিস্তানের আর কোন ব্যাটসম্যান সুবিধা করতে পারেন নি।

২.
ক্যারিয়ার জুড়েই ছিলেন আক্রমণাত্বক ব্যাটিংয়ের প্রতিচ্ছবি। তার নিজের দিনে ছাড় পেত না বিশ্ব সেরা বোলারটাও। তাও বুঝেশুনে ব্যাটিং না। আক্রমণ আর আক্রমণ। ট্রের্ডমার্ক ফ্লিকে জানান দিতেন তার সার্মথ্য। আর স্পিনে কার্যকরী ফুটওয়ার্কের সাথে সোজা ব্যাট আর ক্রস ব্যাট দুই জায়গাতেই ছিলেন সফল।

ক্যারিয়ারের শেষ ওয়ানডেতেও ছিলেন ৪৫ বলে ৪০ রানে অপরাজিত। ২০০৩ বিশ্বকাপের পর আর কোন ম্যাচ খেলেননি। সেই বিশ্বকাপে ৫৪.৫০ গড়ে করেন ২১৮ রান। আর শেষ টেস্টে করেন সেঞ্চুরি।

এরপরও ২০০৩ সালে তারকাবহুল দলের বিশ্বকাপ ভরাডুবিতে বলির পাঠা হন তিনি। ভাল ফর্মে থাকা সত্বেও বিশ্বকাপের পর আর দলে ডাক পাননি। বয়সটা সেই সময় ৩৪ ছুইছুই করলেও ফর্মের সাথে ফিটনেসটাও ছিল দুর্দান্ত। তাছাড়া, তিনি ছাড়া আর কোন নিয়মিত পারফর্ম করা ওপেনারও পাকিস্তান দলে ছিল না। এত কিছুর পরও বোর্ডের নির্বাচকরা হয়ত ভুলে গিয়েছিল যে, সাঈদ আনোয়ার নামে একজন বিশ্বসেরা ওপেনার আছে পাকিস্তান দলে। তাই দুই বছর অপেক্ষার পর বাধ্য হয়ে জাতীয় দল থেকে দেন অবসরের ঘোষণা। অথচ, তার সাথে যাকে সবচেয়ে বেশী তুলনা করা হত সেই শচীন ঐ বয়স থেকেই ছাড়িয়ে যেতে থাকেন সবাইকে, হয়ে যান সবার সেরা। আর সাঈদ আনোয়ার! হয়ে থাকলেন, যিনি তার সময়ের সেরা।

যেদিন তিনি তার শেষ টেস্ট সেঞ্চুরি করেন সেদিনই তার মেয়ে মারা যান। এই দুঃখ নিয়ে ক্যারিয়ার শেষে মনোযোগ দেন ধর্মকর্মে। যোগ দেন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক সংগঠন তাবলীগ জামায়াতে।

ক্যারিয়ারের শেষে দারুণ ফর্মে থেকেও বাদ পড়ে সবার আক্ষেপের পাত্র হলেও ক্যারিয়ারের শুরুটা কিন্তু খুব বাজে ছিল। প্রথম ১১ ওয়ানডেতে করেন ১৮৪ রান। ছিল না কোন পঞ্চাশ রানের ইনিংস।আর টেস্টে শুরুটাতো ছিল আরও বাজে, প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসেই করেন শূন্য রান।

তবে ১২ তম ওয়ানডেতে গিয়ে জাত চেনান নিজের। এডিলেড ওভালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেন ৯৯ রানে ১২৬ রানের ইনিংস। ইনিংসটি সেই সময়তো বটেই এই ২০২০ সালেও যদি কোন তরুণ ব্যাটসম্যান এমন ইনিংস খেলেন, তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যাবে। তার সাথে যদি খেলাটা অস্ট্রেলিয়ার মাঠে কোন উপমহাদেশীয় দলের ব্যাটসম্যানের হয়। তারপর আর ৯ ম্যাচ আরও একটি সেঞ্চুরি। এবার ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ১০১ রানের ইনিংস। কিন্তু তারপরও হতে পারেননি ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান দলের অংশ। তবে বিশ্বকাপের পরে থেকে জাতীয় দলে নিয়মিত খেলতে থাকেন। ধীরে ধীরে পরিণত হন পাকিস্তান দলের সেরা ব্যাটসম্যানে।

বিশ্বকাপের পরের বছর ১৯৯৩ সালে ১৫ ইনিংসে ৫১.৭১ গড়ে করেন ৭২৪ রান। সেঞ্চুরি ছিল ৪ টি আর স্ট্রাইক রেটও ছিল সেই আমলের তুলনায় অনেক ভালো। প্রায় ৮২ এর মত। তারপরের বছর ২৮ ইনিংসে ১ সেঞ্চুরিতে করেন ৮৪৬ রান। ১৯৯৫ সালটা ভাল না গেলেও ৯৬ সালে ফিরে আসেন দুর্দান্তভাবে। ৩৬ ইনিংসে ৫১.৪৫ গড়ে করেন ১৫৯৫ রান। সেঞ্চুরি ছিল ৩ টি আর স্ট্রাইক রেটও ছিল ৯০ এর উপরে। এর মধ্যে বিশ্বকাপে ৮২.২৫ গড়ে করেন ৩২৯ রান, স্ট্রাইক রেট ছিল ৯৫। বিশ্বকাপে প্রতিটি ম্যাচেই পাকিস্তানকে দুর্দান্ত শুরু এনে দিলেও সেই সুবিধা কাজে লাগাতে পারেনি তারা। ফলে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বাদ পড়তে হয় তাদের।

৯৬ বিশ্বকাপের পর সাঈদ আনোয়ার পরিণত হন বিশ্বসেরাদের একজনে। ঐ সময়টায় তার সাথে শচীন টেন্ডুলকারের ব্যাপক তুলনা হত। এখন যেমন বিরাট কোহলি না স্টিভ স্মিথ কে সেরা, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। সেই সময়টা হত সাঈদ আনোয়ার আর শচীন টেন্ডুলকারের মধ্যে।

১৯৯৭ সালে তিনি ভারতের বিপক্ষে খেলেন ১৯৪ রানের ইনিংস। তিনি যখন আউট হন তখনও দলের দুই ওভার বাকি ছিল। তার মানে তিনি সেই সময় ডাবল সেঞ্চুরিও করতে পারত। তারপরও ২৩ বছর আগে ওয়ানডেতে ১৯৪ রানের ইনিংস খেলা মোটেও সহজ ছিল না। এই ইনিংসের মাধ্যমে তিনি ভিভিয়ান রিচার্ডসের করা অপরাজিত ১৮৯ রানের ইনিংসের রেকর্ড ভাঙ্গেন, যা সেই ইনিংসটির আগে ছিল ওয়ানডে ইতিহাসের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। সাঈদ আনোয়ারের করা ১৯৪ রানের ইনিংসটি এক যুগেরও বেশী সময় ধরে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ছিল। পরে ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের চার্লস কভেন্ট্রী ১৯৪ রানে অপরাজিত থেকে সেই রেকর্ডে ভাগ বসান। পরে ২০১০ সালে শচীন সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০০ রানে অপরাজিত থেকে সেই ইনিংসকে ছাড়িয়ে যান। মজার ব্যাপার হলো তার অবসরের ৭ বছর পর তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী শচীন টেন্ডুলকার তার রেকর্ড ভাঙ্গেন।

সাঈদ আনোয়ার বরাবরই ছিলেন ম্যাচ উইনার। তিনি যখন খেলতেন এই দৃশ্যটা নিয়মিতভাবে দেখা যেত, পাকিস্তান দলের একের পর এক উইকেটের পতন হচ্ছে আর অপর প্রান্তে তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। ওয়ানডেতে মোট ১২ বার ক্যারী দ্যা ব্যাট এর ছোট তালিকায়ও আছে তার নাম। শুধু ওয়ানডেতে নয় প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আছে দুই ফর্মটেই ব্যাট ক্যারী করার রেকর্ড। মোট ২৪৭ ওয়ানডেতে ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হন ২৮ বার। পাকিস্তান দলে এর চেয়ে বেশী বার ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হয়েছে শাহিদ আফ্রিদি, ৩২ বার। তাও তার চেয়ে ১৫১ টি ম্যাচ বেশী খেলে। আর তার খেলা তিন বিশ্বকাপে তিনিই ছিলেন পাকিস্তান দলের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী। কমপক্ষে তিনটি বিশ্বকাপ খেলা কোন ব্যাটসম্যানেরই এই রেকর্ড নেই। বিশ্বকাপে ২১ ম্যাচে ৫৩.৮২ গড়ে তিনি করেন ৯১৫ রান। পাকিস্তানের হয়ে বিশ্বকাপে এর চেয়ে বেশী রান করেন জাভেদ মিয়াদাদ। যার জন্য মিয়াদাদকে খেলতে হয়েছে ৬ টি বিশ্বকাপ।

তাকে ওয়ানডের খেলোয়াড় হিসেবে ধরা হলেও টেস্টেও তিনি সফল ছিলেন। সাদা পোশাকের ক্রিকেটেও ধরে রাখেন তার আক্রমণত্বক মানসিকতা। ওয়ানডের মত আক্রমণাত্বক মানসিকতা ধরে রেখে খেলে যেতেন লম্বা টেস্ট ইনিং। টেস্টে কোন সময়ে দুই শতাধিক রান না করলেও বিরূপ কন্ডিশনে তার লম্বা ইনিংস প্রশংসনী।

টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে যেখানে বড় বড় ব্যাটসম্যানকে নাকানি চুবানি খেতে হয়। সেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৫ ইনিংসে ৫৯.০৭ গড়ে করেন ৮৮৬ রান। শুধু তাই নয় SENA এর চার দেশে যেখানে উপমহাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাট ব্যাটিং করা ভুলে যায়। সেই দেশে গিয়ে তিনি ২৮ ইনিংসে ৩৯.৭৫ গড়ে করেন ১১১৩। এ থেকে তার ভিন্ন পজিশনে খাপ খাইয়ে নেবার পারদর্শিতা বুঝা যায়।

তার ক্যারিয়ার সেরা ১৮৮ রানের ইনিংসটিতে তাকে কেউ আউট করতে পারে নি। অথচ সেই ইনিংসে ভারতের জাভাগাল শ্রীনাথ নেন ৮ উইকেট। একজন বোলার যখন ৮ উইকেট নেয়, তখন সেই ইনিংসে তিনি কি রকম বোলিং করতে পারে তা সবারই জানা আছে। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে ওপেনিংয়ে নেমে ১৮৮ রানের ইনিংস। নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এছাড়াও হোম এবং এওয়ে দুই ভেন্যুতেই তিনি ছিলেন সমান ভাবে উজ্জ্বল। ঘরের মাঠে যেখানে ৪২ ইনিংসে ৪৫.৩৭ গড়ে করেন ১৮৬০ রান, তার চেয়েও উজ্জ্বল ছিলেন বাইরের দেশে। সেখানে ৪৯ ইনিংসে ৪৫.৬৭ গড়ে করেন ২১৯২ রান। ঘরে যেখানে রয়েছে ৪ টি সেঞ্চুরি সেখানে বাইরে করেন ৭ টি সেঞ্চুরি।

২০০১ সালে তিনি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে শেষ টেস্ট খেলেন। সেই টেস্ট চলাকালে তার মেয়ে মৃত্যুবরণ করে। তার খেলা শেষ টেস্টে তিনি সেঞ্চুরি করেন। এই টেস্টের পরই তিনি খেলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বলা যায়।

৩.
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের সিন্ধে জন্মগ্রহন করা এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের পিতাও ছিলেন একজন ক্রিকেটার। তার ভাইও খেলেছেন পাকিস্তান অনূর্ধ্ব ১৯ দলে। পিতা ব্যবসায়িক কারণে ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারেননি। ব্যবসায়িক কাজে তিনি দেশের বাইরে থাকতে শুরু করলে সাঈদ আনোয়ারও ছোট বেলায় তার সঙ্গী হন। এজন্য তাকে থাকতে হয়েছে ওমান এবং সৌদি আরবে।

তবে সাঈদ আনোয়ার পড়াশোনায় যথেষ্ট মেধাবী হওয়ায় ইচ্ছে করলেই ক্যারিয়ারটা অন্য খাতে প্রবাহিত করতে পারতেন। ১৯৮৯ সালে করাচীর NED বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্র্যাজুয়েট করা একজন মানুষের পক্ষে অন্য কিছু করা সম্ভবও ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মাস্টার্স করার পরিকল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটেই মন দেন সাঈদ আনোয়ার।

এই মেধার ছাপ তিনি যেমন ব্যাটিংয়ে রেখেছেন, একই ভাবে জাতীয় দলের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই মেধার মূল্যায়ন করেছেন। তিনি দলের হয়ে বেশ কিছু চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত নেন যা দলকে যথেষ্ট সাহায্য করে।

Saeed Anwar sporting a luxuriant growth of hair had another fine knock

তিনি অধিনায়ক থাকাকালীন ইজাজ আহৃেদকে পিঞ্চ হিটার হিসেবে ওপেনিং করান। ৮৪ বলে অপরাজিত ১৩৯ রানের একটা ইনিংস খেলে অধিনায়কের আস্থার প্রতিদানও দিয়েছিলেন। যদিও ৭ টেস্ট আর ১১ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে তেমন সাফল্য পাননি।

এছাড়া শহীদ আফ্রিদী নামক এক পাঠান তরুণের উত্থানের পেছনেও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। লেগ স্পিনার হিসেবে স্কোয়াডে ডাক পাওয়া এই তরুণকে নেটে ব্যাটিং করতে দেখে তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে ওঠে। সেই বুদ্ধির ফলাফল হচ্ছে পরের দিন আফ্রিদির ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পেয়ে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামেন এবং ৩৭ বলে সেঞ্চুরি করে তৎকালীন দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন। যা প্রায় ১৯ বছর ধরে ওয়ানডেতে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড ছিল।

২০০৩ সালে অবসর গ্রহনের পর ধর্মীয় কাজে মনোযোগ দেন। যোগ দেন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক সংগঠন তাবলীগ জামায়াতে। মোট ৫৫ টেস্টে ৯১ ইনিংসে ৪৫.৫২ গড়ে করেন ৪০৫২ রান। সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ভারতের বিপক্ষে অপরাজিত ১৮৮ রান। সেঞ্চুরি ছিল ১১ টি এবং হাফ সেঞ্চুরি ২৫ টি।

আর ২৪৭ ওয়ানডেতে ৩৯.২১ গড় আর ৮০.৬৭ স্ট্রাইক রেটে করেন ৮৮২৪ রান। যেখানে ৪৩ টি হাফসেঞ্চুরির সাথে ছিল ২০ টি সেঞ্চুরি। আর সর্বোচ্চ ছিল ভারতের বিপক্ষে ১৯৪ রানের ইনিংস।

১৪৬ টি ফাস্ট ক্লাস ম্যাচে ৩০ সেঞ্চুরিতে করেন ১০১৬৯ রান। ৩২৫ লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে করেন ১১২২৩ রান। যেখানে গড় ছিল ৩৭.৯১ আর সেঞ্চুরি ছিল ২৬ টি।

ক্যারিয়ারে প্রায় ৩০০ উপরে ম্যাচ খেলে সাঈদ আনোয়ারের আছে অনেক রেকর্ড। তার ক্যারিয়ারের বেশ কিছু রেকর্ড নিচে উল্লেখ করা হল,

টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরি করা, ওয়ানডেতে এইরকম ঘটনা ঘটেছে ১১ বার। এই ১১ বারের মধ্যে রয়েছে সাঈদ আনোয়ারের নাম।
নিজের ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি করা ৩৩ জন ব্যাটসম্যানের মধ্যে তিনি একজন। তাদের মধ্যে পাঁচ জন অভিষেকে শূন্য রান করেন। তিনি সেখানেও আছেন।আর তিনিই একমাত্র যিনি অভিষেক টেস্ট পেয়ার এবং শেষ টেস্টে সেঞ্চুরি করা প্লেয়ার।
দীর্ঘ ১৩ বছর অক্ষত থাকা ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ১৯৪ রানের ইনিংসের মালিক ছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম কোন ওয়ানডে ব্যাটসম্যান যিনি ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথমবারের মত ১৯০ রানের ইনিংস খেলেন।
২৪৭ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ম্যাচ সেরা হন ২৮ বার। অথাৎ প্রতি ১০ ম্যাচে একবার করে ম্যাচসেরা। পাকিস্তান দল তার চেয়ে বেশী ম্যাচ সেরা হন শাহিদ আফ্রিদি,৩২ বার। তাও তার চেয়ে ১৫১ টা ম্যাচ বেশী খেলে।
ওয়ানডেতে তার মোট ২০ সেঞ্চুরির মধ্যে মাত্র ৩ টি ম্যাচ পাকিস্তান হেরেছে। আর পাকিস্তানের পক্ষে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক তিনি।
ইনজামাম উল হক আর মোহম্মদ ইউসুফের পর পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।
মোট তিনটি বিশ্বকাপ খেলে তিনবারই পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। কমপক্ষে তিন বিশ্বকাপ খেলা কোন ব্যাটসম্যান এর এই রেকর্ড নেই।
পাকিস্তানের হয়ে তিনি মোট সিরিজ খেলেন ৬৫ টি। এর মধ্যে ৮ বার হন সিরিজ সেরা। যা ঐ সময়ে পাকিস্তানের পক্ষে সর্বোচ্চ। এই ৬৫ টি সিরিজের মধ্যে পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহ করেন ১৯ বার। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন ১০ বার। অথাৎ ৬৫ সিরিজে ২৯ বারই তিনি প্রথম বা দ্বিতীয় রান সংগ্রাহক ছিলেন।
১৯৯৬ সালে তিনি ৩৬ ম্যাচে করেন ১৫৯৫ রান। যা এক পঞ্জিকাবর্ষে ওয়ানডেতে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ রান। আর পাকিস্তানের হয়ে এক বছরে সর্বোচ্চ। তার আগে রয়েছে শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, মেথ্যু হেইডেন আর সৌরভ গাঙ্গুলির নাম।
আমির সোহেলকে সাথে নিয়ে তিনি মোট ৭৩ ইনিংস ওপেন করেন। যাতে তারা সংগ্রহ করেন ২৮৫৬ রান। এর মধ্যে ছিল ৩টি একশ রানের অধিক পার্টনারশিপ। তাদের জুটিই ওয়ানডেতে পাকিস্তানের সেরা ওপেনিং জুটি। আর রান বিবেচনায় ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসের ১৪ নম্বরে। এছাড়া, ইমরান নাজিরের সাথে জুটি বেধে ২১ ইনিংসে করেন ৮০৬ রান।
ওয়ানডে ক্রিকেটে ১৫ তম সর্বোচ্চ ৯৩৮ টি চার এসেছে তার ব্যাট থেকে।
ওয়ানডেতে ওপেনিংয়ে ৭ম সর্বোচ্চ ৮১৫৬ রানের মালিক তিনি।
ওয়ানডেতে এক ভেন্যুতে সবচেয়ে বেশী সেঞ্চুরি করার রেকর্ড তার দখলে। তিনি শারজায় ৭ টি সেঞ্চুরি করে শচীন টেন্ডুলকার আর রিকি পন্টিং এর সাথে যৌথভাবে শীর্ষে আছেন।
বর্তমান সময়ে রান বল সমান থেকে বড় ইনিংস অহরহ দেখা গেলেও ৯০ এর দশকে সেই সংখ্যা ছিল খুব নগন্য। সেই কীর্তি সাঈদ আনোয়ার ঐ সময়েই অনেক বার করেন। তার একসময়ের ব্যাটিং পার্টনার রমিজ রাজা তার বিস্ফোরক ব্যাটিং সম্পর্কে বলেন,
“Anwar used an eclectic approach to batting – classical betrothed to unorthodox, footwork against spin as quick as a hiccup supple yet powerful to brush the field like a Picasso.”

আর ১৯৯৭ সালে তিনি যখন উইজডেন মনোনিত সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন হন তখন উইজডেন তার ব্যাটিংয়ের বর্ণনা দিয়ে বলেন,

“moved his front foot and head well across, then his wrists hovered, hawk-like, over the advancing ball, extending further and further as if they were elastic if the ball was slanted ever more away from him, before the bat flowed into a square-drive to the boundary”

তার অবসরের পর থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তান দল তার পরিবর্তে আর একজন নির্ভরযোগ্য ওপেনার খুজে পায় নি। তার অবসরের দীর্ঘদিন কোন বাঁহাতি ব্যাটসম্যানও পাকিস্তানের হয়ে সফল হতে পারেনি। তিনি ছিলেন ওয়ানডের এল পিকাসো।শচীন টেন্ডুলকার আর সনাথ জয়াসুরিয়াকে যেমন ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাস বদলে দেবার কারিগর বলা হয়। তাদের সাথে সেই ইতিহাস বদলের খেলায় তার অবদান আছে।

,

মতামত জানান :