১৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

ইয়ান বেলঃ ক্লাসিক ব্যাটিংয়ের ধারক

প্রতিবেদক
Marajul Islam
মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর , ২০২০ ১১:৪০

  • ৯ মার্চ, ২০১৫

বাংলাদেশের জন্য ম্যাচটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলেও ইংল্যান্ড দলের জন্য ছিল হতাশায় মুড়ানো একটি দিন। কিন্তু, সেই শোককে তারা পরিণত করেছিল শক্তিতে। দলে এনেছিল একের পর এক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের ফলও তারা পেয়েছে খুব মধুর ভাবে। হয়েছে ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ান। গল্পটা হয়তো এমনিই লেখা হয়ে থাকবে ইতিহাসে। কারণ ইতিহাস সবসময় বিজয়ীদের মনে রাখে। ভুলে যায় ছোট ছোট অর্জনগুলোকে। একজন ক্রিকেটার হয়তো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব সফল হয়নি, কিন্তু তার কাছে ক্রিকেটার হওয়ার পথটা কিন্তু সবসময় চ্যালেঞ্জিং ছিলো। কিন্তু অসফলতা তাকে মহাকালের গহব্বরে ফেলে দেয়। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই হারে ইয়ান বেলের সেই ইনিংসটিও জায়গা করে নেয় ব্যর্থদের দলে। মূলত সেই ম্যাচের মধ্যে দিয়ে শেষের শুরু হয় তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার।

যখন থেকে আমি গুগলে সার্চ করা শিখেছি, তখন থেকেই খেলোয়াড়দের পরিসংখ্যান ঘাটা আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। এভাবেই একদিন ঘাটলাম ইয়ান বেলেরটা। তাকে দেখতে কম বয়স্ক লাগলেও তার বয়স দেখে প্রথমে অবাক হই। অবাক হওয়ার জন্য আরও কিছু ছিলো। ২০০৬ সালে অভিষেকের মাত্র এক বছরের মাথায় পান ব্রিটিশ রাজদরবার থেকে সম্মানীয় এমবিই। কখনও কেভিন পিটারসেন, কখনও এন্ড্রু স্টর্স কিংবা এলিস্টার কুকদের আড়ালে থাকা এই ইংলিশ ক্রিকেটার বিখ্যাত ছিলেন তার ক্লাসিক কাভার ড্রাইভের জন্য। হয়তো কুমার সাঙ্গাকারার কাভার ড্রাইভ একদম তার নিজের মত ছিল, ট্রেডমার্ক যাকে বলে। আর ইয়ান বেলেরটা একদম কপিবুক স্টাইলের, তা যে কোন এংগেল থেকে। তাকে বলা যায় ক্লাসিক ব্যাটিংয়ের প্রতিচ্ছবি।

এস্টন ভিলা ফুটবল ক্লাবের ফ্যান ইয়ান বেল ১৯৮২ সালের ১১ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ৭ বছর বয়সে সে স্থানীয় ক্রিকেট লীগের জুনিয়র লেভেলে খেলা শুরু করেন। আর একটা বলে রাখি, এস্টন ভিলার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হল কভেন্ট্রি সিটি। এস্টন ভিলার পারিবারিক সাপোর্টার হলেও বেল ছোটবেলায় কিন্তু এই কভেন্ট্রি সিটির ফুটবল স্কুলেও দীক্ষা নেন।

ওয়ারউইকশায়ারের ২য় একাদশের হয়ে ১৯৯৮ সালে মাঠে নামেন বেল। তারপর ১৯৯৯ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে অভিষেক হয় ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে। তারপর প্রায় ২ বছর খেলেন ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে। সফর করেন নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, ভারত এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজে। নিউজিল্যান্ডে অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে টেস্ট খেলার সময় স্যার রিচার্ড হ্যাডলির বড় ভাই ডেইলি হ্যাডলি তাকে তার(ডেইলি) দেখা ১৬ বছর বয়সী সেরা ক্রিকেটার বলেন। তাকে (বেল) তুলনা করেন সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক মাইক আথারটনের সাথে।

অনূর্ধ্ব ১৯ এর পাঠ চুকিয়ে তিনি কাউন্টি ক্রিকেটে নিয়মিত খেলা শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে অভিষেকে ০ রান করে আউট হওয়ার পর তিনি আর ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেন নি। ২০০১ সালের কাউন্টি চ্যাম্পিয়ানশীপে ১৬ ইনিংসে করেন ৮৩৬ রান। যেখানে ছিল ৩ টি সেঞ্চুরি এবং ২ টি ৯৮ রানের ইনিংস। এর মধ্যে অক্সফোর্ড ইউসিসিই’র সাথে তার করা ১৩০ রানের ইনিংসটি ছিল ওয়ারউইকশায়ার কাউন্টি ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরির রেকর্ড। মাত্র ১৯ বছর ৫৬ দিনে তিনি সেঞ্চুরিটি করেন।

তারপর তিনি ইংল্যান্ডের ক্যাম্পে যুক্ত হন। সেখানে থেকে ঐ শীতে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখান থেকে ফিরে আসার পরপরই তাকে মার্ক বুচারের বিকল্প হবে সেবে নিউজিল্যান্ড সফরের জন্য ইংল্যান্ড স্কোয়াডে রাখা হয়। ২০০২ সালে তিনি ২৪.৩৭ গড়ে করেন মাত্র ৬৩৭ রান। তবে বেনসন এন্ড হেজেস কাপে তিনি তার ব্যাটের জাদু দেখান। কোয়ার্টার থেকে ফাইনাল পর্যন্ত তিন ইনিংসের মাত্র ১ টিতে আউট হন। এভাবে দলকে শিরোপা জিততে সাহায্য করেন। নিজে হন ঐ আসরের গোল্ড মেডেল বিজয়ী।

২০০৩ সালেও তার ফর্মের কোন উন্নতি হয় নি। ওয়ানডে লীগে ২৮.৮৫ গড়ে করেন ৭৭৯ রান। আর ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচগুলোতে ৪৩ গড়ে করেন ৫৬০ রান। তবে একটা ওয়ানডে ম্যাচে ১২৫ বলে ১১৩ রান এবং ৪১ রানে ৫ উইকেট নেন। তার কাউন্টি ইতিহাসে মাত্র ২ জন প্লেয়ারই সেঞ্চুরি এবং পাঁচ উইকেটের কীর্তি গড়েন। তবে, ২০০৪ সালে তার ফর্মের উন্নতি দেখা দেয়। সেই বছর কাউন্টি চ্যাম্পিয়ানশীপে ১৪৯৮ রান করেন। এর মধ্যে ছিল সাসেক্স এর বিপক্ষে অপরাজিত ২৬২ রান। ১০ ঘন্টার কিছু সময় কম ব্যাট করেন তিনি। যা তাকে তার কাউন্টির সবচেয়ে কমবয়সী ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের গৌরব এনে দেয়। আর এই পারফরম্যান্স তাকে ইংল্যান্ড দলে ডাক পেতে সাহায্য করে। গ্রাহাম থপ ইনজুরিতে পড়লে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিপক্ষে জন্য ইংল্যান্ড দলে ডাক পান।

আন্তজার্তিক ক্যারিয়ার

২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচে ইয়ান বেলের অভিষেক হয়। প্রথম ইনিংসে তিনি ৭০ রান করেন। তারপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফলোআনে পড়ে এবং ইংল্যান্ড ১০ উইকেটে ম্যাচটি জিতে গেলে তার আর ব্যাটিংয়ের সুযোগ হয় নি। তারপর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তার ওয়ানডে অভিষেক হয়। সেই ম্যাচে ওপেন করতে নেমে তিনি ৭৫ রান করেন এবং অভিষেকেই ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হবার গৌরব অর্জন করেন। পরে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট খেলার সুযোগ না পেলেও সাত ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে তিনি প্রথম চারটি ম্যাচ খেলেন। সেখানে তিন ইনিংসে করেন ২৬ রান।

তারপর দল থেকে বাদ পড়েন। তবে সেই সিজনে তিনি ধারাবাহিক রান করতে থাকেন। এপ্রিল মাসে কাউন্টি ক্রিকেটে করেন রেকর্ড ৪৮০ রান। ফলে ডাক পান বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে। সেখানে বাংলাদেশ দুই টেস্টে ফলোআনে পড়লে তিনি ব্যাটিংয়ের সুযোগ পান দুই ইনিংস। লর্ডসে তিনি করেন অপরাজিত ৬৫ রান এবং চেস্টার-লি-স্টেটে করেন অপরাজিত ১৬২ রান। এই সেঞ্চুরির মাধ্যমে তিনি ১৯৩৫ সালের পর প্রথম কোন ইংলিশ ব্যাটসম্যানের মর্যাদা লাভ করেন যে টেস্টে লাঞ্চ বিরতির আগে সেঞ্চুরি করেন।

তারপর আসে ঐতিহাসিক ২০০৫ সালের অ্যাশেজ সিরিজ। সেই সিরিজে তিনি এবং কেভিন পিটারসেন ছিলেন ইংল্যান্ডের কালো ঘোড়া। কেভিন পিটারসেন সফল হলেও তিনি সেই রকম ভাবে সফল হতে পারেননি। লর্ডসে সিরিজের প্রথম ম্যাচে প্রথম ইনিংসে তিনি করেন ৬ রান। যার ফলে তার এভারেজ হয় ৩০৩। এই এভারেজ যে কোন প্লেয়ার যে কোন সময়ে সর্বোচ্চ এভারেজের তালিকায় ৬ নম্বরে আছে। পুরো সিরিজে খারাপ ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী দেখালেও ওল্ড টার্ফোডে তিনি দুই ইনিংসেই ফিফটি করেন। শেন ওয়ার্নের স্পিনের বিপক্ষে তার খেই হারানো অব্যাহত ছিল পরের ম্যাচেও। দুই ইনিংসে আউট হন শূন্য রানে। মাত্র ১৭ এভারেজ নিয়ে শেষ করেন সিরিজ, যা ছিল ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবুও তিনি স্বাদ পান প্রথম অ্যাশেজ জয়ের। ২০০৬ সালে মনোনিত হত ব্রিটিশ রাজদরবারের সম্মানজনক এমবিই এর জন্য।

এই অ্যাশেজ খারাপ যাওয়ার পরও তিনি পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের ১৭ জনের স্কোয়াডে ছিলেন। অধিনায়ক মাইকেল ভনের ইনজুরিতে সুযোগ পান একাদশে। সেই সিরিজে ৫২.১৬ গড়ে ৩১৩ রান করে ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন। সাথে তুলে নেন নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট উইকেট। সেই সময় দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মোহম্মদ ইউসুফকে কট এন্ড বোল্ড করে তুলে নেন টেস্টে তার একমাত্র উইকেটটি। তারপর বেল আসেন তার প্রথম উপমহাদেশ সফরে। ভারতের বিপক্ষে সেই সিরিজের প্রথম ম্যাচে তিনি দলীয় সর্বোচ্চ ৭৮ রান করলেও পরের ম্যাচগুলোতে খেই হারিয়ে ফেলেন। ফলে সিরিজে তিনি করেন মাত্র ১৩১ রান।

তারপর ইংল্যান্ডের মাটিতে শ্রীলঙ্কা সিরিজের প্রথম ম্যাচে ১৩ সদস্যের স্কোয়াডে তিনি ডাক পেলেও টিম কম্বিনেশনের কারণে একাদশে জায়গা হয়নি। পাকিস্তানের বিপক্ষে পরবর্তী সিরিজে এন্ড্রু ফিলিন্টফের ইনজুরিতে আবার একাদশে জায়গা পান এবং সবসময় যেখানে ৪ এ ব্যাট করতেন সেই সিরিজে ব্যাট করেন ৬ এ। প্রথম তিন টেস্টের তিন ইনিংসে তিনি সেঞ্চুরি করেন। চতুর্থ টেস্টে করেন ৯ রান। পুরো সিরিজে ৯৩ গড়ে ব্যাটিং করেও তিনি সিরিজ সেরা হতে পারেননি। তিনি পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে দলেও ডাক পান। সোফিয়া গার্ডেনে করেন ৮৮ রান (সেই সময়কার সর্বোচ্চ) এবং ট্রেন্ট ব্রিজে করেন ৮৬ রান।

২০০৬ সালের চ্যাম্পিয়ান্স লীগে তিনি মাইকেল টেস্টারহুকের বদলে ওয়ানডে দলে জায়গা পান। ইংল্যান্ডের হয়ে ওপেনিং করে ৩ ইনিংসে করেন ৯৭ রান। ইংল্যান্ড সেই টুর্নামেন্টে ২ ম্যাচে হেরে গ্রুপ পর্বেই বিদায় নেয়। ২০০৬ সালের ফিরতে অ্যাশেজে ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়ার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়। পুরো সিরিজে বেল ৩৩.১০ গড়ে করেন ৩৩১ রান। ঐ সফরটা ছিল ইংল্যান্ডের জন্য বিভীষিকাময়। সেই সফরের ওয়ানডে ত্রিদেশীয় ফাইনালে যদিও ইংল্যান্ড জিতে যায়। দুই ফাইনালের মধ্যে প্রথমটিতে বেল করেন ৬৫ রান। তারপর বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডের স্কোয়াডে ছিলেন বেল। সেখানে পুরো টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডের ৩ নম্বর পজিশনে ব্যাট করেন। তবে সাফল্য ছিল না। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওপেনিংয়ে নেমে করেন ৭৭ রান। আর শেষ ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দল থেকে বাদ পড়েন। উল্লেখ্য, সেটা ছিল ক্যারিবীয় গ্রেট ব্রায়ান লারার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

বিশ্বকাপের পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের চতুর্থ ম্যাচে ইয়ান বেল লর্ডসে সেঞ্চুরি করে। তার সাথে ঐ ম্যাচে এলিস্টার কুক, পল কলিংউড এবং মাট প্রায়রও সেঞ্চুরি করে। ১৯৩৮ সালের পর ইংল্যান্ডের চার ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি করার রেকর্ড এটি। ছয় নম্বরে নেমে সেঞ্চুরি করার ফলে ছয় নম্বর পজিশনে তার গড় ছিল সেইসময় অবিশ্বাস্য ভাবে ৪৮৪। ২১ আগস্ট ২০০৭ সালে ভারতের বিপক্ষে বেল করেন ১২৬ রান। যা ছিল ওয়ানডেতে তার প্রথম সেঞ্চুরি। ২০০৮ সালের নিউজিল্যান্ড সফরে তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হয়ে টেস্টে ২,৫০০ রান করার গৌরব অর্জন করেন। সেই বছর সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে তিনি টেস্টে ১৯৯ রান করে আউট হয়ে যান। ইংলিশ টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ১৯৯ রানে আউট হওয়া ব্যাটসম্যান। তারপর তার বাজে ফর্ম শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতা ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ইংল্যান্ডে অব্যাহত থাকে। ফলশ্রুতিতে বাদ পড়েন ইংল্যান্ডের স্কোয়াড থেকে। তবে বাদ পড়ার পর ঘরোয়া লীগে তিনি রান করে অ্যাশেজে ইংল্যান্ড দলে জায়গা পান। তৃতীয় টেস্টে কেভিন পিটারসেনের বদলে একাদশে জায়গা হয় তার। সেখানে একমাত্র ইনিংসে করেন ৫৩ রান। তারপর চতুর্থ টেস্টে ৮ এবং ৩ রান করেন। শেষ টেস্টে করেন ৭২ রান। পুরো সিরিজে ৫ ইনিংসের মধ্যে চারবারই বেল মিচেল জনশনের শিকার হন। জোনাথান ট্রটের বীরত্বে ইংল্যান্ড সেই সিরিজ ২-১ এ জিতে যায়।

২০১০ সালে সাউথ আফ্রিকা সফরে ডারবান টেস্টে বেল প্রায় ২ বছর পর সেঞ্চুরি করে। ১৪১ রানের ইনিংসের পরের চার ইনিংসে করেন ১৬৬ রান। বাংলাদেশ সফরে এসে ১০৫ বলে করেন ৮৪ রান। তারপর বাংলাদেশের ফিরতি সিরিজে করেন সেঞ্চুরি। যদিও এর পর ইনজুরির কারণে ওয়ানডে সিরিজ এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ খেলতে পারেননি। সেখান থেকে ঘরোয়া লীগে ফিরে আসেন। ৪০ ওভারের টুর্নামেন্টে ফাইনাল খেলেন।

২০১১ সালের অ্যাশেজে বেল ৬ নম্বরে ব্যাট করেন। পুরো সিরিজে করেন ৩২৯ রান। ইংল্যান্ড সেই সিরিজ ৩-১ ব্যবধানে জিতে যান। যা ছিল ১৯৮৬-৮৭ মৌসুমের অ্যাশেজের পর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ইংল্যান্ডের অ্যাশেজ জয়। তারপরে বিশ্বকাপের দলে তিনি জায়গা পান। যদিও বিশ্বকাপে তার বলার মত কোন কিছু ছিল না। ইংল্যান্ড সেই বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেয়। বিশ্বকাপের পর ভারতের বিপক্ষে টেস্টে ইয়ান বেল দলে অন্তর্ভুক্ত হন। সেই সিরিজ ৪-০ জিতে ইংল্যান্ড আইসিসি র্যাকিংয়ে শীর্ষস্থান দখল করে। এই সিরিজে তিনি দেখা পান তার ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির। ভারতের বিপক্ষে করেন ২৩৫ রান। সেই সিরিজে তিনি ১৫৯ রানের আরেকটি ইনিংস খেলেন। যা ঐ বছরের সেরা ইনিংসের তালিকায় স্থান করে নেয়। ঐ বছর আইসিসি মনোনিত বর্ষসেরা টেস্ট একাদশে তিনি জায়গা পান।

২০১২ সালে আরব আমিরাতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে তিনি ৬ ইনিংসে করেন ৫১ রান। সেই সিরিজে তিনি সাঈদ আজমলের বিপক্ষে প্রচুর পরিমাণে ভোগেন। এর পরের শ্রীলঙ্কা সফরেও তিনি তার ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন। তারপর ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আবার রানে ফিরেন। সিরিজের তৃতীয় টেস্টে ৭৩ রান করে দলের হার এড়াতে সাহায্য করেন। ওয়ানডে সিরিজেও ধরে রাখেন তার রিচ ফর্ম। সেই সিরিজে করেন তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। যা ঐ বছরের সেরা ওয়ানডে ইনিংসের জন্য ইএসপিএন-ক্রিকইনফোর মনোনয়ন পান। ২০১৩ সালে তিনি উপমহাদেশে তার প্রথম সেঞ্চুরি করেন। নাগপুরের চতুর্থ টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ৩০৬ বলে অপরাজিত ১১৬ রান। ইংল্যান্ড সেই সিরিজ জিতে নেন ২-১ ব্যবধানে। ২০১৩ সালের অ্যাশেজে লর্ডস টেস্ট তিনি করেন তার অ্যাশেজের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। সেই বছর তিনি আইসিসির বর্ষসেরা টেস্ট একাদশে জায়গা পান। তবে ফিরতি অ্যাশেজ তার ক্যারিয়ারের অন্যতম বাজে স্মৃতি হয়ে থাকবে। সেই সিরিজে তিনি মাত্র ২ টি ফিফটি করেন। অস্ট্রেলিয়া সেই সিরিজ জিতে নেয় ৫-০ ব্যবধানে। তারপর নিউজিল্যান্ড সফরে মোটামুটি পারফরম্যান্স করেন।

২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে তিনি ওয়ানডতে ভাল পারফরম্যান্স করেন। টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে করেন ৫৬ এবং ৯ রান, যা ড্র হয়। পরের টেস্টের প্রথম ইনিংসে তিনি ৬৪ রান করেন। ম্যাচটি ছিল ইয়ান বেলের ক্যারিয়ারের শততম টেস্ট ম্যাচ। এই সিরিজের পর ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে তৃতীয় টেস্টে করেন ১৬৭ রান। ৯৪ রানে থাকার সময় তিনি রবীন্দ্র জাদেজাকে ছয় মেরে সেঞ্চুরি পূরণ করেন। এটি ছিল তার ক্যারিয়ারের ২১ তম সেঞ্চুরি।

২০১৫ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজে বেল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৪১ রানের ইনিংস খেলেন। যা তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। ২০১৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে করেন ১৪১ রান। তারপর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খুব বেশী রান করতে পারেননি। অ্যাশেজেও তিনি একই ভাবে ব্যর্থ হন। তখন টেস্টে মনোযোগ দেওয়ার জন্য ওয়ানডে থেকে তিনি অবসর নেন। বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচটি তার শেষ আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের পর তিনি টেস্ট থেকেও অবসর নেন।

ইয়ান বেল ইংল্যান্ডের হয়ে ১১৮ টেস্টে ২০৫ ইনিংসে করেন ৭৭২৭ রান। ৪৬ টি ফিফটির সাথে করেন ২২ টি সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ২৩৫। এছাড়া, টেস্টে ক্যাচ নেন ১০০ টি। ১৬১ ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ৩৭.১৭ গড়ে করেন ৫৪১৬ রান। ৩৫ টি ফিফটির সাথে করেন ৪ টি সেঞ্চুরি। ৮ টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলে ১৮৮ রান করেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের পরে তিনি কাউন্টি লীগ খেলতে থাকেন। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের টি-টোয়েন্টি ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট গুলোও খেলতে থাকেন। ২০১৭ সালে বিপিএল খেলে যান। ২০২০ সালে তিনি নর্দান কাপের টুর্নামেন্টের পর পেশাদার ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। তিনিই ২০০৫ সালের ঐতিহাসিক অ্যাশেজ সিরিজের শেষ খেলোয়াড় ছিলেন, যিনি এতদিন পর্যন্ত ক্রিকেট খেলে গেছেন। ৩১২ ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচে তার সংগ্রহ ৪৩.৫৮ গড়ে ২০,৪৪০ রান। ১০৫ টি ফিফটি এবং ৫৭ টি সেঞ্চুরি করেন। ৩১৮ টি লিস্ট’এ’ ম্যাচে করেন ১১,১৩০ রান। সেখানে ৭৯ ফিফটি এবং ১৩ টি সেঞ্চুরি করেন। ১০৭ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে করেন ২,৭৯০ রান।

বর্তমানে ব্যাটসম্যানদের দিকে তাকালে নিত্যনতুন শটের পসরা দেখা যায়। তবে ক্রিকেটে কপিবুক স্টাইলের ব্যাটিং এখন দেখা যায় না বললেই চলে। ইয়ান বেল তার ক্যারিয়ারে কোন সময়ই ধারাবাহিক ভাবে সফল ছিলেন না। তবে তার ব্যাটিং ছিল খুব সুন্দর রকমের। ইয়ান বেল যখন উইকেটে সেট হয়ে যেতেন তখন তার ইনিংসকে তিন অঙ্কে নিয়ে যেতেন। হয়তো সময়ের চোরাস্রোতে ইয়ান বেলের মত ব্যাটসম্যানদের আমরা ভুলে যাব। তবে হয়তো কোন একদিন গুগলে কোন এক সাইটে তার সম্পর্কে কিছু পড়ে তার ব্যাটিং দেখার জন্য কোন এক ক্রিকেট প্রেমী ইউটিউবে সার্চ দিবে। দেখবে তার কাভার ড্রাইভ।

‘স্বর্গীয়, মনোহারিণী, মনোমুগ্ধকর, ইয়ান বেল, ইউ বিউটি। ‘

মতামত জানান :