১৯৮২ এর জুলাই ৩০ এ যখন মাইকেল এন্ডারসন তার সদ্যোজাত ছেলেটার নাম জেমস এন্ডারসন রাখছিলেন, তখনো তিনি জানতেন না এই নামটিই একটা জ্বলজ্বলে তারা৷ ইতোমধ্যে এই নামে পৃথিবীতে একজন স্কটিশ গলফার, আমেরিকান ফুটবল প্লেয়ার, অস্ট্রেলিয়ান টেনিস প্লেয়ার, আমেরিকান একজন বাস্কেট প্লেয়ার, একজন ব্রিটিশ প্যারা অলিম্পিক সুইমার এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির হয়ে দুটো প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলা একজন ক্রিকেটার আছেন! তবে এতগুলো নামের দুএকটা জেনে থাকলেও এটা নিশ্চিত যে জেমস এন্ডারসনের লিস্টে আরো একজন বিখ্যাত যোগ হচ্ছেন এটা তারা একেবারেই জানতেন না।
ছোটবেলায় টেনিসের পাঁড় ভক্ত জিমি কিশোর বয়সে বেশ ভালো লেফট আর্ম স্পিন করতে পারতেন। একবার একটি প্রদর্শনী ম্যাচে বাঁ হাতি স্পিনে আউট করেছিলেন ইয়ান বেলকে! অথচ এই এন্ডারসনই ব্যাটসম্যানদের সুইচ হিটিং পছন্দ করেন না, বেশ কয়েকবার বলেছিলেন সুইচ হিটিং নিষিদ্ধ করা উচিত!
—-
ইউরোপের বিখ্যাত সুতার ফ্যাক্টরি গুলো ছিলো বার্নলিতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই ফ্যাক্টরীগুলো যখন ধ্বংস হয়ে যায়, বার্নলি শহরের বলার মত আর কিছুই ছিলোনা। এমনকী এখনও বার্নলির রিয়েল এস্টেটের দাম ইংল্যান্ডের অন্যান্য জায়গার চেয়েও সস্তা। বার্নলির মানুষের বলতে গেলে আছে এক বার্নলি ফুটবল ক্লাব, তাও সেই ক্লাব এবছর প্রিমিয়ার তো পরের বছর ফার্স্ট ডিভিশন, মাঝে মাঝে সেকেন্ড কিংবা থার্ড ডিভিশনেও ভিজিট করে আসে। এই ছোট সুখ নিয়েই বার্নলির শান্তিপ্রিয় মানুষজন সুখে থাকতে চায়৷ এর পাশাপাশি এই বার্নলিতে আছে ছোট্ট একটা ক্রিকেট ক্লাব, ক্লাবের মাঠে কোনো গ্যালারী নেই, চারপাশে রাস্তা দিয়া বাউন্ডারি তৈরি হওয়া সেই ক্লাব মাঠে ছোট দুটো সাইটস্ক্রীণ, একটা বার আর একটা ছোট অফিস, বড়বড় ছাতা দিয়ে প্লেয়ারদের বসার ব্যবস্থা হয় যখন কোনো ম্যাচ চলে। সেই ক্লাবের বারে একজন প্লেয়ারের ছবি ঝুলানো আছে বাঁধাই করা – চার্লি গ্রিফিথ। ল্যাংকাশায়ার লীগে বার্নলির হয়ে খেলে এক সীজনে ১৪৪ উইকেট নিয়েছিলেন, সেই ১৯৬৪ সালে!
পল ব্লেকি ছিলেন সেই বার্নলি ক্রিকেট ক্লাবের বার মালিক, যৌবনে আম্পায়ারিং করতেন বার্নলি ক্লাবে৷ একদিন যথারীতি বারে বসে আছেন, হঠাৎ দেখলেন একটা বয়স্ক লোক আসছে, সাথে একটা লম্বা লিকলিকে বালক। এই বয়স্ক লোকটার নাম মাইকেল, ব্লেকের স্মৃতি মনে করিয়ে দিলো তার আম্পায়ারিং এর দিনগুলোর কথা, এই ক্লাবের দ্বিতীয় দলের হয়ে বছর বিশেক আগে খেলা ছেড়েছেন মাইকেল।
তা এই অসময়ে মাইকেল এখানে কেন! সাথে আবার তার ছেলেটাকে এনেছে,ব্লেকের আস্তে আস্তে মনে পড়লো, আরে এইইতো মাইকেলের সেই ছোট ছেলেটা যে আমাদের ম্যাচের স্কোরারকে হেল্প করতো, জিমি না কি যেন নাম! ব্লেক তখন মাইকেলকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি খবর মাইকেল, ছেলেকে নিয়ে এখানে যে?”, মাইকেলের প্রত্যুত্তরে ছিলো ছেলেকে ক্রিকেটার বানানোর আশা৷ সেদিন সেই বার্নলি ক্রিকেট ক্লাবের নেটে কিশোর জিমির সীম বোলিং এ লেট সুইং এর পসরা দেখে কেউ না বুঝলেও, সেই বারমালিক পল ব্লেক বুঝেছিলেন, বার্নলি থেকে কেউ যদি ইংলিশ টিমে খেলতে পারে, তবে মাইকেলের ছেলেই খেলবে!
—–
মে, ২০০৩ – লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড!
ফ্লাওয়ার ব্রাদার্স, ডিওন ইব্রাহিম, এন্ড্রু ব্লিগনট, হিথ স্ট্রিক, ডগলাস হন্ডো, স্টুয়ার্ট কার্লাইলদের নিয়ে গড়া বেশ শক্তিশালী জিম্বাবুয়ে দল গিয়েছিলো ইংল্যান্ড সফরে। মাত্র চারটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলা জিমি এন্ডারসনের প্রতিভাকে সেই ম্যাচে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন ইংলিশ নির্বাচকরা, কে ই বা জানতো এরপর থেকে তাকে আর দল থেকে তারা বাদই দিতে পারবেন না!
ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারের শেষ বল, লর্ডসের পিচের স্লোপের দিক থেকে বল করতে আসছেন জিমি, মিডল স্ট্যাম্পে টেম্পটেড ফুল লেংথে পড়া বলটি লেগ স্ট্যাম্পে না গিয়ে লেট সুইং করে অফ স্ট্যাম্প ভেঙে দিলো, আত্মবিশ্বাসী মার্ক ভারম্যালেন যেন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না – আর সেই শুরু হলো জেমস মাইকেল এন্ডারসনের ট্রেডমার্ক লেট সুইং এর ম্যাজিক্যাল এরা! এক এক করে সুইং এ সবাইকে বোকা বানিয়ে সেদিন প্রথম ইনিংসেই অভিষেকে পাচ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন, বোকা হয়ে গিয়েছিলো ইংলিশ নির্বাচকরাও, তাইতো তাকে টেস্ট ক্যাপটা পাকাপাকিভাবেই দিয়ে দেয়ার বিচক্ষণ সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন তারা।
বোলিং ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন স্টিভ হার্মিসন, ম্যাথিউ হগার্ড, মার্ক বুচার আর ফ্লিনটফদের সাথে, এরপর স্টুয়ার্ট ব্রড, স্টিভেন ফীন, ক্রিস ট্রেমলেট, দিমিত্রি মাসকারেনহাস, রায়ান সাইডবটম হয়ে এখন গাইড করছেন মার্ক উড, ক্রিস ওকস, প্লাংকেটদেরকে। তিন প্রজন্মের ইংলিশ বোলিং এর ভার কাঁধে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। লাল ডিউক বলের রাজা বলা হয় তাকে, লাল বলকে বাচ্চাদের খেলনার মত যা খুশি করতে পারার দক্ষতা তাকে বানিয়ে ইংলিশ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী, আর এই শতকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী।
—
“Anderson has a gift from God, he could even swing an orange” – Geoff Boycott.
জিওফ বয়কটের এই কথাটার দৃশ্যমান ফলাফল দেখি ২০০৮ সালে ট্রেন্টব্রীজে ব্রেন্ডন ম্যাককালামের হতাশাভরা অসহায় চেহারায়, লেট আউট সুইংগারে যখন তার অফ স্ট্যাম্প নেই হয়ে গেলো, তার ব্যাটটা তখনো লেগের দিকে তাক করা। জিমির এই ভয়াল লেট সুইং এর ফাঁদে যখন দেখি খোদ শচীন টেন্ডুলকারই বলের সুইং জাজ করতে ভুল করে ১৪ বারের দেখায় ০৯ বার আউট হয়েছেন যারমাঝে ০৩ বার এলবিডব্লু, তখন অবিশ্বাস্য লাগে আমাদের কাছেও! ২০১০-১১ এশেজে যখন দেখি পন্টিং জিমির সুইং এ বোকা বনে স্লিপে ক্যাচ দেন, তখন আসলে ধরাধামে আর কিছুই জীবন্ত মনে হয়না, সবকিছু মনে হয় জড়পদার্থ।
অনেক বোলারইতো ব্যাটসম্যানকে হিউমিলিয়েট করে, গতির জোরে থমকে দিতে চায়, বডিলাইনে বল করে ভড়কে দেয়, এলোমেলো শট খেলতে বাধ্য করে, দারুণ ফিল্ড সেট করে ফাঁদ বানায়, বাট জিমির অতো কিছু লাগেনা, সে যা করে তাতে একজন ব্যাটসম্যান আউট হবার পর নিজের ব্যাটসম্যানশীপের ওপরেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, নিজের টেকনিকে খুঁত পায় হাজারটা, জিমির বলের জবাব না দিতে পেরে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ক্যারিয়ার ডিগ্রেডেড হয়ে গেছে কত ব্যাটসম্যানের।
—
জিমি বোলিং করতে প্রচণ্ড ভালোবাসেন, এজন্যই বলেছেন, “I’ll still bowl after i retire without question. Even into a baseball mitt at the other end of the wicket. Just to see the ball do what i can make it do”
এখানেই তো জিমি আলাদা, এজন্যই জিমি ‘বার্নলি এক্সপ্রেস’ থেকে হয়েছেন ‘কিং অফ সুইং’!
বার্নলি ক্রিকেট ক্লাবের বারের দেয়ালে চার্লি গ্রিফিথের ছবির পাশে আরো একটি ছবি এখন যুক্ত হয়েছে৷ তাদের ঘরের ছেলে জিমির, ব্লেক এখন গল্প করে বেড়ান মাইকেলের ছেলের বাচ্চাকালে তাদের স্কোরিং করার গল্প, বার্নলির স্বল্প আয়ের মানুষজনও বার্নলি ফুটবল ক্লাব থেকে আস্তে আস্তে ক্রিকেট ক্লাবের দিকেও আসে৷ এখানেইতো একজন জেমস মাইকেল এন্ডারসনদের সার্থকতা, কালজয়ী অবদানের কিংবদন্তী আওয়াজ!
২০০৩ সালের ২২মে অভিষেক হয় এই সুইং কিং এর, ঠিক ১৭ বছর ১ দিন আগে – মার্ক ভারম্যালেন কে দিয়ে শুরু হওয়া উইকেটের বৃষ্টি এখনো পড়ে যাচ্ছে পূর্ণোদ্যমের বর্ষার মতো। ক্যারিয়ারের শেষদিকে এসে পড়েছেন, তাই আরো কয়েকটা ম্যাচ যাতে তার খেলা দেখতে পারি, সেই কামনাই করি।