পেস বোলার! কথাটা মাথায় আসলেই চোখে ভাসে বর্তমান সময়ের বিশ্বের বাঘা-বাঘা কিছু বোলারদের নাম! যাদের মধ্যে মিচেল স্টার্ক, জাসপ্রিত বুমরাহ, জোফরা আর্চারদের কথা! যারা বাইশ গজে গতির ঝড় তুলে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের ঘায়েল করেন! আর বাংলাদেশের পেসা এটাকের কথা যদি বলি তাহলে প্রথমেই আসবে বাইশ গজে কাটারের ঝড় তুলা কাটার মাষ্টার মুস্তাফিজুর রহমানসহ তাসকিন আহমেদ, রুবেল হুসাইনদের নাম! যারা আসলে বাংলাদেশের পেস এটাকের প্রধান অস্ত্র!
গত যুবা বিশ্বকাপ ২০২০! দক্ষিন আফ্রিকায় অনুষ্টিত এই টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের যুবা দল! যুবা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ম্যাচগুলো টিভিতে সম্প্রচার না হওয়ায় দেখা যায়নি! তবে ফাইনালটা দেখা যায় টিভিতে! ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচটাতে বাংলাদেশের পেসারদের আক্রমনাত্মক বোলিং এখনো চোখে ভাসে! যুবা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পেস আক্রমনের প্রধান অস্ত্রের নাম শরিফুল ইসলাম! ভারতের বিপক্ষে তার আক্রমনাত্মক বোলিং ভূলা কি যায় নাকি ভূলতে চাইবেন আপনি?
জন্মস্থান এবং বেড়ে ওটা:
২০০১ সালের ৩রা জানুয়ারি পঞ্চগড়ের উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের মৌমারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম! বাবা দুলাল ইসলাম পেশায় একজন ভূমিহীন কৃষক! মা বুলবুলি বেগম পেশায় গৃহিণী! ২০০১ সালে আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে শরিফুলের বাবা সাভারে পাড়ি জমালেও রিক্সা চালিয়ে কিছুটা আর্থিক উন্নতি ঘটিয়ে ২০১০ সালে আবারো নিজের গ্রামে ফিরে আসেন!
অভাবের সংসারে শরিফুলের বেড়ে ওটার গল্পটা একটু কষ্টদায়ক! কষ্টের সংসারে অভাবে অনাটনে বড় হোন শরিফুল ইসলাম! বাবা-মায়ের আদরের ছোট ছেলে শরিফুল সবার বেশ আদরের ছিলেন!
ক্রিকেটার হওয়ার গল্প:
প্রত্যেকটা বাবা-মা চান তার সন্তান পড়ালেখা করে অনেক বড় মানুষ হোক! শরিফুলের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছিল! বাবা-মা তাকে স্কুলে ভর্তি করলেও তিনি স্কুল ফাকি দিয়ে ক্রিকেট খেলতে চলে যেতেন! না খেয়ে খেলতে গিয়ে অনেক সময় হাপিয়ে যেতেন শরিফুল! তারপর বড়ভাই আশরাফুল ইসলামকে ফোন দিয়ে না খেয়ে খেলতে যাওয়ার কথাটা জানাতেন, বড়ভাই মাঝেমধ্যে ২০০/৩০০ টাকা দিতেন!ছোট ভাইয়ের খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে তার পাশে দাড়ান বড় ভাই আশরাফুল! ২০১৬ সালে দিনাজপুরে একটি একাডেমিতে ৭দিনের একটি অনুশীলন কোর্সে ভর্তি করিয়েন দেন আশরাফুল! শরিফুলকে প্রেকটিসে যাওয়ার জন্য প্রথম গেম সেটের ব্যাটটি কিনে দেন আশরাফুলের সাভারের ভাড়াটে বাড়ির মালিক! সাতদিনের প্রেকটিস ক্যাম্পের তৃতীয় দিনেই তার বোলিংয়ে মুগ্ধ হোন তৎকালীন জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ধীমান ঘোষ! এরপর সাবেক ক্রিকেটার হান্নান সরকার ও আলমগীর কবিরের সহযোগিতায় তিনি রাজশাহীতে ক্লেমন একাডেমিতে অনুশীলন ক্লাবে ভর্তি হোন! সেখান থেকেই শরিফুলের ক্রিকেটার হওয়ে ওঠা! রাজশাহীর ক্লেমন একাডেমিতে থাকা অবস্থায় ঢাকার থার্ড ডিভিশন লিগে চমক দেখান শরিফুল! তারপর ২০১৮ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে প্রাইম ব্যাংকের হয়ে খেলার সুযোগ পান শরিফুল! এরপর ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) এ খুলনা টাইটান্সের দলে তিনি অন্তর্ভুক্ত হন!
প্রথম কোচ:
ক্লেমন একাডেমিতে তার প্রথম কোচ ছিলেন আলমগীর কবির! শরিফুলের কঠোর পরিশ্রমের মনোভাব থাকে মুগ্ধ করেছিল! সেখানেই আলমগীর কবির তাকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন! রাজশাহীতে তার কোচ ছিলেন জাতীয় দলের সাবেক উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান খালেদ মাসুদ পাইলট! তার হাত ধরেই শরিফুল ঢাকা ডিভিশন লিগ ও বিপিএলে খেলার সুযোগ পান।
পড়াশোনা:
জন্মের পর সাভারে পাড়ি জমানোর পর তখন সাভারের একটি স্কুলে ভর্তি করানো হয় শরিফুলকে! ২০১০ সালে যখন আবার তারা নিজের গ্রামে ফিরে আসে তখন বাড়ির কাছের কালীগঞ্জ এসপি উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয় শরিফুলকে! জেসএসিতে ফেইল করার পর ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হোন শরিফুল! এরপর রাজশাহীতে অনুশীলনের পাশাপাশি পড়াশোনা করে এসএসসিতে পাশ করেন।
সময়টা ছিল ২০১৯ সাল! শরিফুল ইসলাম সুযোগ পেয়ে যান বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) এ! বিপিএল খেলা অবস্থায় নির্বাচকরা তাকে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ডাক দেন! অনূর্ধ্ব-১৯ দলে শরিফুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ দলের প্রধান অস্ত্র!
অনূর্ধ্ব-১৯ দলে শরিফুল ২৮টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন! ২৮ ওয়ানডে ম্যাচে শরিফুল নিয়েছেন ৪৪টি উইকেট! অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ওয়ানডেতে ২৩১ ওভার বোলিং করে ৪.৭৬ ইকোনমিতে তিনি উইকেট নেন ৪৪টি, বোলিং এভারেজ ছিল ২৫!
অনূর্ধ্ব-১৯ দলের পক্ষে ১টি মাত্র টেস্ট খেলার সুযোগ পান শরিফুল ইসলাম! ১টেস্টে তিনি উইকেট নিয়েছেন ৩টি, বোলিং এভারেজ ২৬।
অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ৮টি দলের বিপক্ষে মাঠে নেমেছেন শরিফুল ইসলাম! এই ৮টি দলের বিপক্ষে শরিফুল ইসলামের পারফরম্যান্স:
ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯- ২ ম্যাচে ০ উইকেট।
ভারত অনূর্ধ্ব-১৯- ৬ ম্যাচে ১১ উইকেট।
নিউজিল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯- ৬ ম্যাচে ১৪ উইকেট!
পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯- ২ ম্যাচে ২ উইকেট।
স্কটল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯- ১ ম্যাচে ২ উইকেট।
দক্ষিন আফ্রিকা অনূর্ধ্ব-১৯- ১ ম্যাচে ১ উইকেট।
শ্রীলঙ্কা অনূর্ধ্ব-১৯- ৯ ম্যাচে ১৩ উইকেট।
জিম্বাবুয়ে অনূর্ধ্ব-১৯- ১ ম্যাচে ১ উইকেট।
বিভিন্ন দেশের মাঠে শরিফুলের পারফরম্যান্স:
বাংলাদেশ- ৬ ম্যাচে ১০ উইকেট।
ইংল্যান্ড- ৬ ম্যাচে ৬ উইকেট।
নিউজিল্যান্ড- ৫ ম্যাচে ১১ উইকেট।
দক্ষিন আফ্রিকা- ৬ ম্যাচে ৯ উইকেট।
শ্রীলঙ্কা- ৫ ম্যাচে ৮ উইকেট।
বছর অনুযায়ী শরিফুলের পারফরম্যান্স:
২০১৮- ৭ ম্যাচে ১১ উইকেট।
২০১৯- ১৫ ম্যাচে ২২ উইকেট।
২০২০- ৬ ম্যাচে ৯ উইকেট।
অনূর্ধ্ব-১৯ দলে শরিফুল ইসলাম দুইজন অধিনায়কের নেতৃত্বে খেলেছেন! অধিনায়কদের অধিনে শরিফুলের পারফরম্যান্স:
আকবর আলী: ২১ ম্যাচে ৩১ উইকেট!
তৌহিদ হৃদয়: ৭ ম্যাচে ১৩ উইকেট।
সেরা বোলিং ফিগার:
২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আগে নিউজিল্যান্ডে সফরে গিয়েছিল বাংলাদেশ! নিউজিল্যান্ডের মাঠিতে শরিফুল ইসলাম তার ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগারটি করেন।পরিসংখ্যান বলে ২০১৯ সালটা শরিফুলের ক্যারিয়ারের সেরা সময় ছিল! আর সেই সময়ই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের মাটিতেই সিরিজের ৫ ম্যাচে তিনি এক ইনিংসে ৪৩ রান দিয়ে ৫টি উইকেট নেন।
শরিফুল ইসলাম; বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রেমীদের একটা পরিচিত নাম! অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে নিজের বোলিং মুগ্ধ করে জয় করে নিয়েছেন বাংলাদেশের কোটি ভক্তদের মন! বর্তমান সময়ের তরুন পেসারদের মধ্যে তার বোলিং দেখে মুগ্ধ হয়না এমন ক্রিকেট প্রেমী পাওয়া বড়ই বিরল!
শরিফুলের দৈহিক উচ্চতা ৬ফুট ৩ ইঞ্চি! দেহের উচ্চতাকে কাছে লাগিয়ে বাইশ গজে শরিফুল ছুড়েন একেকটা বারুদ! বোলিংয়ে যেমন দেন গতি তেমনই বজায় রাখেন বলের লাইন-লেন্থ! এভারেজে ১৩৬ গতিতে বল করা শরিফুলের বোলিংয়ের প্রধান অস্ত্র বাউন্স! তার বাউন্সে নিয়মিতই পরাস্ত হচ্ছেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা! বাউন্স, লাইন-লেন্থের সাথে শরিফুল আয়ত্ত করেছেন ভয়ংকর সকল ইয়র্কার! নতুন বলকে দুই দিক থেকেই ভালো সুইং করাতে পারেন শরিফুল!
এইটুকু বয়সেই তিনি হয়ে উঠেছেন ক্যাপ্টেনদের ভরষার প্রতিক! যখন যেই দলে সুযোগ পাচ্ছেন তখনই তিনি নিজের সেরাটা উজাড় করে দিচ্ছেন! নতুন বলে দুর্দান্ত বোলিং করা শরিফুলকে ডেথ ওভারেও পরিকল্পনায় রাখছেন দলের ক্যাপ্টেনরা!
এইতো সদ্য শেষ হওয়া বিসিবি প্রেসিডেন্ট কাপেও দেখিয়েছেন নিজের বোলিং ঝলক! তারকা সমৃদ্ধ তামিম ইকবাল একাদশের পক্ষে সুযোগ হয়েছিল মাত্র ১টি ম্যাচে আর সেই ম্যাচেই তিনি তুলে নিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের চার ব্যাটসম্যানের উইকেট! তার বোলিংয়ের সামনে বোকা বনে গেছিলেন জাতীয় দলের ব্যাটসম্যানরাও।
সবশেষে, শরিফুল ইসলামের মাঝে আমি আরেকটা মুস্তাফিজুর রহমানকে দেখি! কেনো মুস্তাফিজুর রহমানকে দেখি সেটা বলি! ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে মুস্তাফিজ যেমন ভয়ংকর ইয়র্কার দিয়ে ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প ভাংতেন শরিফুলও সেই সকল ইয়র্কার দিয়ে ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প ভাঙছেন নিয়মিতই! ফিজ এখন নিজেকে হারিয়ে খুজতেছে, অনেকদিন হলো তার ভয়ংকর ইয়র্কার গুলো দেখা যায়না! তারপরও সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মুস্তাফিজ আমাদের ভরষার এক নাম! তার সাথে পেস ডিপার্টমেন্টের হাল ধরবেন শরিফুল এমনটা আমাদের আশা! মুস্তাফিজুর রহমানের সাথে তাসকিন আহমেদ আর শরিফুল ইসলামের বোলিং জুটি দেখার অপেক্ষায় রইলাম।