আপনি যদি শচীনের স্ট্রেইট ড্রাইভ অথবা রিকি পন্টিং এর পুল শটকে শৈল্পিক বলে মনে করেন, তাহলে শেন ওয়ার্নের লেগ স্পিনটাকেও শিল্প বলে মানতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি ওই শিল্প শব্দটার আগে ‘বিরল’ শব্দটা জুড়ে দেন। একজন অধিনায়কের কাছে ‘কিলিং উইপন’ খ্যাত এই শিল্পটা ক্রিকেটের সবথেকে পুরাতন এক সৌন্দর্য। কিন্তু আশ্চর্য এবং দুঃখের ব্যাপার এই যে, বাংলাদেশ ক্রিকেটে সেই সৌন্দর্য অনুপস্থিত বেশ ধারাবাহিকভাবেই।
#বর্তমান_অবস্থা
বাংলাদেশে এখন ঠিক কতজন লেগ স্পিনার আছে বলতে পারবেন? অথবা ঠিক কতজনের নাম আপনি জানেন? স্মৃতি হাতড়ে পাঁচটা নাম বের করতেই গলদঘর্ম হয়ে যাবেন অনেক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা তানভীর হায়দার, জুবায়ের হোসেন এবং নুর হোসেন মুন্না ছাড়া গত লীগে আর কোন লেগ স্পিনার খেলেছে কি? এর মধ্যে তানভীর হায়দার একজন ব্যাটিং অলরাউন্ডার যিনি লেগ স্পিন করতে পারেন, জুবায়ের একজন প্রতিভা অপচয়কারী, এবং নুর হোসেন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে। ১৭ বছর ধরে টেস্ট খেলা একটি দেশের ভাণ্ডারে লেগ স্পিন সম্পদ বলতে এই তিন হারাধনের সন্তান। বাইনোকুলার দিয়ে খুঁজলে হয়তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দু-একজনের নাম বের হবে, তবে তারা অনেকটা নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া কচুরিপানার মতোই অকার্যকর।
#ইতিহাস
বাংলাদেশ ক্রিকেটে লেগ স্পিনের ইতিহাস খুঁজতে গেলে পুরোটাই অন্ধকার। অন্ধকার টানেলের শেষ প্রান্তে হয়তো মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা বিন্দু পরিমান আলোর আভাস পাওয়া যাবে। বর্তমানে রুট লেভেল কোচ ওয়াহিদুল গনি নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে লেগ স্পিনার হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এরপর অলক কাপালিকেও এই শিল্পে হাত বোলাতে দেখেছি। মাঝে মাঝে আশরাফুলও চেষ্টা করতেন তার প্রিয় শিক্ষক ওয়াহিদুল গনির অনুসরনে। এছাড়া রায়হানউদ্দিন আরাফাত নামেও একজন বোলার ছিলেন, যার প্রতিভা ছিল। টেনেটুনে হয়তো আরও দু-একটা নাম যোগ করা যায়, কিন্তু সেটা নিতান্তই শার্ট টেনে নিন্মাঙ্গ ঢাকার মতো ব্যাপার।
#কেন_নেই?
বাংলাদেশ ক্রিকেটে লেগ স্পিনার কেন আসেনি অথবা কেন নেই, সেই প্রশ্নের উত্তরে অসংখ্য কারনের কথা উল্লেখ করা যায়। সতেরো কোটি মানুষের মধ্যে খেলা পাগল প্রায় পাঁচ কোটি। সেখান থেকে ১০ জন মানসন্মত লেগি বের হয়ে না আসাটাই একটা অবাক করা ব্যাপার। কিন্তু নির্মম সত্যটা হল, আসেনি। প্রথম কারণ হিসাবে বলা যায়, আমাদের দেশে লেগ স্পিনের ভালো আইডল নেই। পাকিস্তানের ইমরান খানকে দেখেই সে দেশে প্রচুর ফাস্ট বোলার তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে লেগ স্পিন আইডল হিসাবে কাউকে খুঁজে পায়নি উঠতি খেলোয়াড়েরা। তবে কেউ কেন নিজেই ইমরান খানের দায়িত্বটা নেবার সাহস দেখালো না সেটাও আশ্চর্যের। এই যে শত শত বাঁহাতি স্পিনার উঠে আসছে এখন, এর কারণ কিন্তু রফিক, রানা, এনামুল, সাকিব। এদের সাফল্যই অন্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করছে বাঁহাতি স্পিনার হতে। এছাড়া, আমাদের ডোমেস্টিক লীগগুলোতে ক্লাবগুলো যেভাবে লেগ স্পিনারদের এড়িয়ে চলে, তাতে করে বর্তমান প্রজন্ম কোন সাহসে এই কষ্টকর শিল্পে নিজের ক্যারিয়ার জড়াবে! উঠতি ক্রিকেটার বলতে যদি বয়সভিত্তিক লেভেলের খেলোয়াড়দেরকে ধরেন, তাহলে সেখানে লেগ স্পিন শিল্পকে আয়ত্তে এনে দেবার মতো কোচই বা কোথায়? এমন অন্তত আরও দশটা কারণ আছে এদেশে লেগ স্পিনার না থাকার।
#করনীয়
রেডিমেড আবদারে লেগ স্পিনার তৈরি করা সম্ভব না। প্রতিভা দেখেই নামিয়ে দেবার প্রবণতায় জুবায়েরর ক্যারিয়ার ঝাপসা হয়ে গেছে। এটা এমন একটা শিল্প যা বছরের পর বছর অনুশীলনের মাধ্যমে পরিপক্কতা পায়। ইমরান তাহির, অমিত মিশ্ররা চুল পাকিয়ে এই লেভেলে এসেছেন। আপনি রশিদ খান, শাদাব খানের নাম উল্লেখ করতে পারেন, তবে এরাও অনেক ছোট বয়স থেকেই এই শিল্পের চর্চা করে আয়ত্তে এনেছেন। বর্তমানে আমাদের ক্রিকেটে যারা স্বীকৃত লেগ স্পিনার হিসাবে আছেন, এদের নিয়ে আমার তেমন আশা নেই। তবে চেষ্টা করলে আগামী ৫ বছরে কিছু লেগ স্পিনার তুলে আনা সম্ভব। এবং এটার সূচনা করতে হবে অনেক রুট লেভেল থেকে। মানসন্মত কিছু কোচকে নিয়োগ দিতে হবে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে যারা শুধু লেগ স্পিন নিয়েই কাজ করবেন। ছোট বয়সে একজন ক্রিকেটারকে যেকোনো দিকে ট্রান্সফর্ম করানো যায়। একজন অফস্পিনারকেও লেগ স্পিনারে পরিনত করা সম্ভব যদি তার ভেতর প্রতিভা টা থাকে। উদাহরন হিসাবে ভারতের অশ্বিনের কথা বলতে পারি। সর্বমোট ৫০ জন কে নিয়ে কাজ শুরু করলে অন্তত ১৫ জন লেগ স্পিনার শেপে আসবে বলে মনে করি। এরপর তাদেরকে জাতীয় একাডেমীর ছায়ায় হাই প্রোফাইল কোচের মাধ্যমে অনুশীলন করাতে হবে। শ্রম, প্রতিভা, এবং নিশ্চয়তা দিলে এই ১৫ জন থেকেই ১০ জন ক্লাস বোলার বের করে আনা যাবে। এবার আসি নিশ্চয়তার কথায়, এই যে যারা লেগ স্পিনার হিসাবে বের হয়ে আসবে, এদেরকে ডোমেস্টিক লীগের দল পাইয়ে দেবার নিশ্চয়তাটা বোর্ডকে দিতে হবে। লেগস্পিনের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরন করা ক্লাবগুলোকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমাদের শক্তিশালী বোর্ড নিতে পারবে না এটা আমি বিশ্বাস করি না। নিয়মিত খেলার সুযোগ পেলে এই ১০ জন স্পিনারের অন্তত ৩ জন জাতীয় দলের জন্য প্রতিযোগিতা করবে অনায়াসে। ‘বলা সহজ, করা কঠিন’ এই বাক্যের প্রতি যথেষ্ট সন্মান রেখেই বলছি, কঠিন বিষয়কে সহজ করার মতো অর্থ এবং লোকবল দুটোই বিসিবির রয়েছে। দরকার শুধু স্বদিচ্ছা এবং বাস্তবায়নের।
অভাবে যেমন স্বভাব নষ্ট হয়, তেমনি স্বভাবের কারনেই অভাব তৈরি হয়। ‘লেগি নেই, লেগি নেই’ বলে হাহাকার না করে, লেগি তৈরি করাই বোর্ডের দায়িত্ব। কি আছে, কি নেই সেটা নিয়ে গলা ফাটানোর জন্য আমরা আমজনতারাই যথেষ্ট, বোর্ডের উচিত সেই অভাব পূরণের চেষ্টা করা। রাজা নিজেই যদি অভিযোগ করে, তাহলে প্রজারা কোথায় যাই বলুন তো 🙂