যেমন-খুশি-তেমন-সাজা; দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার একটা নিয়মিত ইভেন্ট। এই ইভেন্টে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের সাজে সেজে অভিনয় করে থাকে। আর সেরা গল্পের সাথে সেরা অভিনয় মিলিয়ে যে পারফরমেন্স হয়, সে পায় বিজয়ীর পুরষ্কার। আমাদের দেশে এই খেলার কোনো বোর্ড নেই, মূলত এটা কোনো খেলাও না। তবে “বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড” নামের একটি বোর্ড আছে যারা মূলত নিজেরাই “যেমন খুশি তেমন সাজ”-এ সেজে থাকে। অভিনয়ের ফলাফল বারবার খারাপ হোক কিংবা দর্শকরা তাদের সাজে যতই বিক্ষুব্ধ হোক; তাতে তাদের কোনো মাথা-ব্যাথা নেই। কারণ তারা জানে, যত যাই হোক, এদেশের মানুষ তাদের সাজ দেখবেই- তাদের ব্র্যান্ড ভ্যালু ক্রিকেট বিশ্বে না থাকলেও এদেশের মানুষের কাছে দিনকে দিন তা শুধু বাড়বেই। কমানোর সাধ্য নেই কারো।
তাদের এই চিন্তাটাও যদি সঠিক হতো তবুও চলতো। ব্র্যান্ড ভ্যালু যে কমেছে সেটা তারাও জানে। স্পন্সর খুঁজে পেতে নাকি কষ্ট হয়; সবশেষ বিপিএল এর সবগুলো দল পায়নি টাইটেল স্পন্সরও। মাঠে দর্শকও ছিলো আগের তুলনায় কম; এদেশে যতটুকু কমা সম্ভব হয়তো কমেছে। বাকি যেটুকু আছে তা দিয়েও তারা বিশ্বের ধনী ক্রিকেট বোর্ড গুলোর একটা হয়ে থাকতে পারবে; কারণ অধিকাংশ ক্রিকেট প্রেমীরাই মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তা রাখে না। আর এটাকে জিম্মি করেই তারা বছরের পর বছর যেমনি খুশি তেমনি চালিয়ে নিচ্ছে দেশের ক্রিকেটকে।
সমালোচনা করতে গেলে করা যাবে অনেক কিছু নিয়েই। নিজের যোগ্যতার সীমাবদ্ধতাকে মাথায় রেখে আজকে শুধু বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল ও দলের আগে-পরের কিছু কথা বলবো। বিষয়গুলো কে ভাগ করতে চাইলে করা যায় অনেকটা এমন:
- ক্রিকেটার উঠে আসার প্রক্রিয়া
- উঠে আসা ক্রিকেটারদের পরীক্ষাকেন্দ্র
- নির্বাচন প্রক্রিয়া
- জাতীয় দল
একটা দেশে ক্রিকেটার উঠে আসার একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকে, চেইন থাকে; যে চেইনের মধ্য দিয়ে ভালো ভালো প্লেয়াররা জাতীয় দলে আসে। আমাদের দেশেও সেই চেইন আছে। তবে “যেমন খুশি তেমন সাজ” ধরনের আরকি। কাগজে কলমে থাকলেও ব্যাটে-বলে প্রায় নাই বললেই চলে।
আমাদের দেশের ঘরোয়া কাঠামো কাগজে কলমে বেশ শক্ত। জেলা ২য় বিভাগে খেলে প্রমাণ করে আসতে হয় জেলা প্রথম বিভাগে। সেখান থেকে জেলা দল। নিজেকে প্রমাণ করতে হয় আরও একবার; প্রমাণ করতে পারলেই কেবল জায়গা পাওয়ার কথা বিভাগীয় দলে। সেখান থেকে ফার্স্ট ডিভিশন ক্রিকেট লিগ হয়েই একজন ক্রিকেটারের আসার কথা ছিলো ফার্স্ট ক্লাস, লিস্ট এ এর মতো জায়গায়।
কাগজ-কলমের কাঠামোর সাথে বাস্তবের মিল কোথায়? প্রথম বিভাগ লীগই যেখানে অনেক জায়গায় অনিয়মিত সেখানে তার আগের ধাপগুলোর স্বপ্ন দেখাও বারণ। সেই স্বপ্নে দেখা বারণের লীগ গুলো যতটুকুও হয়ে থাকে সেটাও স্বপ্নের মতোই। কারণ ম্যাচ শুরুর আগেই ম্যাচ শেষ হওয়ার অভিযোগ নতুন না; এটা স্বপ্নেই সম্ভব, বাস্তবে না। শুধু টস করেই পুরো এক টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার অভিযোগও ছিলো। নিম্নমানের আম্পায়ারিং আর সেই আম্পায়ারিং এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে আজীবন ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাও আছে আমাদের দেশে।
যেগুলো হয় না সেগুলো বাদ দেয়া যাক। মানে ক্রিকেটার উঠে প্রক্রিয়া কাগজে-কলমে যেটা ছিলো সেটা বাদ। উঠে আসা ক্রিকেটারদের নিজেদের প্রমাণের জায়গাতে আসা যাক। যেই ফার্স্ট ক্লাশ ক্রিকেটটা নিয়মিত দায় সারা ভাবে হয়ে থাকে সেটাই ক্রিকেটারেদের পরীক্ষাকেন্দ্র হওয়ার কথা ছিলো। সাথে ডিপিএল আর বিপিএলও। কিন্তু বিপিএল ছাড়া বাকিগুলোর দিকে তাকানোই যেত না কয়েকবছর আগেও। কি ভাবছেন, এখন তাকানো যায়? না, এখন ওই বিপিএলের দিকেও তাকানো যায় না।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে থাকবে প্রতিযোগিতা, দলের সাথে দলের পাল্লা, ব্যাটসম্যানের সাথে ব্যাটসম্যানের পাল্লা, বোলারের সাথে বোলারের। কিন্তু আদৌ কি তা হয়? দেশের জাতীয় দলের খেলোয়ারেরা একপ্রকার খেলেনই না ফার্স্ট ক্লাশ, আর যারা ফার্স্ট ক্লাশে ভালো খেলেন তারা আসতে পারেনা জাতীয় দলে। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে কয়টা ম্যাচে জয়-পরাজয় আসে আমাদের? এখান থেকে না তৈরি হচ্ছে ব্যাটসম্যান, না বোলার, না কোনো ভালো আম্পায়ার। তুষার ইমরানরা রান করতো, বয়সের কারণে তারা বাদ। মোসাদ্দেক-ইয়াসিররা রান করে; কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে জাতীয় দলের আশপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরেই তাদের সময় শেষ।
যেই বিপিএলের প্রতি বিসিবির আগ্রহ খুব বেশি, সেই বিপিএলের এখনো নেই নির্দিষ্ট একটা ক্যালেন্ডার। প্রতিবার টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আসে নতুন নতুন নিয়ম আর নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে ড্রাফটের দিনই। টুর্নামেন্ট শুরু পর্যন্ত আর যেতে হয় না। সাথে ব্রডকাস্ট, ধারাভাষ্য সেগুলোও অখাদ্য।
এসব জায়গায় নিজেদের প্রমাণ করে জাতীয় দলে আসা ক্রিকেটারটাও দলে এসেই ভুগতে শুরু করে অধিকাংশ সময়। কারণগুলোও স্পষ্ট। প্রথমত, দলে যারা আসে তারা খেলে আসে একপ্রকার পাকা রাস্তার পিচে। বোলারের জন্য সেখানে কিছুই থাকে না। আর যদি থাকে তাহলে সেটা স্পিনারদের জন্য। এই বল মোকাবেলা করে কেউ জাতীয় দলে এসে একদিকে যেমন পেসারদেরকে সামলাতে ব্যর্থ হবেনই, অন্যদিকে দেশের বাইরের স্পিনারদের কাছেও ধবল ধোলাই হবেন।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের স্পিন বলটা করে থাকে মূলত পিচ, বোলার নিজে করে থাকেন খুব কম। তাই প্রিয় গামিনি ডি সিলভা একটু এদিক ওদিক করে ফেললেই স্পিনারদের খেলা শেষ; মিরপুরের বাইরে গেলে তো অবস্থা আরও আগেই কাহিল। এই প্রক্রিয়ার আরও একটা সাইড ইফেক্ট হলো পেস বোলার তৈরি না হওয়া। আর যারা আসে, তাদেরকেও ওই পিচের দোহাই দিয়ে দেশের মাটিতে খেলানো হয় না। অভিজ্ঞতা ছাড়াই কেউ দেশের বাইরে গিয়েও ভালো করতে পারবেনা। তাইতো দলে মুস্তাফিজ ছাড়া ফিক্সড কোনো পেসার নাই।
দল নির্বাচন প্রক্রিয়ার বেশিরভাগ অংশ জুড়েই থাকে শুধু অনূর্ধ্ব ১৯ দল। বিগত বছরগুলোতে আসা মুস্তাফিজ, সৌম্য, শান্ত, সাইফ, মেহেদি মিরাজ কিংবা এখন দলে আসার অপেক্ষায় থাকা শরীফুল, হাসান মাহমুদ, মৃত্যুঞ্জয় সবাই অনূর্ধ্ব ১৯ দলেরই। সাকিব-মুশফিকরাও সেখান থেকেই এসেছে। বিপিএল থেকেও নজর কেড়ে অনেকে দলে আসছে, তবে ফার্স্ট ক্লাশ বা লিস্ট-এ এর পারফরমেন্স দিয়ে দলে এসে থিতু হতে পেরেছেন এমন খেলোয়ারের সংখ্যা কমই।
দল নির্বাচন নিয়ে বলতে গেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-বাংলাদেশ চলতি টেস্ট (১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ থেকে শুরু হওয়া) এর কথাতেই আসা যাক। দলে সাদমানের ব্যাকআপ হিসেবে সাইফ হাসান আছেন। সাদমান ইনজুরড কিংবা ব্যর্থ হলেই তো সাইফকে নামানোর কথা, তাই না? তাহলে সাদমান ইনজুরড হলে তার জায়গায় হঠাৎ করেই স্কোয়াডের বাইরে থাকা সৌম্য কেনো? ওডিআইতে যাকে সাতে খেলানো হলো সে ২ দিন আগে নিজে টেস্ট দলে আছেন জানতে পেরে দুইদিন পরই কিভাবে টেস্টে ওপেন করতে প্রস্তুত হতে পারেন? সাইফ, ইয়াসিররা সময় কাটাবেন বেঞ্চে বসেই, মাঠে নেমে আউট হবেন না। ফলে আত্মবিশ্বাসটা টইটুম্বুরই থাকবে তাদের।
বহুবার বহু কিছু হয়েছে। কিন্তু লাভ নেই। এই টেস্টেই দেশের কোনো একজন ব্যাটসম্যান দেড়শো করে দিতে পারলেই খেলা শেষ। জিম্বাবুয়ের কাছে ২০১৮ সালে সিলেট টেস্টে হারের পর করা সমালোচনা পরের টেস্ট মুশফিকের ডবল হান্ড্রেডেই শেষ। সদ্য পাওয়া মাঝারি মানের সাফল্যে নিকট অতিতের ভয়াবহ ব্যর্থতা ভুলে যাওয়ার অভ্যাস আমাদের পুরোনো। আর বিসিবি তো মনে রাখেই না। প্রত্যেক সিরিজে তারা শুরু করে নতুন করে, পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ধাঁর ধারে না বিসিবি। ম্যাচ বাই ম্যাচ, সিরিজ বাই সিরিজ পরিকল্পনা সাজান তারা।
দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাবে আমাদের এখনো একজন লেগস্পিনার নাই। আফগানিস্তানের প্লেয়াররাও যেখানে আইপিএলে আলাদা একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে ওই এক সাকিবই। মাঝে মুস্তাফিজ এসেছিলো, হয়তো আবার থাকবেন। তবে এতটুকুই কি যথেষ্ট?
এসব কথা পুরোনো। বলে লাভ হয় না কোনো। এভাবেই চলছিলো, চলছে। কতদিন চলবে জানিনা, তবে এখনই থামছে না সেটা নিশ্চিত। কোনো ক্রিকেটারকে এক সিরিজের স্কোয়াডে ডেকে না খেলিয়েই পরের সিরিজে বাদ দিয়ে দেয়াও চলবে আরও অনেকদিন। আবার নিয়মিত ব্যর্থ কয়েকজনকে সুযোগও দিতে থাকবে নিয়মিত ভাবেই; আর সুযোগ পেয়েও তারা ব্যর্থ হবে এটাই যেন “যেমন খুশি তেমন সাজ” প্রতিযোগিতায় বিসিবির স্ক্রিপ্ট।
আফগানিস্তানের সাথে টেস্ট হেরে বিসিবি প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, “এই টেস্টের কোনো পরিকল্পনাই ঠিক ছিলো না” । এই সত্য কথা যে বলতে পারেন সে অবশ্যই দেশের ক্রিকেট নিয়ে অনেক ভাবেন। উইন্ডিজের কাছে হারের পর রুদ্ধদ্বার বৈঠকও হয়েছে। চেষ্টার তো কোনো ত্রুটি নেই। চেষ্টা করতে করতে তো সাব্বিরকেও টেস্ট খেলিয়েছেন, জাতীয় দল সাইড বেঞ্চ গরম করিয়েছেন হুট করে চলে আসা পেসার ইয়াসির আরাফাতকে দিকেও। ২ ম্যাচ, ৩ ম্যাচ করে তো কত ক্রিকেটারকেই সুযোগ দেয়া হলো। এরপরও বাংলাদেশ দল ভালো না করলে তার তো কিছুই করার নেই।
শেষ করার আগে একটা ভুল ধারণা ভেঙে দেয়া যাক। অনেকেই বলেন ২০০৩ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলা কেনিয়া কিন্তু এখন কোথাও নেই। এটা বলে তারা বুঝাতে চান একদিন আমাদের অবস্থা এমনও হতে পারে। তবে তারা ভুল; আমাদের চিন্তার কিছু নেই, আমরা তিনবারের এশিয়া কাপ রানার্স-আপ; তারা এখনো এশিয়া কাপ খেলতেই পারেনি। আর আমাদের দেশের দর্শক সমাজ তো আছেই ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখতে; ম্যাচের পর ম্যাচ শোচনীয়ভাবে হারলেও স্লোগান হবে একটাই, “হারলেও বাংলাদেশ, জিতলেও বাংলাদেশ” । আর শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলে ট্রল হবেন ম্যাককালাম, শেবাগরা।