ক্রিকেট ইতিহাসে ডন ব্র্যাডম্যান, জাস্টিন ল্যাঙ্গার, কুমার সাঙ্গাকারা, এলিস্টার কুক, শচীন টেন্ডুলকারদের মতো অনেক কিংবদন্তি ব্যাটসম্যানের আগমন ঘটেছে যারা টেস্ট ক্রিকেটকে রঙিন করেছেন আলাদাভাবে। মাঠে নামলে মাটি কামরে ২২ গজে দাঁড়িয়ে থাকা ছিলো তাদের অভ্যাস। গড়েছেন অসংখ্য রেকর্ড। আজকে কথা বলবো শুধু পার্টনারশিপ রেকর্ড নিয়ে, সেটাও মূলত স্যার জন বেরি জ্যাক হবস এবং হার্বার্ট সাটক্লিফ নামের দুই ইংলিশ ব্যাটসম্যানের।
একটি সিঙ্গেল ইনিংসে সর্বোচ্চ পার্টনারশিপের রেকর্ডটা সাঙ্গাকারা এবং জয়বর্ধনের। ২০০৬ সালের ২৭ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজেদের ১ম ইনিংসে (ম্যাচের ২য় ইনিংস) তারা দুজন মিলে করেন ৬২৪ রান। যেখানে সাঙ্গাকারার অবদান ছিলো ২৮৫ আর জয়বর্ধনের ৩০৯। ওই ম্যাচে জয়বর্ধনে খেলেছিলেন ৩৭৪ রানের এক অনবদ্য ইনিংস; যা তার ক্যারিয়ার সেরা। সেরা ৫ এ থাকা বাকি ৪ টিই ২০০০ সালের আগের।
নিজেদের পুরো ক্যারিয়ারের সব ম্যাচের পার্টনারশিপের যোগফল ছিলো এই লেখার মূল লক্ষ্য। সেখানে সেরা রাহুল দ্রাবিড় আর শচীন টেন্ডুলকারের ৬৯২০ রান। ১৯৯৬ থেকে ২০১২ পর্যন্ত তারা এই পরিমাণ রান করতে খেলেছেন ১৪৩ ইনিংস। পরবর্তী ৫ টি পার্টনারশীপের দিকে চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক:
- জয়বর্ধনে-সাঙ্গাকারা, ৬৫৫৪ রান। (২০০০-২০১৪)
- গর্ডন গ্রিনিজ-ডেসমন্ড হেইন্স, ৬৪৮২ রান (১৯৭৮-১৯৯১)
- ম্যাথু হেইডেন-জাস্টিন ল্যাঙ্গার, ৬০৮১ রান (১৯৯৭-২০০৭)
- এলিস্টার কুক- এন্ড্রু স্ট্রস, ৫২৫৩ রান (২০০৬-২০১২)
- ম্যাথু হেইডেন-রিকি পন্টিং, ৪৭৬৫ রান (২০০১-২০০৯)
কিন্তু শিরোনামে থাকা নাম দুটি কোথায়?
শিরোনামে থাকা নাম দুটি খুঁজতে গেলে এই তালিকার ২৮ নম্বর পার্টনারশিপের দিকে নজর দিতে হবে। প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে, সেরা ১০ হলেও মানা যেত; একেবারে ২৮ নম্বর নিয়ে কেনো কথা বলা?
২৮ নাম্বার পার্টনারশিপকে নিয়ে কথা বলার কারণ এটির ব্যপ্তি ১৯২৪ থেকে শুরু হয়ে ১৯৩০ অব্দি। অন্তত ২ হাজার রান করা হয়েছে এমন জোড়ার মধ্যে তাদের জোড়া সবথেকে পুরোনোর দিক থেকে ২য়। সবথেকে পুরোনোটিতেও নাম জড়িয়ে আছে জ্যাক হবসের। রোডসকে নিয়ে তার মোট রান ২২৯৪ যার ব্যাপ্তি ১৯১০ থেকে ১৯২১। জ্যাক হবস আর সাটক্লিফের মধ্যে একজন ইতিহাসের প্রথম পরিপূর্ন ব্যাটসম্যান, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তিনি মালিক ১৯৯ টি শতকের। আর অন্যজন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৫১ টি শতক আর ২২৯ টি অর্ধশতকের মালিক।
১৯২৪-১৯৩০ পর্যন্ত ৩৯ টি টেস্ট ইনিংসে একসাথে ব্যাট করে দুজন একসাথে করেছেন মোট ৩৩৩৯ রান। আর ২২০ রান একত্রে করে গেলেই প্রবেশ করে ফেলতেন সেরা ২০ এ। জ্যাক হবস এবং সাটক্লিফ দুজনই ছিলো ওপেনার এবং এই ৩৯ ইনিংসের মধ্যে ৩৮ ইনিংসেই তারা খেলেছেন ওপেনিং-এ। শুধু ১৯২৫ সালের একটি ম্যাচে জ্যাক হবস এবং হার্বার্ট সাটক্লিফ নেমেছিলেন ৫ এবং ৬ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে।
এই পার্টনারশিপের শুরুটা হয় টেস্ট ইতিহাসের ১৫১ তম ম্যাচ থেকে; সাটক্লিফের অভিষেক ম্যাচ সেটি। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৪ জুন ১৯২৪ থেকে শুরু হওয়া ম্যাচে হবস এবং সাটক্লিফ একসাথে করেন ১৩৬ রান। ২৮ জুন শুরু হওয়া পরের টেস্টে দুজনের একত্রে মোট সংগ্রহ ছিলো ২৬৮ রানের যা তাদের ২য় সর্বোচ্চ। মেলবোর্নে ১৯২৪ সালের ডিসেম্বরে খেলা টেস্টে তারা গড়েন তাদের সর্বোচ্চ ২৮৩ রানের জুটি।

বলতেই পারেন এটা তো এখনকার প্রেক্ষিতে কিছুই না; তবে এখনকার ওডিআই-টি২০ এর যুগে রান করা যত সহজ, সে সময়ের টেস্টে এতো সহজ ছিলো না। তখন ব্যাটসম্যান বোলারদের মধ্যে লড়াইটা হতো সমানে-সমান। তবে তাদের এই জুটি নিয়ে কথা বলার কারণ শুধু এটা না; কারণ হিসেবে পেছনে আছে তাদের নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাস আর অর্জনও। তাদের অর্জনগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছুটা জানানো যাক।
জ্যাক হবস
- জ্যাক হবসের জন্ম ১৮৮২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। ছয় ভাই-ছয় বোনের মধ্যে হবস ছিলেন সবার বড়। দারিদ্রতায় মোড়া সংসারে বাবা মারা গেলে জ্যাককে কিছুটা দায়িত্ব নিতে হয় সংসারের।
- প্রফেশনাল ক্রিকেট শুরু করেন ১৯০৫ সালে; কাউন্টি দল সারের হয়ে। জাতীয় দলে অভিষেক হয় ১৯০৮ সালেই।
- সবথেকে বেশি বয়সে শতকের রেকর্ড হবসের। নিজের ৪৩ বছর বয়স থেকে ৪৬ এর মধ্যে করেছেন প্রায় ১১ হাজার রান।
- দুইবার উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন। সর্বকালের সেরা ইংল্যান্ড দলেও জায়গা পান হবস।
- প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার আছে ১৯৯ টি শতক আর ২৭৩ টি অর্ধশতক। মোট রান ৬১,৭৬০।
- ১৯৫৩ সালে নামের আগে যুক্ত হয় “স্যার” । প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে এটি অর্জন করেন হবস।
- ১৯৬৩ সালের ২১ ডিসেম্বর মারা যান হবস। তবে এখনো আইসিসির অল টাইম বেস্ট টেস্ট ব্যাটসম্যান তালিকায় তিনি আছে ৪র্থ স্থানে।

হার্বার্ট সাটক্লিফ
- সাটক্লিফের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৪ নভেম্বর, মৃত্যু ২২ জানুয়ারি ১৯৭৮।
- জাতীয় দলে অভিষিক্ত হন ১৯২৪ সালে। পার্টনারশিপের শুরুটাও সেখান থেকেই।
- প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার আছে ১৫১ টি শতক আর ২২৯ টি অর্ধশতক। মোট রান ৫০ হাজারের উপরে।
- সাটক্লিফের পুরো টেস্ট ক্যারিয়ারে ব্যাটিং গড় কোনোদিন ৬০ এর নিচে নামেনি। ক্যারিয়ার শেষে গড় ছিলো ৬০.৯৩।
- টেস্ট ইতিহাসে দ্রুততম ১০০০ রান তারই, ৯ ম্যাচ আর ১২ ইনিংসে। ১৯৪৯ সালে এই রেকর্ডে ভাগ বসান ওয়েস্ট ইন্ডিজের এভারটন উইকস। ডন ব্র্যাডম্যান ২ ম্যাচ কম খেলে ১ হাজার করলেও ইনিংস বেশি খেলেছেন ১ টি।
- ১৯৪৯ সালে এমসিসির সদস্য মনোনীত হন। ২০০৯ সালে তিনি আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে স্থান পান।
ধুমধারাক্কা ক্রিকেটের এই যুগে হয়তো এরকম জুটি আরও অনেক হবে, তবে তাৎপর্য কিংবা মাধুর্য কোনোটিই এটিকে অতিক্রম করতে পারেনি, পারবে না। তাইতো আজ ৯০ বছর পরও কেউ একজন তাদের স্মৃতিচারণ করে গেলো।