১০ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

সাকিব আল হাসান, যে মানুষটা তার স্বপ্নের সমানই বড়!

প্রতিবেদক
Arfin Rupok
বুধবার, ২৪ মার্চ , ২০২১ ৮:১৩

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় হয়; কখনো বা স্বপ্নের চেয়েও বড় হয়। ফুটবলার বাবার কথা তোয়াক্কা না করে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে ধাবিত হওয়া সেই ছোট্ট ফয়সাল এখন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার! বাংলার ক্রিকেটের জান, বাংলার প্রাণ; মিস্টার রেকর্ড আল হাসান। বাইশ গজে যিনি রেকর্ড ভাঙ্গার কারিগর, আবার কিছু রেকর্ডে তিনি সেরাদের সেরা। দিনশেষে তিনি কোটি তরুণের আইডল, তিনি সাকিব আল হাসান।

আকাশ সমান স্বপ্ন দেখিছিলেন সেই ছোট্ট বেলাতেই; কিন্তু ফুটবলার বাবা সেই পথে দিয়েছিলেন বাঁধা! ফুটবল প্রিয় বাবা যেখানে স্বপ্ন দেখতেন তাদের সাকিব একদিন সেরা ফুটবলার হবেন। কিন্তু সাকিব মজেছিলেন ক্রিকেটে। হয়তো বাবার কথা অমান্য করে প্রতিজ্ঞ করেছিলে নিজেকে বিশ্বসেরা হিসেবে গড়ে তোলার! হ্যাঁ, সাকিব পেড়েছে তার স্বপ্ন পূরণ করতে। শুধু তাই নয়, নামের পাশে যুক্ত করেছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার তকমা।

ক্রিকেট বাঙালীর আবেগে পরিণত হয়েছে, বিশ্বের সামনে এখন বাংলাদেশ পরিচিত পেয়েছে তার অনেকটাই এই ক্রিকেটের কারণে। যেখানে সাকিব রয়েছেন অনন্য উচ্চতায়, রয়েছেন কোটি মানুষের হৃদয়মাঝে। সাকিব অনন্য, সাকিব এক উপন্যাস, সাকিব এক মহাকাব্য। যেখানে সাকিব এখন ক্যালিস, আফ্রিদি, কপিল, সোবার্সদের পাশে যুক্ত করেছেন নিজেকে, কিছু দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেছেন। কিন্তু শুরুর গল্পগুলো কি এমন ছিলো? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না।

সাকিব সময়ের সাথে সাথে পরিণত হওয়া এক পরিশ্রমী স্বপ্নবাজের নাম। যিনি স্বপ দেখেন, স্বপ্ন দেখান। আবার সেই স্বপ্নগুলো পূরণ করেন, হয়ে উঠেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবন্ধ; ধারণ করেন রূঢ়মূর্তি। ক্রিকেটের বাইশ গজে সাকিব এক মহাকাব্যের রচয়িতা, যেই রচনার পুরোটা জুড়েই নিজের সাফল্য তুলে ধরেছেন সাকিব। সবকিছু যখন সাকিবের পক্ষে কথা বলে তখন বলতেই হয় সাকিব তার স্বপ্নের সমানই বড়!

৯৭’ এ আকরাম খানের হাত ধরে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি লাল-সবুজের দেশে শোভা পেলে সাকিব তার ছোট বেলায় দেখা সেই স্বপ্ন পূরণের পথটি খুঁজতে থাকেন। এরপর শুরু হয় সাকিবের ক্রিকেটীয় উত্তাপ। ফুটবল প্রিয় বাবা সাকিবকে শাঁই না দিলেও সাকিব এগিয়ে যেতে থাকেন নিজের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। এবং সেখানেই সফল সাকিব, অল্প সময়ে ক্রিকেটকে নিজের আয়ত্তে। আজকের বাঁহাতি স্পিনারের শুরুটা হয়েছিলো একজন পেসার হিসেবেই! মাগুরার বিভিন্ন জায়গায় পেসার হিসেবেই পরিচয় পেয়েছিলেন। এভাবেই চলতে থাকে সাকিবের ক্রিকেটীয় অধ্যায়।

সময়টা ২০০১; ষষ্ঠ পেরিয়ে সপ্তম শ্রেণীতে পা রেখেছিলেন সাকিব। পড়াশোনার পাশাপাশি তখন গ্রামাঞ্চলে সাকিব পরিচিত পেয়েছিলেন পেসার হিসেবে। সেই সময় এলাকায় একটা ম্যাচে সাকিব হয়ে উটছিলেন বিধ্বংসী; ব্যাটে বলে প্রতিপক্ষকে গুড়িয়ে দিয়ে নজর কেড়েছিলেন আম্পায়ার সাদ্দাম হোসেনের। এরই সাথে খুলে যায় সাকিবের স্বপ্নের পথ। সাদ্দাম হোসেনের পরামর্শে তৎকালীন সময়ে সাকিব ভর্তি হোন মাগুরার ইসলামপুর পাড়া স্পোর্টিং ক্লাবে। শুরু হয় সাকিবের নতুন পথচলা।

নতুন পথচলায় বদলে যায় সাকিবের বোলিং স্টাইল; পেসার হিসেবে নজর কাড়া সাকিব শুরু করেন স্পিন বোলিং অনুশীলন। এভাবেই চলতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে যাওয়ার লড়াই। সেই লড়াইয়ে সাকিবের কপাল খুলে যায়। সেই বছর-ই বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিড়া প্রতিষ্ঠান বিকেএসপিতে সুযোগ হয়ে যায় সাকিবের। ২০ প্রতিভাবানের একজন সাকিব সেবার আশরাফুল হক বাপ্পি এবং কোচ সাদ্দাম হোসেনের পরামর্শে যুক্ত হোন বিকেএসপিতে। সেই সাথে মন জয় করেন বাবা-মায়ের। শুরু হয় সাকিবের নতুন অধ্যায়!

বাবা-মায়ের আদরের সেই ছোট্ট ফায়সালের নতুন অধ্যায়ে যেনো বাংলাদেশ ক্রিকেটে স্বস্তির বাতাস বইছিলো। মাগুরা মাতানো সাকিব ২০০২ সালে সুযোগ পেয়ে যান বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব ১৯ দলের ক্যাম্পে। সেই ক্যাম্পে যুক্ত হয়ে সাকিব চেনাতে শুরু করেন নিজের প্রতিভা। সেই প্রতিভার বিকাশ ঘটান ২০০৫ সালে এসেই; ইংল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে মাত্র ৮৬ বলে সেঞ্চুরি এবং বাঁহাতি স্পিন ঘূর্ণিতে তিন উইকেট শিকার করে জানান দেন বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন রাজার আগমন ঘটতে চলছে!

এর আগে, ২০০৪ সালে ফিরে যাই; যেখানে ১৭ বছরের দুরন্ত তরুণ সাকিব। মানুষ যে কখনো কখনো তার স্বপ্নের চেয়েও বড় হয় সেটির প্রমাণ দিয়েছিলেন সাকিব। মাত্র ১৭ বছরেই সুযোগ তৈরি করেছিলেন নিজেকে চেনানোর! খুলনা বিভাগের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেকও হয়ে গিয়েছিলো সাকিবের। আহ; এ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!

এই সময়ে অনূর্ধ্ব ১৫, ১৭ দলের হয়ে প্রতিভার বিকাশ ঘটানো সাকিব অ-১৯ কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেট; সবখানেই নিজেকে প্রমাণে হয়ে উঠেছিলেন মরিয়া। এর মাঝে ২০০৬ সালে অ- ১৯ দলের হয়ে মাত্র ১৮ ম্যাচে ৩৫.১৮ গড়ে ৫৬৩ রান এবং বল হাতে ২২ উইকেট শিকার করে যেনো হৈচৈ বাধিঁয়ে দিয়েছিলেন ক্রিকেট পাড়ায়!

২০০৬ সালে ক্রিকেট পাড়ায় হৈচৈ বাঁধানো সাকিব নজর কাড়েন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের তৎকালীন প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদের। জায়গা করে নেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অ্যাওয়ে সিরিজের স্কোয়াডে। যেখানে পাশে পেয়েছিলেন খালেদ মাসুদ, আশরাফুল, রফিকদের! পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম চার ম্যাচে একাদশ সুযোগ না পেলেও পঞ্চম ম্যাচে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পান সাকিব। নিজের অভিষেক ম্যাচে হারারেতে এলটন চিগুম্বুরাকে বোল্ড করে উল্লাসে মাতা সাকিব ব্যাট হাতে ৩০ রানে অপরাজিত থেকে দলকে জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছিলেন!

MUMBAI (BOMBAY), INDIA – OCTOBER 2: A headshot of Saqibul Hasan of Bangladesh taken ahead of the ICC Champions Trophy on October 2, 2006 in Mumbai, India. (Photo by Pradeep Mandhani/Getty Images)

এই হারারেতেই শুরু হয় সাকিবের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অধ্যায়! যেখানে সময়ের সাথে সাথে সাকিব ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকে, পূরণ করেছেন ছোট্ট বেলায় দেখা সেই স্বপ্ন গুলো! নদীর স্রোতের মতো বহমান এই জীবনে সাকিব যেই অর্জনগুলোর পাশে নিজেকে বসিয়েছেন তাতেই নিজেকে নিয়েছেন বিশ্বসেরাদের কাতারে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে দেওয়া সাকিব হয়তো একটু বেশীই ভাগ্যবান ছিলেন! নয়তো মাত্র এক ম্যাচ খেলেই বিসিবির চুক্তিতে আসার কথা নয় তার। তবে যেখানে নামটি সাকিব, সেখানে অসম্ভব বলেও কিছু নেই। সেই ধারাবাহিকতায় ২৮ নভেম্বর খুলনায় লাল-সবুজের টি-২০ জার্সিতেও নিজেকে নিযুক্ত করা সাকিব পরের বছরই জায়গা করে নেন ওয়ানডে বিশ্বকাপের স্কোয়াডে। আহ সাকিব; স্বপ্নবাজ সাকিব।

সাকিবের উদযাপন!

নিজের স্বপ্নের পথে অটুট থাকা সাকিবের স্বপ্ন ছিলো সাদা পোশাকে দেশের হয়ে মাঠ মাতানোর। সেই স্বপ্নটি পূরণ হতেও বেশী সময় নেননি তিনি। ২০০৭ সালের ১৮-ই মে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে ক্রিকেটের রাজকীয় ফরম্যাটের জার্সিটি গায়ে জড়ান সাকিব আল হাসান। ততদিনে নিজের স্বপ্নের পথ উন্মোচন হয়েছিলো সাকিবের। শুধু প্রমাণ করায় বাকি ছিলো তাঁর। ঘড়ির কাঁটার মতো সাকিব চলছেন সামনের দিকে। কখনোবা তীব্র ঝড়ে হারিয়েছেন গতি, তবে হননি পিছুটান। লড়াই করেছেন, পরিশ্রম আর সাধনায় নিজেকে মেলে ধরেছেন বিশ্ব দরবারে। যেখানে এখন সাকিব এক সফল ব্যক্তির নাম।

একজন স্বপ্নবাজ সাকিব কিংবা হালের বিশ্বসেরা সাকিবের গল্প সবারই জানা। জানা এক ঘাড়ত্যাড়া, বেয়াদবের গল্প। জানার কথা একজন প্রতিবাদীর গল্প। জানার কথা স্রোতের বিপরীতে বয়ে চলা এক লড়াকু সাকিবের গল্পগুচ্ছ! তবুও যদি জানতে ইচ্ছে করে তাহলে আসুন জেনে নিই সাকিবের জানা অজানা গল্পগুলো।

হালের সেরা এই অলরাউন্ডারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের শুরুর গল্পে ছিলোনা এতোটা রাজকীয় ভাব! ছিলোনা বোলার সাকিবের কৃতিত্ব! সেই সময়ে নির্ভরযোগ্য মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবেই সাকিব ছিলেন পরিচিত। ওয়ানডে ক্রিকেটে নিজের ৩৯ তম ম্যাচে এসে স্পর্শ করেছিলেন ১০০০ রানের মাইলফলক! ততোদিনে তুলে নিয়েছিলেন রঙ্গিন পোশাকে নিজের প্রথম শতক, খেলেছিলেন ১৩৪ রানের অপরাজিত ইনিংস, যেটি এখন পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে সাকিবের সর্বোচ্চ রানের ইনিংস! আচ্ছা আসুন সাকিবের পুরো ওয়ানডে ক্যারিয়ারের গল্প শুনি…

ওয়ানডে ক্রিকেট এবং সাকিব:
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে লাল-সবুজের জার্সিতে অভিষেক হওয়া সাকিব এখন পর্যন্ত খেলেছেন ২০৯ টি ওয়ানডে ম্যাচ। এই ২০৯ ম্যাচে সাকিবের পারফরম্যান্সগুলো দেখে নেওয়া যাক।

ব্যাটসম্যান সাকিব:

ম্যাচ    রান     গড়    সেঞ্চুরি   ফিফটি  
২০৯   ৬৪৩৬   ৩৮.০৮     ৯      ৪৮

বোলার সাকিব:

ম্যাচ   মেইডেন  উইকেট   গড়   পাঁচউইকেট   
২০৯     ৮৫     ২৬৬  ২৯.৭৩     ২

বোলার সাকিব কিংবা ব্যাটসম্যান সাকিব ২০৯ টি আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছেন ১৬ টি দেশের বিপক্ষে। যেভাবে সবচেয়ে বেশী(৪৫) ম্যাচ খেলেছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এই ১৬ টি দেশের বিপক্ষে সাকিবের পারফরম্যান্স দেখে নেওয়া যাক:

  প্রতিপক্ষ       রান     উইকেট  
আফগানিস্তান     ২২৮      ১৮
অস্ট্রেলিয়া       ২১৭      ০৫
বারমুডা         ৬৮       ০৩
কানাডা         ১৩৪      ০২
ইংল্যান্ড         ৩৯৯      ১৪
ভারত          ৫৯১      ১৯
আয়ারল্যান্ড      ১৭৫      ১২
কেনিয়া          ৫৮      ০৩
নেদারল্যান্ডস      ১৬      ০৩
নিউজিল্যান্ড      ৬৩৯      ৩৭
পাকিস্তান        ৫৫৩      ২১
স্কটল্যান্ড        ১১৬      ০৩
দক্ষিণ আফ্রিকা   ৩৯৭      ১৩
শ্রীলঙ্কা         ৬০৭       ১৫
ওয়েস্ট ইন্ডিজ    ৮৩৪      ২৪
জিম্বাবুয়ে       ১৪০৪      ৭৪
বিজয়ের উল্লাস!

১৬ টি দেশের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্রিকেট মাতানো সাকিব একাদশে থাকা অবস্থায় দলের মোট রানের ১৪.৫১% রান এবং মোট উইকেটের ১৭.৬২ শিকার করেছেন। এখানে ৬৪৩৬ রান করা সাকিব ওয়ানডে ক্যারিয়ার বোল্ড আউট হয়েছেন ৩২, ক্যাচ আউট ১০৪, এলবিডব্লিউ ১৪, স্ট্যাম্পিং ৭ এবং রান আউট হয়েছেন ১২ বার। এবং স্পিন ঘূর্ণিতে ২৬৬ উইকেট শিকার করা সাকিব বোল্ড করেছেন ৫৬, ক্যাচ ১৩৯, এলবিডব্লিউ ৫০ এবং স্ট্যাম্পিংয়ের মাধ্যমে শিকার করেছেন ২১ উইকেট। এরই মাঝে টপ অর্ডারে ৯৮, মিডল অর্ডারে ১২০ এবং লোয়ার অর্ডারে ৪৮ টি উইকেট শিকার করেছেন।

ওয়ানডে ক্রিকেট বেশকিছু রেকর্ডের সাথে যুক্ত সাকিব; চলুন সেই রেকর্ডগুলো দেখে নেওয়া যাক:

  • এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ৪০+ উইকেট শিকার করা ৭০ বোলারের একজন সাকিব। ২০১০ সালে ৪৬ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় বোলার হিসেবে এই কীর্তি গড়েন সাকিব।
  • ওয়ানডে ক্রিকেটে এক ম্যাচের পুরো স্পেল শেষ করে ১.১০ এর নিচে রান দেওয়া ৩১ তম বোলার সাকিব। ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাত্র ১১ রান খরচায় ৩ উইকেট শিকার করা সাকিবের পর এতো কম ইকোনমিকে স্পেল শেষ করতে পারেনি কোনো বোলার!
  • আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্রুততম সেঞ্চুরির তালিকায় রয়েছেন ২৫ নাম্বারে, বাংলাদেশ পক্ষে দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান সাকিব।
  • ওয়ানডে ক্রিকেট একই ম্যাচে ফিফটি এবং চার উইকেট শিকারের ঘটনা ঘটেছে ৬৭ বার। যেখানে সাকিব এমন ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছেন ৩ বার।
  • একই ম্যাচে সেঞ্চুরি এবং চার উইকেট শিকার করা ১৫ অলরাউন্ডারের একজন সাকিব।
  • অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশী সেঞ্চুরির তালিকায় সাকিব রয়েছেন ২৬ নাম্বারে!
  • একটি নির্দিষ্ট মাঠে সবচেয়ে বেশি রান করা ব্যাটসম্যানের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন সাকিব।
  • এক ইনিংসে দলের মোট রানের ৫০% বা তার বেশী রান করা ৫৫ ব্যাটসম্যানের একজন সাকিব।
  • ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ব্যাট হাতে ৫০০০+ রান, বল হাতে ২৫০+ উইকেট এবং ফিল্ডিংয়ে ৫০ টি ক্যাচ নেওয়া চার অলরাউন্ডারের একজন সাকিব।
  • একই ম্যাচে সেঞ্চুরি এবং পাঁচ উইকেট শিকার করা ১৫ ক্রিকেটারের একজন সাকিব।
  • এক সিরিজে ৬০০+ রান এবং ১০+ উইকেট শিকারী চার ক্রিকেটারের একজন সাকিব।

এই গেলো ওয়ানডে ক্রিকেটের গল্প! এবার টি-২০ ক্রিকেটে তাকালে দেখা যায় এখানেও সফল সাকিব, একজন সফল অলরাউন্ডার তিনি। লাল-সবুজের হয়ে ৭৬ ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা অর্জন করা সাকিব রয়েছেন সেরা হবার দৌড়ে। আসুন ব্যাটে-বলে সাকিবের পারফম্যান্স দেখে নেওয়া যাক:

ম্যাচ   রান   ব্যাটিংগড়  উইকেট   বোলিংগড়   ৭৬   ১৫৬৭   ২৩.৭৪    ৯২      ২০.৫৯

যেখানে দলের মোট রানের ১৪.৬৭% রান এবং মোট উইকেটের ২০.৩৫ উইকেট শিকার করেছেন সাকিব। ওয়ানডের মতো টি-২০ ক্রিকেটেও ১৬ টি দেশের বিপক্ষে খেলেছেন সাকিব। যেখানে ৬ টি দেশের বিপক্ষে ১০০+ রান এবং ৩ টি দেশের বিপক্ষে ১০+ উইকেট শিকার করেছেন এই অলরাউন্ডার। ৯২ উইকেট শিকার করা সাকিব বিপক্ষের টপ অর্ডারের ৪৮.৯% উইকেট শিকার করেছেন। টি-২০ ক্রিকেটেও বেশকিছু রেকর্ডের সাক্ষী হয়ে আছেন সাকিব, চলুন চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক:

  • এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশী চার উইকেট শিকার করা বোলারদের তালিকায় আছেন ৪ নাম্বারে।
  • মোট উইকেটের ১৯.৫৭% উইকেট শিকার করেছেন বোল্ড আউটের মাধ্যমে, যা সাকিবকে রেখেছে ৯ নাম্বারে।
  • টি-২০ ক্রিকেটে ক্যাচ আউটের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশী উইকেট শিকারী বোলারের তালিকায় আছেন ৪ নাম্বােরে। ক্যারিয়ারের ৫০% উইকেট শিকার করেন বোল্ড আউটের মাধ্যমে।
  • টি-২০ ক্রিকেটে ১৫০০+ রান এবং ৫০+ উইকেট শিকার করা তিন ক্রিকেটারের একজন সাকিব।

রঙিন পোশাকের সাকিবকে এবার ক্রিকেটের রাজকীয় ফরম্যাটে বিশ্লেষণ করতে গেলে সামনে আসবে সাফল্যের গল্প। একেকটা গল্প দিয়ে লেখা যাবে উপন্যাস। ক্যারিয়ার শেষে সাকিব ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটার অপেক্ষায় থাকতে হবে আরো কিছুদিন। আপাঃতত ক্রিকেটের রাজকীয় ফরম্যাটে সাকিবের কিছু দিক দেখে নেওয়া যাক:

ভারতের বিপক্ষে টেস্ট জার্সি গায়ে দেওয়া সাকিব এখন পর্যন্ত খেলেছে ৫৭ ম্যাচ। যেখানে সাকিব ব্যাটে বলে মেলে ধরেছেন সাকিব, ছাড়িয়ে গেছেন সেরাদের। এই ৫৭ ম্যাচ খেলেই সাকিব যতোটা পথ পাড়ি দিয়েছে সেটাই চোখ বুলিয়ে দেখা যাক!

ব্যাটসম্যান সাকিব:

 ম্যাচ    রান    গড়   সেঞ্চুরি   ফিফটি  
 ৫৭    ৩৯৩০  ৩৯.৭০    ৫      ২৫

বোলার সাকিব:

ম্যাচ   মেইডেন   উইকেট  গড়  পাঁচউইকেট   
৫৭     ৩৯৩     ২১০  ৩১.২০   ১৮

সাদা পোশাকের স্পিনার সাকিবের শুরুটা ছিলো হতাশাজনক! নিজের প্রথম ৬ ম্যাচে মাত্র ৩ উইকেট শিকার করা সাকিব ৭ম টেস্টে করে বসেন বাজিমাৎ; নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে মাত্র ৩৬ রান খরচায় তুলে নেন ৭ উইকেট। এরপর সাকিবকে পিছনে তাকাতে হয়নি, শুধু সময়ের বিবর্তনে ছাড়িয়ে গেছেন সেরাদের কিংবা বসেছেন সেরাদের কাতারে। দিনশেষে সাকিব বাংলার গর্ব; বাংলার অহংকার।

অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সাকিবের উদযাপন!

দলীয় রানের ১৩.৯০% রান করা সাকিব শিকারে পুড়েছেন দলের মোট উইকেটের ২৭.২৪ শতাংশ! এখানেই শেষ নয়, করেছেন বেশকিছু রেকর্ড। চলুন সেই রেকর্ডে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক:

  • টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে ৯ টি ভিন্ন ভিন্ন দেশের বিপক্ষে ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকারী চার বোলারের একজন সাকিব।
  • একই ম্যাচে ফিফটি এবং পাঁচ উইকেট শিকারের ঘটনা রয়েছে ১৯৮ বার, যেখানে সাকিব সাত বার এমন কীর্তি গড়েছেন।
  • একই ম্যাচে সেঞ্চুরি এবং ১০ উইকেট শিকার করা তৃতীয় ক্রিকেটার সাকিব।
  • একই ম্যাচে সেঞ্চুরি এবং পাঁচ উইকেটের ঘটনা ঘটেছে ৩৩ বার, যেখানে সাকিবের মাধ্যমে ঘটেছে ২ বার।
  • এছাড়াও টানা ৩ ইনিংসে পাঁচ উইকেটের কীর্তি রয়েছে সাকিবের।
  • অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে সেরা বোলিং ফিগার সাকিবের দখলে।
  • রয়েছে নির্দিষ্ট মাঠে ১ হাজারের বেশী রান করার রেকর্ড!
  • এছাড়াও ১০ টি দলের বিপক্ষে টেস্ট খেলা সাকিবের ৮ টি দেশের বিপক্ষে কমপক্ষে ৫০ রানের ইনিংস রয়েছে।
  • ব্যাটিংয়ে ৩৫০০+ রান এবং ২০০+ উইকেট শিকারী ৯ ক্রিকেটারের একজন সাকিব।

এমন বেশকিছু রেকর্ডের সাক্ষী হয়ে আছেন এই অলরাউন্ডার! এখানেই শেষ হতে পারতো সাকিবের পারফরম্যান্স। কিন্তু কিছু বিষয়ে এখনো অজানায় রয়ে গেলাম। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে সাকিবকে বিশ্লেষণ করতে গেলে সাকিব রয়েছেন তিন জনের মধ্যে! আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ হাজার রান এবং ৫০০ উইকেট শিকারী তৃতীয় ক্রিকেটার আমাদের সাকিব আল হাসান।

ব্যাটে বলের পারফরম্যান্স নিয়ে তো অনেক কিছুই জানা হলো, এবার একটু অন্য পরিসংখ্যানে নজর দেওয়া যাক:

একজন ক্রিকেটার কখনো ঘরের মাঠে খেলে আবার কখনো ঘরের বাহিরের মাঠে, কখনো বা রাতে আবার কখনো বা দিনে; অধিনায়ক কিংবা নন অধিনায়ক হিসবেও খেলে থাকেন অনেকে। চলুন এবার এমন কিছুতে সাকিবকে জানা যাক।

হোম না-কি অ্যাওয়েতে সেরা সাকিব?
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে যেই পরিসংখ্যান সামনে আসবে সেখানে সাকিব কোথায় সেরা সেটি প্রমাণ করা কষ্টকর। তাই পরিসংখ্যানই দেখে নেওয়া যাক:

ফ্যাক্ট:

ফরম্যাট    ম্যাচ     রান     উইকেট
হোম      ১৭১    ৬১১৩      ৩৩৬
নিউট্রাল    ৬২    ৩৮২২      ১৬১
অ্যাওয়ে    ১০৯   ১৯৯৮       ৭১

ঘরের মাঠে পাঁচ সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া সাকিব অ্যাওয়ে সিরিজে ৬ বার করেছেন সেঞ্চুরি উদযাপন! এছাড়াও নিরপেক্ষ ভেন্যুতে ৩ টি সেঞ্চুরি উদযাপন করেছেন মি. অলরাউন্ডার।

হোম, অ্যাওয়ের গল্প বাদ দিলে আসবে দিনের আলো না-কি ফ্লাডলাইটের আলোতে সেরা সাকিব! না-কি দিবারাত্রির ম্যাচে সফল এই অলরাউন্ডার? আসুন দেখে নেওয়া যাক:

   ফ্যাক্ট      ম্যাচ     রান     উইকেট 
  ডে ম্যাচ     ২০৫    ৮২২৮     ৩৮৬
 নাইট ম্যাচ     ২৯     ৫৯৫      ৩২
ডে-নাইট ম্যাচ   ১০৮    ৩০১০     ১৫০

ডে ম্যাচে ১১ সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া সাকিব ডে-নাইট ম্যাচে করেছে ৩ সেঞ্চুরি, এছাড়াও নাইট ম্যাচে খেলেছেন ৭০ রানের অপরাজিত ইনিংস!

আন্তজার্তিক ক্যারিয়ারে আট অধিনায়কের নেতৃত্ব মাঠ মাতিয়েছেন সাকিব। যেখানে মাশরাফির অধিনে ১০১ ম্যাচ খেলা সাকিব রান এবং উইকেটের দিক দিয়ে সফলতা পেয়েছেন ৬৭ ম্যাচ খেলা মুশফিকের নেতৃত্বে। এই দুই অধিনায়কের নেতৃত্বেই রয়েছে ৩ হাজারের বেশী রান এবং ১০০ এর বেশী উইকেট।

অধিনায়ক এবং নন অধিনায়ক সাকিব!
ব্যাটে বলে বিশ্ব মাতানো সাকিব অধিনায়ক হিসেবেও মন্দ নয়। ক্যারিয়ারের ৩৪২ ম্যাচের ৮৫ ম্যাচে করেছেন টস! এবার অধিনায়ক এবং নন অধিনায়ক সাকিবের পারফরম্যান্স দেখে নেওয়া যাক:

  ফ্যাক্ট      ম্যাচ     রান    উইকেট   
 অধিনায়ক    ৮৫     ২৯১৯    ১৫৬
নন অধিনায়ক ২৫৭     ৯০১৪    ৪১২
২০১১ বিশ্বকাপে অধিনায়ক সাকিব!

আইসিসির বিভিন্ন টুর্নামেন্টে সাকিব!
সাকিব মানেই রেকর্ড; বিশ্বমঞ্চেও সেটির প্রমাণ রেখেছেন সাকিব। ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টানা ৮ ইনিংসে খেলেছেন ৪০+ রানের ইনিংস। এছাড়াও এক বিশ্বকাপে ৭ ফিফটির রেকর্ড রয়েছে সাকিবের। এখানেই শেষ নয়, এক বিশ্বকাপে ৬০০+ রান এবং ১০+ উইকেট শিকারী একমাত্র ক্রিকেটর সাকিবের আরো একটি জায়গায় নাম্বার ওয়ান! বিশ্বকাপ ইতিহাসে ১১০০ রান এবং ৩০ উইকেট শিকারী একমাত্র অলরাউন্ডার সাকিব। এছাড়াও ওয়ানডে এবং টি-২০ বিশ্বকাপে দেশের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার সাকিব!

বিশ্বকাপে সেরাদের সেরা সাকিব!

একজন সাকিব শুধু ব্যাটে বলেই অবদান রেখেছেন? না।
অলরাউন্ডার সাকিব সবকিছুতেই অলরাউন্ডার। দেশের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আন্দোলনের; পেশ করেছিলেন বেশকিছু দাবী। যেটির পর নড়েচড়ে বসেছিলো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড; বেশকিছু ক্ষেত্রে দেখাও মিলেছে উন্নতির। সাকিব একজন ভয়ডরহীন ক্রিকেটারের নাম। যার কাছে দেশের ক্রিকেটের উন্নতিই মূখ্য!

ক্রিকেটারদের আন্দোলনে লিডার সাকিব!

সাকিবের গুণগান তো অনেক হলো এবার বিতর্কিত সাকিবকে জানা যাক!

সাকিব বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারের একজন হলেও বিতর্ক তাকে ঘিরে রাখে। কখনো নিয়ম ভঙ্গ, কখনো অশোভন আচরণ আবার কখনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়েও হয়েছেন নিষিদ্ধ। ক্রিকেট বোর্ড থেকে ৬ মাসের সাজা পাওয়া সাকিব নিষিদ্ধ হয়েছিলেন আইসিসি থেকেও। ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত না হয়েও শুধুমাত্র বিষয়গুলো গোপন রাখায় এক বছরের সাজা পেতে হয়েছিলো সাকিবকে। এছাড়াও ক্রিকেটের বাইশ গজে প্রতিবাদী সাকিবকে বেশকয়েকবার গুনতে হয়েছে জরিমানা। শুধু তাই নয়, ২০১৯ বিশ্বকাপের দলের ফটোশেসনে না থাকায় হয়েছিলেন সমালোচিত, এবং সর্বশেষ আরেকটি বিতর্ক জন্ম দিয়েছেন সাকিব। বিতর্কিত সাকিব কিংবা সমালোচিত সাকিব, কখনো এইসব নিয়ে ভাবেবনা, প্রমাণ করেন বাইশ গজে, দেন সমালোচনার জবাব। তাইতো সাকিব অন্য সবার থেকে আলাদা, অনন্য নিদর্শন।

নিজের ভুল স্বীকার করে আরো কঠিন হয়ে ফেরার ঘোষণা সাকিবের!

সাকিব কোটি তরুণের আইডল, কোটি ভক্তের ভালোবাসার নাম। এই সাকিব স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে। দিনশেষে সাকিব বাঙালির গর্ব, বাঙালির অহংকার।

সাকিব এক বিশ্বসেরার নাম; আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়াও টি-২০ ক্রিকেটে ফেরি করে বেড়ান বিভিন্ন দেশ, ব্যাটে-বলে পারফরম্যান্স করে উজ্জ্বল করেন দেশের নাম, নিজেকে নিয়ে যান রেকর্ডের প্রথম পাতায়!

এই সাকিব ১৯৮৭ সালের আজকের দিনে খুলনার মাগুরা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ৩৪ পেরিয়ে ৩৫ এ পা দেওয়া সাকিবকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

শুভ জন্মদিন ময়না!

, ,

মতামত জানান :