ফরোয়ার্ড শব্দটির সাথে কে না পরিচিত; ফুটবলে এই শব্দটির ব্যপক ব্যবহার লক্ষনীয়। একজন ফরোয়ার্ড যে কিনা কখনোবা দলকে রক্ষা করেন আবার কখনোবা প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে ফাঁকি দিয়ে গোল করে দলকে জিতিয়ে দেয়, আবার কখনোবা তৈরি করে গোলের সুযোগ। সবমিলিয়ে একজন ফরোয়ার্ডের ভূমিকা পরিবর্তনীল। ঠিক তেমনি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ক্ষেত্রেও; কিন্তু কিভাবে?
জয়ের লক্ষ্যমাত্রা ২৬৬ রান, অনেক আশা নিয়ে টিভির সামনে খেলা দেখতে বসলেন, কিন্তু ৪৪ রানে ৪ ব্যাটসম্যান সাজঘরে, রাগে ক্ষোভে টিভির সামনে থেকে উঠে পড়লেন। কিছুটা সময় অতিবাহিত হবার পরে যখন আপনি জানতে পারলেন বাংলাদেশ জিতেছে, তখন আপনার মনে নিশ্চিত ভাবনা আসবে কে বা কারা দলকে জিতিয়েছে বা জয়ের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। স্কোরকার্ডে নজর দিতেই দেখতে পেলেন পাঁচ নাম্বার পজিশনে নামা সাকিব ১১৪ ও ছয় নাম্বার পজিশনে নামা মাহমুদউল্লাহ ১০২ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছে, তখন আপনি মাহমুদউল্লাহকে কিভাবে মূল্যয়ন করবেন জানিনা, তবে আমি একজন ফরোয়ার্ড হিসেবেই মূল্যয়ন করবো। এখানে মাহমুদউল্লাহ দলকে জয়ী করানোর ক্রেডিট পাবে আবার জয়ের পথে এগিয়ে নেওয়ারও ক্রেডিট পাবে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন বেশকিছু ইনিংস খেলেছেন মাহমুদউল্লাহ, যার কারণে আপনি তাকে ফরোয়ার্ড বলতেই পারেন। পরিস্থিতি যখন যেখানে যেমন তখন সেভাবেই মেলে ধরেছেন নিজেকে। কখনো প্রতিপক্ষের বোলারদের দেখেশুনে খেলে এগিয়ে নিয়েছে দলকে আবার কখনো চার-ছক্কায় এগিয়ে নিয়েছেন রানের চাকা। দিনশেষে রিয়াদের এমন বেশকিছু ইনিংসের কারণেই লড়াইয়ে পুঁজি পাওয়া বাংলাদেশ জয়ের মুখও দেখছে কিছু ম্যাচে, কিংবা কমিয়েছে হারের ব্যবধান। আবার কখনো প্রয়োজনীয় মূহুর্তে বল হাতে ব্রেকথ্রু এনে দিয়েও বেশকিছু ম্যাচে রেখেছে অবদান। ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং; সবমিলিয়ে অলরাউন্ডার মাহমুদউল্লাহকে দিনশেষে ফরোয়ার্ড বলা কি যায়না? অবশ্যই যায়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে ৯ টি টেস্ট, ৮৮ ওয়ানডে এবং ২৯ টি টি-২০ মিলিয়ে মোট ১২৬ টি ম্যাচ জয়ের সাক্ষী হয়ে আছেন মাহমুদউল্লাহ। যেখানে ৪৭ গড়ে রান করেছেন তিনি, এর থেকেও বড় কথা মাহমুদউল্লাহর ব্যাটে ভর করে বেশকিছু ম্যাচে জয়ের পথ উন্মোচন হয়েছিলো। এইসব খুঁজতে গেলে কয়েকটি ইনিংস তুলে ধরতেই হয়…..
[ওয়ানডে]
২০০৮ সাল, প্রতিপক্ষ আয়ারল্যান্ড; ৪৯* ও ৪১/১
তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবস্থা জানার কথা। ১৭৮ রানে ৫ উইকেট হারানো বাংলাদেশ পুঁজি পেয়েছিলো ২৯৩ রানের। যেখানে তামিম ইকবালের ১২৯ এবং নাফিসের ৫৪ রানের পর সাতে নেমে মাহমুদউল্লাহ খেলেছিলেন ৪৯ রানের অপরাজিত ইনিংস। মাহমুদউল্লাহ – তামিমের কল্যানে পরের ১৩ ওভারে আসে ১১৫ রান! শুরুতে তামিমকে সঙ্গ দিলেও শেষ দিকে দলের এবং নিজের রানকে বাড়িয়ে নিয়েছিলেন রিয়াদ, সেই সাথে ১০ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৪১ রানের বিনিময়ে শিকার করেছিলেন ১ উইকেট। ম্যাচটিতে ৭৯ রানে জয় পায় বাংলাদেশ।
২০০৯ সাল, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ; ৩৮/২ ও ৫১*
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট কিটসে সেদিন বল হাতে ২ উইকেট শিকার করা মাহমুদউল্লাহ ব্যাট হাতে রক্ষা করেছিলেন দলকে। শুধু রক্ষা নয়, জয়ও এনে দিয়েছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দেওয়া ২৪৯ রানের জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নামা বাংলাদেশ ১৩৩ রানে হারিয়ে বসে ৫ উইকেট। সেখান থেকে মুশফিক, নাঈমকে সাথে নিয়ে দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেওয়া রিয়াদ জিতেছিলেন ম্যাচসেরার পুরষ্কার।
- ২০১১ সাল, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে; ৬০* ও ১৩/৩
২০১১ সাল, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড; ২১* এবং বিশ্বমঞ্চে প্রথমবার ইংরেজ বধ!
ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড বধের কথা সবারই জানা। ২২৬ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ ১৬৯ রানে হারিয়ে বসে ৮ উইকেট। সেখানে দায়িত্বশীল ইনিংস খেলে দলকে এনে দেন ২ উইকেটের জয়। যদিও এখানে ক্রেডিট শফিউলকে দিতে হবে, কিন্তু রিয়াদের অবদান অস্বীকার করার কারণ নেই।
২০১৫ সাল, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড; ১০৩
এর আগে চার বিশ্বকাপে বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি সংখ্যা শূন্য! সেখানে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ, সেটিও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে ৮ রানে ২ উইকেটের পতন টাইগার শিবিরে। সেখান থেকে অসাধারণ এক সেঞ্চুরি উপহার দেন রিয়াদ। ম্যাচে রিয়াদের ১০৩ রান, ও মুশফিকের ৮৯ রানের উপর ভর করে ২৭৫ রানের পুঁজি পাওয়া বাংলাদেশ জিতেছিলো রুবেলের অসাধারণ বোলিং নৈপুণ্যে। রিয়াদ হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা!

- ২০১৬ সাল, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড; ৭৫ রান এবং বাংলাদেশ ৩৪ রানে জয়ী।
২০১৭ সাল, প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড; ৪৬*
ডাবলিনে ত্রিদেশীয় সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই! নিউজিল্যান্ডের দেওয়া ২৭১ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ ৩৮.২ ওভারে করে ১৯৯ রান! জয় থেকে তখনো ৭২ রান দূরে, এমন পরিস্থিতিতে মুশফিককে সাথে নিয়ে ৩৬ বলে ৪৬ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলকে জয় এনে দিয়েছিলেন ৫ উইকেটের। বোলিংয়ে সুযোগ না পেলেও ফিল্ডিংয়ে নিয়েছিলেন ২ ক্যাচ।
২০১৭ সাল, প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড; ১০২*
কার্ডিফে বাংলাদেশের অর্জন বেশ। ঠিক তেমনি আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতেও রয়েছে স্মরণীয় জয়। ২৬৬ রানর জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নামা বাংলাদেশ যখন ৪৪ রানেই হারিয়ে বসে ৪ উইকেট, তখনি সাকিবের সাথে ৫ম উইকেট জুটিতে করে বসেন বাজিমাৎ, খেলেন হার না মানা ১০২ রানের অপরাজিত ম্যাচ উইনিং ইনিংস। সেদিন রিয়াদের ব্যাটিং বা বুদ্ধিমত্তাকে কিভাবে মূল্যয়ন করবেন সেটি আপনার উপর নির্ভর করবে।
- ২০১৮ সাল, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ; ৬৭* এবং বাংলাদেশ ১৮ রানে জয়ী।
২০১৭ সাল, প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান; ৭৪ ও ১৭/১
এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেদিন মহাগুরুত্বপূর্ণ এক ইনিংস খেলেছিলেন রিয়াদ। মাত্র ৮৭ রানে ৫ উইকেট হারানো বাংলাদেশ পুঁজি পেয়েছিলো ২৪৯ রানের, ইমরুলের ৭২ রানের সাথে রিয়াদ খেলেছিলো ৭৪ রানের ইনিংস। সেই সাথে বোলিংয়ে ৫ ওভার হাত ঘুরিয়ে ১ উইকেট শিকার করেন। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ জয় পেয়েছিলো মাত্র ৩ রানে!
- ২০১৯ সাল, প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা; ৩৩ বলে ৪৬* এবং ২০১৯ বিশ্বকাপে প্রথম জয়।
- ২০২১ সাল, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ; ৬৪ এবং বাংলাদেশের জয়।
[টেস্ট]
২০০৯ সাল, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ – ৯; ৫৯/৩ ও ৮; ৫১/৫
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়, শুধু তাই নয় টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের দ্বিতীয় দ্বিতীয় জয়ের ম্যাচে ব্যাটসম্যান রিয়াদ অচেনা হলেও বল হাতে দুই ইনিংসে যা করেছিলো তাতে নিয়ে বলায় যায়। একজন ফরোয়ার্ড যেমন সবসময় গোল না করেও দলকে জেতাতে পারেন তেমনি রিয়াদ ব্যাটিংয়ে সেরাটা না দিয়েও বোলিংয়ে সেরাটা দিয়ে দলকে জয় এনে দিয়েছিলো সেদিন।
- ২০১৬ সাল, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড; ১৩, ৪৭ এবং টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়!
২০১৮ সাল, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে- ১০১*
প্রথম ইনিংসে মুশফিকের ডাবল এবং মুমিনুলের সেঞ্চুরিতে জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হলেও দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ২৪ রানে ৪ উইকেট থেকে ২২৪ রানের পুঁজি এনে দিতে রিয়াদের অবদান কম ছিলোনা!
- ২০১৮ সাল, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ; ১৩৬ এবং বাংলাদেশের জয়।
[টি-২০]
২০১৮ সাল, প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা; ১৮ বলে ৪৩*
এই ম্যাচটির কথা কম-বেশি সবারই জানা। কি ঘটেনি ম্যাচে? টানটান উত্তেজনা কিংবা বিতর্ক, সবই ঘটেছিলো। শ্রীলঙ্কার দেওয়া ১৬০ রানের বিপরীতে শেষ ৪ বলে প্রয়োজন ছিলো ১২ রানের। সেখানে ১ বল হাতে রেখে জয় পাওয়া বাংলাদেশ সেদিন আনন্দে মেতেছিলো রিদায়ের ছক্কাতেই। সেদিন ২৩৮।স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করা রিয়াদ জিতেছিলেন ম্যাচ সেরার পুরুষ্কার।

- ২০১৮ সাল, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ; ৪৩* ও ১/১ এবং বাংলাদেশের জয়।
- ২০১৯ সাল, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে; ৪১ বলে ৬২ এবং বাংলাদেশের জয়।
জয়ী ম্যাচগুলোতে এমন আরো ইনিংস রয়েছে মাহমুদউল্লাহ। কমবেশি সব ম্যাচেই রয়েছে অবদান। দিনশেষে এটার জন্য বাহবাও মিলেছে তাঁর।
জয়ী ম্যাচে যেমন অবদান রেখেছেন হারের ম্যাচেও দলকে রক্ষার জন্য লড়াই করেছেন বেশ, যদিও পারেননি দলকে জয় এনে দিতে। তাই বলে ২০০৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে দলের বিপর্যয়ের মূহুর্তে অপরাজিত ৫৮, ভারতের বিপক্ষে ২০১০ সালে ৪৫ বলে ৬০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলকে ২৯৬ রানের পুঁজি এনে দেওয়া কিংবা ৯৫ রানে ৫ উইকেট হারানো দলকে ২৪৭ রানে পৌঁছে দিতে ৬৪* রানের ইনিংসগুলো কিন্তু খারাপ ছিলোনা।
ভারতের বিপক্ষে ২০১০ টেস্টে ৫১ রানে ৫ উইকেট হারানো বাংলাদেশ ২৩৩ রানের পুঁজি পেয়েছিলো রিয়াদের ৯৬ রানেই! ২০১০ এ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কঠিন পরিস্থিতিতে ১১৫ ও ৪২ রানের ইনিংসগুলোর জন্যও রিয়াদ লড়াই করেছিলো বেশ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০১১ সালের ৬৮ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছিলো বেশ। এছাড়াও চাপের মুখে ৭৬, ৫২, ৫৬, ৬৪, ৭৫, ৬৬, ৫৩, ১২৮, ৬৭, ৬৯ রানের ইনিংগুলো কোনো অংশেই খারাপ ছিলোনা। খারাপ ছিলোনা ২০২১ এ এসে নিউজিল্যান্ডের মাঠে ৮২ রানে ৭ উইকেট হারানো বাংলাদেশকে ১৫৪ তে নিয়ে যেতে হার না মানা ৭৬ রানের ইনিংসটিও!
একজন ফরোয়ার্ড সবসময় ভালো কিছু করে দলকে জিতিয়ে দেয় এমনটা নয়, একজন ফরোয়ার্ড ৫/৭ জনকে কাটিয়ে গোলের সুযোগ তৈরি করলেও খলনায়ক হয়ে যান একটা পাসিং না করে নিজেই গোল করতে গিয়ে মিস করে! ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিজের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসার নজিরও কম স্হাপন করেননি মাহমুদউল্লাহ। ২০১২ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে মাত্র ২ রানের হার কিংবা ২০১৬ সালে টি-২০ বিশ্বকাপে ১ রান হার! সবখানেই রিয়াদকে দোষী করতে পারবেন।
কিন্তু ফিনিশিং পজিশন তথা সাত, আটে ব্যাটিংয়ে নেমে দলকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করা রিয়াদকে আপনি দোষী করতে পারবেন না সহজে। কিংবা আপনি সাত/আট নাম্বার পজিশনে ব্যাটিং করা রিয়াদকে ফিনিশারও বলতে পারবেন না। কিন্তু কেনো? কারণটা ঐ একই! রিয়াদ সাত, আটে ব্যাটিং করলেও বেশীরভাগ সময়ই চাপকে করেন জয়, আবার চার, পাঁচে নামলেও নিতে হয় দলকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব। দিনশেষে মাহমুদউল্লাহ আসলে মিডল অর্ডার না কি ফিনিশার সেটা বের করা কষ্টকর; অনেক বেশী কষ্টকর!