৭ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

কালিদাস পন্ডিতের “সৌম্য সরকার ধাঁধা”

প্রতিবেদক
Rabiul Islam Shakib
রবিবার, ২৮ মার্চ , ২০২১ ৯:৩৭

ধাঁধা:

“লাল কিংবা সাদা বল; আমি থাকি বারো মাস,

আমাকে পেতে লোকে করে কত আশ।

আমাকে ছাড়া হয় না দলের কোনো খেলা-অনুষ্ঠান,

হীরকের চেয়ে আমাকে বেশি দেয় সম্মান। “

– বলুন তো আমি কে?

উত্তর: সৌম্য সরকার।

কিংবা

“আজব কথা বলি হাড়ি,

এক গাছে হয় টেস্ট, টি২০, ওডিআই, ওপেনিং, ওয়ান ডাউন, নাম্বার সেভেন আর পেস বোলিং অলরাউন্ডার নামক তরকারি! বলুনতো কী”

উত্তরটা এখানেও সৌম্য সরকার।

না, এখানে মোটেও সৌম্যকে মক করা হচ্ছে না, মক করা হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিকে।  

বোলার সৌম্য সরকার।

এদেশে একটা সময় এসেছিলো, যখন বাঁ হাতে ব্যাট নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত দিয়ে বুকে আঘাত করা সেলেব্রেশন এদেশের সবাই দেখেছে, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে, বারবার দেখতে চেয়েছে, সৌম্যকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছে। সেটা মোটেও বাড়াবাড়ি ছিলো না। শুরুটা সৌম্য যেভাবে করেছিলেন, তাতে করে যে কেউ তাকে নিজে বাজি ধরবেন- এটাই স্বাভাবিক। বরং, সৌম্যকে এভারেজ ভাবাটাই হয়তো তখন অস্বাভাবিক ছিলো। 

২০১৪ সালের ডিসেম্বরের শুরুর দিন, ঢাকায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক হলো এক তরুণ ব্যাটসম্যানের, নাম সৌম্য সরকার। শুরুর দিনে ১৪ বল মোকাবেলা করে ৪ টি চারে মোট ২০ রান করে আউট হয়ে ফিরেন প্যাভিলিয়নে। তবে কোচ হাথুরুসিংহের ভালো লেগেছিলো তাকে, প্রতিভা ছিলো খুব, হাতে শটও ছিলো সব অসাধারণ। এক ম্যাচ খেলেই উড়াল দিলেন দলের সাথে বিশ্বকাপে।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ম্যাচ খেললো ৬টি, সৌম্যও ৬ টি। মাত্র এক ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্ব আসরে খেলতে গিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪০ আর নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে করে বসলেন ৫১ রান। ফ্লুক বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। কারণ বিশ্বকাপ থেকে ফিরেই পাকিস্তান সিরিজে ১২৭ রানের অপরাজিত ইনিংস, পরের ভারত সিরিজে ৫৪, ৩৪ এবং ৪০ এর পর দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে ৮৮* এবং ৯০ রানের ইনিংসকে কখনোই কেউ ফ্লুক হিসেবে উড়িয়ে দিতে পারে না, সম্ভব না, উচিতও না।

এই পারফরমেন্সই সৌম্যেকে নিয়ে বাজি ধরতে সাহস জুগিয়ে দিতে যথেষ্ট। তবে এর সাথে আরও একটি বিশেষ দিক ছিলো সৌম্যের। যে দিকটা বাংলাদেশ ক্রিকেটে সচরাচর দেখা যায়নি, এখনো দেখা যায় না। আর সেটা প্রায় প্রত্যেক ম্যাচেই নিজের স্ট্রাইক রেট ১০০ এর উপরে রাখা। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ পর্যন্ত খেলা ১৬ ম্যাচের ৯ ম্যাচেই স্ট্রাইক রেট ছিলো ১১০ এর উপরে, আবার পড়ুন “একশো দশের উপরে”। এক ম্যাচে ছিলো ঠিক ১০০.০০। আধুনিক ক্রিকেটে এমন একজন ব্যাটসম্যান আমাদের খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো। তাই তো “যেই একজন পেলাম, ওমনি ধরে গাপুস গুপুস খেলাম”।

পেরিস্কোপ শটের নাম তো শুনেছেনই। নিজের ট্রেডমার্ক বানিয়ে ফেলা শটসহ আরও কত দৃষ্টি নন্দন শটের পসরা সাজিয়ে বসতেন সৌম্য সেটা যারা ’১৫ এর সৌম্যকে দেখেছে তারাই জানে। সেই ছোটবেলায় নানান সব কারুকার্জ করা একেকটা টেরাকোটা দেখেও মন ততোটা পুলকিত হতো না, যতটা সৌম্যকে দেখে হতো। একশোর উপরে স্ট্রাইক রেটে খেলা ব্যাটসম্যান নিঃসন্দেহে টি-টুয়েন্টি আর ওয়ানডে ক্রিকেটের জন্য পারফেক্ট। টেস্টে তাকে চিন্তা করার মানেই হয় না। কিন্তু ওইযে, কানাবগীর ছাঁ যেমন একটা পুটি মাছ পেলেই গাপুস গুপুস করে খাবে ভেবেছিলো, চান্দিকা হাতুরুসিংহে সৌম্যকে সেভাবেই ব্যবহার করতে শুরু করলো।

২৪ এপ্রিল ২০১৫, পাকিস্তান সিরিজে টি২০ ক্রিকেটে অভিষিক্ত হলেন সৌম্য শান্ত সরকার, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম পা রাখলেন সাতক্ষিরারই আরেকজন মুস্তাফিজুর রহমান। শুরুর ম্যাচে তামিম ইকবালের সাথে মিসকমিউনিকেশনে কোনো বল মোকাবেলা না করেই সৌম্যকে ফিরতে হয় রান আউট হয়ে। পরের টি২০ যতদিনে খেলেছেন, ততদিনে টেস্ট খেলে ফেলেছেন ৩টি।

সেই ৩ টেস্টে সৌম্য খেলেছে ৬ আর ৭ নাম্বার পজিশনে। ব্যাট করেছেন ৫ ইনিংস, রান করেছেন ৩৩, ৩৩, ৩, ১, ৩৭। একদিনের ক্রিকেট সফল সৌম্যের মাথায় ততদিনে ঢুকে গেছে, “নিজেকে টেস্টের জন্যও প্রস্তুত করতে হবে” । ব্যাস, খেলা শেষ। সেই যে সৌম্য গেলেন তো গেলেনই। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পর খেলা ৪৫টি ওডিআইতে সৌম্য পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস খেলেছেন মাত্র ৯টি। ৪৭ টি টুয়েন্টি-টুয়েন্টি ম্যাচে ৩০+ রানের ইনিংসও ৯ টি। যে টেস্টের জন্য প্রস্তুত হতে গিয়ে হারিয়ে গেছেন সৌম্য, সেখানেও তার ষাটোর্ধ্ব রানের ইনিংস মাত্র ৪ টি, অথচ ইনিংস খেলেছেন ২৪টি।

’১৫ এর সৌম্য ’১৫ তেই শেষ। কিন্তু না! তিনি এখনো আছেন আমাদের মাঝে। এখনো টেস্ট, ওডিআই, টি২০ সবই খেলেন। এখনও তিনি ওপেন করেন, ওয়ান ডাউনে খেলেন, সাত নাম্বারে খেলেন আবার সিক্সথ বোলার হিসেবেও খেলেন। মাঝে মধ্যে স্কোয়াডে না থাকলেও অন্য যে কারো ইনজুরিতে ডাক পরে সৌম্যরই। যে কাজটা এক সময় ছিলো ইমরুল কায়েসের। ইমরুল হুটহাট ডাক পেয়ে হুটহাট ভালো ২/১ টা ইনিংস খেলতে পারতেন, কিন্তু সৌম্য সরকার একের পর এক ব্যর্থ।

– ব্যর্থতার দায় কি শুধু সৌম্যেরই?

– সৌম্যের ব্যর্থতার দায় সৌম্যকেই নিতে হবে, তবে সৌম্যের কারণে দলের যে ব্যর্থতা সে দায় মোটেও সৌম্যের না।

সৌম্য সরকারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিলো ওয়ান ডাউন পজিশন দিয়ে। এনামুল বিজয়ের ইনজুরিতে সৌম্য পায় ওপেনিং স্লট। ওডিআইতে যে তার পজিশন খুব বেশি উলট পালট করা হয়েছে তেমনটা বলার কোনো অবকাশই নেই। কারণ ক্যারিয়ারের ৫ টি ম্যাচ শুধু খেলেছেন অন্যসব পজিশনে। বাকি ম্যাচ নিজের পজিশনে খেলেও ব্যর্থ সৌম্য সরকার। এই দায় অবশ্যই সৌম্যের।

টি২০ ক্রিকেটে খেলা ৫০ ইনিংসের মধ্যে ৩৯টি ইনিংস খেলেছেন ওপেন কিংবা ওয়ান ডাউনে, বাকি ১১ ম্যাচ এদিক ওদিক। এখানেও সৌম্যের ব্যর্থতার দায় সৌম্যেরই। দুইয়ে ব্যাট করা ম্যাচে সৌম্যের গড় ২০.২৩ আর তিনে খেলা ইনিংসগুলোতে ২৪.২০। পুরো ৫০ ম্যাচ হিসাব করলে ১৮.৮২ গড়ের টি২০ ব্যাটসম্যান হার্ডহিটার সৌম্য সরকার।

১৬ টেস্ট ম্যাচে খেলেছেন ৩০ ইনিংস, গড় ২৭.৭০, মোট রান ৮৩১। তার খেলা সেরা ইনিংসটি নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে, ১৪৯ রানের। এই এক ইনিংস বাদ দিলে বাকি ২৯ ইনিংসে তার টেস্ট গড় ২৩.৫১। এই পরিসংখ্যানের মালিককে যখন দিনের পর দিন খেলানো হয় আর দল হারে, তখন হারের দায়ের একটা অংশ সৌম্যর উপর বর্তায় না, এই অংশটা চলে যেতে হবে তাকে যারা দলে রাখছে তাদের ঘাড়ে। কিন্তু তবুও সৌম্য থাকে। ওডিআই ক্রিকেটে ৭ নম্বরে খেলা সৌম্য একদিনের নোটিশে হয়ে যান টেস্টের ওপেনার। দায়টা কর্তাদেরই। সে যে পারেনা, পারছেনা সেটা সে অনেক আগে থেকেই দেখিয়ে আসছে; তবুও তাকে দলে খেলানো হলে তার কি?

নিউজিল্যান্ডে শতক হাঁকানোর পর। ছবি: নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট

– তাহলে তাকে আসলে দলে রাখে কেন? নিশ্চয়ই ঘরোয়া পারফরমেন্স অনেক বেশি আশাজাগানিয়া। সৌম্যতো টি২০ এর আদর্শ প্লেয়ার তাই না? তাহলে বিপিএল দিয়েই দলে আছে।

– বিপিএলে সৌম্য খেলে শুরুর সিজন থেকে। এ পর্যন্ত ৬ দলে মোট ৬৩ ম্যাচ খেলা সৌম্যের বিপিএল রান ৯৩৬। গড় মাত্র ১৭.৩৩ আর স্ট্রাইক রেট ১১১.১৬। টি২০ স্পেশালিস্ট ৬৩ ম্যাচে পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস খেলেছে মাত্র ৩ বার। বিপিএলে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তালিকায় তার অবস্থান ২২। তার ঠিক উপরে থাকা পাকিস্তানের শেহজাদ রান করেছে তার থেকে ১ বেশি, ম্যাচ খেলেছে তার থেকে ৩৬টি কম।

– বিদেশি প্লেয়ারদের দেখান কেন? আমাদের দেশে কেউ ওর থেকে ভালো করে?

– বিপিএলের রান সংগ্রাহকের তালিকায় ১৯ নম্বরে আছেন জুনায়েদ সিদ্দিক যিনি সৌম্যর থেকে ম্যাচ খেলেছেন ১৮টি কম।

– অন্য সব?

– সবধরনের লিস্ট-এ ম্যাচে সৌম্যর গড় ৩২.৮৪, প্রথম শ্রেণিতে ২৯.৬৫ আর টি২০ তে ১৯.৫৪।

– তাহলে সৌম্য আসলে দলে আছে কিভাবে?

– টু বি অর নট টু বি, দ্যাট ইস দ্যা কোয়েশ্চেন।

মতামত জানান :