১৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

অবিশ্বাস্য স্টোকস জন্ম দিয়েছে রূপকথার!

প্রতিবেদক
Arfin Rupok
রবিবার, ২৮ মার্চ , ২০২১ ৮:৩৪

ইডেন থেকে লর্ডস; দূরত্ব প্রায় আট হাজার কিলোমিটারের হলেও ব্যবধান মাত্র ৩ বছরের। ইডেনে ছক্কা ঝড়ে ম্লান হওয়া স্টোকস লর্ডসে বনে গিয়েছিলেন রূপকথার নায়ক। ইডেনে  কার্লোসের ছক্কাগুলো স্টোকসকে অবিশ্বাস্য করে তুললেও হেডিংলিতে রূপকথার গল্প রচিত করেছিলেন নিশ্চিত! শুধু সময়ের ব্যবধান ছিলো মাত্র, ব্যবধান ছিলো খলনায়ক থেকে নায়ক বনে যাওয়া স্টোকসের মাঝেও।

স্টোকসকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি গল্প কাহিনী লেখা সম্ভব।  যেখানে শুরুর গল্পটিতে স্টোকস থাকবে খলনায়ক চরিত্রে, মাঝের গল্পে থাকবে ব্যাডবয় চরিত্রে এবং শেষ গল্পে থাকবে রূপকথার গল্পের নায়কদের বেশে। এর মাঝে তুলে ধরা যাবে একজন স্টোকসের পরিশ্রম কিংবা সাধনার গল্প। অথচ এই গল্পগুলোর শেষ হতে পারতো খলনায়ক চরিত্রেই। কিন্তু কথায় আছে উপরওয়ালা কাউকে শূন্য হাতে ফেরায় না! তেমনটা স্টোকসের ক্ষেত্রেও।

[খলনায়ক স্টোকস]

৩ এপ্রিল, ২০১৬
টি-২০ বিশ্বকাপ ফাইনাল।
ইডেন গার্ডেন, কলকতা।

দ্বিতীয় বারের মতো টি-২০ বিশ্বকাপের ট্রফি ঘরে তুলতে ইংল্যান্ডকে ডিফেন্ড করতে হবে ১৯ রান। বেশকয়েক বছর ধরে হিরো বিহীন ইংল্যান্ড ক্রিকেটের হিরো বনে যাওয়ার সুযোগ বোলার বেন স্টোকসের সামনে। কিন্তু সেদিনও হিরোর দেখা মেলেনি ইংল্যান্ড ক্রিকেটে, স্টোকস পারেনি হিরো হতে। ইডেনে অচেনা কার্লোস ব্রাথওয়েটের ব্যাটের সামনে পর পর চারটি ইয়র্কার ইঞ্চি-ব্যবধানে শর্ট করে স্টোকস বনে গিয়েছিলেন খলনায়ক! পর পর চারটি বল যখন সীমানার বাহিরে আঁচড়ে পড়ছিলো তখন নির্মম ভাবে চেয়ে থাকা স্টোকসের কাছে সবকিছুই যেনো অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিলো। কান্নায় ভেজা চোখ দু’টি হয়তো সেদিন স্বপ্নগুলোকে ঢেকে নিয়েছিলো সবার আড়াল থেকে। মাঠের বাইশ গজে ভেঙে পড়া স্টোকস সেদিন সান্ত্বনাতে ভাসলেও স্মৃতিটা ভুলতে পারেনি। যদি ভুলেই যেতেন তাহলে হয়তো আর কখনো জাতীয় দলের হয়ে খেলা হতোনা তাঁর!

চার ছক্কা হজম করে খলনায়ক বনে যাওয়া স্টোকস কান্নায় নিমজ্জিত!

কিন্তু সফল ব্যক্তিরা একটা কথা বলেন, ‘ব্যর্থতাকে মেনে নিন এবং এগিয়ে যান!’ ঠিক এই কথাটি মনেপ্রাণে ধারণ করেছিলেন স্টোকস, নয়তো এগিয়ে চলার রাস্তায় এতো সাফল্য লাভ করার কথা নয় তার।

[ব্যাডবয় স্টোকস]

২০১৭ সালে, ব্রিস্টল এবং বিতর্ক!

এইতো ক’দিন আগেই খলনায়ক বনে গিয়েছিলেন। এবার কি খুব বেশী প্রয়োজন ছিলো বিতর্কে জড়ানোর? কিন্তু কি আর করার, সিরিজ চলাকালীন সময়ে ব্রিস্টলে পানশালায় মারপিট করে এক তরুণের মুখ ফাটিয়ে দিয়ে সমালোচনার ঝড়ে বইতে থাকেন স্টোকস! এরই জের ধরে স্টোকসকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড, হারিয়ে বসেন সহ-অধিনায়কের পদ। অথচ ক’দিন পরেই অ্যাশেজ মাতাতে যাওয়ার কথা ছিলো তাঁর। তা আর হয়নি, তবে অদূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই উড়াল দিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলতে। আহ; সময় কতো দ্রুত বদলে যায়, কতো দ্রুত শেষ হয় তিলে তিলে গড়া স্বপ্নগুলো। স্টোকস সেই ২০১৭ তে যেমন ক্ষ্যাপাটে ছিলেন ঠিক তার থেকেও ক্ষ্যাপাটে রূপ ধারণ করেছেন বির্তকের পরেই। কিন্তু এবার ক্ষ্যাপাটে হবার কারণটা ভিন্ন, উদ্দেশ্য একটাই, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার।

কথায় আছে, আপনি যখন সফল হবেন তখন সবাই আপনাকে সম্মান করবে, গুরুত্ব দিবে, সাহায্য করতে চাইবে। আপনার জীবন তখন আনন্দে ভরপুর থাকবে। ঠিক তেমনি স্টোকসের পরবর্তী সময়ের গল্প, যেখানে খলনায়ক স্টোকস কিংবা ব্যাডবয় স্টোকস রূপ নিয়েছে রূপকথার নায়কে। আহ; এ যে বড্ড আনন্দের।

[রূপকথার নায়ক স্টোকস]

সময় মানুষকে কতো কিছুরই না মুখোমুখি করায়! ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপে চার ছক্কা হজম কিংবা ২০১৯ সালে এসে বিশ্বজয়ের নায়ক বানানো, সবকিছুতেই রয়েছে সময়ের ব্যবধান! শুধু বদলে গেলো পরিবেশ, বদলে গেছে ডাক নাম। কিন্তু এই নাম আদায় করে নিতে কম কষ্ট করতে হয়নি স্টোকসকে। দিনরাত পরিশ্রম, একটা ক্যাচ মিস করে নিজের উপর রাগান্বিত হয়ে ফুটবলকে শট মারার মতো পা নাড়ানো কিংবা ড্রেসিংরুমে গিয়ে প্রিয় ব্যাটটি ছুড়ে মারা; আবার ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনায় নিয়োজিত করে ভুল শুধরে নতুন মিশনে নামার লড়াই, সবকিছুরই মুখোমুখি হতে হয়েছে স্টোকসকে। দিনশেষে স্টোকস জন্ম দিয়েছে রূপকথার।

১১-ই জুলাই, ২০১৯
ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনাল।
লর্ডস, লন্ডন।

এর আগেও তিন তিনবার বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলার সৌভাগ্য অর্জন করলেও স্বপ্নের সোনালী ট্রফি ছুয়ে দেখার ভাগ্য হয়নি ইংল্যান্ডের, ভাগ্য হয়নি কারো ফাইনালে হিরো হবার। অবশেষে ২০১৬ এর খলনায়ক স্টোকস সেই শূন্যতা পূরণ করলেন। কিন্তু এর মাঝে যা ঘটেছে সেটিই বা রূপকথার চেয়ে কম কিসে? নিউজিল্যান্ডের দেওয়া ২৪২ রানের লক্ষ্যমাত্রাও একটা সময় হয়ে ওঠে পাহাড় সমান। চাপের মুখে সেদিন জস বাটলারের টাইমিং হয়তো আপনাকে প্রেমিকার মুখের হাসির থেকেও বেশী তৃপ্তি দিয়েছে। একটা প্রান্ত আগলে রেখে বাটলার খেলে গেলেও স্টোকস তখনও নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলো। এরই মাঝে মিসটাইমিংয়ে বিদায় ঘন্টা বেজে উঠলো বাটলারের; ইংল্যান্ডের প্রয়োজন তখনও ৪৬ রান, বল বাকি ৩০। ভরসা ঐ স্টোকসই! যেখানে পুরোনো হিসেব চুকানোর পালা স্টোকসের।

সময় গড়ানোর সাথে সাথে ভরসার প্রতিক হয়ে উঠতে থাকেন স্টোকস, টেইল-এন্ডারদের বিদায়ে সব চাপ স্টোকসের কাঁধে! এদিকে বোল্টের করা শেষ ৪ বলে প্রয়োজন ১৫ রান; পারবে কি স্টোকস? পারবে কি সুপারস্টার হতে? এমন প্রশ্নের উত্তরে যখন উত্তেজনায় টানটান লর্ডস। ৫০ তম ওভারের তৃতীয় বলটি সীমানার ওপারে পাঠিয়ে দিয়ে পরের বলে রহস্যময় ছয় রান!! এ যে কল্পনাতেও ছিলোনা, গাপটিলের করা থ্রো’টি যে ব্যাটে লেগে বাউন্ডারি ছাড়া হবে সেটা স্বয়ং স্টোকসও আঁচ করতে পারেনি। যদি পারতোই তাহলে অদ্ভুত এই ঘটনার পর স্টোকস দুই হাত তুলে ক্ষমা চাইতেন না নিউজিল্যান্ডের কাছে! এরপর বেশকিছু সময় কেটে গেলো, স্টোকস তখনও অন্য জগতে; সতীর্থ রাশিদ হয়তো স্টোকসকে বুঝাচ্ছিলেন এটা খেলারই অংশ! কিন্তু স্টোকস তখনও যেনো ঘোরেই আছেন।

অনিচ্ছাকৃত ভুল; দুই হাত তুলে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা!

শেষ দুই বল, ট্রফি ছুঁয়ে দেখতে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ৩ রান। বোল্টের করা মিডল স্টাম্পের ইয়র্কার খেলতে গিয়ে মোমেন্টাম ধরে রাখতে স্টোকস পড়েই গিয়েছিলেন প্রায়। এই যাত্রায় এক রানকে দুই রানে পরিণত করতে গিয়ে নিজের উইকেট বিলিয়ে দিয়েছিলেন রাশিদ! শেষ বলে প্রয়োজন ২ রান; স্ট্রাইকে স্টোকস! কি হতে চলছে? পারবে কি স্টোকস? এদিকে দৌড়ের জন্য প্রস্তুত উড। শেষ বল, লো ফুলটস! মিডঅনে ঠেলে দিয়েই ভোঁ দৌড়! এক রান পূর্ণ হলেও ২ রান নিয়ে গিয়ে রান আউট উড। ম্যাচ গড়ালো সুপার ওভারে। ঐদিকে ব্যাটে লাথি দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ স্টোকসের।

শেষ বলে যখন ২ রান পূর্ণ করতে পারেননি উড, তখন বেন স্টোকসের রাগান্বিত চেহারার বহিঃপ্রকাশ!

সুপার ওভারে ব্যাটিংয়ে বাটলারকে সাথে নিয়ে ১৫ রানের পুঁজি পেলেও স্পর্শ করেছিলো নিউজিল্যান্ড। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী স্বপ্নের ট্রফি ছুঁয়ে দেখে ইংল্যান্ড, সুপারস্টার বনে যান বেন স্টোকস। মনে করিয়ে দেন খলনায়ক থেকেও নায়ক হওয়া যায়!

বিশ্বকাপে সুপারস্টার বনে যাওয়া স্টোকসে অ্যাশেজেও রচিত হয়েছিলো রূপকথা। হেডিংলিতে কি অবিশ্বাস্য ব্যাটিংটাই না করেছিলেন স্টোকস। আহ, এ যেনো গৌরবময় এক দিনের গল্প।

এটা শুধু ট্রফি নয়, দীর্ঘ দিনের জমানো আবেগ, ছবিটা অন্তত সেটাই বলে।

২২-২৫ আগষ্ট, ২০১৯
অ্যাশেজ টেস্ট এবং অপরাজিত ১৩৫*

শুধু অ্যাশেজ নয়, টেস্ট ক্রিকেটের সেরা ম্যাচগুলোর তালিকায় এই ম্যাচটি থাকবে উপরের দিকেই। প্রথম ইনিংসে ৬৭ অলআউট হওয়া দলটি চতুর্থ ইনিংসে জয় পায় ৩৫৯ রান তাড়া করে। ক্রিকেটকে বলা হয় গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা, সেটির প্রমাণ করেছিলেন স্টোকস। ২৮৬ রানে ৯ উইকেট হারানো ইংল্যান্ডকে জয় পাইয়ে দিয়েছিলো ঐ ১ উইকেটের। লীচের দেওয়ালের বিপরীতে স্টোকস ছিলেন ভয়ংকর; অনেক বেশী ভয়ংকর। যদি ভয়ংকর না হতো তাহলে শেষ ৭৬ রান মাত্র ১০ ওভারেই সংগ্রহ করতে পারতেন না। কি ছিলোনা ম্যাচে? স্টোকসই বা কি দেননি সেদিন? নিজের সবটা দিয়েছিলেন উজাড় করে। দিনশেষে এই একটি ইনিংস স্টোকসকে কোথায় পৌঁছিয়ে দিয়েছে সেটা সবারই জানা। সবমিলিয়ে স্টোকস এক রূপকথার নায়ক।

অ্যাশেজে অসাধারণ এক জয়ের পর উদযাপন!

সেদিন ম্যাচ জয়ের পর স্টোকসের ক্ষ্যাপাটে উদযাপন কিংবা বিজয়ী উদযাপন যাই বলিনা কেন সেটা ছাপিয়ে গিয়েছে সবকিছুকে। হয়তো গলা ফাটিয়ে জয়ের উদযাপনের সময় ইডেনের স্মৃতি মনে পড়েছিলো স্টোকসের। হয়তো দু-হাত বাজপাখির মতো করে উৎসর্গ করেছিলেন ইডেনকে!

শুধু এই দুই ইনিংস দেখেই স্টোকসকে রূপকথার নায়ক বলার কারণ নেই। ২০১৬ সালের ঐ সুনামির পর স্টোকস যেনো নিজের ব্যাটিং কিংবা বোলিংয়েই চালিয়েছেন বিপক্ষ শিবিরে সুনামি। কিংবা সুপারম্যানের মতো ক্যাচ ধরে তাক লাগিয়েছেন বিশ্বকে; জানিয়ে দিয়েছেন ঐ ওভারটি শুধু সামনে এগুনোর প্রেরণা ছিলো!

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত ২০৩ ম্যাচে ৭৮৯০ রান এবং ২৫৬ উইকেট শিকার করা স্টোকস শেষ ৪ বছরে ৯৭ ম্যাচে ৪৩.৩৫ গড়ে করেছেন ৪৫৫২ রান এবং পকেটে পুরেছেন ১২১ উইকেট। যেখানে ৫৮ টি জয়ের সাক্ষী হয়ে আছেন এই অলরাউন্ডার।

স্টোকস; এশিয়া কিংবা আমেরিকা, হোম কিংবা অ্যাওয়ে সবখানেই নিজেকে প্রমাণ করে চলছেন নিয়মিত। ভারতের বিপক্ষে ৪০ বলে ৫০ থেকে ৫২ বলে ৯৯ রানে পৌঁছানো ইনিংসটি অন্তত এটাই বলে। শুধু এই ইনিংসেই শেষ নয়, বেশকিছু ভালো এবং গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে দলের জয়ে সাক্ষী হয়ে আছেন তিনি। স্টোকস একজনই; এই স্টোকস সেই স্টোকস, যে পুড়ে পুড়ে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছেন। এই স্টোকস সেই স্টোকস যে খলনায়ক থেকে নায়ক বনে গিয়েছিন। বিশ্ব ক্রিকেটে সফল ক্রিকেটারদের নাম নিতে গেলে উপরেই রাখতে হবে বেন স্টোকসের নাম। স্টোকস; এক রূপকথার নায়ক। যে থাকে কোটি তরুণের হৃদয়মাঝে, মনিকোঠায়।

, , , ,

মতামত জানান :