২৪শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

‘মুত্তিয়া’ দ্য গ্রেটেস্ট অফ স্পিনার এভার

প্রতিবেদক
Arfin Rupok
শনিবার, ১৭ এপ্রিল , ২০২১ ৭:২০

ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুটা একজন পেসার হিসেবে হলেও শেষটা হয়েছিলো সফলতম স্পিনার হিসেবেই। এর মাঝে বল চাকিংয়ের দায়ে তিন তিনবার অভিযুক্ত! যেখানে একবার চাকিংয়ে পড়ে হতাশ হয়ে ক্রিকেট ছাড়ার ঘটনা ঘটেছে বহুবার, সেখানে তিনি সকল বিতর্ককে মিথ্যে প্রমাণিত করেছেন, ফিরেছেন স্বরূপে; স্বমহিমায়। ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে নিয়েছেন অনন্য এক উচ্চতায়। যেখানে তিনি সেরাদের সেরা, দ্য গ্রেটেস্ট অফ স্পিনার। বলছি লঙ্কান কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরনের কথা।

ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ছিলো বাড়তি নেশা, মাত্র নয় বছর বয়সেই ক্রিকেটের সাথে জড়িয়েছিলেন নিজেকে। স্বপ্ন ছিলো একজন পেসার হিসেবে রাজত্ব চালাবেন ক্রিকেটের বাইশ গজে! কিন্তু পেসার হিসেবে রাজত্ব চালানো হয়নি। মুত্তিয়ার বয়স যখন ১৪, তখন কোচ সুনীল ফার্নান্দোরের পরামর্শে স্পিন বোলিংয়ে মনোযোগী হোন। স্পিনে বোলিংয়ে মুত্তিয়া হয়ে উঠেছিলেন রহস্যময় এক বোলার। ইতিহাসের প্রথম স্পিনার হিসেবে রপ্ত করেছিলেন রিস্ট-স্পিনিং অফ স্পিনিং বোলিং। সাথে অফ ব্রেকের পাশাপাশি টপ স্পিন ও দুসরার সমন্বয় তাকে রহস্যময় স্পিনার বানিয়ে দিয়েছিলো।

১৯৯১ সাল; স্কুল ক্যারিয়ার শেষে মুত্তিয়া যুক্ত হয়েছিলেন তামিল ইউনিয়ন ক্লাবে। পেশাদার ক্রিকেটে যোগদানের পর মুত্তিয়া নজর কাড়তে থাকেন ক্রিকেটবোদ্ধাদের। মূলত রহস্যময় স্পিন তাকে আলোচনায় আনতে বাধ্য করেছিলো। এই সময়ে শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলেও সুযোগ পেয়ে যান মুত্তিয়া মুরালিধরন। কিন্তু এরপর যা হলো তা হয়তো স্বয়ং মুরালিধরনও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! কেননা এ দলের হয়ে টানা পাঁচ ম্যাচে মুত্তিয়া ছিলেন নিস্ফল, ছিলেন উইকেটশূন্য। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত সময় অতিবাহিত করা মুত্তিয়ার জাতীয় দলে সুযোগ হওয়ার কথায় ছিলোনা। অনেকে তো ধরেই নিয়েছিলেন জাতীয় দলে আর বুঝি সুযোগ হবেনা তার। কিন্তু, নির্বাচকরা ছিলেন তাদের সিদ্ধান্তে অবিচল। অবশেষে মুত্তিয়া পেয়ে যান সু-খবর! এর পরের গল্পে মুত্তিয়ার কখনো জন্ম দিয়েছেন উত্থানের গল্প আবার কখনো বা পততেন গল্প। তবে এই সময়ে মুত্তিয়ার স্পিন ঘূর্ণিতে কাবু হয়েছিলো বিশ্বের বহু বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান। ক্যারিয়ার শেষে তিনি অফস্পিনকে নিয়ে গেছেন শিল্পের পর্যায়ে, অফস্পিন দিয়ে ব্যাটসম্যানদের শাসন করেছেন যুগের পর যুগ। আজকের গল্পে জানবো একজন মুত্তিয়া মুরালিধরনের রহস্যময় বোলিং থেকে শুরু করে জানা-অজানা নানান গল্প।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা:
১৭-ই এপ্রিল ১৯৭২ সালে শ্রীলঙ্কার ক্যান্ডির এক তামিল পরিবারে জন্ম হয় মুত্তিয়া মুরালিধরনের। বাবা-মায়ের আদরের ছোট্ট মুত্তিয়া বেড়ে উঠতে থাকেন নিজ শহরেই। ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেট নামক নেশা গ্রাস করেছিলো তাকে! যদি তা-ই না করতো তাহলে মাত্র নয় বছর বয়সেই ক্রিকেটে ঝুঁকে পড়ার কথা ছিলোনা। হ্যাঁ, সেইন্ট অ্যান্থনি কলেজে মাত্র নয় বছর বয়সেই পেস বোলিংকে রপ্ত করেছিলেন তিনি।

ক্রিকেট আগমন:
কলেজ জীবনে পেসার হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা মুত্তিয়া ১৪ বছর বয়সে ঝুঁকেছিলেন স্পিন বোলিংয়ে! ১৯৯১ সালের শেষ দিকে শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের হয়ে সুযোগ পাওয়া মুত্তিয়া ১৯৯১ সালের শুরুতেই যুক্ত হয়েছিলেন তামিল ইউনিয়ন ক্লাবে। এরপর আর পিছনে ফিরতে থাকতে হয়নি তাকে, পর্যায়ক্রমে পেশাদার ক্রিকেটে স্পিন ঘূর্ণিতে নিজের জাত চেনাতে থাকেন তিনি।

রহস্যময় বোলিংয়ের সাথে অদ্ভুত একশন; মুত্তিয়াকে আলোচনায় রেখেছিলো শুরু থেকেই। এরই জের ধরে জাতীয় দলেও এসেছিলেন অল্প সময়েই। হয়তো তাঁর রহস্যনয় বোলিং মন কেড়েছিলো লঙ্কান নির্বাচকদের। এরপরের গল্পে মুত্তিয়া কখনো বনেছেন নায়ক আবার কখনো বা হয়েছেন বিতর্ক। এরই মাঝে লঙ্কান জার্সিতে যেই সাফল্য পেয়েছেন তাতেই বনে গেছেন গ্রেটেস্ট স্পিনার।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আগমন:
২৮ আগস্ট ১৯৯২; অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কলম্বো টেস্টে সাদা পোশাকে অভিষেক হয় মুত্তিয়া মুরালিধরনের। অভিষেক ম্যাচে রাঙাতে পারেননি তিনি, প্রতিদান দিতে পারেনি নির্বাচকদের আস্থার। অভিষেক টেস্টের ২ ইনিংসে হাত ঘুরিয়ে শিকারে পরিণত করেছিলেন মাত্র ৩ উইকেট! টেস্টের পর ১৯৯৩ সালে লঙ্কানদের পক্ষে রঙিন পোশাক অভিষেক হয় তাঁর। টেস্টের মতো রঙ্গিন পোশাকের শুরুটাও ছিলো সাদামাটা, ম্যাচে শিকার করেছিলেন মাত্র ১ উইকেট। এ যেনো নিস্ফল আগমন!

অভিষিক্ত মুত্তিয়া মুরালিধরন!

মোরাতুয়া টেস্ট ও মুত্তিয়ার প্রথম:
অভিষেকের পর ৬ ম্যাচ খেলে ফেলা মুত্তিয়া তখনো পাঁচ উইকেট শিকারের খাতা খুলতে পারেনি! একবার কি ভেবেছেন ইনিংসে ৬৭ বার পাঁচ উইকেট শিকার করা বোলারটি নিজের প্রথম ৬ ম্যাচেও পাঁচ উইকেট শিকার করতে পারেনি একবারও! অবশেষে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে শূন্যস্থান পূরণ করেছিলেন মুত্তিয়া। এই শুরু…..

সপ্তম ম্যাচে এসে প্রথমবার পাঁচ উইকেট শিকার করা বোলারটি পরের ম্যাচেও শিকার করেছিলেন পাঁচ উইকেট। এখানেই শেষ নয়, পরের টেস্টেও পকেটে পুড়েছিলেন ৫ উইকেট। এ যেনো মুত্তিয়ার নতুন পথচলার শুরু!

প্রথম ১১ টেস্ট শেষে ইনিংসে পাঁচ উইকেট দুই বার এবং ইনিংসে চার উইকেট ৫ বার শিকার করা মুত্তিয়ার পথচলা চলছিলো বেশ। রহস্যময় স্পিন ঘূর্ণিতে ঘর কিংবা ঘরের বাহিরে ততদিনে ভয়ংকর হয়ে উঠছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৯৫ সালে এসে ক্যারিয়ারে একটা ধাক্কা খেয়ে বসেন তিনি। আচ্ছা কি সেই ধাক্কা? চলুন জানতে থাকি।

১৯৯৫ সাল; বক্সিং ডে টেস্টে ও বিতর্ক:
নিজ গতিতে এগিয়ে চলা মুত্তিয়া অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বক্সিং টেস্টে পড়েছিলেন বোলিং বিতর্কে। আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ারের চোখে মুত্তিয়া হয়ে উঠেছিলেন দোষী! ম্যাচে বারবার মুত্তিয়ার বলগুলো নো বল ডেকে বসেন তিনি। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে হেয়ার যে প্রান্তে আম্পায়ারিং করছিলেন সে প্রান্তে মুরালিকে আর বোলিংয়েই আনেননি রানাতুঙ্গা! ম্যাচ শেষে আম্পায়ারের বিপক্ষে লঙ্কান বোর্ড অভিযোগ আননেও আইসিসি সেটি আনলে না নেওয়ায় পরের টেস্টে মুত্তিয়াকে ছাড়াই মাঠে নেমেছিলো লঙ্কান’রা।

বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষার মুত্তিয়া মুরালিধরন!

আচ্ছা, এখানেই কি থমকে গেছিলো মুত্তিয়ার ক্যারিয়ার? না কি তিনি ফিরেছিলেন স্বমহিমায়? এমন সব প্রশ্নের উত্তরে নিজের অ্যাকশনকে সঠিক প্রমাণে অস্ট্রেলিয়ায় বায়োমেকানিক্যাল পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। এই পরীক্ষায় বৈধ প্রমাণিত হয় মুত্তিয়ার অ্যাকশন! এই পরীক্ষায় জানা যায় মুত্তিয়ার কনুই জন্মগতভাবেই কিছুটা বাঁকানো, এরই ফলে বল ছাড়ার সময় চাকিং মনে হয় অনেকের।

একজন মুরালিধরন কি শুধু ঘরের মাঠেই সফল স্পিনার?

মুত্তিয়া যে বাউন্স উইকেটেও স্পিন ঘূর্ণিতে তাণ্ডব চালিয়েছেন এটা অনেকেরই জানা। ১৯৯৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ উইকেট শিকার সেটির একটি নমুনা মাত্র! সেদিন মুত্তিয়ার তাণ্ডবে নিউজিল্যান্ডের মাঠে প্রথমবারের মতো টেস্ট জিতে ছিলো লঙ্কানরা। ম্যাচ শেষে মুত্তিয়ার বোলিংয়ের প্রশংসা করে তৎকালীন লঙ্কান ম্যানেজার দুলিপ মেন্ডিস বলেছিলেন, “মুরালির যা প্রতিভা তাতে সে কংক্রিটের পিচেও টার্ন আদায় করতে সক্ষম।” এখানেই শেষ নয়, ‘৯৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩ টেস্টে ১৯ উইকেট শিকার করে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেছিলেন এই স্পিনার, সাড়া ফেলেছিলেন বিশ্ব ক্রিকেটে। আহ; এ সাফল্য যেনো মুত্তিয়ার স্বপ্নের সমান-ই বড়ো ছিলো!

সাদা পোশাকে ততোদিনে নিজেকে চেনাতে শুরু করা মুত্তিয়া ১৯৯৬ সালে পেয়ে যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তকমা। কিন্তু কিভাবে? উত্তরটি সবার-ই জানা। কেননা, সেবার ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুলেছিলো লঙ্কানরা। আর সেই দলের সদস্য ছিলেন মুত্তিয়া মুরালিধরন।

১৯৯৬ বিশ্বকাপ ও মুত্তিয়ার অবদান:
বিশ্বজয়ে মুত্তিয়া আহামরি পারফরম্যান্স উপহার দিতে পারেনি ভক্তদের! তবে, যা দিয়েছিলেন সেটিই বা কম কিসে? ৬ ম্যাচে মাত্র ৭ উইকেট শিকার করা মুত্তিয়া রান দিয়েছিলেন মাত্র ৩.৭৮ ইকোনমিকে। দারুণ বোলিংয়ে প্রতিপক্ষের রানের চাকা আটকে রাখা মুত্তিয়ার অবদান অস্বীকার করার কারণ নেই। সবমিলিয়ে সেই আসরে মুত্তিয়ার ইকোনমিক বোলিং ছিলো লঙ্কানদের বিশ্বজয়ের বেশকিছু কারণের একটি।

ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে থাকেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। ১৯৯৬-২০০০ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ ক্যালেন্ডার ইয়ারে ৩০+ উইকেট শিকার করা মুত্তিয়া ২০০১ সালে প্রথমবারের মতো এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ৫০+ উইকেট শিকারের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে সবচেয়ে বেশী উইকেট শিকারী বোলারের তালিকায় মুত্তিয়ার অবস্থান দশম!

সময় গড়ানোর সাথে সাথে মুত্তিয়া যেনো পরিণত হয়ে উঠছিলেন! সেটির প্রমাণ রেখে ১৯৯৭ সালে প্রথম লঙ্কান বোলার হিসেবে গড়েছিলেন নতুন মাইলফলক।

মুত্তিয়ায় প্রথম:
টেস্ট ক্রিকেট লঙ্কানদের পথচলা ১৯৮১ সালে হলেও ততোদিনে কোনো বোলারই ১০০ উইকেট শিকার করতে পারেনি। অবশেষে মুত্তিয়ার হাত ধরে ১৯৯৭ সালে পূরণ হয়েছিলো সেই শূন্যস্থান। লঙ্কান জার্সিতে ২৭ নাম্বার ম্যাচে এসে নিজের শততম উইকেট শিকারের উদযাপনে মাতেন ক্যারিয়ার শেষে কিংবদন্তি বনে যাওয়া মুত্তিয়া মুরালিধরন।

১৯৯৭ সালে টেস্ট ক্যারিয়ারের শততম উইকেট শিকারী মুত্তিয়া তখন হয়তো ভাবেন নি ক্যারিয়ার শেষে তিনি হবেন সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার! আর ভাববেনই বা কি করে, এ যে বড্ড লম্বা পথ! ঠিক আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নের মতো।

লঙ্কানদের হয়ে প্রথম ১০০ উইকেট শিকারী মুত্তিয়া তখনো একটি শূন্য স্থান পূরণ করতে পারেননি। সাদা পোশাকে ততোদিনে ৩৪ নাম্বার ম্যাচটিও শেষ করেছিলেন তিনি, কিন্তু তখনো ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার করা হয়নি তার। অবশেষে এলো সেই সাফল্য! ১৯৯৮ সালে নিজের ৩৫ তম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৭ উইকেট শিকার করে প্রথমবারের মতো ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি।

সাদা পোশাকে তৎকালীন সময়ে মুত্তিয়া হয়ে উঠেছিলেন প্রতিপক্ষের ভয়ের কারণ। স্পিন ঘূর্ণিতে বাইশ গজে মুত্তিয়ার তাণ্ডবলীলা যেনো চলছিলো তুখোড় গতিতে! যদি এমনটা না-ই হয় তাহলে ১৫ ম্যাচের ব্যবধানে ২০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করার কথা ছিলোনা। জ্বী ঠিকই পড়ছেন, নিজের ২৭ তম ম্যাশে ১০০ উইকেট শিকারী মুত্তিয়া ৪২ তম ম্যাচেই স্পর্শ করেছিলেন ২০০ উইকেট শিকারের মাইলফলক।

ব্রিটিশ বধে অতিমানবীয় মুত্তিয়া:
টেস্ট ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের মাঠে তখনো জয় পাওয়া হয়নি লঙ্কানদের। অবশেষে প্রথম জয়ের লক্ষ্যে মাঠে নামা লঙ্কানরা হেসেছিলো মুত্তিয়ার বোলিং তাণ্ডবে! আচ্ছা ম্যাচে ১৬ উইকেট শিকারী মুত্তিয়াকে অতিমানবীয় বললে ভুল হবে কি? না। সেই ম্যাচে টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা(তৎকালীন সময়ে) বোলিং ফিগারও গড়ে নিয়েছিলেন মুত্তিয়া, সেটিও ইংল্যান্ডের উইকেটে! আহ; এটাকেই হয়তো সফল্য বলে।। ম্যাচে প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৪.২ ওভার হাত ঘুরিয়ে মাত্র ৬৫ রানে পকেটে পুড়েছিলেন ৯ উইকেট। হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা।

এর কিছুদিন বাদেই নতুন বিতর্কের জন্ম; এখানেও বিতর্কের মধ্যমণি মুত্তিয়া মুরালিধরন। কেননা ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় বারের মতো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিলো তাঁর বোলিং অ্যাকশন। রয় এমারসনের প্রশ্নের জবাবে আবারো বায়োমেকানিক্যাল পরীক্ষায় অংশ নেন মুত্তিয়া। এবারও সফল হয়েছিলেন মুত্তিয়া মুরালিধরন।

অ্যাকশন পরীক্ষার পর মুত্তিয়ার স্পিন বিষ আরও কঠিন হয়ে ধরা দিয়েছিলো। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে খুব বেশী মেলে ধরতে না পারলেও ২০০০ সালে নিজের শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন এই লঙ্কান স্পিনার। ২০০০ সালে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে মাত্র ৩০ রানে ৭ উইকেট শিকার সেটিরই প্রমাণ দেয়।

এক বছর যেতেই ২০০২ সালে মুত্তিয়া টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য পেয়ে যান। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাত্র ৫১ রানে ৯ উইকেট শিকার করে পূর্বের সেরা বোলিং ফিগার ভেঙ্গে নতুন বোলিং ফিগার রচিত করা মুত্তিয়া নিজের ৭২ তম ম্যাচে টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে দ্রুততম বোলার হিসেবে ৪০০ উইকেট শিকার করেছিলেন।

মুত্তিয়া যখন সাফল্য পায় তখন যেনো চারদিক থেকে সাফল্য পান! সেটির প্রমাণ আবারও রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, ২০০২ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করে দলকে করেছিলেন যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন। এরপরের বছর তথা ২০০৩ বিশ্বকাপে মেলে ধরেছিলেন মুত্তিয়া, খোলাসা থেকে বাহির হয়েছিলেন, ভুলে গেছিলেন আগের দুই বিশ্বকাপের স্মৃতি! সবমিলিয়ে ১০ ম্যাচে ১৭ উইকেট শিকার করা মুত্তিয়া রান খরচ করেছিলেন ৩.৬৪ ইকোনমিক রেটে। সেবার লঙ্কানরা বিদায় নিয়েছিলো সেমিফাইনাল থেকে।

এরপরের গল্পে মুত্তিয়ার প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিলো আরেক কিংবদন্তী শেন ওয়ার্ন! বাইশ গজে তৎকালীন সময়ে ওয়ার্ন- মুত্তিয়ার লড়াই জমেছিলো বেশ। পিছিয়ে ছিলেন না মুত্তিয়া মুরালিধরনও। সেরা হবার দৌড়ে দু’জনই ছিলো এগিয়ে। অবশ্য ৫০০ উইকেটের মাইলফলকে মুত্তিয়ায় পৌঁছেছিলেন ওয়ার্নের আগে, সাথে ভেঙ্গেছিলেন ওয়ালশের ৫১৯ উইকেটের রেকর্ডটিও। অপরদিকে ওয়ার্নও যে খুব বেশি পিছিয়ে ছিলো এমনটা না। সেটিরই প্রমাণ রেখে অল্প কিছুদিন বাদের ওয়ার্ন পিছনে ফেলেছিলেন মুত্তিয়া মুরালিধরনকে।

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো! কিন্তু মুত্তিয়া ছিলেন নিজের শক্তির উপর অবিচল। তাইতো কঠিন মূহুর্তেও দমে যাননি, নিজের কাজগুলোও করে গেছেন নিষ্ঠার সাথে। দিনশেষে সাফল্য পেয়েছেন, পেরেছেন সেরাদের সেরা হতে!

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলতে গেলে বিতর্ক যেনো পিছু ছাড়েনা মুত্তিয়ার। এবারও সেটি হয়েছিলো। সময়টা ২০০৪ সাল, দুসরা বোলিং করে নিজের বিপদ ডেকে এনেছিলেন কিংবদন্তি বনে যাওয়া মুত্তিয়া। এই নিয়ে তৃতীয় বারের মতো বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছিলো তাকে। এবারও সবকিছু বিবেচনায় পাস মার্ক পেয়েছিলেন তিনি। এরপর আর পিছনে ফিরতে হয়নি, গিয়েছেন সাফল্যের।সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে, ধরাছোঁয়ার বাহিরে।

এভাবেই চলছিলো বেশ; মুত্তিয়া চলছিলো নিজ গতিতে। অপরদিকে ওয়ার্ন ততোদিনে বনে গিয়েছিলেন সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার। তাই বলে কি হাল ছাড়বেন মুত্তিয়া? অবশ্যই না। ২০০৬ সালে মাত্র ১১ টেস্টে ৯০ উইকেট উইকেট শিকার করে সেটিরই জানান দিয়েছিলেন তিনি। এখানেই শেষ নয় ২০০৭ বিশ্বকাপে খুব কাছে গিয়েও শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হয়নি মুত্তিয়ার, তবে হয়েছিলেন আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার। এরপর যেনো কিছুটা নড়েচড়ে বসেছিলেন মুত্তিয়া। ততোদিনে ওয়ার্ন বিদায় বলে দিয়েছিলো ক্রিকেটকে।

শেন ওয়ার্ন ক্রিকেটকে বিদায় বলার আগেই গড়েছিলেন ইতিহাস, টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসেবে ৭০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করা ওয়ার্ন বিদায় বলেছিলো ৭০৮ উইকেট শিকারের পরেই। তাইতো নিজেকে সবার উপরে নিতে খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি মুত্তিয়া মুরালিধরনের!

২০০৭ সালে টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের দ্বিতীয় বোলাী হিসেবে ৭০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করা মুত্তিয়া সাত সালেই টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলারের মকুট করে নিয়েছিলেন নিজের নামে। এরপর ২০০৯ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটে ওয়াসিম আকরামের ৫০২ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করে ওয়ানডে ক্রিকেটেও সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বনে যান মুত্তিয়া। এতোসব কিছুর পরেও যেনো পুরোটা পাওয়া হয়নি মুত্তিয়ার। তাইতো খেলে চলছিলেন অবলীলায়, স্বমহিমায়!

রঙ্গিন পোশাকে মুত্তিয়া মুরালিধরন!

এভাবে আরো কিছুদিন নিজের সেরাটা দিতে থাকেন তিনি। ওয়ার্ন কিংবা ওয়াসিম; সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েও ক্ষান্ত হননি মুত্তিয়া। হয়তো ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে এমন জায়গাতেই নিতে চেয়েছিলেন যেখানে তিনি থাকবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে! হয়েছেও তাই। একদম যেনো কাঁটায় কাঁটায় মিলিয়েছেন প্রাপ্তির হিসেব। এ যেনো নিখুঁত; বড্ড নিখুঁত!

২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট থেকে বিদায় বলার আগে মুত্তিয়ার ঝুলিতে ৭৯২ উইকেট; টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো ৮০০ উইকেট শিকারী বোলারের দেখা কি মিলবে না তাহলে? এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন মুত্তিয়া। ভারতের দুই ইনিংস মিলিয়ে ঠিক ৮ উইকেট শিকার করে শেষটা রাঙিয়ে যাওয়ার সাথে টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র বোলার হিসেবে ৮০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলে কিংবদন্তী এই স্পিনার। এ যে স্বপ্নপূরণ!

বিদায় বেলা!

মুত্তিয়ার ক্যারিয়ার যেনো চলন্ত গাড়ির মতো, কখনো দ্রুতবেগে এগিয়ে যাওয়া আবার কখনো মাঝপথে থমকে দাঁড়ানো! কিংবা হঠাৎ ঝড়ে তছনছ হয়ে যাওয়া রুখতে কঠোর পরিশ্রম। উত্থান কিংবা পতনের সংমিশ্রণেই মুত্তিয়া হয়ে উঠেছেন সেরাদের সেরা, কিংবদন্তী কিংবা গ্রেটেস্ট স্পিনার।

১৮ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে কতো কিছুই না ছুয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো মুত্তিয়ার। তবে ওয়ানডে ক্রিকেটে চান্দিমা ভাস ছাড়া বিশ্বমানের বোলারের সাথে জুটি বাঁধার একটা আক্ষেপ হয়তো রয়ে যাবে চিরকাল! মুত্তিয়া যেনো লঙ্কান ক্রিকেটের শুভাকাঙ্ক্ষীও ছিলেন, যদি এমনটা না হয় তাহলে তার বিদায়ের পর প্রায় দুই বছর টেস্ট ক্রিকেটে লঙ্কানদের জনশূন্য থাকার কথা ছিলোনা। এখানেই শেষ নয়, প্রায় ১১ বছর আগে টেস্ট ক্রিকেটে বিদায় বলা মুত্তিয়ার জায়গা পুরোদমে দখল করতে পারেনি তেমন কেউ। রঙ্গনা হেরাথ কিছুদিন নিজেকে চেনালেও মেন্ডিস, কৌশাল, ধনঞ্জয়রা নিজেদের হারিয়ে খুঁজছেন নিয়মিত।

এবার মুত্তিয়া মুরালিধরন এবং তার কিছু রেকর্ডে নজর দিলে কেমন দেখাবে? চলুন দেখে নেওয়া যাক….

  • ওয়ানডে ও টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার মুত্তিয়া।
  • একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে ১০+(১১) ম্যান অফ দ্য সিরিজের পুরষ্কার জিতেছেন মুত্তিয়া।
  • সাদা পোশাকে নির্দিষ্ট ম্যাচে সর্বোচ্চ (১৬৬) উইকেট শিকারী বোলার মুত্তিয়া।
  • একমাত্র বোলার হিসেবে টানা ৪ টেস্টে ১০ উইকেট শিকার করেছেন মুত্তিয়া।
  • টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেট সবচেয়ে বেশিবার বোলিং করার রেকর্ডটিও মুত্তিয়ার দখলে।
  • টেস্ট ক্রিকেটে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলে সর্বোচ্চ(৪৭) উইকেট শিকারী বোলার মুত্তিয়া।
  • সাদা পোশাকে এক ম্যাচে বিপক্ষের ১০ ব্যাটসম্যানকে আউট করা ষষ্ঠ বোলার মুত্তিয়া।
  • টেস্ট ক্রিকেট পঞ্চম সেরা বোলিং ফিগার মুত্তিয়ার দখলে।
  • টেস্টে এক ম্যাচে সেরা বোলিং ফিগারে তৃতীয় স্থানে মুত্তিয়া।
  • সাদা পোশাকে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারর বোলার মুত্তিয়া।
  • টেস্ট ক্রিকেটে নির্দিষ্ট মাঠে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার মুত্তিয়া।
  • টেস্ট ক্রিকেটে ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকারী বোলারের তালিকায় শীর্ষে মুত্তিয়া।
  • টেস্টে ম্যাচে সবচেয়ে বেশী ১০ উইকেট শিকারী বোলার মুত্তিয়া।
  • টেস্টে টানা চার ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার করা একমাত্র বোলার মুত্তিয়া।
  • টেস্টে সবচেয়ে বেশীবার ক্যাচ, এলবিডব্লুর, বোল্ড, কট এন্ড বোল্ড ও স্ট্যাম্পিংয়ে মাধ্যকে উইকেট শিকার করা বোলার মুত্তিয়া।
  • টেস্টে দ্রুততম ৪০০, ৫০০, ৬০০, ৭০০, ৮০০ উইকেট শিকারী বোলার মুত্তিয়া।
  • ওয়ানডে ক্রিকেটে ৬ষ্ঠ সেরা বোলিং ফিগার মুত্তিয়ার দখলে।
  • ওয়ানডে ক্রিকেটে ম্যাচে সবচেয়ে বেশীবার ৫ ও ৪ উইকেট শিকারের তালিকায় মুত্তিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়।
  • ওয়ানডে ক্রিকেট সবচেয়ে বেশী ক্যাচ, কট এন্ড বোল্ড ও স্ট্যাম্পিং করা বোলার মুত্তিয়া।
  • ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্রুততম ৪৫০ ও ৫০০ উইকেট শিকারী বোলার মুত্তিয়া।
  • তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ব্যাট হাতে সর্বোচ্চ ডাক(শূন্য) মারা ব্যাটসম্যান মুত্তিয়া।
  • তিন ফরম্যাট মিলিয়ে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার মুত্তিয়া।
  • তিন ফরম্যাট মিলিয়ে টানা ৮ ইনিংসে ৪ উইকেট শিকার করা একমাত্র বোলার মুত্তিয়া।
  • তিন ফরম্যাট মিলিয়ে সবচেয়ে বেশী বল করা মুত্তিয়া রানও দিয়েছেন সবেচেয়ে বেশী।
  • তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১০০+ স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলা একমাত্র বোলার মুত্তিয়া।

এমন আরও অনেক রেকর্ডের সাক্ষী হয়ে আছেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। যার সবটা সম্ভব হয়েছে অধ্যবসায় আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। সম্ভব হয়েছে বিতর্ককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বারবার বাইশ গজে ফিরে লড়ার করার ফলেই। সম্ভব হয়েছে একই লাইন-লেন্থে বল করার দক্ষতার কারণে। দিনশেষে রহস্যময় স্পিনার নিজেকে নিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়, ধরাছোঁয়ার বাইরে। দিনশেষে মুত্তিয়া না কি ওয়ার্ন সেরা সেটার উত্তরে একেকজনের কাছে একেকজন সেরা হলেও পরিসংখ্যানে সেরা দ্য গ্রেটেস্ট মুত্তিয়া মুরালিধরন-ই!

, ,

মতামত জানান :