ক্রিকেটের বাইশ গজে তুলেছেন ঝড়, সবুজ মাঠে ব্যাট হাতে তুলেছেন সুর, গড়েছেন একের পর এক রেকর্ড, হয়েছেন ক্রিকেটের বরপুত্র। বলতে যাচ্ছি গ্যারি সোবার্সের কথা, লিখতে যাচ্ছি তার কিছু গল্প-কাহিনী। যাকে নিয়ে বলতে গেলে বলে হবে অনেক কিছুই, তবুও কোথাও যেনো একটু শূন্যতা রয়েই যাবে! কেননা, তিনি ছিলেন ক্রিকেট আকাশের শত তারার মাঝে একটি সূর্য। তিনি ছিলেন প্রকৃতির উন্মাদ! যিনি সেরা ব্যাটসম্যান, ছিলেন বহুমুখী বোলার, ফিল্ডার হিসেবেও ছিলেন সেই সময়ের সেরা ছাত্র। তাকে বলা হয় ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার। আজকের গল্পে জানবো এই সেরা অলরাউন্ডারকে নিয়ে জানা অজানা নানান গল্প।
১৯৩৬ সাল; ব্রিজটাউনের বার্বাডোসে শামন্ত ও থেলমা সোবার্স দম্পতির কোল জুড়ে আলো হয়ে আসেন ফুটফুটে এক সন্তান। বাবা মা সেই ছেলেটিকে আদর করে গ্যারি বলেই ডাকতেন। সেই ছোট্ট ছেলেটি বাবা মায়ের আদর এবং ভালোবাসায় বড় হতে লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই গ্যারির জীবনে নেমে আসে শোকের ছায়া। যেই ছেলেটির বাবার সংস্পর্শে থেকে এগিয়ে যাওয়ার কথা, সেই ছেলেটি মাত্র ৫ বছর বয়সে বঞ্চিত হয়েছিল বাবার স্নেহ মমতা থেকে। হঠাৎ এমন ঝড়ে হয়তো হারিয়ে যাবার কথা ছিলো গ্যারির! কিন্তু ছেলেটি হারিয়ে যায়নি। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন স্বপ্ন দেখতেন বড় হয় অনেক বড় ক্রিকেটার হবেন। কিন্তু এতো লম্বা পথ পাড়ি দিবে কিভাবে? মাথায় উপরে আজ ছায়া হয়ে থাকা বাবা যে পরপারে চলে গেছেন।
একদিকে বাবার স্নেহ মমতা পাওয়া হলো না। আরেকদিকে স্বপ্ন পূরণের নেশাটা তখন গ্র্যাস করেছিল গ্যারিকে। কিন্তু সবকিছু তো বললেই হয়না, এর জন্য কষ্ট করতে হয়, করতে হয় পরিশ্রম। তার উপর অনেক খরচের বিষয়। গ্যারির বাবা তখন দুনিয়ায় নেই, এতো খরচ কে দিবে তাকে? কথায় আছে ভাগ্য সবসময় সাহসীদের পক্ষে থাকে। ঠিক তেমনি সেই ছোট্ট গ্যারির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ডেনিস অ্যাটকিনসন।
নিজেকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপে গ্যারি পাশে পেয়েছিল ডেনিসকি। এবার পাশে দাঁড়ানো সেই ডেনিসের অধিনেই শুরু হয়েছিল গ্যারির ক্রিকেটীয় অনুশীলন। বার্বাডোসের ওয়ান্ডেরার্স ক্রিকেট ক্লাবে ডেনিসের সংস্পর্শে নিজেকে নিয়ে কাজ করতেছিলেন ছোট্ট গ্যারি। বোলিং প্যাক্টিসে নিজেকে ঝালিয়ে নিয়ে সময়ের সাথে সাথে বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন গ্যারি সোবার্স। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন সামনের দিকে।
শুরুতে বোলিং নিয়ে কাজ করা ছেলেটি ব্যাটিংয়েও ছিলেন মনোযোগী ছাত্র। নিজেকে সেই ছোট বেলা থেকেই যেনো তুখোড় ভাবে গড়ে তুলেছিলেন গ্যারি। তাইতো সেই সময়েই সবার কাছে সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন তিনি। আর সবচেয়ে মজার বিষয়, সেই ছোট বেলাতেই ব্যাটিং এবং বোলিংয়ে সমান পারদর্শী হওয়ায় নজরে আসতে সময় লাগেনি তার। তার উপর তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী একজন বোলার। তাইতো সবার চোখের নজরেই থাকতেন গ্যারি সোবার্স।
নিজেকে দারুণভাবে গড়ে তোলা গ্যারির সামনে প্রথম সুযোগটি আসে ১৯৫২ সাল। সফরকারী ভারতীয় দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগ হয়েছিল তার। সেই খেলায় নিজেকে দারুণ ভাবে মেলে ধরেছিলেন গ্যারি; ২২ গজে নিজেকে প্রমাণ করে সেই ছোট্ট বেলায় দেখা স্বপ্ন পূরণের পথটি তৈরি করে নিয়েছিলেন গ্যারি।
সময়টা ১১ জানুয়ারি ১৯৫৩ সাল; গ্যারির বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর। বয়সটা কম হলে কি আসে যায়? মানুষ তো তার পারফরম্যান্স দেখতে মুখিয়ে, আর গ্যারিও বা কম কিসে? ব্যাটিং-বোলিংয়ে পারদর্শীতা দেখিয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ঘরোয়া লীগে নিজের নামটি লিখেছিলেন। নিজের অভিষেক ম্যাচে ৯ নাম্বারে ব্যাটিংয়ে নেমে ৭ রানে অপরাজিত থাকার পাশাপাশি বল হাতে দুই ইনিংসে ৭ টি উইকেট শিকার করে জানান দেন বিশ্ব ক্রিকেট কাঁপাতে আসছেন তিনি!
ঘরোয়া ক্রিকেটে তখন একজন ধারাবাহিক পারফর্ম গ্যারি। দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটাও নিজ গতিতে এগিয়েছে, সময়টাও গড়িয়েছিলো অনেক। ক্যালন্ডারের পাতা উল্টোতেই দেখা মিলেছিল ১৯৫৪ সালের। নতুন বছরের শুরুর দু’মাস পর গ্যারির স্বপ্ন পূরণের পথ খুলে গিয়েছিল।
৩০ মার্চ ১৯৫৪ সালে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সাদা পোশাকে অভিষেক হয়েছিল তরুণ গ্যারির।
নিজের অভিষেক ম্যাচটি খেলতে নামার আগে হয়তো বাবাকে স্মরণ করেছিলেন! হয়তোবা মনে মনে বলেছিলেন একদিন সেরাদের কাতারে নিজের নামটি নিয়ে যাবেন, শাসন করবেন ২২ গজ, রাজত্ব চালাবেন বিশ্ব ক্রিকেট। কিন্তু, তখন যে সবে তার আন্তজার্তিক ক্রিকেটে পথচলা। সামনে পেরিয়ে যেতে হবে অনেক রাস্তা, পাড়ি দিতে হবে বিশ্ব ক্রিকেট। লড়াই করতে হবে সেরা ক্রিকেটারদের বিপক্ষে। হ্যাঁ, সেদিনের সেই স্বপ্ন দেখা বালকটি পেরেছিলেন ২২ গজে নিজেকে প্রমাণ করতে, ক্যারিয়ার শেষে হয়েছেন সেরা অলরাউন্ডার! শুধু সেরা বললে ভুল হবে, কেননা তিনি নিজের নামটি নিয়েছিলেন সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের তালিকায় সবার উপরে।
কিন্তু…
সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের স্থানে যেতে পাড়ি দিতে হয়েছিল লম্বা পথ। যার শুরুটা হয়েছিল নিজের অভিষেক ওভারে উইকেট সংগ্রহের মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, ব্যাটিংয়ে নিজের অভিষেক ম্যাচে ছিলেন অপরাজিত। জাতীয় দলে অভিষেকের পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি গ্যারিকে। শুধু পাড়ি দিতে হয়েছে লম্বা পথ। ক্রিকেটের ২২ গজে এই লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া গ্যারি সাক্ষী হয়ে আছেন অসংখ্য রেকর্ডের।
আসুন এবার ক্রিকেটের ২২ গজে গ্যারির কিছু রেকর্ডে চোখ বুলিয়ে দেখা যাক:
১. একই টেস্টের ২ ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছেন গ্যারি। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে এই রেকর্ডটি করেছিলেন গ্যারি।
২. টেস্টে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ১০০০+ রান করেছেন গ্যারি। সেই সময়ে এটি করা অনেক কঠিন কাজ ছিলো।
৩. এক ম্যাচে মিনিমাম ১০ ওভার বোলিং করা বোলারদের মাঝে চতুর্থ সেরা ইকোনমিক বোলিং করেছিলেন গ্যারি। ১৯৫৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪ ওভার বোলিং করে মাত্র ৩ রান খরচ করেছিলেন।
৪. ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে টেস্টে দ্রুততম ৫০০০ রানের রেকর্ড গ্যারির দখলে।
৫. সাদা পোশাকে গ্যারির ব্যাটিং গড় ৫৭.৭৮। যা ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড়।
৬. টেস্টে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসে ৩৬৫* রান করা গ্যারি আছেন চার নাম্বারে।
৭. টেস্টে একই ম্যাচে ১০০ এবং ৫ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড রয়েছে দুইবার।
৮. টেস্টে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে ৬ টি সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন তিনি।
৯. সাদা পোশাকে অধিনায়ক হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে তৃতীয় ম্যাচ সেরা বোলিং ফিগার গ্যারির দখলে।
১০. এক সেশনে সেঞ্চুরির রেকর্ডও রয়েছে গ্যারির।
১১. ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে সবচেয়ে বেশী সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানের তালিকায় ৩ নাম্বারে গ্যারি। যদিও ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে সবার আগে ২৫ টি সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন তিনি।
১২. টেস্টে এক মাঠে ১০০০+ রান করা ব্যাটসম্যানদের একজন তিনি।
এমন অনেক রেকর্ডের সাক্ষী হয়ে আছেন গ্যারি। এইসব রেকর্ডের হিসেবে করলে তাকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। কারণ গ্যারি ছিলেন অসাধারণ একজন ক্রিকেটার। যিনি ব্যাট-বলের সাথে ফিল্ডিংয়েও ছিলেন সমান পারদর্শী। অনেক ৫০% সুযোগকে পরিণত করেছেন ১০০% এ! মাঠের বিভিন্ন পজিশনে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন তিনি, তাইতো তাকে বলা হয় সেরা অলরাউন্ডার ফিল্ডার।
এইসব নিয়ে না হয় অন্য একদিন আলোচনা করবো। আজ আলোচনা করতে যাচ্ছি ক্রিকেট মাঠে গ্যারির কিছু সাফল্যের গল্প নিয়ে:
হাটনের রেকর্ড ভেঙ্গে সবার উপরে গ্যারি:
সময়টা ১৯৫৮ সাল; সোবার্সের বয়স তখন ২১ বছর ২১৩ দিন। প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যাট হাতে ওয়ান ডাউনে গ্যারির আগমন। ব্যাটিং নেমেই যেনো বদলে গিয়েছিলেন গ্যারি। মাঠের চারদিকে খেলেছিলেন দারুণ ভাবে, ব্যাট থেকে আসছিল একের পর এক দুর্দান্ত শট। সেই সাথে হান্টের সাথে গড়েছিলেন ৪৪৬ রানের ম্যারাথন জুটি। সেই সাথে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য এক উচ্চতায়। ততক্ষণে সেঞ্চুরি, ডাবল এবার ট্রিপল সেঞ্চুরিও করা শেষ। বাকি আছে হাটনের সর্বোচ্চ ৩৬৪ রানের রেকর্ড ভাঙ্গার কাজ। সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া গ্যারি ঠিক ৩৬৫ রান করে ব্যাট উঁচিয়ে ধরেছিলেন, ভেঙ্গেছিলেন হাটনের ৩৬৪ রানের রেকর্ড সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। যেটি ছিলো তৎকালীন সময়ে টেস্টে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস। এরই সাথে নিজের নামটি নিয়েছিলেন ইতিহাসের পাতায়। নাম লিখিয়েছিলেন সোনার অক্ষরে। কেনই বা লিখবেন না! মাত্র ২১ বছরে ট্রিপল করা তো চাট্টিখানি কথা নয়। গ্যারিরড সেদিনের ঐ ৩৬৫ রানের ‘মহাকাব্যিক’ ইনিংস সম্পর্কে উইজডেন লিখেছিল, “His willow entered a phase of supreme brilliance that remained undimmed till the end.”
অধিনায়ক গ্যারি সোবার্স:
ব্যাটিং- বোলিংয়ের সেরা ছাত্র তখন ক্রিকেট মাঠে অনেক পরিণত। তাইতো তার কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছিল অধিনায়কের দায়িত্ব। ১৯৬৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। অধিনায়ক হিসেবে গ্যারি ছিলেন সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী। ক্যাপ্টেন্সির সূচনাটাও ছিল দুর্দান্ত, নিজের অভিষেক টেস্ট সিরিজেই শিরোপা এনে দিয়েছিলেন দলকে। কিন্তু শুরুর সাফল্যটা শেষদিকে আর ধরে রাখতে পারেন নি গ্যারি। কিন্তু তাতে কি? ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে ঠিকই নিয়েছেন সেরাদের সেরার কাতারে।
টেস্ট ক্রিকেটে গ্যারিই প্রথম:
গ্যারি যখন ২২ গজ মাতাচ্ছিলেন তার অনেক আগেই শুরু হয়েছে টেস্ট ক্রিকেটের পথচলা। অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে ততোদিনে। কিন্তু একটি রেকর্ড তখনও ছুঁয়ে দেখেনি কেউ! শুনেছি, সেরারা না কি কোনো এক গল্পের প্রথম স্মৃতি হয়ে থাকেন। ঠিক তেমনি গ্যারি গড়েছিলেন এক বিশ্বরেকর্ড। টেস্ট ইতিহাসের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে সর্বোচ্চ ৩ বার এক সিরিজে ৩০০+ রান এবং ২০ উইকেটের ‘ডাবল’ অর্জনের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন গ্যারি।
- ১৯৬২ সালে ভারতের বিপক্ষে ৪৭৪ রান এবং ২৩ উইকেট
- ১৯৬৩ সালের ইংল্যান্ড সফরে ৩৩২ রান এবং ২১ উইকেট।
- ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড সফরে ৭২২ রান এবং ২০ উইকেট।
এছাড়াও টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে রিচি বেনো’র পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ২০০০ রান এবং ২০০ উইকেট দখল করেছিলেন গ্যারি।
৬ বলে ৬ ছক্কা:
ক্রিকেটে ৬ বলে ৬ ছক্কার রেকর্ড কম নেই। কিন্তু আপনাকে যদি বলা হয় ক্রিকেটে সর্বপ্রথম ৬ বলে ৬ ছক্কা কে হাঁকিয়েছে। তাহলে আপনার উত্তরে কার নামটি আসবে? আপনি যেই নামটিই নেননা কেনো! আমি নিবো গ্যারির নাম।
সময়টা ১৯৬৮ সাল। কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে নটিংহামশায়ারের হয়ে গ্ল্যামারগনের বিপক্ষে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে প্রথম বারের মতো এক ওভারে টানা ৬টি ছক্কা হাঁকিয়েছিলে গ্যারি সোবার্স। আর সেই ৬ ছক্কা হজম করেছিলেন ২৩ বছর বয়সী বাঁহাতি পেসার ম্যালকম ন্যাশ! অথচ ৪ উইকেট নিয়ে সেদিন বিপক্ষ দলের সফলতম বোলার ছিলেন ঐ ন্যাশই! তাহলে ভাবুন সেদিন কতোটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন গ্যারি!
সোবার্সের সেদিনের সেই আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের প্রশংসা করে গ্ল্যামারগন অধিনায়ক টনি লুইস বলেছিলেন, “It was not sheer slogging through strength, but scientific hitting with every movement working in harmony.”
৬ ছক্কা হাঁকানো গ্যারিরকে নিয়ে চারদিকে প্রশংসার ঝড় শুরু হয়েছিল। সবাই যখন গ্যারিকে নিয়ে প্রশংসায় মত্ত! তখন ন্যাশই বসে থাকতে পারেন কি করে! হ্যাঁ তিনিও পারেন নি, তাইতো, হত্যভাগ্য ন্যাশ বলেই ফেলেছিলেন, “I was just part of the history and there was nothing I could do. I could have bowled wide to try to stop him from scoring but that wasn’t what I was all about. It was just one over in my life. Would I take it back? Never. I just wish I got paid for it. It would have made me rich.”
ইংরেজদের বিপক্ষে ১০ সেঞ্চুরি:
টেস্ট ক্রিকেটে গ্যারির সেঞ্চুরি সংখ্যা ২৬ টি। কিন্তু ক্রিকেটে গ্যারির প্রিয় প্রতিপক্ষ কে ছিলেন? বা কাদের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশীবার সেঞ্চুরির দেখা মিলেছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে সবার প্রথমে আসবে ইংল্যান্ডের নাম। কেননা, এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০ টি টেস্ট সেঞ্চুরির দেখ পেয়েছেন গ্যারি।
ওয়াইড বল ‘শূন্য!’
প্রায় দুই দশক ধরে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের অন্যতম ভরসা গ্যারি সোবার্সকে বিশ্বের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারও বলা হয়ে থাকে। যিনি ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি বল হাতেও বহু রেকর্ডের সাক্ষী হয়ে আছেন। সোবার্স আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোট ২০৬৬০টি বল করেছেন তিনি। বলা বাহুল্য, তার মধ্যে একটা বলও নির্দিষ্ট সীমার বাইরে পড়ে নি। মানে, একটিও ওয়াইড বল দেননি তিনি।

এমন অনেক গল্পের নায়ক গ্যারি। এই গ্যারির গল্প গাঁথা ইনিংসগুলো লেখে শেষ করা অনেকটা কঠিন। তবে ক্রিকেটার গ্যারি ২০ বছরের ক্রিকেটীয় জীবনে নামের পাশে যুক্ত করেছেন অসংখ্য সম্মাননা। এবার সেই সম্মাননা গুলো এক নজরে দেখে নেওয়া যাক:
- ১৯৫৯ সালে বর্ষসেরা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারের পুরস্কার লাভ করেন।
- ১৯৬৪ সালে উইজডেন ‘ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।
- ১৯৭০ সালে ইংরেজ প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে বর্ষসেরা অলরাউন্ডারের পুরস্কার লাভ করেন।
- ১৯৭৪ সালে ইংলিশ কাউন্টি কর্তৃক ‘ওয়াল্টার লরেন্স ট্রফি’ প্রাপ্ত হন।
- ক্রিকেটে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে ব্রিটেনের রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কর্তৃক ‘নাইট’ উপাধি প্রাপ্ত হন।
- ১৯৯৮ সালে সরকারি উদ্যোগে ন্যাশনাল হিরো অব বারবাডোজের মর্যাদা অর্জন করেন।
- ২০০০ সালে উইজডেন কর্তৃক শতাব্দীর সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন হিসেবে মনোনীত হন সোবার্স। ১০০ জন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯০টি ভোট পান তিনি। তাঁর সঙ্গে বাকি চারজন হলেন স্যার ডন ব্রাডম্যান (১০০), স্যার জ্যাক হবস (৩০), শেন ওয়ার্ন (২৭) ও স্যার ভিভ রিচার্ডস (২৫)।
- ২০০৪ সালে আইসিসি প্রবর্তিত ‘বর্ষসেরা ক্রিকেটার’ পুরস্কারটির নাম রাখা হয় ‘স্যার গারফিল্ড সোবার্স ট্রফি’।
- ১৯৫৮-১৯৭০ সালের মধ্যে মোট ৮ বার উইজডেন ‘লিডিং ক্রিকেটার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন সোবার্স। সর্বোচ্চ ১০ বার এই সম্মান অর্জন করেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান।
এতো কিছুর পর আর কি চাই! হয়তো আর কিছুই চাওয়ার থাকে না। শুধু সম্মাননা দিয়েই শেষ হয়নি গ্যারির জীবন। তাকে নিয়ে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা প্রকাশ পেয়েছিলো। ১৯৬৭ সালে ‘বোনাভেঞ্চার এন্ড দ্য ফ্ল্যাশিং ব্লেড’ শীর্ষক উপন্যাস এবং একই বছর জে.এস. বার্কারের সাথে যৌথভাবে ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ইতিহাস’ নামের বই প্রকাশ করেন।
ক্রিকেটকে বিদায়:
যেতে নাহি দিব হাই তবু যেতে দিতে হয়;
কেউতো আর চিরদিন ক্রিকেটে থাকে না, ঠিক তেমনি গ্যারিও থাকেননি। ৫ এপ্রিল ১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন গ্যারি। দীর্ঘ ২০ বছরের ক্যারিয়ারের শেষে তার নামের পাশে কি ছিলো না? ছিলো তো অনেক কিছুই, একজন সেরা ব্যাটসম্যান, একজন সেরা বোলার এবং একজন সেরা ফিল্ডার। সবমিলিয়ে তিনি ক্যারিয়ার শেষে নামের পাশে যুক্ত করেছেন সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের তকমাটি।
সোবার্সকে নিয়ে এখনো অনেক কিছুই জানার বাকি। তাকে নিয়ে আরো কিছু জানার আগে একনজরে তার ক্রিকেট মাঠের পরিসংখ্যান গুলো দেখে নেওয়া যাক:
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সাদা পোশাকের ৯৩ ম্যাচে ১৬০ ইনিংসে ব্যাট হাতে নেমেছেন তিনি। যেখানে ২১ বার অপরাজিত থেকে মাঠ ছেড়েছেন। এই ৯৩ ম্যাচে ৫৭.৭৮ গড়ে সর্বোচ্চ ৩৬৫* রানে ২৬ সেঞ্চুরি এবং ৩০ ফিফটির সাথে নামের পাশে যুক্ত করেছেন ৮০৩২ রান। এবং বল হাতে সর্বোচ্চ ৭৩/৬ উইকেটে ২৩৫ উইকেট শিকার করেন।
পরিসংখ্যান দেখে চোখ কপালে উঠার কথা। কেননা এমন পারফরম্যান্স দিয়ে তাকে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার কিভাবে বলা যায়? আসলে, পরিসংখ্যান দেখে এই প্রশ্ন তুলতে গেলে সেটা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। কেননা, সোবার্সের সময়ে পিচের অবস্থা এখনকার মতো এতোটা ভালো ছিলো না, সেই সময় বৃষ্টির মাঝে পিচ ঢাকারও উপায় ছিলো না, অনেক সময় কাদামাখা পিচেই ব্যাটিং করতে হয়েছে। শুধু তাইনয়, সেই সময়ে হেলমেটও ছিলো না। আর হ্যাঁ, ক্রিকেট মাঠে গ্যারির ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ ক্রিকেটবোদ্ধারা। সেই সময়ে সোবার্সের ব্যাটিং দেখে ব্যারি রিচার্ডস বলেছিলো, সোবার্স ৩৬০° ব্যাটসম্যান। সেই সাথে দলের প্রয়োজনে কখনো ধীরগতির ব্যাটিং আবার কখনো মারমুখী ব্যাটিংয়েও নজর কেড়েছেন। এছাড়াও তার ব্যাটিং দেখে তাকে সেরা মানতে বাধ্য ছিলো সবাই।
এখানেই শেষ নয়, গ্যারি বোলিংয়েও দারুণ ছিলেন। মজার বিষয় তিনি দলের প্রয়োজনে কখনো স্পিন, কখনো চ্যায়নম্যান বোলিং, আবার কখনো মিডিয়াম পেসার হিসেবেও বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন। আবার কখনো ফিল্ডিংয়েও নজর কেড়েছেন। অনেক হাফ চান্সকে ফুল চান্সে পরিণত করেছেন। এছাড়াও তার ফিল্ডিং দেখে সেইসময় তাকে সেরা ফিল্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
অনেক তো হলো, কিন্তু একটা জিনিস এখনো অজানা রয়ে গেলো! আচ্ছা কি সেটা? মনে পড়ছে কিছু? আচ্ছা আমিই বলি। একজন গ্যারি সোবার্স থেকে স্যার গ্যারি সোবার্স হবার সেই গল্পটি:
সময়টা ১৯৭৫ সাল; ততোদিনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে গুড বাই বলেছিলেন গ্যারি সোবার্স। কিন্তু তাঁর ক্রিকেট মাঠের অসাধারণ পারফরম্যান্স যেমন মুগ্ধ করেছিল ক্রিকেটবোদ্ধাদের। সাধারণত ক্রিকেটের ইতিহাসে যারা অসামান্য অবদান রেখেছেন তাদেরকে সম্মানসূচক নাইট উপাধিতে ভূষিত করার প্রচলন আছে অনেক আগে থেকেই। সাধারণত দুটি ক্যাটাগরিতে এই উপাধি দেওয়া হয়। প্রথমটি ক্রিকেটে অনন্য সব রেকর্ড গড়ে অবদান রাখার জন্য, আর দ্বিতীয়টি অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য। ঠিক তেমনি সোবার্স অসামান্য পারফরম্যান্স করে জয় করেছিলো নাইট উপাধি। ১৯৭৫ সালে ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথের হাত ধরে এই সম্মানে ভূষিত হয় তিনি। এরপর থেকে গ্যারি সোবার্সকে বলা হয় স্যার গ্যারি সোবার্স।
একজন স্যার গ্যারি সোবার্স ক্রিকেটের নায়ক ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে এই নায়ককে নিয়ে লেখার কারণ কি? এবার ফিরে যাবো ১৯৩৬ সালের আজকের দিনে। যেই দিনে জন্ম হয়েছিল এই সোবার্সের। অর্থাৎ আজ তার জন্মদিন।
শুভ জন্মদিন স্যার গ্যারি সোবার্স!