১৯শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

পুরানো সেই দিনের কথা………….

প্রতিবেদক
Niloy Chowdhury
শনিবার, ৩০ মে , ২০২০ ৫:২৯

মকবুল মিয়া; বয়স ষাটের কাছাকাছি। থাকেন মিরপুরের কানাগলির ছোটখাটো এক রুমের বাসায়। বাসা না বলে ঝুপড়ি বলাই ভালো। দেয়ালের এখানে সেখানে আলকাতরা উঠে গেছে, দেখলে মনে হয় যেকোন মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়বে। তবে নিন্মবিত্ত মানুষদের জন্য এই জায়গাটাই বেহেস্তের মত। রাত দিন ঝগড়া-বিবাদ, শত সমস্যা থাকলেও দিন চলে যায় নিজের আপন গতিতে। হাজার বছরের পুরনো সেই চিরচেনা রাতগুলোতে মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ তাদের মনের অব্যক্ত কথা শোনায়। নিচু বাল্বের আলো অনেকটাই উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয় বয়স্কদের চোখে। হাজার সমস্যার মাঝেও সবাই এখানে সবার আপনজন। বৃদ্ধ মকবুল তাদেরই একজন। বয়সের কারণে চামড়ায় ভাজ পড়লেও মনটা এখনো ১৮ বছরের যুবকের মতই তরতাজা। এই একটা জিনিসই হয়তো তাঁকে এখনো শক্ত রেখেছে ভেতর থেকে। পুরো রুমে আসবাব বলতে একটা পুরনো চৌকি আর একটা চেয়ার। তবে রুমের অনেকটা জুড়েই খেলার বিভিন্ন পেপার কাটিং আর পত্রিকা ছড়ানো ছিটানো। অবসরে খেলার পাতা থেকে খেলোয়াড়দের ছবি কেটে আলাদা করে রাখেন মকবুল মিয়া। এটা তার পেশা নয় অনেক পুরনো একটা নেশা!

একটা সময় মকবুল মিয়ার সবকিছু ছিল। নিজের বাড়ি, পরিবার। জীবিকার তাগিদে মালয়েশিয়াতে ছিলেন বেশ কয়েকবছর। বিয়ে করবে না, করবে না ভেবেও মধ্যবয়সে গিয়ে ঘরে এনেছিল ফুটফুটে, চঞ্চল এক মেয়েকে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে বেচারী নিজেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমায়। চাঁদের মতো ঘর আলো করে আসা মেয়েটাও বাবার উপর অভিমান করেই কিনা ৬ মাস বয়সে কি এক অজানা অসুখে মায়ের কাছে চলে যায়। তারও বছর দুয়েক পর সর্বনাশা পদ্মার করাল স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে নিজের ভিটামাটি। কোন পিছুটান না থাকায় মকবুলও তাই আশ্রয় নিয়েছে এই জাদুর শহরে। প্রতিদিনের মত রুটি-রুজির তাগিদে আজও খুব সকাল সকাল বের হয় মকবুল মিয়া। যদি কোন ছুটা কাজ জুটিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে সন্ধ্যে নামার আগেই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসা যাবে। মহাসড়কের আশেপাশে দুই একটি ভ্যান ঠেলে ৮০-৯০ টাকা লুংগির গিটের মধ্যে গুঁজে রেখে রাস্তার মোড়ের টং দোকানটার দিকে এগিয়ে যায় মকবুল মিয়া।

উদ্দেশ্যে; খানিক জিরিয়ে নেওয়ার মাঝে এক কাপ লিকার চা আর একটা সিগারেট শেষ করা। চা খেতে খেতেই মকবুল মিয়ার কানে আসে পাশে বসা ভার্সিটির উঠতি বয়সী কিছু ছেলের কথোপকথন। একজন বলে মামা সামনে তো বিপিএল আর আইপিএল আসতেছে, টাকা পয়সা জোগাড় কর। গতবার অনেক টাকা লস গেছে এইবার পোষায় নিতে হবে। পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠলো খেলবে ওরা, তোরা টাকা খরচ করবি কেন? আগেরজন উত্তর দেয় আরে মামা খেলোয়াড়গো ধোয়া তুলসিপাতা ভাবো নাকি? তারাও ওই টাকার জন্য খেলে। গাড়ি, বাড়ি, নাম কামানোর জন্য খেলে, চান্স পাইলে ম্যাচ ফিক্সিংও করে! এই কথা শুনে মকবুল মিয়া নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না। উঠে জটলার কাছে গিয়ে একটু কর্কশ ভাষাতেই বললেন, ‘বাজান সবাই টাকার জন্য খেলে কথাটা ঠিক না, দুনিয়ায় টাকা পয়সার বাইরে মহব্বত নামেও একটা জিনিস আছে!’

মকবুলের কথায়, তরুণদের দলটা বেশ থতমত খেয়ে যায়। অবশ্য রোম উঠে যাওয়া জামা আর কুচকানো লুঙ্গি পরিহিত একজন বৃদ্ধের এমন বজ্রকন্ঠও চমকে যাওয়ার কারণ হতে পারে। মকবুল আবার বলে; বাজান তোমাদের বয়স কম, রক্ত গরম। তোমরা একটা বিষয়কে যাচাই বাছাই না করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নাও, ঘটনার পেছনেও অনেক ঘটনা থাকে। আচ্ছা বলতো? তোমরা বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখ কেন? মকবুলের মত বৃদ্ধের মুখে ক্রিকেট নিয়ে প্রশ্ন দেখে কৌতুহল বাড়ে তরুণদের। একজন উত্তর দেয় কেন আবার? সাকিব-তামিমরা খেলে বলেই দেখি! মকবুল একটু মুচকি হেসে বলেন বাজান; তোমাদের হাতে সময় থাকলে তোমাদের আজ একটা গল্প শুনাবো। গল্পের কথা শুনে তরুণদের দলটা আবারো নড়েচড়ে বসে। সিরাজ মামাকে নতুন করে আরেক পর্ব চায়ের আর্জি দিয়ে মকবুল মিয়াকে সবার মাঝে বসার জায়গা করে দেয়। তাঁকে ঘিরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে অন্যরা।

মকবুল মিয়া বলতে শুরু করেন, তখন আমার তোমাদের মতোই কাঁচা বয়স। এলাকায় তখনো ক্রিকেটের তেমন জোয়ার শুরু হয়নি। চারদিকে খেলা বলতেই তখন সবাই ফুটবলকে বুঝতো। তবে আমি ব্যতিক্রম! ছোটবেলা থেকেই আমি ক্রিকেটকে কেন জানি বেশি ভালোবাসতাম। বিভিন্ন এলাকায় চলে যেতাম ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে এবং দেখতে। খুব জোরে বল করতে পারতাম বলে এলাকায় নাম ডাক হয়ে গিয়েছিল, খেলা বলতেই তখন পাগল ছিলাম। নব্বই সালের দিকে দেশে ক্রিকেটের একটা জোয়ার সৃষ্টি হয়। জাতীয় লীগগুলোতে বিদেশী ক্রিকেটার এসে খেলতে শুরু করে। আমার স্বপ্নটাও তখন ডালপালা মেলা শুরু করে। স্বপ্ন দেখতাম আমিও একদিন দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবো! এই খেলাধুলার কারণেই মেট্রিক পাশ করে আর পড়াশুনা করা হয়ে উঠেনি। গঞ্জের দোকানে কাজ করে কিছু পয়সা জমিয়ে এলাকার পরিচিত এক বড় ভাইয়ের হাত ধরে ঢাকায় গিয়ে নিয়মিত প্র‍্যাকটিস করার স্বপ্ন দেখছিলাম। সেই সময়টাতেই আব্বা মারা যান এবং আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।

পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়ে। বাধ্য হয়েই ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাই মালয়েশিয়াতে। দিন রাত কঠোর পরিশ্রমের পরেও মন থেকে ক্রিকেটকে মুছে ফেলতে পারিনি। তখন কিন্তু এই বাংলাদেশ দলে সাকিব-মাশরাফিরা ছিল না, ছিল না কোন বড় নাম। ওই আকরাম, নান্নু, বুলবুল আর আতাহাররা সবাই একটা দল হয়ে খেলতো। তাই আমাদেরও কোন নির্দিষ্ট ভালোবাসার খেলোয়াড় ছিলনা। লাল সবুজের এই দেশটার হয়ে যে-ই নামতো তার হয়ে গলা ফাটাতাম আমরা। দেখতে দেখতে ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির সময় চলে আসলো। কাজের জন্য সব ম্যাচ দেখতে না পারলেও খবর নিচ্ছিলাম প্রতিনিয়ত। ২২ দলের অংশগ্রহণে সেরা ৩ দল সরাসরি খেলবে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের মূল পর্বে! এর আগে ২বার একদম কাছাকাছি গিয়েও পারেনি বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন পূরণ করতে; (১৯৮২ এবং ১৯৯০ সালে) সেমিফাইনাল থেকে বাদ।তবে সবচেয়ে ভালো সুযোগ হারিয়েছিল ১৯৯৪ সালে নাইরোবিতে কেনিয়ার কাছে হেরে। দেশে তখন ক্রিকেট জোয়ার ছড়িয়ে পড়েছে বেশ ভালোভাবে।

এফ গ্রুপে থেকে প্রথম পর্বে বাংলাদেশ ৫ ম্যাচের সবক’টি ম্যাচেই জয় তুলে নিল। ২য় পর্বের ১ম ম্যাচে হংকংকে ৭ উইকেটে হারালেও ২য় ম্যাচ আইরিশদের সাথে পন্ড হয় বৃষ্টির কারণে। আমার রক্তেও তখন এড্রোলিনের মাত্রা বাড়ছিল ধীরে ধীরে। পরবর্তী ম্যাচ ডাচদের সাথে জিততেই হবে সেমিফাইনাল খেলতে হলে! যদিও বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক আকরাম খান তখনো বিষয়টা জানতেন না, যেটা পরবর্তী সময়ে বুঝতে পেরেছিলাম! কর্মস্থলের পাশে হওয়াতে রাবার রিসার্চ ইনিস্টিউট মাঠে আমিও সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম প্রিয় দলকে পাশে থেকে সমর্থন দিতে! অধিনায়ক আকরাম খান টসে জিতে নেদারল্যান্ডসকে ব্যাট করতে পাঠালেন। বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে নেদারল্যান্ডসকে ১৭১ রানে আটকে দেই আমরা। রফিকের পাশাপাশি আকরাম খানও জোড়া উইকেট পেয়েছিলেন সেদিন!

জয়টা যখন সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিল, ঠিক তখনই ম্যাচের ২য় ইনিংসে ডাচ অল-রাউন্ডার রোনাল্ডের ১ম স্পেলের বিদ্ধংসী বোলিংয়ে ১৫ রানেই প্যাভেলিয়নে ফিরলেন আতাহার, দূর্জয়, সানাউর এবং আমিনুল ইসলাম। আমাদের গুটি কয়েক প্রবাসী দর্শক এবং সাংবাদিকদের মনে তখন ভয় ঢুকে গেছে ১৯৯৪ সালের নাইরোবি স্মৃতি আবার ফিরে আসবেনা তো? আবারো হয়তো হাতছাড়া হচ্ছে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। অধিনায়ক আকরাম এবং নান্নু ছিলেন ক্রিজে। ঠিক ১৯.২ ওভারের মাথায় এলো বৃষ্টি। একে তো ২২ গজের এক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নাস্তানাবুদ অবস্থা, মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে আসলো বৃষ্টি। কোন রিজার্ভ ডে নেই, সেমিফাইনালে জায়গা পেতে ২ পয়েন্ট নিতেই হবে এই ম্যাচ থেকে। সেই সময়টাতে দেখলাম এক অদ্ভুত কান্ড। কিছু সাংবাদিক; খেলোয়াড়দের ব্যবহৃত টাওয়েল নিয়ে মাঠের ভেতর থেকে থেকে পানি নিষ্কাশন করছেন! আমাদের আর পায় কে? আমরাও নেমে গেলাম মাঠ শুকানোর কাজে। সেই এক অবিশ্বাস্য স্মৃতি। যেভাবে হোক খেলিয়েই ছাড়বো দলকে।

এমন অদ্ভুত সমস্যার মাঝেও কিছু মানুষ হয়তো ভরসা রেখেছিলেন এই দলটার প্রতি, যাঁর মধ্যে একজন অধিনায়ক আকরাম খানের প্রিয়তমা স্ত্রী। পরে জেনেছিলাম খেলা বৃষ্টির কারণে খেলা বন্ধ থাকার সময়টায় দেশ থেকে আকরামের কাছে ফোনে বলেছিলেন, ধৈর্য্য হারাবেন না। আপনারা পারবেন, দেশের সবাই আপনাদের জন্য দোয়া করছেন! এই কথাগুলোই হয়তো আকরামকে পরবর্তীতে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভালো খেলতে সাহায্য করেছিল। পাশ থেকে রাশেদ নামে একজন বলে উঠলো আরে চাচা! আমাদের শিশির ভাবীও সাকিব ভাইকে ফোন করেছিল অস্ট্রেলিয়ার সাথে টেস্ট চলাকালীন সময়ে এবং সাকিব ভাই বলেছিলেন সেই ফোনের পরেই তিনি বল হাতে একাই গুড়িয়ে দিয়েছিলেন অজিদের। মুচকি হেসে মকবুল মিয়া বললেন, পরবর্তীতে ১৫/৪ এই অবস্থা থেকে মাঠে নেমে আকরাম খেললেন অপরাজিত ৯২ বলে ৬৮ রানের ম্যাচ জয়ী এবং কারো কারো মতে কালজয়ী ইনিংস। ডার্কওয়াথ লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ম্যাচ জেতে ৩ উইকেটে! অনেক ক্রিকেটবোদ্ধারা বলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস বলতে গেলে আর আকরামের এই ইনিংস তুলে না আনলে বাংলাদেশের ক্রিকেট অসম্পূর্ণ থেকে যাবে!

এইটুকু বলে থামলেন মকবুল মিয়া, বয়স হয়েছে। একটানা অনেকক্ষণ কথা বলতে পারেন না আগের মতো৷ পাশ থেকে এক তরুণ চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দেয়। এমনিতেই বেশ সময় নিয়ে চা খেতে পছন্দ করেন তিনি। তবে আজ যেন নেশা ধরেছে তাঁর, গল্প বলার নেশা। তরুণরাও বেশ উসখুশ করছে, তাদেরও তর সইছেনা পরবর্তী কথাগুলা শোনার জন্য। এক চুমুকে চা শেষ করেই আবার শুরু করলেন মকবুল কিয়া। ডাচদের হারিয়ে মানসিকভাবে চাঙ্গা হয়েছিল পুরো দলই। সেমিফাইনালের মত এক ঐতিহাসিক ম্যাচে স্কটল্যান্ডকে তাই হারাতে বেশ বেগ পেতে হয়নি দলকে। প্রথমে ব্যাট করে খালেদ মাসুদের ইনিংস সর্বোচ্চ ৭০ (৯৬) এবং বুলবুলের ৫০ রানে ভর করে ২৪৩ রান করে বাংলাদেশ, জবাবে রফিকের ৪ এবং এনামুল মনির ৩ উইকেটে ৭২ রানে জয় পায় বাংলাদেশ! এবং হাতে পেয়ে যায় ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের (১৯৯৯) টিকেট। রেডিওতে, ফোনে যে যেভাবে পেরেছে এই ম্যাচের খবর রাখার চেষ্টা করেছিল সেদিন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের শুরুর দিকে জায়গা করে নেয় এই ম্যাচ। শুনেছি জয়ের পর উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছিল রাজধানী ঢাকা। লক্ষাধিক মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল!

এরপর আসে সেই স্মরণীয় দিন। আইসিসি ট্রফির ফাইনাল ম্যাচ। ১২ এপ্রিল, তেনাগা স্পোর্টস স্টেডিয়াম, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া। প্রতিপক্ষ; কেনিয়া। প্রতিটি জিনিস সেদিন ইতিহাসের অংশ হওয়ার অপেক্ষায় ছিল। টস জিতে কেনিয়াকে ব্যাট করতে পাঠায় বাংলাদেশ। এই কেনিয়া, যারা ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশকে হারিয়ে দিয়েছিল এবং ভেঙ্গে দিয়েছিল ১৯৯৬ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। ১৯৯৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে মরিস উদুম্বের শতরান এবং দীপকের সাথে সেঞ্চুরি পার্টনারশিপে ২৯৫ করেছিল কেনিয়া। মধ্যবিরতির সময় প্রতিপক্ষ অধিনায়ক আসিফ করিম বলেছিলেন এই লক্ষ্যে অতিক্রম করতে পারবে না বাংলাদেশ। দিনশেষে সেটাই সত্যি হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের ইনিংসের দুই ওপেনার জাহাঙ্গীর আলম (৫৭) এবং আমিনুল ইসলাম বুলবুলের (৭৪) রানে ভর করে একপর্যায়ে ১৩৯ রানে তুলে ফেলে বাংলাদেশ! তবে তাদের আউট হওয়ার পরে আকরাম, নান্নুর প্রচেষ্টা হারের ব্যবধান কমিয়েছিল শুধু। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিন রেডিওতে কান পেতে ছিল, তাদের নিরাশ করে বাংলাদেশ হেরেছিল ১৩ রানে, ম্যাচের পর খেলোয়াড়রা নিজেরাও বুঝতে পারছিলনা কি হচ্ছে তাদের সাথে? অনেকেই ভেবেছিল এই দিনটাই হয়তো দেশের ক্রিকেটের ইতি টেনে দিবে! কিন্তু কাহিনী অন্য। উল্টো এই ম্যাচ পরবর্তীতে খেলোয়াড় আরো একতাবদ্ধ করেছিল! তবে, সেই ২৫ ফেব্রুয়ারি দিনটি দেশের ক্রিকেটের জন্য একটা কালো দিন ধরা হয়।

যাই হোক, ইতিহাস নতুন করে লিখতেই যেন, সাইফুল ইসলাম কোমরে রুমাল গুজে বল হাতে দৌঁড় শুরু করলেন তেনাগা স্টেডিয়ামের বোলিং প্রান্ত থেকে। বোলার তেমন গতিসম্পন্ন নয় বলেই কিনা প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান মাথায় হেলমেট ব্যবহার করলেন না। ইনিংসের ৫ম বলে সাইফুল তিনটি স্ট্যাম্প উপড়ে ফেললেন ব্যাটসম্যানের, ব্যাটসম্যানটি আর কেউ নন, ছিলেন আসিফ করিম! অধিনায়কত্বের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন আরো আগেই, কিন্তু পা বাড়াচ্ছিলেন কিংবদন্তী হওয়ার পথে, হয়তোবা অমরত্বেরও! যাঁর বাবা ছিলেন কিংবদন্তীতুল্য টেনিস তারকা। আসিফ নিজেও টেনিসের উপর স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৮১-৮৫ পর্যন্ত আমেরিকাতে পড়াশুনা করেছিলেন। কিন্তু দেশে ফিরে এসে হয়ে গেলেন ক্রিকেটার, নিয়তি কখন কোথায় দাঁড় করিয়ে দেয় কেইবা বলতে পারে? সাইফুলের পরবর্তী শিকার কেনেডি ওটিয়েনো, মিডল স্ট্যাম্পের বল প্যাডে লাগলে বোলারের পাশাপাশি আবেদন উঠে গ্যালারী থেকেও, ইংরেজ আম্পায়ার আঙ্গুল তুলে সিদ্ধান্ত দিলে উল্লাসে ফেটে পড়ে গ্যালারী, ইনিংসের বয়স তখন ৬.২ বল। দলীয় ৫৮ রানে সঞ্জিত গুপ্তাকে নিজের বলে নিজ ক্যাচ নিয়ে সাজঘরে ফেরান খালেদ মাহমুদ।

এরপরই আসলে শুরু হয় বাংলাদেশী বোলারদের মূল পরীক্ষা। ক্রিজে আসেন মরিস উদুম্বে। সেই উদুম্বে যিনি ৯৪তে শতক হাঁকিয়ে একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে। অপর পাশে ব্যাট করছিলেন কেনিয়ানদের প্রিয় ছেলে স্টিভ টিকালো, যিনি ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন কেনিয়ার ক্রিকেট আকাশের অন্যতম ধ্রুব তারা হিসেবে! দুইজনেই কেনিয়ার ইতিহাসের সুপ্রিম ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত। তবে এইদিন উদুম্ব রইলেন পার্শ্বনায়ক হিসেবে, হাত খুলে খেলতে দিলেন টিকালোকে। দুইজন মাঠের চারদিকে নানা শটের পসরা বসিয়ে রানের চাকা সামনে নিতে লাগলেন। এরমাঝে দলীয় ১৭৩ রানের মাথায় নিজের শতক পূর্ণ করেন টিকালো। তবে গিয়ার পরিবর্তন করে রান পাহাড়ে চড়ার ইচ্ছে পূর্ণ করার আগেই দলীয় ১৯৬ রানে ডাউন দা উইকেটে এসে মোহাম্মদ রফিকের ঘূর্ণিতে বোকা বনে স্ট্যাম্পিং হন উদুম্বে। ধারাভাষ্য থেকে ভেসে আসে It’s gone, Deniel Harris given him, not the quickest stumping in the world, but good enough because udumbe was long way down and Rafiq struck just about the right moment!

উদুম্বের আউট হওয়ার পর টিকালো যেন আরো ক্ষিপ্র হয়ে যান। দলীয় ২৩০ রানের মাথায় টিকালো যখন সুজনের বলে লং অনে সাইফুল ইসলামের দূর্দান্ত ক্যাচে পরিনত হন, নামের পাশে তখন জ্বলজ্বল করছে ১৪৭ রান দূর্দান্ত ইনিংস! কেনিয়া ২৪১ রানে ইনিংস শেষ করার পরে শুরু হয় বৃষ্টির বাগড়া। ক্রিকেট বিধাতা যেন ধৈর্য্যের চুড়ান্ত পরীক্ষা নিচ্ছেন। ভাগ্যিস রিজার্ভ ডে’র ব্যবস্থা ছিল! পরবর্তী দিন ডার্ক ওয়াথ লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের নতুন লক্ষ্য দাড়ায় ২৫ ওভারে ১৬৫ রান! বাংলাদেশ অধিনায়ক আকরাম খান একটা জুয়া খেলেন এখানে, স্লগে ব্যাট করা মোহাম্মদ রফিককে ওপেনিংয়ে নামিয়ে দেন দূর্জয়ের সাথে। তবে ইনিংসের প্রথম বলেই দূর্জয়ের স্ট্যাম্প উপড়ে নেন মার্টিন সুজি। তবে অন্যদিকে রফিক ছোটখাট ঝড় তুলেন অক্রমণাত্মক ব্যাটিং দিয়ে। রফিকের এক একটি বাউন্ডারি গ্যালারীতে তখন তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি করছিল! তবে দলীয় ৫০ রানের মাথায় উচ্চাভিলাষী শট খেলতে গিয়ে রফিক আউট হয়ে যায় উদুম্বের বিশ্বস্ত হাতে তালুবন্দি হয়ে, শিকারি সেই মার্টিন সুজি। রফিকের মতো ব্যক্তিগত ২৬ রানেই মিড উইকেটে প্যাটেলের অবিশ্বাস্য এক ক্যাচে সাজঘরে ফেরেন নান্নু, কারো কারো মতে আসরের সেরা ক্যাচও সেটি! বুলবুল-আকরাম জুটি প্রতিরোধ গড়ে সামনের দিকে নিতে থাকেন দলকে।

দলীয় রান ১১০/৩। ইনিংসের ১৯তম ওভার করছেন আসিফ করিম, লেফট আর্ম স্পিনার। ওভারের ২য় বলে পারফেক্ট টাইমিংয়ে মিড উইকেটের উপর ছয় হাঁকালেন বুলবুল! ঠিক পরের বলেই সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান বুলবুল। ১০০ স্ট্রাইক রেটে ইনিংস সর্বোচ্চ ৩৭ রানে যখন বুলবুল ফিরছেন নাম না জানা ধারাভাষ্যকার তখন বলছেন ” Well I just wander whether That is the end for Bangladesh!” তাঁর কথাকে পরিপূর্ণতা দিতেই যেন ঠিক পরের ওভারে কেনিয়ান অধিনায়ক উদুম্বের বলে ক্যাচ আউট হয়ে ফিরলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক আকরাম খান! এবং এরপরের ওভারে এনামুল মনি ৬ষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়ে ম্যাচের পাল্লা কেনিয়ার দিকে ঠেলে দেন। ২২ বলে প্রয়োজন আরো ৪৩ রান। দলীয় ১৩৩ এবং ইনিংসের ২৩তম ওভারের প্রথম বলে সাইফুল ইসলাম আসিফ করিমকে ছয় মেরে ম্যাচে টান টান উত্তেজনা তৈরী করে দেন, তবে ঠিক পরের বলেই সেই বুলবুলের মত আউট সাইফুলও। পার্থক্য এইবার বোল্ড নয়, ক্যাচ আউট! তবে ওভারের শেষ বলে আরো একটি ছয় আসে বাংলাদেশ ইনিংসে, খালেদ মাসুদ পাইলটের ব্যাটে! শেষ দুই ওভারে প্রয়োজন ১৯ রান।

শেষ ওভারের ঠিক আগের ওভার করতে বোলিং প্রান্তে আসলেন অধিনায়ক উদুম্ব নিজেই। ১ম বলে সুজনের দৃষ্টিনন্দন শটে বল বাউন্ডারির বাইরে, ৪ রান। বাউন্ডারির রোপের বাইরে তখন একজন সাবের হোসেন চৌধুরী দারুণ উত্তেজিত এবং রোমাঞ্চিত! অবস্থাদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল তিনিই বুঝি টাইগারদের কোচ! যাই হোক পরের বলেই স্ট্যাম্পিং সুজন, ৮ম উইকেটের পতন। শেষ ৬ বলে রান দরকার ১১! স্ট্রাইকে খালেদ মাসুদ, বলিং প্রান্তে সুজি। প্রথম বলেই লো ফুলটস বলে স্ট্রেইট হিট এবং ৬ পাইলটের! এই কথা শোনা মাত্র মকবুল মিয়ার একদম পাশে বসা ছেলেটি বলে উঠলো আরে খালেদ মাসুদ ভাইকে তো কিছুদিন আগে একটা বেসরকারি টিভি চ্যানেলে ছয় কয়টা মেরেছেন জানতে চেয়েছিলেন? তিনিও মনে করতে পারছিলেন না ঠিক। কিন্তু এই ঐতিহাসিক ম্যাচেই তো তিনি দু দু’টি ছয় মেরেছিলেন! মকবুল মিয়া আবার বলেন ম্যাচের সমীকরণ তখন নেমে এসেছে ৫ বলে ৫ রানে। পরের বল ডট দিলেও ঠিক পরের বলটা ওয়াইড দেওয়ায় রান আর বলের পাল্লা আবারো সমান হয়ে যায়। ৩ নাম্বার বলে ব্যাটে ঠেকিয়ে পড়িমরি করে ১ রান নিলেন খালেদ মাসুদ। কিন্তু পরবর্তী বলে বড় শট খেলতে গিয়ে ডট দিয়ে দেন হাসিবুল হোসেন। এতক্ষণে দৃশ্যপটে দেখা যায় লাল সবুজ দলটার মাষ্টার ট্যাকটেশিয়ান এবং কোচ গর্ডন গ্রিনিজকে!

হাতের ইশারায় হাসিবুলকে ইংগিত দিলেন সিংগেল নেওয়ার। ২ বলে প্রয়োজন ৩ রান! ৫ম বলে হাসিবুল পুল করে নিলেন ২ রান এবং স্কোর লেভেল করলেন। পুরো ম্যাচে উত্তেজনার পারদ এতটাই উপরে উঠেছিল ধারাভাষ্যকারের সরল স্বীকারোক্তি ছিল ‘Ever a game deserve a tie, this is it!’ শেষ বলটা হাসিবুল ব্যাটে লাগাতে না পারলেও প্যাডে লাগিয়ে ১ রান সম্পন্ন করেন এবং বাংলাদেশ প্রথম কোন আইসিসি ট্রফি ঘরে তুলে নেয়। আমিনুল ইসলাম ১০ ম্যাচে দলের পক্ষে ২১৭ রান সংগ্রহ করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন, মোহাম্মদ রফিক ৯ ম্যাচে ১৯ উইকেট নিয়ে আসিফ করিমের সাথে আসরের যৌথভাবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীতে ভাগ বসিয়েছিলেন। তবে আসর সেরার মুকুট জিতে নিয়েছিলেন উদম্বু ৪৯৩ রান করে। এইটুকু বলে মকবুল মিয়া চুপ করে যায় হটাৎ। তরুণরা লক্ষ্য করেন তাঁর চোখ পানিতে টলমল করছে। তিনি আবার বলা শুরু করেন; ম্যাচ শেষ হওয়ার পর পর ধারাভাষ্যকক্ষে বসে থাকা একজন মানুষ কিছু কথা বলেছিলেন, পরবর্তীতে পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছিলাম ভদ্রলোকের নাম ‘হার্শা বোগলে’। তাঁর প্রতিটা কথা আমার এখনো স্পষ্ট কানে বাজে। তিনি বলছিলেন, “What a day in the history, not only on Bangladesh Cricket but of the nation that is exactly 25 years old! Next Test playing nation? You will never no. তিনি তখন না জানলেও এখন সবাই জানে পরবর্তীতে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ব্যাপারে এই ম্যাচটা কতটা সাহায্য করেছিল!

মকবুল মিয়ার কথা থেমে গেলেও এখনো সবাই চুপ, একটা ঘোরের মধ্যে আছে যেন সবাই। ঘটনার মধ্যে সবাই এতটাই ঢুকে গিয়েছিল কখন দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে বুঝতেই পারেনি কেউ। নীরবতা ভেঙ্গে মকবুল মিয়া-ই বললেন বাজানেরা; আমার অনেক বয়স হয়েছে, আজ আছি কাল নেই। তবে তোমরা তরুণরা ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দিবে। অনুরোধ থাকবে অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করবেনা এবং খেয়াল রাখবে তোমার মাধ্যমে যেন তোমার ভালোবাসার জিনিস কলুষিত না হয়। ক্রিকেট অনেকের কাছে বিনোদনের মাধ্যম হলেও কিছু কিছু মানুষের কাছে আবেগের জায়গা, ভালো লাগার কিংবা ভালোবাসার জায়গা। ক্রিকেট জিনিসটাই হয়তো বিচিত্র, এক ‘ঝিঁঝিঁপোকার’ মতো। তরুণদের দলটা সামান্য মাথা ঝাঁকায়, অনেক প্রশ্নের জট খুলে যায় মগজের মধ্যে! মকবুল মিয়া আর বসেন না, ধীরে ধীরে পা বাড়ান অচেনা পথ ধরে চেনা গন্তব্যের দিকে।

#Cricketkhor_Writing_Competition
#গর্জনের_সাত_বছর

মতামত জানান :