‘আমার খুব প্রিয় একটি জিনিস কেড়ে নিয়ে হলেও বাংলাদেশকে ম্যাচটি জেতাও।’ একজন ব্যাটসম্যানের এমন নিবেদন আর আত্মত্যাগ থাকলে ভাগ্যবিধাতাও তার দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য। শুধুই কি ভাগ্য বিধাতার সহায়তায় সব হবে? মাঠেও যে সেই ব্যাটসম্যানের থাকা লাগবে নিবেদন। যে নিবেদন ছিলো ১৯৯৭ সালের ১৩ই এপ্রিল মালেশিয়ার কিলেত কিলাব ক্লাব মাঠে ব্যাট হাতে শেষ ওভারে স্ট্রাইক প্রান্তে থাকা খালেদ মাসুদ পাইলটের, সাথে বিধাতার কাছে মিনতি প্রিয় জিনিসের বিনিময়ে হলেও ম্যাচটা জিতিয়ে দেওয়ার আকুতি। যে আকুতি ছিলো কোটি বাংলাদেশীরও মনে, হয়তোবা তাদেরটা ভিন্ন জনের ভিন্ন ভাবে। কেউ মোনাজাতে কেউ পৈতা গলায়। কারো প্রার্থনা আল্লাহর কাছে, কারো ঈশ্বরের কাছে কারোবা গডের কাছে। তবে সব প্রার্থনা কেন্দ্র বিন্দু ছিলো “জিতিয়ে দাও বিধাতা, যে কোনো মূল্যেই হোক। ” যারা নিয়মিত ক্রিকেটের খোঁজ খবর রাখতেন না তারাও সেদিন প্রর্থনারত ছিলেন, আশায় বেধিছিলেন নিজেদের।
যে জার্নিটা শুরু হয়েছিলো ৯৭ এর ২৪ শে মার্চ; সেই জার্নিটা এর আগেরবার শেষ হয়েছিলো আরব আমিরাত, স্বাগতিক কেনিয়া, ডাচদের কাছে হেরে ১৯৯৪ এর আইসিসি ট্রফিতে। সেবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে হারলেও ইষ্ট এন্ড সেন্ট্রাল আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র এবং আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত করে বাংলাদেশ । দ্বিতীয় রাউন্ডে হংকংকে হারালেও স্বাগতিক কেনিয়া এবং নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে বিশ্বকাপের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয় বাংলাদেশের। সেদিন সংযুক্ত আরব আমিরাত, স্বাগতিক কেনিয়া এবং নেদারল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়া বাংলাদেশ বিশ্বকাপে দর্শক হয়ে থাকলেও, সেই তিন দলই সেবার খেলেছিল বিশ্বকাপে ।
আবারো নতুন শুরু, কিন্তু স্বপ্নটা একই এবং অবিচ্ছেদ্য। বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন এবং আগেরবারের কেনিয়ার দুঃস্বপ্নকে স্বপ্নে পরিণত করতেই মালয়েশিয়া যাওয়া। গ্রুপ পর্বেই আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন সংযুক্ত আরব আমিরাতকে হারায় বাংলাদেশ। এছাড়াও ডেনমার্ক, পশ্চিম আফ্রিকা, স্বাগতিক মালয়েশিয়া এবং আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে গ্রুপ পর্বের সবগুলো ম্যাচেই জয় পায় বাংলাদেশ ৫ ম্যাচে ১০ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় পর্বে, গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পা রাখে বাংলাদেশ।
গত আসরে আরব আমিরাতের কাছে হারের ক্ষত কিছুটা কমলেও এখনো অন্য দুই জায়ান্ট নেদারল্যান্ডস এবং কেনিয়ার মুখোমুখি হওয়া তখনো বাকি। বর্তমান ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে দুটি দেশ আমাদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকা দল হলেও তখনকার প্রেক্ষাপটে তারা আমাদের কাছে জায়ান্টই ছিল। দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে হংকংকে ৭ উইকেট হারিয়ে দারুণ শুরু করেছিলো বাংলাদেশ, ২য় পর্বেও। পরের ম্যাচে আয়ারল্যান্ডকে মাত্র ১২৯ রানে অলআউট করেও ম্যাচ জিততে না পারার আক্ষেপ তো আছেই। বৃষ্টি বাধায় বেশী বল মাঠে গড়ায়নি। যার ফলে নামের পাশে “No Result” এ তখন লেখা 1. হতে পারতো 2.
বৃষ্টির বাধায় ১ পয়েন্ট হারিয়ে, কঠিন সমীকরণের সামনে ছিলো বাংলাদেশ। নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে যে ম্যাচটা আমাদের জিততেই হতো। নাইলে যে খেলা হবে না পরের রাউন্ডে, খেলা হবে না বিশ্বকাপ। আক্ষেপ আর হতাশায় পুড়তে হবে আরো ৪ বছর। এর আগের আসরে নেদারল্যান্ডের সাথে হেরে আসরের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে বাংলাদেশে। এবার আর সেই ভূল নিশ্চয়ই করা যাবে না, এমনই পণ করেছিলেন ক্রিকেটাররা এবং পেয়েছিলেন অবিশ্বাস্য এক জয়। নেদারল্যান্ড কে ১৭১ রানে আটকে রাখলেও বৃষ্টি আবারও বাধা কিন্তু এই ম্যাচে যে বাংলাদেশের জয় চাই-ই চাই। বৃষ্টি বাধায় ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের টার্গেট দাঁড়ালো ৩৩ ওভারে ১৪১। কিন্তু ব্যাট করতে নেমে ৮৬ রানেই নেই উপরের সারির ৬ ব্যাটসম্যান। “ক্যাপটেন লিডিং ফ্রম দ্যা ফ্রন্ট” কথাটি সেদিন হাড়ে হাড়ে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন আমাদের ক্যাপ্টেন চট্টলার আকরাম খাঁন। বোলার সাইফুল ইসলামকে নিয়ে যান তখন একাই টেনে নিলেন ১৩৬ এ। ৭ উইকেট পড়লেও ততক্ষণে ম্যাচ জয় নিশ্চিত, উইকেটরক্ষক মাসুদও তখন ক্রিজে। বাংলাদেশ পায় ৩ উইকেটের মহামূল্যবান এক জয়। অধিনায়ক আকরাম এর ব্যাটেই রচিত হয় “সুগোই বুলো”র মহাকাব্য। শুধু ব্যাট হাতেই নয় বল হাতেও দুটি উইকেট শিকার করেছিলেন অধিনায়ক। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সেই ম্যাচের প্রসঙ্গে আকরাম খাঁন জানান, “ওই ম্যাচটা যদি আমরা হারতাম বা টাই হতো, তাহলে সেমিফাইনাল খেলতে পারতাম না। ওখান থেকেই বিদায় নিতে হতো। অনেক কঠিন অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। ওরা ১৭১ রান করেছিল, ৫০ ওভারে খুব সহজ একটা লক্ষ্য ছিল। কিন্তু ১৫ রানেই আমাদের চারটা উইকেট চলে যায়। আতহার, দুর্জয়, বুলবুল, সানোয়ার আউট হয়ে যায়। এরপর দলগত পারফরম্যান্স ছিল। আমি একটা ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়েছিলাম। অসাধারণ একটা ম্যাচ ছিল।”
সেমিতে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ তখনও বিশ্বকাপের স্বপ্ন নিয়ে খেলতে আসা স্কটল্যান্ড। নির্ধারিত ৫০ ওভারে বাংলাদেশ তুলে ২৪৩ রান। উইকেটরক্ষক পাইলটের ব্যাট থেকে আসে ৭০ রান , শুধু ৭০ রান বললে নিছক ভুলেই হবে ‘মহাকাব্যিক’ এবং ‘মহাগুরুত্বপূর্ণ’ ৭০ রান, টপ অর্ডারের প্রমোশন পেয়েই এই বাজিমাত। সেই ম্যাচে পাইলটের যখন ২৫-৩০ রান তখন বুলবুল তাকে চাপ মুক্ত রাখতে বার বার বলছিলেন, ‘তুই-ই ম্যাচসেরা হবি। আর কম্পিউটারটা আমাকে দিবি।’ কারণটা আর কিছু নয়, সিএনএস নামের একটি কম্পিউটার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান তখন ঘোষণা দিয়েছিলো, সেমিফাইনালে বাংলাদেশের কেউ ম্যাচসেরা হলে তাঁকে একটি পেন্টিয়াম ওয়ান কম্পিউটার পুরস্কার দেওয়া হবে। আর বুলবুলের ভাইয়ের স্ত্রী ছিলেন কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্রী।
সেই ১২ ই এপ্রিল, প্রথম ওভারের পঞ্চম বলেই বলে সাইফুল ইসলামের বলে কেনিয়ান ওপেনার আসিফ করিম প্যাভিলিয়নে। দিনের শুরুটা ও ভালোভাবে শুরু করেছিলো টাইগাররা। কেনিয়ার ক্রিকেটের নির্ভরতার প্রতীক স্টিভ টিকোলো এবং অধিনায়ক ওধুম্বের ব্যাটিংয়ে ভর করে ২৪১ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর দাড় করায় কেনিয়া। কেনিয়ার হয়ে টিকোলো সর্বোচ্চ ১৪৭ রান করেন, ১৫২ বলে। ইনিংসটি সাজিয়েছিলেন ৩ ছক্কা আর ১২ চারে। বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট শিকার করেন বাঁহাতি অলরাউন্ডার মোহাম্মদ রফিক ।
২৪২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নামার আগেই বৃষ্টি বাধায় ফাইনাল এবং বাংলাদেশের ব্যাটিং। রিজার্ভ ডে’তে গড়ায় ম্যাচ। ১২ এপ্রিল ম্যাচ শুরু হলেও বাংলাদেশ ব্যাটিং করে ১৩ই এপ্রিল। সমীকরণ কঠিন হয়ে যায় বাংলাদেশের জন্য বাংলাদেশের তখন প্রয়োজন পড়ে ১৬৬ রান ওভার প্রতি প্রায় ৭ এর কাছাকাছি। কেনিয়ার যেমনটা ইনিংসের প্রথম ওভারেই উইকেট পতন ঘটিয়েছিলো বাংলাদেশ, তেমনি কেনিয়াও উইকেটের পতন ঘটিয়েছিল বাংলাদেশের, ইনিংসের প্রথম ওভারেই ওপেনার নাঈমুর রহমান দুর্জয় বোল্ড হন সুজির বলে। অন্যপ্রান্তে ওপেনার রফিকের ঝড়ো ১৫ বলে ২৬।
মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ও আমিনুল ইসলাম বুলবুল স্ট্রাইক রোটেড করে খেলতে থাকেন। নান্নু ২৬ এবং বুলবুল ৩৭ রানে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। সবারই তখন স্ট্রাইক রেট ধরে রেখে রান তোলার তাড়না। ১৫১রানে ৮ উইকেটের পতন হয় বাংলাদেশের। ক্লাইমেক্সের তখনো অনেক বাকি……
শেষ ওভারে তখন বাংলাদেশের প্রয়োজন পড়ে ১১ রান। বোলার মার্টিন সুজিকে প্রথম বলেই ছক্কা উইকেট-রক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলটের। ৫ বলে প্রয়োজন ৫ রান। মাঝে ৪ বলে আসে ৪ রান।
শেষ ওভারের শেষ বলে জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন এক রান। মার্টিন সুজির করা ২৫ তম এবং ইনিংসের শেষ ওভারের শেষ বলটি হাসিবুল হাসান শান্ত’র পায়ে লাগার পরই শান্ত এবং পাইলট এর দৌড় এবং একবারের জন্য স্ট্রাইক চেঞ্জ। বাংলাদেশ ততক্ষণে জয়ী দল, চ্যাম্পিয়ন দল। ঐতিহাসিক এই জয়ের মাধ্যমে ক্রিকেট এক করে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। এক করে দিয়েছিল পুরো জাতিকে, স্বাধীনতার পর প্রথম কোন বড় আয়োজনে, একই জয়োৎসবে শামিল হয়েছিলো পুরো দেশবাসী। যে জয় ক্রিকেটের, যে জয় পুরো জাতির, যে জয় বাংলাদেশের……..