
একদিনের ক্রিকেটে একই ম্যাচে সেঞ্চুরী এবং পাঁচ উইকেট নেয়া ক্রিকেটারের নাম কি? ইন্টারনেটের এই যুগে খুব সহজেই উত্তরটি খুজে বের করা সম্ভব। আচ্ছা বলুন তো একদিনের ক্রিকেট এক হাজার রান এবং পঞ্চাশ উইকেটের মালিক হওয়া প্রথম ক্রিকেটার কে? দুই প্রশ্নের উত্তরই হলো আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেক্সান্ডার রিচার্ডস।
“অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স” কথাটির সার্থকতা খুজে পাওয়া যেতো ভিভের ব্যাটিং দেখলে। হ্যান্ড আই কো-অর্ডিনেশন, পাওয়ার, টাইমিং এবং স্টাইল সবই ছিলো ভিভের ব্যাটিংএ। গর্ডন গ্রিনিজ কিংবা ডেসমন্ড হেইন্স আউট হবার পর চুইংগাম চিবুতে চিবুতে রিচার্ডস রাজার মতো ব্যাটিং করতে নামতেন । কখনোই হেলমেট পড়ে ব্যাটিং করতেন না,হেলমেট পড়ে ব্যাটিং করাটা তার কাছে ছিলো বড্ড লজ্জাজনক। ব্যাটিংএর জন্য গার্ড নেয়ার সময়টাতেই প্রতিপক্ষ দলের চিন্তার কারণ হয়ে দাড়াত মেরুন ক্যাপ পড়া ভিভ। চার- পাঁচ পা এগিয়ে, মাঠের চারদিকে চোখ বুলিয়ে ফিল্ডারদের অবস্থান দেখার পর বোলারের দিকে ভিভের চাহনিতেই প্রতিপক্ষ বোলারের মানসিক হার শুরু হয়ে যেতো।
১৫ এপ্রিল ১৯৮৬ , ভিভের জন্মভূমি অ্যান্টিগায় ক্যারিয়ারের বিশতম শতক হাকান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভিভ সেদিন খুনে মেজাজে ব্যাটিং করেন এবং টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে দেড় শতর বেশী স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করে শতক হাকান ভিভ।
ম্যানচেষ্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে ১৯৮৫ সালে ইংলিশ বোলারদের দাপটে কোনঠাসা হয়ে পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ব্যাটম্যানদের যাওয়া আসার রেসে দলীয় সংগ্রহ যখন ১৬৬ তখন উইকেট আছে মাত্র একটি। শেষ উইকেটে ভিভ একাই করেন ৯৩ রান, জুটি বাঁধেন ১০৬ রানের। বারো টি চার এবং পাঁচ ছক্কায় ভিভ সেদিন ১৭০ বলে করে ছিলেন ১৮৯ রান। সেদিন ইংল্যান্ডের বোলারা ব্যর্থ হয়েছিলো ভিভের পাল্টা আক্রমনের কাছে। পুরো ইংল্যান্ড দলের মোট সংগ্রহ ছিলো ভিভের থেকে ২১ রান কম ।
লিলি বনাম ভিভ যুদ্ধটা শুরু হয় অস্ট্রেলিয়াতে। ইয়ান চ্যাপেলের অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। ভিভ তখন দলে নতুন , অভিষেক হয়েছে একবছর। তখনকার দ্রততম বোলার লিলি এবং তার সঙ্গি থমসনের বিপক্ষে ভিভ সাবলিল ভাবে ব্যাটিং করেন এবং মাঠের চারপাশে চোখ জুরানো সব সট খেলেন। সেই সিরিজে ৩৮.৭২ গড়ে ছয় ম্যাচে ৪২৬ রান করে ভিভ।
টেস্টে ব্যাট হাতে ভিভ সেরা সময় পার করেন ১৯৭৬ সালে, দুই সিরিজে মাত্র আট ম্যাচে ভিভ সংগ্রহ করেন ১৩৮৫ রান। এর মাঝে ইংল্যান্ড সিরিজেই ভিভের সংগ্রহ ছিলো ১১৮ গড়ে ৮২৯ রান!

ফিরে যাওয়া যাক ১৯৭৪ সালে, ভারতের বিপক্ষে চেন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে টেস্টে অভিষেক হয় তরুন ভিভের। বয়স তখন মাত্র বাইশ। দুই ইনিংসে ভিভের সংগ্রহ মাত্র সাত! তবে দিল্লিতে নিজের দ্বিতীয় টেস্ট অপরাজিত ১৯২ রানের ইনিংসের মধ্যদিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয় ক্রিকেট পেতে যাচ্ছে “ মাস্টার ব্লাস্টার” ভিভকে৷ এরপর বিশ্ব দেখেছে নতুন ধারার ক্রিকেট। সে সময় “ hitting across the line ” কে চিটিং হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ভিভ সেই লজ্জাজনক পাপকেই নিজের সঙ্গী করে নিয়ে ছিলো। জিওফ থমসন, ইমরান খান ডেনিস লিলি কিংবা কপিল দেবদের মতো পেস বোলাররা যখন ব্যাটসম্যানদের চোখ রাঙ্গিয়ে বল করতো সেই সময় ভিভ তাদের বলের সুইং, গতি বা বাউন্সারের তোয়াক্কা না করেই খেলতেন হুক, পুল অথবা ফ্লিক। ভিভ আক্রমনাত্নক ব্যাটিং যেমন করেছে তেমনি ধারাবাহিক ভালো খেলে গিয়েছেন। আঠারো বছরের ক্যারিয়ারে ১৮৭ টি একদিনের ম্যাচ খেলে ভিভ সংগ্রহ করেছে ৬৭২১ রান, ৪৭ গড়ে ব্যাটিং করা ভিভের স্ট্রাইক রেট ছিলো ৯০ এর উপরে। তখনকার অন্য ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইকরেট ভিভের ধারে কাছেও ছিলো না। রিচার্ডস টেস্ট খেলেছে ১২১ টি, ৫০.২৩ গড়ে ভিভ মোট সংগ্রহ করেন ৮৫৪০ রান। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মোট ৫০ টি টেস্ট ম্যাচে নেতৃত্ব দেয়। এর মাঝে কোন টেস্টে হারের মুখ দেখেনি তার দল। এবং এখনো পর্যন্ত তিনিই এক মাত্র ক্যারিবিয়ান অধিনায় যার অধিনে হারের স্বাদ পায়নি ক্যারিবিয়ানরা।
১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়, তারকায় ভরপুর ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের নিয়মিত সদস্য ছিলো ভিভ। তবে ব্যাটিংএর সুযোগ হতো খুব কম। তাই বিশ্বকাপটিও গেলো সাদামাটা। তবে ফাইনালে টার্নার, গ্রেগ চ্যাপেল এবং গ্রেগ চ্যাপেলের রান আউট ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট ছিলো, এবং সবাই রান আউটই ভিভের হাতে।
১৯৭৯ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে ভিভ ছোট ছোট ক্যামিও ইনিংস খেললেও ফাইনালে ভিভ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৩৮ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন। একপর্যায়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর ছিলো ৯৯/৪, পঞ্চম উইকেটে স্যার ক্লাইভ লয়েডকে সাথে নিয়ে ভিভ ১৩৯ রানের জুটি বাধেন। ১১ চার এবং ৩ ছক্কার এই ইনিংস ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বড় সংগ্রহ এনে দেয় এবং দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে সাহায্য করে।
তৃতীয় বিশ্বকাপে ভিভ প্রথম কয়েক ম্যাচ ব্যর্থ হন তবে সেই ব্যর্থতা বেশি স্থায়ী হয়নি। ভারকের বিপক্ষে জ্বলে উঠে ভিভের ব্যাট,ছয় চার এবং এক ছক্কা ১৪৬ বলে ভিভ করেন ১১৯ রান। পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভিভ ৯৫ রানের ইনিংস এবং সেমি ফাইনালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ৮০ রানের ইনিংস ক্যারিবিয়ানদের তৃতিয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হবার স্বপ্ন দেখায়। ফাইনাল ম্যাচে ভারত ১৮৩ রানে অল অাউট হলে চ্যাম্পিয়ন হতে ক্যারিবিয়ানদের প্রয়োজন হয় ১৮৪ রান , কিন্তু ক্যারিবিয়ানরা অল আউট হয়ে যায় মাত্র ১৪০ রানে। ভিভ তার শেষ বিশ্বকাপে ক্যারিবিয়ানদের অধিনায়ক ছিলো এবং ব্যাট হাতে ৩৯১ রান করেন ছয় ম্যাচে। ক্যারিবিয়ানরা গ্রুপ পর্বেই বাদ পরে৷
ভিভকে ধরা হয়ে সর্বকালের সেরা ওডিআই ব্যাটসম্যান । ২০১৭ ওয়ানডেতে দ্রুততম এক হাজার রান করা ব্যাটসম্যান হয় পাকিস্তানের ফকার জামান, তার পূর্বে সেই রেকর্ডের মালিক ছিলো তারই স্বদেশী ব্যাটসম্যান ইমাম উল হক। তবে এর পূর্বে সেই রেকর্ডের মালিক ছিলো ভিভ, মাত্র ২১ ম্যাচে এক হাজার রান করেন তিনি। রেকর্ডটি অক্ষত ছিলো ৪১ বছর। দ্রততম পাঁচ হাজার রানের মালিকও ছিলো ভিভ। টেস্টে সর্বাধিক ছক্কার মালিক ছিলেন প্রায় তেরো বছর। ভিভ প্রতি ১৫ ম্যাচ পর পর একটি করে শতক হাকিয়েছেন