ক্রিকেটখোর এর ৭ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত লেখা প্রতিযোগিতার জন্য ধন্যবাদ গ্রুপের কর্তাদের। অনেকেই অনেক ভাবেই নিজেদের মাধুরি মিশিয়ে লেখা গুলো ফুটিয়ে তুলে গ্রুপ পোস্ট করছেন, যেমনটা আপনারা গত ৭ বছর ধরেই করে এসেছেন। আমিও আপনাদের ব্যতিক্রম নই। কে না চায় এমন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ না করতে। অনেক উচ্ছ্বাস নিয়ে আমিও লিখতে বসেছি। তবে আমি কোনো পরিংসংখ্যান, ঘটনা কিংবা নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি নিয়ে লিখতে চাচ্ছি না। আমি চাই আমাদের গ্রুপের ৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমাদের ক্রিকেটের ৫ সেনানীকে খোলাচিঠি লিখতে। আমি জানি না আমার এই চিঠিটা, আমার কথা গুলো তাদের কানে পৌঁছাবে কিনা তবে আমি তাদের ভালোবেসে লিখতে চাই, উৎসর্গঃ করতে চাই।
দ্যা ক্রাইসিস ম্যান;
আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ছক্কা কোনটি? অন্য কেউ কি বলবে বা কি ভেবে কোনটা উত্তর দিবে আমি জানি না। তবে আমি উত্তরে বলবো কুয়ালামাপুরের কিলাত কেলাব ক্লাব মাঠে ১৯৯৭ এর ১৩ই এপ্রিল মার্টিন সুজিকে মারা আপনার সেই ঐতিহাসিক ছক্কার কথা। ওই এক ছক্কাই তো আমাদের অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছে পাইলট ভাই। আপনি সেদিন ওই ওভার বাউন্ডারি না হাঁকালে তো জয়টা অসম্ভব হয়ে যেতো। সেই ছক্কাটি হয়তো আমাদের জন্মের পূর্ববর্তী সময়ে হওয়ায় এই আবেগ আমরা একটু কমই টের পাই কিন্তু গল্পে আড্ডা তখনকার তরুণরা এখনো রোমাঞ্চিত হয়। আমার কাছে যদি মনের অবস্থা জানার কোনো যন্ত্র থাকতো আর সময়টাকে পিছনে নিয়ে যাওয়ার কোনো যন্ত্র থাকতো, আমি দুটো যন্ত্রকে বসিয়ে ১৯৯৭ এর ১৩ ই এপ্রিলে নিয়ে যেতাম আর মনের যন্ত্র দিয়ে দেখতাম সেদিন, সে সময় ওই ছয়ের পর আপনার অনুভূতি কেমন ছিলো? তবে কোনো যন্ত্র বসানো ছাড়াই এটা বলে দিতে পারি সেই সময়ের অনুভূতিটা ছিলো স্বর্গীয় অনুভূতি। এর বেশী কিছু জানতে আমার ওই দুটো মেশিন যে লাগবে!
এক সাক্ষাৎকারে আপনি একান্তই ব্যক্তিগত একটি কথা শেয়ার করেছিলেন সেই ওভারের আগে আপনি মনে মনে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘আমার খুব প্রিয় একটি জিনিস কেড়ে নিয়ে হলেও বাংলাদেশকে ম্যাচটি জেতাও।’ সত্যিই পাইলট আপনার এমন দেশাত্মবোধ আমাকে ওই সাক্ষাৎকারের পর থেকে অনুপ্রাণিত করে সবসময়। দেশের জন্য খুব প্রিয় একটি জিনিস বলিদান দিতে পারবে কজন?
দেশাত্মবোধের পাশাপাশি আপনার আরেকটা মহৎ গুন যেটা হচ্ছে আত্মনিবেদন। আপনার আত্মনিবেদনের মানসিকতা দেখাতে পারে কজন? শুধু ক্রিকেট নয়, ক্রিকেটের বাহিরেও অন্যান্য পেশায় এমন চিন্তাভাবনা খুব কম লোকই করে। ২০০৭ এর শ্রীলঙ্কা সফরে আপনি আপনার পরিবর্তে শেষ টেস্টে মুশফিককে খেলাতে বলেছিলেন। “শ্রীলঙ্কাকে অলআউট করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে উইকেট যেহেতু ফ্ল্যাট, এখানে দেড়-দুই দিন ব্যাটিং করে ফেলতে পারলে টেস্ট ড্র করার একটা সুযোগ তৈরি হবে।” তবে আফসোস ওখানেই এমন একটা কথার পর একটি মহল ছড়ালো আপনি নাকি শ্রীলঙ্কাকে মোকাবেলা করতেই ভয় পান, তাই এমনটা বলা। পরে অবশ্য পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন অনেক পরেই, “আমার কাছে মনে হয়েছিল আমার বদলে মুশফিক ম্যাচটাতে ভালো খেলবে।” সেই ম্যাচে মুশফিকের অনবদ্য ৮০ রান এখনো আপনার কথার সাক্ষী হয়েই আছে৷ ১৯৯৭ এর আইসিসি ট্রফিতে আপনি উপরের দিকেই ব্যাট করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে ওপেনিং করেছিলেন কিন্তু আপনার সাথে ‘পাইলট ভয় পায়’ এমন ট্যাগ আপনি মেনে নিতে পারেননি। তাইতো, আমাদের রেকর্ড তো আপনার হয়েই কথা বলে। আশরাফুলের পর মুরালির বিরুদ্ধে সবচাইতে সফল ব্যাটসম্যান তো আপনিই। ওয়ানডেতে সেখানে হয়েছিলেন সিরিজ সেরা। যে যাই বলুক আপনি আমাদের অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন মাসুদ ভাই। যদিও সেই টেস্টের পর আর আপনাকে দলে ডাকা হয়নি। এর আগে আপনাকে ডাকা হয়নি বিশ্বকাপ স্কোয়াডেও৷
আত্মনিবেদন কিংবা স্পোর্টসশীপে আপনি অতুলনীয়। প্রথমবার আপনাকে অধিনায়কত্ব দেওয়া হয় ২০০১ এর শেষের দিকে। টেস্ট সিরিজের পর ওয়ানডের আগে সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচক মাইনুল হক অধিনায়ক দুর্জয়কে ছাড়াই ১৪ জনের দল ঘোষণা করেছিলেন সাথে দুর্জয়ের ব্যাপারে বলেছিলেন, “ও তো শুধু হাত ঘুরিয়ে বল ছেড়ে দিচ্ছে, আমিও অমন বোলিং করতে পারবো।” এরপর নাটকীয় ভাবেই আপনাকে অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়, আপনি নিজেও অবাক হয়েছিলেন। এই দায়িত্ব নেওয়ার সামান্য ইচ্ছাটুকুও আপনার ছিলো না। আপনি নির্বাচকদের বলেছিলেন, “আমি খুব খুশি হব, যদি এই সিরিজে দুর্জয়কে রেখে পরের সিরিজে আমাকে অধিনায়ক করা হয়। কারণ এভাবে সিরিজের মাঝপথে কাউকে ছুড়ে ফেলাটা ভীষণ অসম্মানজনক।” পাইলট আপনি সেদিন মুগ্ধ করেছিলেন আপনার এমন আত্মনিবেদন দিয়ে।
২০০৩ এ একই ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো আবার৷ ২০০৩ বিশ্বকাপের জন্য দেশ ছাড়ার আগে আপনি সংবাদ সম্মেলনে জানালেন পরিবারকে আরো বেশী সময় দিবেন এজন্যই আপনি অধিনায়কত্ব ছাড়ছেন, অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপই আপনার শেষ সিরিজ। সেদিন হয়েছিলেন অশ্রুসিক্ত, অথচ আপনি আমাদের সদাহাস্যজ্বল এক পুরুষ। বিশ্বকাপে উইকেটরক্ষক হয়েও দলের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছিলেন আপনি। ছেড়ে দিলেন অধিনায়কত্ব। একই ঘটনা আবার ঘটানোর অপেক্ষায় তখন বোর্ড৷ পাকিস্তানে সিরিজের শেষে টেস্টের আগে বোর্ড কর্তারা চেয়েছিলো আপনাকে আবার অধিনায়ক পদে বসাতে। আপনি বুঝতে পেরেছেন বিসিবি আপনাকে ব্যবহারই করে যাচ্ছে। আপনি আগের বার যেটা আগের বার করতে পারেননি এবার সেটিই করে দেখালেন। আর বোর্ড কর্তাদের রুমে যাওয়ার আগে অধিনায়ক সুজনের সাথে করিডরে যখন দেখা হয়েছিলো তখন তাকে নির্ভয় দিয়ে নলেছিলেন, ‘চাচা, চিন্তা কোরো না। আমি তো জানিই যে কী করব।’ কোচ আর বোর্ড কর্তাদের বললেন, “আমি আর নেব না। কারণ আমাকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। দুর্জয়কে বাদ দেওয়ার সময় আমার খুব খারাপ লেগেছিল। আপনাদের কাছে অনুরোধ, পারলে সুজনকে এই অসম্মানটা করবেন না।”
আমাদের সাকিব এখন অহরহই সিরিজ সেরা হয়; তামিম, মুশফিক, মুস্তাফিজরাও এটিকে নিয়ম করে ফেলেছে। কিন্তু সিরিজ শেষে কেউ যখন ‘ম্যান অব দ্যা সিরিজ’ এই এওয়ার্ড তখন আপনার কথা মনে পড়ে খুব। আমাদের প্রথম সিরিজ সেরা যে আমাদের ক্রাইসিস পাইলটই। শ্রীলঙ্কা বিপক্ষে ২০০২ এর সেই সিরিজ ছিল শ্রীলঙ্কার মাটিতেই আপনি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেছিলেন সত্যিকারের ক্রাইসিস ম্যানের মতোই৷ পুরো হতশ্রী পারফরম্যান্স বাংলাদেশ দল আর তার ক্রিকেটারদের। শুধু মাত্র আপনিই ছিলেন ব্যতিক্রম। পুরো সিরিজ জুড়ে করেননি সর্বোচ্চ রান, নেননি কোন উইকেট, নেই কোনো সেঞ্চুরি, কোনো ম্যাচে হতে পারেননি ম্যান অব দ্যা ম্যাচ, নেই কোনো ম্যাচ জয়ী ইনিংস। দল জেতেনি কোনো ম্যাচ। ৩ ম্যাচে রান করেছেন ১০৬ আর সাথে ৩ ক্যাচ উইকেটের পেছন থেকে। কিন্তু আপনিই পেয়েছিলেন ম্যান অব দ্যা সিরিজের পুরস্কার। এর পেছনে মূল কারণ অধিনায়কত্ব আর লড়াকু মানসিকতা। ক্রিকেট ইতিহাসে এভাবে আর ম্যান অব দ্য সিরিজের পুরষ্কার পাননি। আমাদেরও প্রথম ম্যান অব দ্যা সিরিজও আপনিই। কত জনেই তো পাবে, কত বারই পাবে কিন্তু আমাদের ক্রাইসিস ম্যান আমাদের ইতিহাসের ১ম সিরিজ সেরা ক্রিকেটার।
স্ট্যাম্পের পেছন থেকে পেইন, ধোনি, সরফরাজদের প্রায় সময় মারাত্মক স্লেজিং করতে দেখি। আর এসব আমাকে আপনার কথা খুবই মনে করিয়ে দেয় প্রিয় উইকেটরক্ষক পাইলট। উইকেটকিপিং এর পরিসংখ্যান আপনার হয়েই কথা বলে, বিশ্বসেরাদের একজন ছিলেন আপনি। তেমনি স্লেজিংয়ের গুনটাও আপনার ছিলো। তার স্বাক্ষর ক্যারিয়ারের প্রথম থেকেই দিয়ে এসেছিলেন। মনে আছে পাইলট? গাঙ্গুলীর সেই প্রশ্ন আর আপনার উত্তর? আপনার মনে থাকারই কথা, তবুও আমি মনে করিয়ে দিতে চাই। আমার মনকে আটকানোর সাধ্যি যে আমার নেই! ভারতের অধিনায়ক গাঙ্গুলী সেদিন আপনাকে বলেছিলেন “এতো বিরক্তিকর ব্যাটিং কোথা থেকে শিখেছ?” উত্তরে আপনি বললেন, “তোমাদের সুনীল গাভাস্কারের কাছ থেকে। তিনি তো ৬০ ওভার মাঠে টিকে ১৭৪ বল খেলে তুলেছিলেন মাত্র ৩৬ রান! মনে নেই?” গাঙ্গুলী নিশ্চয়ই সেদিন আপনার কথায় অবাকই হয়েছিলো হয়তো।
আপনার মনে আছে মাসুদ ইনজামামের সেই আলু এর ঘটনাটা? মনে করিয়ে দিবো? ১৯৯৭ তে টরেন্টোতে সাহারা কাপে যখন দর্শকরা ইনজামামকে ‘আলু’ ‘আলু’ বলে চিৎকার করছিলেন তখন তিনি ব্যাট নিয়ে তেড়ে গিয়েছিলেন দর্শকদের দিকে। ইনজামাম ফিরে এসে যখন ব্যাটিংয়ে মন দিচ্ছিলেন তখন উইকেটের পেছন থেকে আপনার খোঁচা দেওয়ার শুরু। “ইনজি ভাই, বোলো না, তোমকো আলু কিউ বলতা হ্যায়?” তখন সে আপনাকে গালি দিয়েছিলো। এভাবে অনেক জনকেই উত্তেজিত করে আউটও করিয়েছিলেন আপনি। ২০০৫ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে ব্যাটিংয়ে আপনার সাথে মুরালিধরনের তুমুল তর্ক। আপনি বলে বসলেন ‘তোর পাঁচশ উইকেট তো চাক করে রে।’ আপনার এমন কথা আমাকে সত্যিই গর্বিত করেছিলো, কারণটা ছিলো ছোট দলের খেলোয়াড় হয়েও বড় দলের বড় তারকার সাথে এভাবে ডোমিনেট করে চোখে চোখে রেখে কথা বলা। পরের বছর অবশ্য মুরালি তার ১০০০ উইকেটের মাইলফলকও স্পর্শ করেছিলেন আপনাকে আউট করে। আপনি আরো একবার ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন পাইলট।
আপনার ব্যাটিং নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। পরিসংখ্যান দিয়ে সব সময় ক্রিকেটকে মূল্যায়ন করা যায় না, এজন্যই এটিকে এক কিংবদন্তি বলেছিলেন, “পরিসংখ্যান আস্ত একটা গাদা।” সেটির সত্যতা প্রমাণের জন্য এক আপনিই যথেষ্ট। বহুবার আমাদের কলাপ্স হওয়া ব্যাটিং লাইন আপকে একার হাতে টেনে নিয়েছেন বোলারদের, এনে দিয়েছিলেন সম্মান সূচক স্কোর কিংবা সম্মান সূচক পরাজয়। দেশের হয়ে প্রথম ১০০০ রানের মালিক তো আপনিই। এখানেও যে আপনি ১ম হয়েই থাকবেন সারাটা জীবন। আপনি সেরা হয়ে থাকবেন ২০০৪ এর সেই সেন্ট লুসিয়া টেস্টের সেঞ্চুরির জন্য। যে ম্যাচ আমরা প্রথমবার নিজেদের কৃতিত্বে ড্র করি। সে ম্যাচে আপনার ধৈর্যের রুদ্রমূর্তিতে ড্র করে বাংলাদেশ। প্রিয় মাসুদ ভাই, যে ম্যাচ জিতে আমরা নিশ্চিত করেছিলাম প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলার টিকিট। সেটিও আপনার ৭০ এর কল্যানেই জিতেছিলাম আপনি হয়েছিলেন অব দ্যা ম্যাচ৷ সব কিছুর জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে পাইলট।
মিস্টার সেঞ্চুরিয়ান;
মনে আছে দেশের ইতিহাসের ১ম টেস্টের ১ম দিন শেষে ভারতীয় অধিনায়ক গাঙ্গুলীর সাথে সেই কথোপকথন?
দিনশেষে ৭০* রানে আপনি যখন অপরাজিত তখন হোটেল যাওয়ার সময়ে লিফটে আপনার আর ভারতীয় কাপ্তানের দেখা। মানসিক চাপে রাখতে তিনি আপনাকে বলেছিলেন, ‘কাল সকালে নতুন বল নেবো।’ বুলবুল আপনি বলেছিলেন, ‘তোমার যা খুশি কোরো, আমি সেঞ্চুরি করবো।’ কথার এই বাউন্সকে কনফিডেন্টলি আপার কাট করে সীমানা ছাড়া করার গাটস্ টা দেখিয়েছিলেন আপনি। কেউ মানবে কি মানবেনা জানি না তবে এমন গাটস্ কিংবা এতো এতো সাহস নিয়ে কোনো বড় দলের অধিনায়ককে হুমকি দেওয়ার মতো ক্রিকেটার এখনো আমাদের নেই। ব্যাট হাতে অ্যাবিলিটি থাকলেও কেউ বিপক্ষে অধিনায়ক কোহলি, রুট কিংবা উইলিয়ামসনের কথাকে এভাবে উঁড়িয়ে দেওয়ার সেই গাটস্ টা নেই।
গাঙ্গুলী তো এমন কথার আপার কাটে লিফটের ভিতরেই কথা থামিয়ে দিয়েছিলেন। ১ম দিনে আপনি লিখেছিলেন ৭০* পৃষ্ঠা, অর্থাৎ মহাকাব্যের ১ম খন্ড। শেষ খন্ডটা লেখার তখনও বাকী ছিলো। বেলা ১১ টা বেজে ০৪ মিনিটে, রোজ বৃহস্পতিবার, ৬ ঘণ্টা ২৯ মিনিট, মুরালি কার্তিককে সুইপ করে স্কয়ার লেগে বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলেন আপনি।
আমরা পেয়েছিলাম আমাদের টেস্ট ইতিহাসের ১ম সেঞ্চুরি। ৩য় ব্যাটসম্যান হিসেবে দেশের টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যান তখন আপনি। এই মহাকাব্যের শেষ পাতা পর্যন্ত যেতে যেতে পৃষ্ঠা লেখেছিলেন ১৪৫ টি৷ লিখেছিলেন ৫৩৫ মিনিটে ৷ সহজ ভাবে বললে ১৪৫ রান করেছিলেন ৫৩৫ মিনিটে বা ৮ ঘন্টা ৫৫ মিনিটে।
আপনার তো খেলারই কথা ছিলো না অভিষেক টেস্টে আর সেই আপনিই কিনা করে বসলেন অনন্য এক রেকর্ড। আপনার যে ব্যাট থাকার কথা বাসার আসবাবপত্র কিংবা ক্রিকেটের ইন্সট্রুমেন্টের সাথে আর সেই ব্যাটই কিনা শোভা পাচ্ছে লর্ডসে৷ সবই ভাগ্যবিধাতা আর ইচ্ছা শক্তির খেল বুলবুল ভাই। এই নশ্বর পৃথিবীতে আরো অনেক রান, সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি কিংবা হাজার হাজার রান হবে তবে চার্লস ব্যানারম্যান, ডেভ হটন, আপনি এবং কেভিন ও’ব্রায়েন এই ৪ জনের সেঞ্চুরি থাকবে অনন্য উচ্চতায়৷ ধন্যবাদ আমিনুল ইসলাম বুলবুল। আপনার এই কীর্তির জন্য আপনি ক্রিকেট ইতিহাসে বেঁচে থাকবে যতদিন ক্রিকেট বাঁচবে।
আমাদের আক্ষেপ হয় এখনো, আপনার যোগ্য সম্মানটা আমরা দিতে পারিনি কখনো। ক্রিকেট বোর্ডের এসব হ য ব র ল কার্যক্রমে আপনার যথেষ্ট বিমুখতা রয়েছে। কালেভদ্রে ম্যাচ পেতাম তাই সব সময় সেরাটা দিতে পারেননি, বিদায়টাও হয়েছে কেমন যেনো ধোয়াশা দিয়ে। তবে যাওয়ার আগে অনেক কিছুই দিয়েছেন। অনেক কিছুরই সাক্ষী হয়েছেন এই ক্রিকেট ক্যারিয়ারে। আমাদের প্রথম বিশ্বকাপের অধিনায়ক তো আপনিই। অধিনায়ক হিসেবে বিশ্বকাপ ম্যাচ তো আপনার অধীনেই। আমাদের প্রথম ওয়ানডে জয়ে ছিলেন, ছিলেন আমাদের ইতিহাসের প্রথম টেস্টে। হাঁকিয়েছিলেন আমাদের হয়ে প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। ছিলেন আমাদের আইসিসি ট্রফি জয়ী দলের অন্যতম সদস্য। বিদেশের মাটিতে ব্যাট হাতে ডোমিনেট করাটাও আমাদের আপনিই শিখিয়েছিলেন। শুনেছি অস্ট্রেলিয়ায় আপনি যে বাড়ি কিনেছেন তার নামও -‘100’.
বুলবুল ভাই একটা ম্যাচে ব্যাটেরর পাশাপাশি অনুপ্রেরণা দিয়েও আমাদের জিতিয়েছিলেন একটি ম্যাচ৷ ১৯৯৭ এর আইসিসি ট্রফির সেমিতে আপনার আর পাইলটের সেই কথোপকথন কী আপনার মনে পড়ে? সে ম্যাচে পাইলটের যখন ২৫-৩০ রান তখন আপনি তাকে চাপ মুক্ত রাখতে বার বার বলছিলেন, ‘তুই-ই ম্যাচসেরা হবি। আর কম্পিউটারটা আমাকে দিবি।’ কারণটা আর কিছু নয়, সিএনএস নামের একটি কম্পিউটার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান তখন ঘোষণা দিয়েছিলো, সেমিফাইনালে বাংলাদেশের কেউ ম্যাচসেরা হলে তাঁকে একটি পেন্টিয়াম ওয়ান কম্পিউটার পুরস্কার দেওয়া হবে। আর আপনার স্ত্রী ছিলেন কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্রী। তাই আপনি এসব বলে বলেই মূলত অনুপ্রেরণা দিচ্ছিলেন তাকে। সেদিন পাইলটের ৭০ রানে ভর করে আমরা ম্যাচ জিতি এবং সেটি আমাদের প্রথমবার বিশ্বকাপে সুযোগ করে দেয় পরবর্তীতে ওয়ানডে স্ট্যাটাসের পথ সুগম করে। আপনাকেও একটা ধন্যবাদ জানাতেই হয় আমাদের৷ দিনশেষে আপনি কোটি ভক্তের ধন্যবাদ পাবেন আপনার ক্যারিয়ারের এই অর্জন গুলোর জন্যও। আশা করি ভবিষ্যতে অন্য কোনো ভূমিকায় আমাদের অনেক প্রথমের সাক্ষী হবেন, ধন্যবাদ মিস্টার সেঞ্চুরিয়ান।
মায়ের প্রিয় ক্রিকেটার;
প্রিয় রফিক, আপনাকে কোনটা দিয়ে মূল্যায়ন করবো? পরিসংখ্যান দিয়ে নাকি পরিসংখ্যান ছাড়া? পরিসংখ্যান দিয়ে মূল্যায়ন করলেও আপনাকে মূল্যায়ন করা যাবে অনেক বেশীই আবার তখন আফসোসও হবে অনেক। আবার চাইলে আপনাকে কোনো পরিসংখ্যান ছাড়াই একজন ক্রিকেটার এবং একজন ব্যক্তি রফিক হিসেবেও মূল্যায়ন করতে পারি।
মূলতানে সেদিন ‘মানকাডিং’ করে উমর গুলকে আপনি আউট করলেও পারতেন ক্রিকেটের নিয়মে তা আউটই হতো। কিন্তু ‘মানকাডিং’ শব্দটাকে আপনি রূপ দিলে ‘ম্যান কাইন্ডিং’য়ে৷ ক্রিকেট স্পিরিটের বাহিরে যেতে চাননি আপনি, তাই আর উমর গুলকে আউট করেননি। সেদিন তখন গুলকে আউট করলেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে চলে আসতো। লেখা হতো ‘মূলতান রূপকথা’। কিন্তু ক্রিকেটীয় স্পিরিটের বাহিরে গিয়ে এমন রূপকথার লেখক হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা কিংবা আকাঙ্কা কোনোটাই আপনার ছিলো না। আপনি বলেছিলেন, “এভাবে জিতলে দেশের বদনাম হতো।” সেদিন আপনি চাইলেই আমরা প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পেতাম, কিন্তু তখন পাওয়া না হলেও পরে যখন আমরা প্রথম টেস্ট জিতি সেখানেও আপনি ছিলেন। আপনি সে ম্যাচে ব্যাট হাতে ৬৯ ও ১৪ রান আর বল হাতে এক ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়ে জয়ের অন্যতম নায়ক হয়ে আছেন আমাদের ইতিহাসে। আমরা নিজেদের প্রচেষ্টায় প্রথম যখন টেস্ট ড্র করি ম্যাচ টায় ড্র এর পিছনে সবচাইতে বড় অবদান তো আপনারই। নয় নাম্বারে নেমে ১১১(১৫২), প্রথমবার ইনিংস ডিক্লেয়ার দেওয়ার সাহস করেছিলাম আমরা সে ম্যাচে। লারা সেদিন আপনাকে বলেছিলেন, “তুমিই তো ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হচ্ছো।” কিন্তু জুরিরা কেনো দেয়নি সেটি তাদেরই ব্যাপার। আপনি ছিলেন আমাদের প্রথম ওয়ানডে জয়েও। ভূমিকা রেখেছিলেন বল হাতে ৩ উইকেট আর ওপেনিংয়ে ৭৭ রানের অনবদ্য এক ইনিংসে ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়ে। রফিক, আপনি তো আমাদের প্রথম টি টুয়েন্টি জয়েও অবদান রেখেছিলেন ব্যাট হাতে ৫ বলে ১৩ রান এবং ১ উইকেট শিকারে। আপনি তো থাকতে থাকতে অনন্য এক রেকর্ডই গড়ে ফেলেছেন রফিক। ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আপনি দেশের তিন ফরম্যাটের সব গুলোর প্রথম জয়েই ছিলেন একাদশে। দীর্ঘ ১৩ বছর পর মোহাম্মদ নাবী আপনার ক্লাবের সদস্য হয়। যে তালিকায় আপনিই প্রথম৷
আমাদের ইনিংসে তখন ছক্কা হতো একটি কিংবা দুটি। একটি ছক্কা হলে সবাই বুঝে নিতো সেটি আপনারই মারা। খেলা ছেড়েছেন সেই ১২ বছর আগেই। বছরখানেক আগেও টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড আপনারই দখলে ছিলো। এইতো সেদিন ঐ রেকর্ড তামিম নিজের করে নিয়েছেন। আপনিই আমাদের প্রথম ফিঞ্চ হিটার। আপনিই তখন ওয়ানডেতে শেষের দিকে ঝড় তোলা আমাদের প্রথম ব্যাটসম্যান। শেষ কিংবা শুরু সব খানেই ঝড় তুলতেন আপনি। যে ম্যাচ যে আমরা প্রথম বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করি সে ম্যাচে ১৬(৭), আইসিসি ট্রফির মহাগুরুত্বপূর্ণ ফাইনালে ২৫(১৫), প্রথম ওয়ানডে জয়ে ওপেনিংয়ে ৭৭(৮৭), প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়ে ৭২(৬৬) কিংবা প্রথম টি টুয়েন্টিতে ১৩(৫)। আধুনিক এই ধুমধাড়াক্কার ক্রিকেটে আপনাকে খুব মিস করি রফিক। আমার মা এজন্যই আপনার অনেক বড় ফ্যান ছিলেন। আমি যখন ছোট তখন মা খেলা দেখতে দেখতে বলতেন, “রফিক নামসে, এখন ছক্কা মারবে। রফিক নামলেই ছক্কা মারে।”
আমাদের সাকিব আল হাসান অলরাউন্ডার হিসেবে এখন অনেক অনেক এলিট ক্লাবে প্রবেশ করছে টেস্ট এবং ওয়ানডেতে। বিভিন্ন ডাবলের কীর্তি গড়ছেন তিনি। কিন্তু ডাবল এর এলিট প্যানেলের যাত্রা যে আপনাকে দিয়েই শুরু করেছিলাম আমরা। আপনিই তো প্রথম বাংলাদেশী অলরাউন্ডার যে কিনা টেস্টে ১০০০ রান এবং ১০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেছিলেন। আপনিই তো প্রথম বাংলাদেশী অলরাউন্ডার যে কিনা ওয়ানডেতে ১০০০ রান এবং ১০০ উইকেটের ডাবল স্পর্শ করেছিলো। আপনি এজন্যই সেরা এবং অনন্য হয়েই থাকবেন আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসে। এমন রেকর্ড গড়ার সুযোগ প্রতি দেশ থেকে দুজন করে ক্রিকেটার সবার আগে করার সুযোগ পেয়েছেন, যেখানে আমাদের দুটো রেকর্ডই আপনার দখলে। আপনিই প্রথমবার আমাদের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে ইনিংসে ৫০ এবং ৫ উইকেট শিকারের রেকর্ড করেছিলেন।
আমাদের প্রথম টেস্ট বোলার হিসেবে ১০০ উইকেটের মাইলফলক আপনিই স্পর্শ করেছেন। তেমনি ওয়ানডেতেও আমাদের প্রথম ১০০ উইকেটের মাইলফলকও আপনার দ্বারাই প্রথম স্পর্শিত হয়েছিলো। তবে অনেক আফসোস হয় আপনার জন্য। অনেক গুলো কারণে আফসোসও হয়। ভুল যুক্তি দিয়ে ওয়ানডে বোলার বানিয়ে টেস্টে বসিয়ে রাখা হয়েছিলো আপনাকে। অনেক দিন খেলতে পারেননি টেস্ট ক্রিকেট। অথচ টেস্টে ৩৩ ম্যাচ এবং ৪৮ ইনিংস বল করেই আপনার ঝুলিতে ১০০ টেস্ট উইকেট। আরো দ্রুতই হতে পারতো এই রেকর্ড। টেস্ট ক্রিকেটে স্পিনারদের স্বর্গের মতো দিন ৪র্থ এবং ৫ম দিন। হায় কপাল, তখন আমাদের বেশীর ভাগ টেস্টই ৩ দিনেই শেষ হয়ে যেতো। ব্যাটিং ব্যর্থতায় আপনার জন্য আর কিছুই থাকতো, মোটকথা বোলারদের জন্য কিছুই থাকতো না।আপনারা ৪র্থ ইনিংস বোলিংয়েরই সুযোগ পেতেন না। আপনার ৩৩ টেস্টে মাত্র ১৫ বার আপনি বিপক্ষের ২য় ইনিংসে বোলিংয়ের সুযোগ পেয়েছেন। তাও প্রায় প্রতিবারই আপনি বোলিংয়ে আসার কয়েক ওভার না যেতেই ম্যাচ শেষ কিংবা ততক্ষণে প্রতিপক্ষের ইনিংস ঘোষণা। তবে দেখেছিলাম আপনার ১০০ উইকেট পূরণের পরই প্রোটিয়া কাপ্তান স্মিথ ইনিংস ঘোষণা করেছিলেন। আপনার ক্যারিয়ারের শেষাংশে এসেই আমরা পেয়েছিলাম ওয়ানডে এবং টেস্ট স্ট্যাটাস। বেশী দিন সার্ভিস দিতে পারেননি আপনি। ক্যারিয়ারের প্রায় প্রতিটা সময়ই হয়েছিলেন উপেক্ষিত, বিশেষ করে টেস্টে৷ তবুও আপনি অনেক দিয়েছেন আমাদের। অনেক ক্ষোভ আর আক্ষেপ নিয়েই বিদায় বলেছেন ক্রিকেটকে।
প্রথমবার অবসর তো নিয়েছিলেন ১৯৯৯ তেই। বিশ্বকাপে আপনাকে তিনটে ম্যাচ বসিয়ে রাখা হয়েছিলো সাইড বেঞ্চে। তার পর আপনি বলেছিলেন, “আমাকে যে তিন ম্যাচ বসিয়ে রাখা হলো, আমি এতই খারাপ প্লেয়ার?” আসলেই আমারো তাই প্রশ্ন, এর আগের বছরই তো আপনি আমাদের প্রথম ওয়ানডে জেতালেন। তবে বোর্ড কর্তাদের একজন হাস্যকর ব্যাপার নিয়ে আপনাকে অপমান করেছিলেন, শুনেছি সে কারণেই মূলত আপনার অবসরে যাওয়ার চিঠি পাঠানো। আত্মসম্মান বোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তখন। আমাদের প্রথম লড়াকু যোদ্ধা রফিক প্রতিবারই আপনি আমাদের লড়াই করতে শিখিয়েছেন, আমাদের জিততে শিখিয়েছেন। শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা আপনার প্রতি। উদাহরণ হয়ে থাকবেন আপনি।
মিস্টার ফিফটি ;
আচ্ছা সুমন ভাই, আপনার ওয়ানডে রানের কাটা ৭৮ থেকে উপরে কেনো উঠতো না? ১৪ বারই কেনো আপনাকে ৫০-৭৮ এর ভিতর থামতে হয়েছে। আমাদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হয়েও কেনো একটা ওয়ানডে সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারলেন না আপনি? আপনার জন্য আমার বড়ই আফসোস হয় এই ব্যাপারটা। লিস্ট এ তেও আপনি কেনো পারেননি একটি সেঞ্চুরি হাঁকাতে? তাই আপনাকে আমি পরিসংখ্যান দিয়ে মূল্যায়ন করতে চাই না। অধিনায়ক হিসেবেও আপনি সফল ছিলেন। জিততে শিখিয়ে ছিলেন আমাদের। ২৯ টি ওয়ানডে আর ১ টি টেস্ট জিতেছিলাম আপনার অধীনে। আপনার এই ২৯ টি জয়কে এখনকার ৫৮ জয়ের সমান মনে করেন বর্তমান অধিনায়ক মাশরাফি। আপনার সময়ের একটি জয় মাশরাফির চোখে এখনকার সময়ের দুটি জয়ের সমান। আসলেই তো তাই।
আপনার সময়ে আমরা প্রথমবার ভারতে হারাই, দেশের মাঠে প্রথম জিতি, অজিবধ আপনার নেতৃত্বেই। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রথমবার লংকা জয়ে, প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয় আপনার অধীনে, প্রথম টেস্ট জয়ও আপনারই অধীনে, বিশ্বকাপে ভারতবদ আপনারই অধীনে, প্রোটিয়াদেরও আপনার অধীনেই হারাই। আপনিই মনে হয় এই ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে সুখী এক অধিনায়ক, ছোট দল হয়েও বিশ্বের সব বাঘা বাঘা দলকে হারানোর গৌরব চাইলেও সব অধিনায়ক অর্জন করতে পারেন না। প্রথম টেস্ট জয়ের ইতিহাসও আপনারই নেতৃত্বে রচিত হয়েছে। আমাদের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ও আপনারই অধীনে। নিজেদের কৃতিত্বে প্রথম ড্রটাও আসে আপনার অধীনে, আপনারই সেঞ্চুরিতে। আমাদের টেস্ট ইতিহাসের প্রথম অর্ধশতকেও মালিকও আপনি। আমাদের সেরা বিশ্বকাপের একটি ২০০৭ বিশ্বকাপ, সেটিও আপনারই নেতৃত্বে। প্রথমবার ২য় রাউন্ডে যাওয়ার সু্যোগও আসে আপনার অধীনেই।
আপনার ব্যাটিং নিয়ে আমি কিছুই বলবো না সুমন ভাই। আপনার অনেক অনেক কীর্তি, কোনটা রেখে কোনটা বলবো সেটাই জানা নেই। বললে যে এই ছোটো চিঠিতে জায়গা হবে না। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি আপনি সেরাদের সেরা৷ অন্যান্য ক্রিকেটারদের মতো আপনার বিদায়টাও সুখকর না হওয়ার ব্যথিত সুমন ভাই। শ্রদ্ধা রইলো আপনার প্রতি, সব উপহারের জন্য ধন্যবাদ। জীবনের এই রঙিন ক্রিজে একটা সেঞ্চুরি আসুক, হোক না সেটা বয়সের সেঞ্চুরি।
চট্টলার নায়ক অপরাজিত ৬৮*;
১৩ ই এপ্রিল কিলাত কেলাব ক্লাবে ট্রফি উঁচিয়ে ধরা আকরাম ভাই, কুয়ালামাপুরের সুগোই বুলোকে কতটা মিস করছেন এই সময়টাতে? সত্যিই কখনো কি ভেবেছিলেন সুগোই বুলোর মহাকাব্যের মতো মহাকাব্য লেখা হবে আপনার ব্যাট দিয়ে। যে নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে শেষ হয়েছিলো আমাদের ৯৬ এর বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন, যাদের কাছে ৯৭ এর আইসিসি ট্রফির প্রস্তুতি ম্যাচেও হেরেছিলাম আমরা, যাদের কাছে ৯৭ এর সেই আসরের কোয়াটার ফাইনালে হারলে ধূলিসাৎ হয়ে যেতো আমাদের ৯৯ এর বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন, এতো সহজে পাওয়া হতো না ওয়ানডে স্ট্যাটাস সেই বাঁচা মরার লড়াইয়ে এমন এক অসাধারণ ইনিংস। আকরাম ভাই, আপনার এই অপরাজিত ৬৮ নিসন্দেহে আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস৷ কিন্তু আমার একটা আফসোসও আছে। ওই ম্যাচটার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। নাহলে আমাদের ইতিহাসের সেরা ওয়ানডে ইনিংসের মাঝে যেটির স্থান হতো অনেক উপরে। যত যাই বলি না কেনো সেই ইনিংসের জন্য আপনি সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন অন্যরকম ভাবেই।
আজ আমরা নিয়মিত জিতি। একটা সময়ে কালেভদ্রে জিততাম। এর আগে জয় আসতো কয়েক বছর একবার। তাও বেশীরভাগই আনঅফিসিয়াল ম্যাচেই তুলনামূলক দুর্বল দল গুলোর সাথে। তবে ৯৪ তে আপনার অধিনায়কত্বের অভিষেকে আমাদের মূল দল খেলে সার্ক ক্রিকেটে। সেবার পাকিস্তান এ দলের কাছে জিততে জিততে ১ উইকেটে হার, ভারত এ দলের বিপক্ষে ১ রানে জয়, শ্রীলঙ্কা এ দলকে হারিয়ে ফাইনালে খেলেছিলাম সেবার। আমরা ফাইনালে হারলেও সর্বোচ্চ রানের দৌড়ে রাহুল দ্রাবিড়ের চেয়ে এক রান করে আপনি ২য় সেরা হয়েছিলেন। সেই ফাইনালে আপনার লড়াকু ৬৬ রান অনেক দিন অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো আমাদের ব্যাটসম্যানদের। সেবার আপনার দল দেশবাসীর মন জয় করে নিয়েছিলো। আপনি আমাদের জিততে শিখিয়েছেন নেতৃত্ব দিয়ে। আপনার হাত ধরেই আসে আমাদের প্রথম আইসিসি ট্রফি, আপনার অধীনেই নিশ্চিত হয় ওয়ানডে স্ট্যাটস এবং বিশ্বকাপ খেলা। আপনি গর্বিত আপনি আপনার দেশের টেস্ট অভিষেকে ছিলেন, দেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ে ছিলেন, প্রথম বিশ্বকাপে খেলেছেন, বিশ্বকাপের প্রথম জয়েও ছিলেন। আপনার পরিবার থেকেই খেলা হয়েছে আমাদের দেশের ইতিহাসের ১ম টেস্ট, ৫০ম টেস্ট এবং ১০০ তম টেস্ট। এ এক বিরল অর্জন। আপনিই প্রথম শিখিয়েছেন আমাদের –
“জেগে ওঠো তোমরা ,
সময় এসেছে আজ জাগতে হবে তোমাদের। “
তবে অন্যান্য বাংলাদেশী সাবেক ক্রিকেটারদের মতো আপনার বিদায়টাও যে সুখকর ভাবে হয়নি। তবে এমন সব অর্জনের জন্য আপনাকে টুপিখোলা সালাম।
#Cricketkhor_Writing_Competition
#গর্জনের_সাত_বছর
#স্টে_ক্রিকেটখোর