টিভিতে সদ্য শেষ হয়ে গেলো বাংলাদেশ বনাম ভারতের মধ্যেকার একদিনের আন্তর্জাতিক সিরিজের ২য় ম্যাচ। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম জনশূন্য হতে শুরু করেছে। এই শূন্য বেদনার নয় বরং আনন্দের! সকালে সারাদেশে পানি কম্পন ছিল আর রাতে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম দেখলো টাইগারদের গর্জন। হারতে হারতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একটা দল যখন ভারতের মত শক্তিশালী দলকে হারায়, তখন আনন্দের মাত্রাটা একটু বেশি থাকে। “প্রতিপক্ষ যখন ভারত, হার তখন নিয়তি”- কথাটি ভুল প্রমাণ করতে সার্থক হলেন হাবিবুল বাশারের দল।
—
যে মুহূর্তে শীতে কাঁপছে পুরো দেশ। শৈত্যপ্রবাহ চলতে থাকায় কনকনে শীতে জবুথবু মানুষেরা লেপের নিচ থেকে বের হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না ঠিক সে সময়েই রাতের খাবার শেষ করে চিলেকোঠায় গল্পে বসেছে বীরযোদ্ধা ইমামুল হক ও তার ৯ বছর বয়সী দৌহিত্র আরিয়ান। প্রতিদিনই আহার শেষে টুকটাক গল্প-দিয়েই ঘুমোতে যায় তারা। তবে আজ গল্পের মূল বিষয় বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস জানবে আরিয়ান।
—
বয়সটা কম হলেও দেশের প্রতি আগ্রহটা যেন গভীর। দুজনেই হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বসেছে গল্পে মেতে উঠতে। ধোয়া জড়ানো কাপে মুখ দিতেই আরিয়ানের প্রশ্ন আচ্ছা দাদা ভাই, “বাংলাদেশ কিভাবে এসেছিল?”
আরিয়ানের এই ছোট মুখে এতো গম্ভীর কথা শুনে ইমামুল সাহেব হয় বেশ অনেকটাই চমকে যায়। কিভাবে সে বুঝিয়ে বলবে বাংলাদেশের জন্মের কথা? আরিয়ান কি বুঝবে এতো অল্পবয়সে এতো কিছু? ইমামুল হক চুপ করে চেয়ে আছেন আরিয়ানের দিকে। কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। হটাৎ আরিয়ান বললো, কি হলো দাদা ভাই বলছো না কেন? ইমামুল হক নড়েচড়ে বসেন এবং সিদ্ধান্ত নেন, বয়সটা অল্প তাতে কি! জীবন যুদ্ধের কথা সকলেরই আজ নাহয় কাল জানা প্রয়োজন।
—
চায়ের কাপ হাত থেকে নামিয়ে শুরু করেন তিনি। সে অনেক আগের কথা সালটি ছিল ১৯৪৭, সে সময়ের দিকে ব্রিটিশ ভারত ছিল সব কিছু। সাতচল্লিশের দিকে ভারতকে বিভক্ত করে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয় যার নাম ভারত ও পাকিস্তান। মুসলিম আধিক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তান দুটি পৃথক অঞ্চল হয়ে ওঠে, যার একটি পূর্ব পাকিস্তান এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল প্রধানত পূর্ব বাংলা নিয়ে, যা বর্তমানের “বাংলাদেশ”। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের মাঝে ব্যাপক হারে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক এবং ভাষাগত পার্থক্য বিরাজমান ছিল। এ পার্থক্যের জন্যই তাদের মধ্যে একপ্রকার বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
—
বিক্ষোভ থেকে শুরু হয় সংঘর্ষের। ২৩শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রের একমাত্র জাতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে ঘোষণা করে। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী জনগণও দেশব্যাপী সকলের মধ্যে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক বৎসর ব্যাপী সংঘর্ষ চলার পর, কেন্দ্রীয় সরকার অবশেষে পরাজয় স্বীকার করে এবং ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষায় পাবার পর পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংঘর্ষ লেগেই চলছিল। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ, তৎকালীন সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে একটি সভার আয়োজন করেন। আরও একটা কথা জেনে রাখো দাদু ভাই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামানুসারে রমনা রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে “সোহরাওয়ার্দী উদ্যান” রাখা হয়।
—
সভায় শেখ মুজিবের একটি ভাষণের পর বাঙ্গালী জাতির মধ্যে জাগ্রত হয় শক্তির। নিজের দেশের জন্য শুরু হয় লড়াই। এর মধ্যে ২৫শে মার্চ মধ্যে রাতে শেখ মুজিবকে তার নিজ ভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। আর সেখান থেকেই জড়সড় ভাবে শুরু হয় যুদ্ধ। অসহায় শিশু নারীদের প্রতি চলে অন্যায় অবিচার। দীর্ঘ ৯ মাস চলতে থাকে এই যুদ্ধ। সবুজে ঘেরা এই দেশে হাজারো প্রাণের লাল রক্তে রঙ্গিত হয় লাল সবুজের এই দেশ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে সমাপ্ত হয় যুদ্ধ। এবং বাঙ্গালীরা জয়ী হয়ে দেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ে তোলে। এখানে ছোট বড় আরও অনেক কিছু হয়ে থাকে সময়ের সাথে সাথে সেটাও তোমাকে জানাবো তবে তা আজ নয়। সময়ের সাথে সাথে নিজের দেশ সম্পর্কে তোমাকে সব জানতে হবে আরিয়ান। আজ তোমাকে জানাবো আমাদের দেশের ক্রিকেট ইতিহাস। জীবন যুদ্ধে মানুষ যেমন জয় পরাজয়ের সাথে লড়াই করে, ঠিক তেমন ভাবেই ব্যাটে বলে লড়াই করেছিল আমাদের দেশের ক্রিকেট সৈন্যরা।
—
আরিয়ান শুনো! প্রথমে তোমায় বলি, ক্রিকেট শব্দ কিভাবে এসেছিল।
– জ্বি দাদা ভাই বলেন।
সর্বপ্রথম এটাকে বলা হতো “ক্রেকেট”। ধীরে ধীরে শব্দ ভাণ্ডারে শব্দ যুক্ত হবার সাথে সাথে নাম হয় “ক্রিকেট”। পরবর্তীতে সময়ের সাথে সাথে সম্পূর্ণ বিশ্বে এটি ছড়িয়ে পরেছে বলাই যায়। ১৮৪৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হলেও ইতিহাস স্বীকৃত টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ খেলা শুরু হয় আরও পরে। প্রথমদিকে সুনামধন্য কয়েকটি দেশ নিয়ে ক্রিকেট খেলা হতো।
ওহ তোমাকে একটা গল্প তো বলাই হয়নি।
– কোন গল্প দাদা ভাই?
ইমামুল হক বেশ আকস্মিক ভাবে শুরু করেন, শুনো তোমায় বলি- এক মুক্তিযোদ্ধা রকিবুল হাসানের গল্পঃ
স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে আমাদের অঞ্চলের অন্যতম সেরা ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিল রকিবুল হাসান। পূর্ব পাকিস্তানী ও বাঙালী বিধায় তিনি তৎকালীন পাকিস্তান দলের হয়ে খেলতেন। তবে ১৯৬৯-৭০ মৌসুমে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড টেস্ট সিরিজে দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের রকিবুল হাসান সুযোগ পান। আন্তর্জাতিক ম্যাচে বেশি দিন খেলার সুযোগ হয়ে উঠেনি তাঁর, গড় ছিল ৮.৫০। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ছোট হলেও তিনি অনন্য হয়ে আছেন তাঁর সাহসিকতা, বীরোচিত মনোভাব ও আপোষ-হীনতার কারণে। স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকারের নানান অপশাসনের মাঝেও তিনি চোখ রাঙিয়ে কথা বলতেন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। বাঙালি হওয়ার অপরাধে ভাল খেলেও পাকিস্তান দলে সুযোগ না হওয়া রকিবুল হাসান একাদশে প্রথম ডাক পায় ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ এর বিশ্ব একাদশের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে। সেই ম্যাচে পাকিস্তান একাদশের খেলোয়াড়দের দেওয়া হয় গ্রে নিকোলাস ব্র্যান্ডের ব্যাট যাতে লাগানো ছিলো আইয়ুব খানের নির্বাচনী প্রতীক তলোয়ার। কিন্তু এটি মেনে নিতে পারেননি আমাদের স্বাধীনতা চেতি রকিবুল হাসান, মাঠে নামেন “জয় বাংলা” স্টিকার ব্যাটে লাগিয়ে। জয় বাংলা লেখা যেখানে একটা লাল সূর্যের মাঝে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের হলুদ ম্যাপ লাগানো ছিল। তারপর সেটা ব্যাটের উল্টো দিকে লাগিয়ে মাঠে নামে রকিবুল। হাজার হাজার বাঙালি দর্শক সাক্ষী হয়ে ছিলেন সেদিন। জয় বাংলার স্লোগানে মুখরিত হয়েছিলো সেদিন স্টেডিয়াম।
—
রকিবুল হাসানের মত পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলে সুযোগ পাওয়ার যোগ্য খেলোয়াড় ছিলেন শহীদ জুয়েল এবং শহীদ মুস্তাক। শহীদ জুয়েল অত্যন্ত মারকুটে উইকেট কিপার সাথে ভাল একজন ব্যাটসম্যান ছিলেন। সেই সময় তার ভাল পারফরমেন্সের কারনে বলা হতো পাকিস্তান দলে সুযোগ পাবেন তিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুয়েল এবং আরো অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ অংশ গ্রহণ করে, শহীদ জুয়েলের স্বপ্ন ছিল একদিন বাংলাদেশ দল হবে আর সে দলে খেলবেন তিনি। শহীদ জুয়েল ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। ২৯ আগস্ট ১৯৭১, গেরিলা যোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা পড়েন জুয়েল। শহীদ জুয়েলের সবচেয়ে বড় সাপোর্টার ছিলেন শহীদ মুসতাক যার সাহায্যে জুয়েলের ব্যাট স্টেনগানে রূপ নেয়, ক্রিয়া সংগঠক আজাদ বয়েস ক্লাবের সাথে যুক্ত ছিলেন মুসতাক, ২৫ মার্চ রাতে হত্যা করা হয় মুসতাককে।
—
আরিয়ান বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলেন, দাদা ভাই আর্মিদের কাছে শহীদ জুয়েল ধরা পরার পর জুয়েল কি আর কখনো দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলতে পারে নি?
ছোট মুখের এতো কঠিন প্রশ্ন যেন তীরের মত লাগে ইমামুলের। চিবুক শক্ত করে ইমামুল উত্তর দেয়, সেদিনের পর জুয়েলকে আর খুজে পাওয়া যায়নি, এমনকি জুয়েলের লাশটিও পাওয়া যায়নি। দেশের জন্য যাদের প্রাণ যায় তাদের নামের পূর্বে শহীদ শব্দটি যুক্ত করা হয়ে থাকে বলেই জুয়েলের নামের পূর্বে শহীদ যুক্ত করে শহীদ জুয়েল বলা হয়।
—
১৯৭১ সালের শেষ দিকে দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২/৭৩ মৌসুমে স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলার আয়োজন করা হয়েছিল। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত একটি দেশ ক্রিকেটেও মননিবেশ করে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড। কিছু সময় যাবার পর ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেট প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বাংলাদেশে প্রথম ঢাকা ক্রিকেট লীগে শান্তিনগরকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কালিচরন বাবু-নওয়াব-রিজভী-বাদশা-মুকুল ও শেখ কামালের দল আবাহনী। আরিয়ান দাদু শুনো! বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে জাতীয় লীগে প্রথম সেঞ্চুরি করেন কুমিল্লার আহসান জহির। ঢাকা স্টেডিয়ামে বরিশালের বিপক্ষে ১০১ রান করেন।
তৎকালীন একজন ব্রিটিশ ক্রিকেট সাংবাদিক রবিন মারলার বাংলাদেশ ক্রিকেটের তৎকালীন অবস্থার প্রশংসা করে “Whither Bangladesh?” নামক একটি লেখা মিডিয়াতে প্রকাশ করেন। যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নজরে আসে। ১৯৭৬ সালে রেজা-ই-করিম অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত এমসিসিকে বাংলাদেশ ভ্রমণে আহবান জানান। এমসিসির সফরের উপরই অনেকটা নির্ভর করছিলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পদচাপের গৌরব। ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭৬ সালে এমসিসি বাংলাদেশের মাটিতে পা দেয় এবং ৪০ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে একটি প্রীতি ম্যাচে অংশ নেয়। তখনকার বাংলাদেশ জাতীয় দল এমসিসির বিপক্ষে ২টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে, ম্যাচ গুলো অনুষ্ঠিত হয় রাজশাহীতে।
এমসিসি মানে কি দাদা ভাই?
— মেলবোর্ন ক্রিকেট কাউন্সিলকে সংক্ষিপ্ত করে এমসিসি বলা হয়।
ইমামুল সাহেব আবার ফিরে যান সাল ১৯৭৭, এমসিসির একটা দল আবারও বাংলাদেশে আসে। এর মাঝেই ১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থার (আইসিসি) সহযোগী সদস্য পদ লাভ করে বাংলাদেশ। যা আমাদের ক্রিকেটের পথ চলা শুরু করতে সাহায্য করে। রাকিবুল হাসানের নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের মে মাসে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে বিশ্ব ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশের। সেবার ৬০ ওভারের ম্যাচে ফিজিকে ২২ রানে হারিয়ে জয় পায় বাংলাদেশ। ওই টুর্নামেন্টে মালয়েশিয়া-কেও হারায় বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে গ্রুপ “বি” তে তৃতীয় স্থান দখল করে বাংলাদেশ। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের ক্রিকেট লীগে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করেন আজাদ বয়েসের আশরাফুল হক। ইলেভেন স্টারের বিপক্ষে ২০১ রান করেন ২৯ টি চার ও ৭ টি ছক্কার সাহায্যে। এইটা ইতিহাস মনে না রাখলেও তোমরা জানবে এবং পরের প্রজন্মকে জানাবে।
—
আরিয়ান বলে উঠে, ফিজির সাথে জয়, এটা কি বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম জয় ছিল?
ইমামুল হক জানান, হুম এটাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম জয় ছিল। তবে এই ম্যাচ গুলো আন্তর্জাতিক ম্যাচ নয়। বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে আরও অনেক পরে।
—
আশির দশকে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তখন ফুটবলের জয়জয়কার। তারই মাঝে ক্রিকেট জনপ্রিয় হতে শুরু করে। শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান দলের “এ” দল গুলো বাংলাদেশ সফরে এসে আমাদের সাথে অনেক গুলো সিরিজ খেলে।
১৯৮০ সালে জাতীয় ক্রিকেটে রাজশাহীর বিপক্ষে দীপু রায় উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করেন। ১২২ ও ১০৬। সে সাথে একই ম্যাচে ৪ উইকেট নেয়। ওইবার খুলনা মানে আমাদের বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই বছর দিপু রায় আর ও একটা বড় রেকর্ড গড়ে গ্যান্ডারিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরি সাথে হ্যাট্রিক করেন এবং এক ওভারেই নেয় ৪ উইকেট। ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় বারের মত আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে ৬ ম্যাচের মাঝে ৪টি ম্যাচ জয় লাভ করেও ফাইনালে উঠতে পারেনি। পাপুয়া নিউগিনির সাথে ১৭০/০ রান থেকে ২২৪ রানে অল আউট হয় বাংলাদেশ। তবে সেদিন ওপেনার ব্যাটসম্যান ইউসুফ রহমান ১১৫ রানের ইনিংস খেলে। বলা বাহুল্য ম্যাচটি আন্তর্জাতিক ছিল না, নাহলে তিনি হতেন আমাদের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান।
—
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৪-৮৫ সালের জাতীয় ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়। তারিকুজ্জামান মনির বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি করেন ৩০৮, এবং বর্তমান ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খানের সাথে জুটি করেন ৪৪৭ রানের। যদিও এই ম্যাচ গুলো প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা ছিল না বলে রেকর্ড বা ইতিহাসের পাতায় এগুলো থাকবে না। ১৯৮৪ সালে ঢাকায়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আই সি সি টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়, টুর্নামেন্টে রফিক ১৬ টি ৪ এবং ৩ টি ছক্কায় ১২৯ রানের ইনিংস খেলেন সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে। ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ এর দুইটা দল অংশ নেয়। টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় রকিবুলের বাংলাদেশ দল। এটাই বাংলাদেশের আইসিসি কোন ইভেন্টের প্রথম ট্রফি ছিল।
—
সাউথ এশিয়ান ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপে হংকংকে হারিয়ে ১৯৮৬ এশিয়া কাপে খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। ৩১ মার্চ, ১৯৮৬ বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা দিন। পূর্ণাঙ্গ শক্তিধর ও টেস্টখেলুড়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাংলাদেশ। টায়রোন ফার্নান্দো স্টেডিয়াম, মোরাতুয়া, শ্রীলঙ্কায় ৪৫ ওভারের ম্যাচে দলের অধিনায়ক হিসেবে গাজী আশরাফ হোসেন লিপু’র নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল মাত্র ৯৪ রানে গুটিয়ে যায়। সেই সাথে সাত উইকেট হারিয়ে জয় পায় পাকিস্তান। ২য় ম্যাচে শ্রীলংকার সাথে ১৩১ রান করে করে ৮ উইকেট হারিয়ে। মিনহাজুল আবেদীন ৪০রান করেন। সে ম্যাচও হারে ৭ উইকেটে।
—
১৯৮৬ সালে আইসিসি ট্রফিতে ৩য় বারের মত অংশ গ্রহণ করে বাংলাদেশ। এবার বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ, কিন্তু ৬ ম্যাচে মাত্র ২টিতে জয় লাভ করে কেনিয়া ও আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। জিম্বাবুয়ে, ডেনমার্ক, ইস্ট আফ্রিকা এবং মালেয়শিয়ার কাছে হেরে বসে বাংলাদেশ। তাই আর হয়নি বিশ্বকাপ খেলা।
আরিয়ানের চোখে মুখে প্রশ্নের ছাপ। কিছু একটা বলতে চাইছে। কিছুটা থেকে গিয়ে আরিয়ান কে প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন। দাদুভাই তুমি কি কিছু বলতে চাইছ? সময় না নিয়েই আরিয়ান চট করে বললো, দাদা ভাই ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু কেউ কি শতক বা অনেক গুলো উইকেট সংগ্রহ করতে পারে নি?
ইমামুল হক আবারও শুরু করলেন, ওই টুর্নামেন্টে নাজমুল আবেদিন নান্নু, রফিকুল আলম ও নেহাল হাসনাইন একটি করে অর্ধশত রান করেন। টুর্নামেন্টে জাহাঙ্গীর শাহ ১২ উইকেট লাভ করেন। এগুলোই ছিল প্রাপ্তি।
—
১৯৮৮ সালে সাউথ ইস্ট এশিয়ান টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে ৩ ম্যাচে ম্যাচ সেরা হয় আতহার আলী খান। হংকং ৯২* এবং সিঙ্গাপুরের ৬৯*, ফাইনালে হংকং এর সাথে করেন ৬৪ রান। ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মত কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করে বাংলাদেশ। তা হলো এশিয়া কাপ। চট্টগ্রামে ২৭ অক্টোবর, ১৯৮৮ সালে ঘরের মাঠে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচেই পরাজয় এবং পরের দুই ম্যাচ ও হারে। নিজের দলের হারার পরও স্টেডিয়ামে উপচে পরা ভিড় দেখা যায় এই দেশের ক্রিকেট পাগল মানুষের।
১৯৯০ সালে জুন মাসে অনুষ্ঠিত হয় আইসিসি ট্রফি। এবারও নিজেদের বাধা হয় সেই জিম্বাবুয়ে যারা প্রতিবার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে। নিজেদের ১ম ম্যাচে কেনিয়ার বিপক্ষে ৩ উইকেটে জয় লাভ করে। ২য় ম্যাচে বারমুডাকে ৩৬ রানে ও ৩য় ম্যাচে পিজি কে ৩ উইকেটে এবং ৪র্থ ম্যাচে ডেনমার্ককে ৩ উইকেটে হারায় বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে সে ম্যাচে জিম্বাবুয়ের টপ-অর্ডারের ৪ জন ব্যাটসম্যানকে আউট করে ৩৭ রানের মাথায়। তারপরও জিম্বাবুয়ে করে ২৩৭ রান আর বাংলাদেশ অলআউট হয় ১৪৭ রানে। বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন তখন শেষ হয়। ১৯৯০ সালে অস্ট্রাল-এশিয়া কাপে খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। যেটি অনুষ্ঠিত হয় শারজায়। ২ ম্যাচে শক্তিশালী নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হয় বাংলাদেশ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আজহার ৫৪ রান করে যা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম অর্ধশত রানের রেকর্ড। আর হ্যাঁ এই ম্যাচ গুলো আন্তর্জাতিক ম্যাচ অর্থাৎ যে ম্যাচ গুলো বিশ্ব ক্রিকেট পরিসংখ্যানে লেখা থাকবে এবং আই সি সি এই তথ্য গুলো জমা হিসেবে রাখে।
—
১৯৯০-৯১ এশিয়া কাপ সালে বাংলাদেশ এশিয়া কাপে অংশ নেয় যা অনুষ্ঠিত হয় ভারতে। ২ ম্যাচে ভারত ও শ্রীলংকার বিপক্ষে পরাজিত হয় বাংলাদেশ। ম্যাচে ৭৮ রান করেন আতহার আলী খান, এবং ম্যাচ সেরা পুরষ্কার লাভ করেন। সেই সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে ১ম ম্যাচ সেরা হওয়ার রেকর্ড গড়েন।
৯২ বিশ্বকাপ খেলতে না পারলেও এবার ঢাকা প্রিমিয়ার লীগকে জনপ্রিয় করতে দেশের ক্রিকেটের মান বাড়াতে কাজ শুরু করে ক্লাব গুলো। আবাহনীতে দায়িত্বে থাকা আহম মুস্তফা কামাল নিয়ে আসেন ভারতের ৮৮ বিশ্বকাপ জয়ী কপিল দেবকে। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ মহিন্দ্র অমরনাথকে কোচ হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৯৪ আইসিসি ট্রফির আগের বাধা ছিল জিম্বাবুয়ে এবার তারা নেই সেহেতু সুযোগ আমাদের। আর্জেন্টিনা, ইস্ট আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সহজে লাভ করে কিন্তু আরব আমিরাতের কাছে পরাজিত হয়ে এরপর ২য় পর্বে উঠে, কেনিয়ার সাথে জয়ের কাছে গিয়েও হারতে হয় ১৩ রানে। আবারও বিশ্বকাপের স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। কেনিয়ার ২৯৪ রানে জবাবে তবু ভালই খেলেছিল সেদিন। পরে নেদারল্যান্ডের সাথেও হারতে হয়, বিশ্বকাপ স্বপ্ন আবারও অধরা।
—
১৯৯৫ সালে এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হয় পেপসি এশিয়া কাপঃ যেখানে বাংলাদেশ ৩ ম্যাচে ভারত শ্রীলংকা ও পাকিস্তানের সাথে বিশাল ব্যবধানে হারে। ১৯৯৫ সালে ডিপিএলে খেলতে আসেন পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম। এছাড়া শ্রীলংকার অর্জুনা রানাতুঙ্গা, এরা ছাড়া ও আসেন রমন লাম্বা, অরুন লাল, কেনিয়ার স্টিভ টিকোলো, মরিস ওদুম্বে, থমাস ওডোয়ো। ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় বার অনুষ্ঠিত হয় পেপসি এশিয়া কাপ। এখানেও বিশাল ব্যবধানে ৩ ম্যাচ হারে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ১৯৯৭ সালে কেনিয়া, বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়েকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট কাপ আয়োজক ছিল কেনিয়া, যেখানে ৪ ম্যাচে ৪ টিতে পরাজিত হয় বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত স্বাধীনতা কাপে ২ ম্যাচের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে মোটামুটি ভাল লড়াই করে ৪ উইকেটে হারে কিন্তু পাকিস্তানের কাছে ৯ উইকেটে পরাজিত হয়।
১৯৯৭ সালে আই সি সি ট্রফিঃ এই ট্রফি আসলে বিশ্বকাপের কথাই মাথায় আসে এখানে সেরা হওয়া মানে বিশ্বকাপ। টুর্নামেন্টের ৫ ম্যাচের সব গুলোতে জয় লাভ করে। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে, প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ড। বলে রাখা ভাল, । টসে জিতে বাংলাদেশ ফিল্ডিং করে। ১৭১ রানে আটকে রাখে বাংলাদেশ। ১৭২ রানে জয়ের জন্য মাঠে নেমে ১৫ রানে ৪ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। এই ম্যাচ হারলে বিদায়। স্বপ্ন ভঙ্গের আশঙ্কায় এই দেশের মানুষ, টিভিতে খেলা দেখা না গেলেও রেডিও ছিল মানুষের এক মাত্র সম্বল। শুরু হয় বৃষ্টি। এবার বৃষ্টি আইনে টার্গেট দাঁড়ায় ৩৩ ওভারে ১৪১ রান। অর্থাৎ ৮৫ বলে ৮৫ রান।। ৯২ বলে মাত্র ৩ টি চারের সাহায্যে অপরাজিত ৬৮ রান। ঠাণ্ডা মাথায় দৃঢ়তা ও দক্ষতা দেখিয়ে জয় এনে দেন আকরাম খান । এই ম্যাচটি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস পালটে দেয়। এই জয়ে সেদিন সারা বাংলাদেশ কেঁদেছিল জয়ের নায়ক, Akram says everybody cried that day. The journalists, and their friends, say they cried too. “Gordon [Greenidge, their coach] cried the most. Everybody was crying, he couldn’t hold himself back.” পরে সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ড ৭২ রানে ও ফাইনালে কেনিয়াকে ডি এল ম্যাথডে ২৫ ওভারের ১৬৬ রানের বিশাল টার্গেটে ২ উইকেটে টান টান উত্তেজনাকর ম্যাচে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। অবশেষে এই টুর্নামেন্ট জিতে বাংলাদেশ এবং স্বপ্নের বিশ্বকাপ টিকেট পায়। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত স্বাধীনতা কাপে ২ ম্যাচের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে মোটামুটি ভাল লড়াই করে ৪ উইকেটে হারে কিন্তু পাকিস্তানের কাছে ৯ উইকেটে পরাজিত হয়।
—
বিশ্বকাপ নিশ্চিত হলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৮ অব্দি টানা বারো বছর বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরাজয়ের দ্বারা অব্যাহত চলতে থাকে। জয়ের স্বাদ পাওয়াটা যেন চাঁদকে চোয়া থেকেও কষ্টকর হয়ে উঠে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়ার, নিউজিল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে সকলের কাছে হারের মাধ্যমে যেন নিজেদেরকে অবস্থান খারাপ করে ফেলছিল বাংলাদেশ।
হটাৎ আরিয়ান বলে উঠলো, দাদা ভাই “অন্য দেশগুলো কি অনেক শক্তিশালী ছিল? বাংলাদেশ কেন বার বার হেরে যাচ্ছিল?”
নাতির এমন প্রশ্নের কি উত্তর দিবে ইমামুল? তিনি বললেন, বাংলাদেশ দল কম শক্তিশালী ছিল না শুধু তাদের পরিকল্পনা শক্ত থেকে শক্ত-তর হয়ে উঠতে পারছিল না। তবে ১৭ই মে ১৯৯৮ সালে অবশেষে জয়ের করে জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম জয় হিসেবে বেশ স্মরণীয় এই দিনটি। হায়দ্রাবাদের লাল বাহাদুর শাস্ত্রী স্টেডিয়ামে কেনিয়ার বিপক্ষে এই ম্যাচটি হয়েছিল। টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় কেনিয়া। নির্দিষ্ট ওভার শেষ হবার আগেই ২৩৬ রান সংগ্রহ করে অল আউট হয় তারা। ২৩৭ রানের জবাবে মাঠে নামে আকরাম খানের দল। ৪৮ ওভার শেষে মাত্র ৪টি উইকেট হারিয়ে তুলে নেন ৬ উইকেটের জয়। সেদিন ৭৭ রানের সাথে ৩টি উইকেট তুলে নেন মোহাম্মদ রফিক।
—
১৯৯৯ সালে মার্চ মাসে একটি ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে ঢাকায় আসে পাকিস্তান দল যেখানে ১৫২ রানে পরাজিত হয় বাংলাদেশ। এর কয়েক দিন পরেই মেরিল আন্তর্জাতিক ত্রিদেশীয় সিরিজ হয় বাংলাদেশে। যেখানে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের কাছে ৪ ম্যাচেই পরাজিত হয় বাংলাদেশ। তবে ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চের এই ত্রিদেশীয় সিরিজের ম্যাচে জিম্বাবুয়ের সাথে বঙ্গবন্ধু জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ১০১ রান অপি ১১৬ বলে। যা আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসে ওয়ানডে ম্যাচে প্রথম সেঞ্চুরি। মজার বিষয় মেহরাবের চাচা ১ম ৫০ রান করেছিল আর মেহরাব ১ম সেঞ্চুরি।
টানা ২২ ম্যাচ হারের পর কেনিয়ার সাথে জয়ের পরবর্তীতে আবারও ৯ ম্যাচের হার। তবে ভাগ্যের টানে স্বপ্নের বিশ্বকাপ খেলতে ইংল্যান্ড যায় দল। সাল ১৯৯৯, আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপে প্রথম দুই ম্যাচ হারে এরপর ৩য় ম্যাচে কাঙ্ক্ষিত জয় পায় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ রানে। এবং নিজেদের শেষ ম্যাচে সেই সময় অন্যতম পরাক্রমশালী পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬২ রানে জয় বাংলাদেশ।
—
হটাৎ ইমামুল সাহেব তার বিছানার তোশক উল্টিয়ে কি যেন বের করলেন, সেখানে ছিল কয়েক গুচ্ছ কাগজ। এ শুধু কাগজ নয়, এ ছিল সাদা কালো খবরের কাগজের টুকরো বিশেষ। যেখানে রয়েছে বিশেষ বিশেষ খেলার উক্ত বিবরণী, খেলোয়াড়দের ছবি সহ বিভিন্ন তথ্যের আনাগোনা।
কাগজের টুকরো গুলোর মাঝে একটা নীল কাগজের টুকরো দেখতে পায় আরিয়ান। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা, “সাতচল্লিশটি হার কিভাবে মেনে নিব?”
আরিয়ানের হাত থেকে নীল কাগজের টুকরো টা ইমামুল সাহেব হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রয়। হটাৎ কেমন যেন ঝিমিয়ে পরলেন ইমামুল সাহেব। এ ঝিমিয়ে পরার কারন, বুকভরা এক চাপা কষ্টের। নিজের দেশের জন্য লাখো প্রাণ দেওয়া একটা দেশের মানুষ যখন নিজের দেশকে হেরে যেতে দেখে সেই মুহূর্তের তীব্রতর কষ্টের আর কিছু রয় না। দাদার চোখ ভিজে আসতে দেখে আরিয়ান বলে, দাদা ভাই মনে আছে তোমার? গতবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা যখন ইট দিয়ে শহীদ মিনার বানিয়েছিলাম তখন বার বার ভেঙ্গে যাচ্ছিল। সে সময় মা বলেছিল, “দশে মিলা করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ!” পরবর্তীতে কয়েকবার চেষ্টা করার পর একটা সময় গিয়ে কি সুন্দর একটা শহীদ মিনার বানিয়ে ফেলেছিলাম।
—
হুম! দাদু ভাই মনে আছে। কি ভাবে ভুলতে পারি বলো। ওটা তো আমাদের এলাকার সব থেকে সুন্দর শহীদ মিনার হয়েছিল। এবং অনুষ্ঠান শেষে মাননীয় কমিশনার বলেছিলেন, “আগামী বছরেও যেন সব থেকে সুন্দর হয় তোমাদের বানানো শহীদ মিনার।”
এই তো দাদা ভাই, তোমার তো দেখছি সব মনে আছে। একবার ভেবে দেখো তো কত মানুষ নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশকে নিজেদের বানিয়েছে। এটা কি খুব সহজ কাজ ছিল? নিশ্চয়ই সহজ ছিল না। তখন সবাই মিলে এক হয়ে নিজের দেশের জন্য লড়াই করেছিল। সবাই এক হয়েছিল বলেই দেশের জন্য যুদ্ধ করে জয়ী হতে পেরেছিল। কেউ কিন্তু হতাশ হয়ে পিছ পা হয়নি। তবে দেশের ক্রিকেটের বেলায় কেন হতাশ হতে হবে? সবাই মিলে এক হয়ে নিশ্চিত কোন ভালো একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্যদের সাথে জয়ী হওয়া অবশ্যই সম্ভব। কি বলো দাদা ভাই সম্ভব হবে না?
—
ইমামুল হক আবারও ফিরলেন সেই পুরনো বুক চেরা ইতিহাসের পাতায়। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের জয়টা যেন রাজ্যজয় সমান ছিল। আজ ২৬শে ডিসেম্বর ২০০৪ সাল। আজকের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ আর পাকিস্তান মুখোমুখি হয়েছিল আঠারো বার। কিন্তু জয়ের স্বাদ মিলে একবারই আর সেটা ছিল সাল ১৯৯৯ মে ৩১, আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপের ২৯ তম ম্যাচে। কাউন্টি গ্রাউন্ড, নর্দাম্পটন! পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬২ রানে জয়ী হয় বাংলাদেশ। আমিনুল ইসলামের অসাধারণ অধিনায়কত্বে প্রকাশ পায় বাংলাদেশের ক্রিকেট হারিয়ে যায়নি। টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে নির্দিষ্ট ৫০ ওভার শেষে ৯ উইকেট হারিয়ে তুলে নেয় ২২৩ রান। ২২৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা ওয়াসিম আকরামের দল সব কটি উইকেট হারিয়ে ৪৪.৩ ওভার শেষে নিজেদের সংগ্রহে ১৬১ রান নিয়ে মাঠ ত্যাগ করেন। সে সময়কার অন্যতম শক্তিশালী দলকে হারিয়ে বেশ নাম কামিয়ে নিলেও পরবর্তীতে জয়ের দেখা মিলতে ৪ বছর সময় নিয়ে নেয় বাংলাদেশ দল।
—
বিশ্বকাপের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ আসে ঢাকায়, যেখানে দুই ম্যাচের সিরিজে পরাজিত হয় বাংলাদেশ। ২৬ জুন, ২০০০ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের পূর্ণাঙ্গ সদস্যের মর্যাদা লাভ করে। বোর্ডের নাম পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড নামকরণ হয়। ২০০০ সালের শেষ দিকে, ১০ই নভেম্বর থেকে ১৩ই নভেম্বরে বাংলাদেশ দল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী টেস্টে ভারতের মুখোমুখি হয়।
আরিয়ান বলে উঠে, দাদা ভাই উদ্বোধনী মানে কি?
উদ্বোধনী বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে, ২০০০ সালে দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দল টেস্ট ক্রিকেটে যুক্ত হয়। টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ম্যাচ ছিল ১০ই নভেম্বর, ২০০০ সালে। সে ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৯ উইকেটে পরাজিত হয় বাংলাদেশ। অভিষেক ম্যাচে আমিনুল ইসলাম করেন ১৪৫ রান। বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করেও ২য় ইনিংসে ৯১ রানে অল আউট হয়ে হারতে হয়।
—
পরাজয়টা যেন নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একের পর এক হারের মাধ্যমে নিজেদের কোন এক দূর গগনে হারিয়েই ফেলতে লাগলো। কিছু ব্যক্তিগত রেকর্ড ব্যতীত অর্জনের খাতায় শূন্যই পাচ্ছে বাংলাদেশ। অর্জন বলতে মোহাম্মদ আশরাফুল তিনি সবচেয়ে কম বয়সী টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান৷ ২০০১ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক করতে নেমে এই সাফল্য (১১৪ রান) পান তিনি৷ তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর ৬১ দিন৷ যে রেকর্ড এখনও টিকে আছে। দলীয় অর্জন পাকিস্তানের বিপক্ষে গতবছর ২০০৩ সালে মুলতান টেস্টে জয়ের একদম দ্বারপ্রান্তে গিয়েও আম্পায়ারের ভুলে ১ উইকেটে হারতে হয় বাংলাদেশকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম হ্যাট্রিক করেন অলক কাঁপালি।
—
এক দিনের আন্তর্জাতিকে ২টি পরিত্যক্ত বাদে টানা ৪৫ ম্যাচের হার সামলে নেওয়া চারটে খানিক কথা নয়! অন্যদিকে টেস্ট ক্রিকেটেও তিনটি ড্র (একটা মূলত ৫ দিন খেলে) বাদে ৩১টি ম্যাচে ১৬ টি সিরিজে পরাজিত হয় বাংলাদেশ দল। ক্রিকেট জগতের সবচেয়ে বড় পতনের সম্মুখীন হয়েছিল হয়তো এই সময়ের বাংলাদেশ দল। টানা পাঁচটি বছর পরাজয়ের পর ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ে ও হংকং এর বিপক্ষে ৮ ও ১১৬ রানের জয়ে নিজেদেরকে ফিরিয়ে আনতে শুরু করে।
—
চলতি বছরের একদম শেষে, দু’টি টেস্ট ও তিনটি এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে ভারত দল বাংলাদেশ সফরে আসে। ১০ থেকে ১৩ ও ১৭ থেকে ২০ নভেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রামে দু’টি টেস্ট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানের দুটোতেই জয়ী ভারত। এই সিরিজের প্রথম ওডিআই ম্যাচে ২৩শে নভেম্বর হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে মাঠে নামে বাংলাদেশ দল। জয়ের দ্বার প্রান্তে গিয়েও ফিরে আসতে হলো।
হ্যাঁ, দাদা ভাই মনে আছে। সেদিনের ম্যাচ টা তো আমিও দেখেছিলাম। তোমরা ভেবেছিলে আমি ঘুমাচ্ছি, কিন্তু নাহ! সকালে আমি লেপের নিচে শুয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে খেলা দেখেছিলাম। দিনের ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েক বার দরজার কোনায় লুকিয়ে খেলা দেখেছিলাম। টসে জিতে বাংলাদেশ বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ২৪৫ রানে আটকে দেয় প্রতিপক্ষ ভারতকে। ২৪৬ রানের লক্ষ্যে মাঠে নেমে খালেদ মাহমুদের অপরাজিত অর্ধশতক কিংবা হাবিবুল বাশারের ৬৫ ও যেন হার মেনে গেলো। ভারতের কাছে ১১ রানে হেরে যেতে হয় আমাদের। হতাশার মাঝেও হাসি উজ্জ্বল চেহারায় ইমামুল বলতে শুরু করেন, আরিয়ানকে উদ্দেশ্য করে, “দুষ্টু পাকা, তুমি দেখছি লুকিয়ে লুকিয়ে সকল খবরই রেখেছ।”
—
আরিয়ান চোখ নামিয়ে চুপটি করে হেসে দিল। সাথে সাথে বলে, দাদা ভাই আমি সব কিছু ভুলতে পারলেও বাংলাদেশের খেলা ভুলতে পারি না। মনে পরে দাদাভাই তোমার, আমরা যখন কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়েছিলাম সে সময়ের কথা? ইমামুল সাহেব বলে উঠেন, হুম খুব মনে আছে। তুমি বলেছিলে তোমার কোন খেলনা বা কোন জামা কাপড় কিচ্ছু চাই না। তোমার শুধু চাই “এক সেট ক্রিকেট কিট।” আমি চাই আজীবন এমন ভাবেই তোমার মধ্যে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা জন্মে থাকুক। একদিন তোমার মত আরিয়ানদের মাঝ থেকে বাংলাদেশ পাবে একজন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। যে বিশ্বকাপ এনে দিবে বাংলাদেশকে। হয়ত আমি দেখব না কিন্তু দেখবে বাংলাদেশ!
আজকের এই জয়টা বাংলাদেশ ক্রিকেটের অন্যতম একটা জয় তাই না দাদা ভাই?
ইমামুল হক প্রতি উত্তরে বলেন, ভারতের বিপক্ষে যেকোনো জয়ই উল্লাসের। অন্যদিকে ভারত বা পাকিস্তানের কাছ থেকে যখন ক্রিকেটের ময়দানে জয় আসে, সেটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের।
আজকের মতো এই ছিল দাদা ও নাতির গল্পকথন। জয়ের আনন্দ নিয়েই ঘুমিয়ে পরলেন দুজনে। দু’জনের মনে একটাই স্বপ্ন, নতুন সকাল যেন নিয়ে আসে নতুন কোন জয়ের। জয়ের মাধ্যমে মিশে থাকুক “বাংলাদেশ ক্রিকেট” বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে।