উঠতি জেনারেশনের বেশিরভাগই হয়ত শোনেন নাই অথবা শুনলেও জানার আগ্রহ জন্মে নাই। অথচ, এই লোকটার নাম ক্রিকেট নামক স্পোর্টসে লিজেন্ডারি তালিকায় থাকার কথা ছিল! “ছিল” শব্দটি কেন ব্যবহার করেছি এবং কেন নামটি ক্রিকেট শিক্ষায় গুরুত্ব বহন করে, সেই গল্পটি আজ শোনাবো। ধৈর্য থাকলে পড়তে পারেন 🙂
পুরো নাম ভিনোদ গানপাত কাম্বলি! ছোটবেলায় ক্রিকেট ছিলো যার একমাত্র ভালোবাসা। শচীন টেন্ডুলকারের সাথে স্কুল ক্রিকেটের সেই অমর পার্টনারশিপ, যেখানে কাম্বলি একাই করেছিলেন অপরাজিত ৩৪৯! সময়ের সেরা প্রতিভা, উহু শচীন নয়, কাম্বলিকেই বলা হত। দ্য গ্রেট শচীন থেকেও কাম্বলিকে হাইলি রেট করা হত, এবং সেটা যে ফ্লুক কিছু নয় তার প্রমান হাতেনাতেই দিয়েছিলেন কাম্বলি।
নিজের প্রথম সাত টেস্টেই দুটি সেঞ্চুরি এবং দুটি ডাবল সেঞ্চুরি হাকিয়ে কাম্বলি জানিয়েছিলেন এক নক্ষত্রের আগমনী বার্তা! হ্যাঁ, দ্রুততম ইন্ডিয়ান হিসেবে টেস্টে এক হাজারের মাইলফলকটি তার ছিল। নিজের খেলা রঞ্জি ক্রিকেটের প্রথম বলেই ছক্কা মেরে শুরু করা ক্রিকেটার এই কাম্বলি! ভারতীয়দের ক্রিকেট কালচার বিবেচনায়, একজন সুপারস্টার হতে আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে কি? ভারতীয় ক্রিকেট আকাশের উজ্জ্বল এই নক্ষত্র তাহলে উল্কা হয়ে ঝরে পড়লো কিভাবে? কিভাবে মাত্র ২৩ বছর বয়সেই থেমে গেলো তার টেস্ট ম্যাচ ক্যারিয়ার? কেনই বা একজন কাম্বলি হয়ে উঠতে পারলেন না একজন ক্রিকেট ঈশ্বর!
খ্যাতির চূড়ায় পৌছে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটা একটা আর্ট। স্বচ্ছন্দ কভার ড্রাইভের মত করে খ্যাতির বলটাকে সীমানার বাইরে পাঠাতে না পারাটাই হয়ত সবথেকে বড় অন্তরায় ছিল। রানের ফ্লোতে ভাসতে ভাসতে কাম্বলি ভুলে গিয়েছিলেন তার শেকড়! কারো কারো মতে, বিলাসিতা, মেয়েমানুষ, গোল্ডের প্রতি তার অত্যধিক মোহ খেলায় প্রভাব ফেলছিল। এছাড়া শর্ট বলে তার চিরায়ত দুর্বলতা, যেটা নিয়ে কখনো কাজ করার আগ্রহই দেখাননি তিনি। শুধু কি এগুলোই কারন? নাকি এর বাইরেও কিছু ছিল?
হ্যাঁ, কাম্বলির জন্য আরেকটি অন্তরায় ছিল “সময়”। খুব ভুল সময়ে ফর্মের বাইরে চলে যান তিনি, যখন ভারত হাতে পেয়ে যায় দ্রাবিড়, সৌরভ এবং লক্ষনকে! হ্যাঁ, ১৯৯৬ সালে এই তিন লিজেন্ডকে আনলিশ করে ভারত, টেস্টের দরজাটাও চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় কাম্বলির জন্য! কি অদ্ভুত তাই না? ৫৪ গড়ের একজন ক্রিকেটার, অমিত প্রতিভাবান… কিন্তু মাত্র ২৩ বছর বয়সেই শেষ টেস্ট ক্যারিয়ার! সুযোগের সদ্ব্যবহার না করার কি চরম খেসারত! অনেকেই ভারতীয় ম্যানেজমেন্টের এমন চরম সিদ্ধান্তকে হার্শ বলে অভিহিত করেন, তবে ম্যানেজমেন্ট নিরুপায় ছিল সেটাও মাথায় রাখতে হবে।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৪ সালে, যখন কোর্টনি ওয়ালশ একের পর এক বাউন্সার ছুড়ছিলেন, কিন্তু কাম্বলির কাছে কোন উত্তর ছিল না। প্রতিভা কিন্তু একটা স্টেজ পর্যন্তই আপনাকে নিয়ে আসবে, কিন্তু এরপর পুরোটাই আপনার এপ্লিকেশন্স। “মেক ইট বিগ”, যা কাম্বলি কখনোই করতে আগ্রহী ছিলেন না।
কাম্বলি সম্পর্কে বলতে গিয়ে হার্শা ভোগলে বলেন, ” “After a point, work ethic counts for far more than talent.
কার্যত কাম্বলি নিজেকে আর টেস্টে সেভাবে ফেরাতে পারেন নাই, এবং সেখানেই টেস্ট ক্যারিয়ারের সমাপ্তি। অবশ্য ছোট ফরম্যাটে মোট নয়বার কামব্যাক করেছিলেন তিনি, কিন্তু প্যাশনটা সেখানে ছিল না। ইন্ডিসিপ্লিন, হেয়ালিপনা, সব কিছুর মিশেলে কাম্বলি আর নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। প্রতিভা তখনও ছিল, এপ্লিকেশনটা ছিল না। ২০০২ সালে খেলেন নিজের শেষ ওয়ানডে ম্যাচ, অথচ এমনটা হবার কথা ছিল না!
একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শচীন তার বায়োগ্রাফিতে লেখেন, “কোন এক প্র্যাক্টিস ম্যাচ চলাকালে অপরপ্রান্তে কাম্বলিকে দেখতে না পেয়ে অবাক হয়ে যান শচীন। এরপর তিনি লক্ষ করেন, কাম্বলি নন স্ট্রাইকিং প্রান্ত থেকে ২০ গজ দুরে ঘুড়ি উড়াচ্ছেন, সেটাও ব্যাটিং করার সময়! কোচ রামাকান্ত কিভাবে নেবেন ব্যাপারটি সেটা ভেবেই শিউরে উঠেছিলেন শচীন, কিন্তু কাম্বলি ছিলেন ভাবলেশহীন! ডিসিপ্লিন এবং চিন্তার পার্থক্য কতটা প্রভাব ফেলে সেটা এই উদাহরন থেকেই মিলিয়ে নেয়া যায়। অপেক্ষাকৃত কম প্রতিভাবান ১০০ সেঞ্চুরির মালিক হয়ে যায়, আর এদিকে কাম্বলির প্রতিভার রঙিন ঘুড়ির সুতো কাটা পড়ে! বোকাট্টা….
কাম্বলি অবশ্য দাবী করেন, বোর্ড, ম্যানেজমেন্টের পক্ষপাতীত্বের ব্যাপারকে। এমনকি আঙুল তুলেছেন খোদ শচীনের দিকেও। কিন্তু নিজের দায় কি এড়াতে পারবেন কাম্বলি?
তাইতো ক্রিকেট কলামিস্টরা বারবার কাম্বলিকে উদাহরন মানেন… If you ever feel you’re getting too ahead of yourself or that distractions are getting in the way of your passion, just pause for a second and remember Vinod Ganpat Kambli.
হ্যাঁ, শুধু কাম্বলির পরিনতির কথা ভাবলেই নিজেকে আবারও ট্র্যাকে নিয়ে আসা পসিবল।
শুধুমাত্র গল্প শুনে বা পড়ে কাম্বলির ব্যাটিং ক্লাস সম্পর্কে ধারনা পাওয়া অসম্ভব। ওয়ার্নকে স্টেপ আউট করে স্ট্রেইট সিক্স, অথবা ফাস্ট বোলারকে মারা কভার ড্রাইভ কিছুই লেখা থাকে না আর্টিকেলে। এমনকি শুরুর দিকের কাম্বলির একটা ডিফেন্সিভ পুশও ছিল শিল্পের মত আই ক্যাচিং!
Talent alone will not ensure excellence. শুধু প্রতিভা কখনোই আপনাকে সাফল্যের চুড়ায় নিয়ে যাবে না। তবে সেই সাথে এটাও ঠিক যে, কাম্বলির মত প্রতিভাও প্রতিটি জেনারেশনে র্যানডম আসবে না। যত্নটা তাই দুই দিক থেকেই হতে হবে।
প্রতিভার আবির্ভাব খুব বড় ঘটনা নয়, প্রতিভার বিচ্ছুরনটাই আসল। একই পথে একই সময়ে যাত্রা করা দুই পথিক আজ তাই আলাদা আলাদা উদাহরনের কারন হয়ে লেখকের কলমে ঠাই পায়। অথচ, গল্পটা ভিন্ন হতে পারত, কাম্বলি নিজেই গল্পটা ভিন্ন করতে পারতেন। হয়ত ক্রিকেট চায়নি, অথবা হয়ত সময় চায়নি। কাম্বলি আজ শুধু আফসোসই করতে পারেন।
শুধু কি কাম্বলিই, আফসোসটা কি ক্রিকেটের নয়?
লিখেছেনঃ- Tonmoy Bose দাদা