প্রত্যেক খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারে অফ ফর্ম আসে এবং সেটা ক্রিকেটের সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে আজও আছে,ভবিষ্যতেও সবারই এমন হবে। কিন্তু এতো হাজার হাজার খেলোয়াড়ের মাঝে একজন ছিলেন ব্যতিক্রম। তার ক্যারিয়ারে কখনো অফ ফর্ম ছিলো না। তবে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টে ১৮ এবং ১ রান করে তিনিও অফ ফর্মের অযুহাতেই একাদশ থেকে ছিটকে গিয়েছিলেন।
১৯২৮ সালের ৩০ নভেম্বর ২০ বছর বয়সে এক্সিবিশন গ্রাউন্ডে অভিষেক হয় ইংল্যান্ড বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়ে। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৮ আর দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১। প্রথম টেস্টে মোটে ১৯। বাদ দেওয়া হলো একাদশ থেকে। যদিও পরে তার ক্যারিয়ার জুড়ে দুই ইনিংসেই ব্যাটিং করে এটিই ছিলো সর্বনিম্ন,কখনোই দুই ইনিংস মিলিয়ে ১৯ এর কম করেননি। এটিই ছিলো প্রথম এবং শেষ বাদ পড়া।
সেই সিরিজের পরের টেস্টগুলোতে সুযোগ পাওয়ার পর ৬৬.৮৬ গড়ে করেছিলেন ৪৬৮ রান। সেই সিরিজ হেরেছিল ইংল্যান্ড।পরের সিরিজে ৫ ম্যাচে ৭ ইনিংসে করেন ৯৭৪ রান ।যা কিনা অাদৌ সর্বোচ্চ। এক টেস্ট সিরিজে ৯০০+ রান করেছেন আর একজন। ওয়ালি হ্যামন্ড ৯ ইনিংসে করেছিলেন ৯০৫ রান ।১২ টি ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন যা আদৌ সর্বোচ্চ।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এক সিরিজে ৮০০ এর অধিক রান করার কীর্তি আছে মাত্র ৯টি। ব্র্যাডম্যান একাই কাজটা করেছেন তিনবার। কোনো ব্যাটসম্যান এই কাজ দু’বারও করতে পারেননি। সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ১৯৩১-৩২ মৌমুসের একটি সিরিজে ৫ ইনিংসে ৪টি সেঞ্চুরির সাহায্যে ২০১.৫০ গড়ে রান করেছিলেন ৮০৫। যা এখনো ৪ বা ততোধিক ম্যাচ খেলা সিরিজে সর্বোচ্চ গড়।
আধুনিক ক্রিকেট ব্যাটসম্যানদের হলেও গেইল ৩০ আর ভিলিয়ার্স ৩১ বলে সেঞ্চুরি করেছেন আর ডন তার আমলেই করেছিলেন ২২ বলে, তবে সেটি একটি চ্যারিটি ম্যাচে। ক্যারিয়ার ছিলো ২০ বছর আর ৫২ ম্যাচ – ৮০ ইনিংসের।দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ ক্যারিয়ার থেকে কেড়ে নিয়েছিলো ৮ টি বছর। যখন তার বয়স ২৮ থেকে ৩৬ এর ঘরে,একজন ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারের স্বর্ণ সময় কিন্তু এই সময়টাতেই। বিশ্বযুদ্ধ এই বছর গুলো কেড়ে না নিলে হয়তো তাণ্ডবলীলার চিত্র আরো ভয়াবহ হতো নিশ্চিত ভাবেই বলাই যায়। তাহলে গড় কত হয়, সেটাই প্রশ্ন জাগে মনে….
৮০ ইনিংসের মধ্যে ১০ ইনিংসেই আউট হয়েছেন রানের খাতা খোলার আগেই। তার মানে বাকী ৭০ ইনিংসে তান্ডব চালিয়েছেন। এরমাঝে প্রথম দুই ইনিংস মিলিয়ে ১৯।আরো বাকী ৬৮ ইনিংস। মাঝে টানা ৫ ইনিংস পঞ্চাশ স্পর্শ করতে পারেননি। তবে এর মাঝেও ৩০ এর অধিক স্কোর ছিলো ৩টিতে। আরো ৬৩ ইনিংস বাকী থাকে। এই ৬৩ ইনিংসের মাঝেই ২৯ টি স্পর্শ করেছেন তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার। আর অর্ধশতক, শতকের অর্ধেকেরও কম। শতক যেখানে ২৯, অর্ধশতক সেখানে মাত্র ১৩।
দ্বিশতক কিনা অর্ধশতকের প্রায় সমান। দ্বিশতক ১২ টি আর অর্ধশতক ১৩ টি। ক্যারিয়ারে ট্রিপল সেঞ্চুরি ২ টি। আবার ইতিহাসের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে ২৯৯ রানে অপরাজিত থাকা ইনিংস, ২৯৯ মার্টিন ক্রো একবার করেছিলেন তবে তিনি আউট হয়েছিলেন, আর ডন সেখানে ছিলেন অপরাজিত। ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ রান ৩৩৪, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। ৩য় ব্যাটসম্যান হিসেবে লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরির রেকর্ড তো আছেই।
অধিনায়ক হিসেবে ৫ সিরিজ নেতৃত্ব নিয়ে ৪ সিরিজে জয় আর একটিতে ড্র। ২০০০ সালে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া শতাব্দীর সেরা অস্ট্রেলিয়া দলের তাকে অধিনায়ক হিসেবে স্বীকৃত দেয়। ২০ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ১২ বছর মাঠে নেমেছেন। আর ১০ বারই হয়েছেন উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার, যেটি সর্বোচ্চ।
ক্রিকেটের কাছে চাওয়ার হয়তো কিছুই ছিলো না। ক্যারিয়ারে শেষ বারের মতো ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট কেনিংটন ওভালে ইংল্যান্ড এর বিপক্ষে যখন মাঠে নামেন এর আগেই বিধাতার কাছে একটা ব্যাপারে হয়তো প্রার্থনা করেছিলেন ব্র্যাড। ক্রিকেট বোদ্ধারাও হয়তো সে প্রার্থনাই করেছিলেন সেদিন। ক্রিকেট কে এতো কিছু দেওয়া ডন সেদিন শেষ বারের মতো যখন মাঠে নামছেন তখন বিধাতা আর ক্রিকেটের কাছে হয়তো মাত্র চারটি রানই তো আবদার করেছিলেন। তখনও ব্যাটিং গড় ১০০ এর অধিক কিন্তু শুধুমাত্র ৪ রান করলেই সব ইনিংস মিলিয়ে গড় হয়ে যেতো ১০০। বিধাতাই হয়তোবা চায়নি সেটা, চেয়েছে আমাদের আক্ষেপে পুড়াতে।
কিন্তু বিধাতা এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিবে তা কখনোই কেউ কল্পনা করেনি। যে ব্যাটসম্যানের গড় ১০০ এর অধিক সেই ব্যাটসম্যান কিনা শেষ ইনিংসে এসেই রানের খাতা খোলার আগেই সাজঘরে। ব্যাট আর কবজিও সেদিন বেঈমানি করেছিলো। নাহলে ৯৯.৯৪ গড়ের ক্যারিয়ারটা ১০০ তে থাকতো। এই আফসোসের ক্ষত হয়তো তার আমৃত্যু তাকে ভুগিয়েছে, সাথে ৭ হাজার রানের আক্ষেপও তাকে পোড়ানোরই কথা। এর আগেই ৬৯৯৬ রান সংগ্রহ করেন।ক্রিকেট বড়ই নিষ্ঠুর। সব পাওয়ার মাঝে একটা না পাওয়াটাই আজীবনের আক্ষেপ।
৪ রানের আফসোস আজও ক্রিকেট প্রেমীরা বয়ে বেড়ান। ফুটবলে সর্বকালের সেরা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু অবিতর্কিত ভাবেই ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান। ব্যাটসম্যানদের যুগে হালের ফর্মের চূড়ায় থাকা স্মিথ কোহলি আমলা ভিলিয়ার্স কিংবা কিংবদন্তী শচীন লারা পন্টিং সাঙ্গা রিচার্ডসদের গড় সর্বোচ্চ ৫০-৬০ এর মাঝেই। আর এই কিংবদন্তী তখনকার সময়েই করে গেছেন অতিমানবীয় এক রেকর্ড।আর কিছু কিছু রেকর্ড তাকে নিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। এজন্যই হয়তো তিনি সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার।
বয়সটা যখন আর ৮ পার করলেই সেঞ্চুরি স্পর্শ করবে ঠিক তখনি ২০০১ সালের আজকের এইদিনে ৯২ বছর বয়সে ওপারে পাড়ি জমান সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। আরো ১২ বছর বেঁচে থাকলে বয়সের সেঞ্চুরি তো হতোই সাথে টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে সবচাইতে বেশী বছর বেঁচে থাকার রেকর্ডটি তার হয়ে যেত, ১০৩ করে আউট হন বিলি ব্রাঊন। ১৯ বছর আগের আজকের এইদিনে অ্যাডিলেডে নিজ বাড়িতে পরলোক গমন করেন এই ক্রিকেটার। ওপারে ভালো থাকুন স্যার প্রয়াণ দিবসে ডনের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা, ওপারে ভালো থাকুন ডন – লাম্বা, রানা, হিউজদের নিয়ে……..
(লেখাটি ক্রিকেটখোর গ্রুপে ২ বছর আগে তার জন্মদিনে লেখা হয়েছিলো, আজ কিছু জায়গায় পরিবর্তন করে আবার দিয়েছি তার প্রয়াণ দিবসে)