ক্রিকেট খেলার শুরুটা এক রহস্যময় অধ্যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্যাক্সন বা নরম্যানদের সময় উইল্ডে বসবাসকারী শিশুরা এই খেলা শুরু করে৷ উইল্ড হলো দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের কেন্ট ও সাসেক্সের মধ্যবর্তী একটি অরণ্য এবং তার মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা৷ ক্রিকেটের উৎস সম্পর্কে আরো ধারণা করা হয় যে, এই খেলা ফ্রান্স বা ফ্লেন্ডার্সে শুরু হয়েছিলো। আর এই ক্ষেত্রে ক্রিকেট শুরুর উল্লেখিত তারিখ ছিল ১০ই মার্চ, ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ ( জুলিয়ান তারিখ) । এবং বলা হয় রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ড “ ক্রেগ ” খেলতেন ওয়েস্টিনস্টার ও নিউএন্ডেন নামক দুইটি জায়গায়। আর ক্রেগকে বলা হয়েছিলো ক্রিকেটের পুরাতন ইংরেজি শব্দ।
—
এটা বিশ্বাস করা হয় যে, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের খেলা হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত বহু প্রজন্ম ধরে ক্রিকেট খেলা শুধুমাত্র শিশুদের খেলা ছিল। সম্ভবত ক্রিকেট খেলা উদ্ভূত হয়েছিলো বোলস খেলা থেকে। যেহেতু বোলস একটু পুরানো খেলা, তাই মনে করা হয় বলটিকে তার লক্ষ্যের আগে ব্যাটসম্যান ব্যাট দিয়ে থামিয়ে সেটিকে আঘাত করে দূরে পাঠানো থেকেই ক্রিকেট খেলার উৎপত্তি। খেলা শুরু হয় মেষ-চারিত কোনো মাঠ বা ফাঁকা জায়গায়, মূল সরঞ্জামের মধ্যে বল হিসাবে ব্যবহার করা হয় ভেড়ার দলা পাকানো পশম (বা এমনকি একটি পাথর অথবা একটি ছোটো কাঠের ডেলা); ব্যাট হিসাবে ব্যবহার করা হয় একট লাঠি বা একটি বাঁকা দণ্ড বা খামারবাড়ির কোনও যন্ত্র; উইকেট হিসাবে একটি বসার টুল বা গাছের গোড়ার শিকড় অথবা কোনো দরজা (যেমন একটি উইকেট দরজা)।
—
তবে বর্তমানে সর্বজনস্বীকৃত তথ্য হলো, “ ক্রিকেটের জন্মস্থান ইংল্যান্ড ”। আর সেই ক্রিকেটের জন্মস্থান তথা ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন স্টেডিয়াম “ লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড” যাকে বলা হয় “হোম অফ ক্রিকেট ”।
—
লর্ডসের নাম বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে বিশাল এক মিডিয়া সেন্টার। বিশাল হলওয়ে সাথে প্রাচীন প্যাভিলিয়ন। ১৭৮৭ থেকে ১৮১৪ এর মাঝে লর্ড কর্তৃক তিনটা স্টেডিয়াম বানানো হয়। যার মাঝে প্রথমটা লর্ডস ওল্ড গ্রাউন্ড যেটা বর্তমানে ডরসেট স্কয়ার নামে পরিচিত। দ্বিতীয় মাঠ লর্ডস মিডল গ্রাউন্ড যেটা রিজেন্টস ক্যানেলের জন্য পরিত্যক্ত করা হয়। আর তৃতীয় মাঠ হিসেবে বানানো হয় দ্যা লর্ডস’কে যেটি মিডল গ্রাউন্ড থেকে ২৫০ গজ দূরে অবস্থিত।
—
লর্ডসের নাম নিলেই আপনার “ দ্যা প্যাভিলিয়ন ” এর কথা মাথায় আসবেই। ভিক্টোরিয়া যুগের স্থাপনা হিসেবে ১৮৮৯-৯০ মৌসুমে প্যাভিলিয়নসহ লম্বা রুমটি তৈরী করা হয়। বিখ্যাত স্থপতি টমাস ভেরিটি এই প্যাভিলিয়নের নকশা করেছিলো। ২০০৪-০৫ মৌসুমে আট মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং বরাদ্দ করা হয়েছিল প্যাভিলিয়নের পুনঃনির্মাণে। এই প্যাভিলিয়নে খেলা দেখার জন্য আসন, লং রুম বার, বোলারস বার, মেম্বারদের জন্য শপের ব্যবস্থা ছিল। দুটো অনার্স বোর্ডই রয়েছে এই প্যাভিলিয়নে। যেখানে টেস্ট সেঞ্চুরি ও ইনিংসে পাঁচ উইকেট ও টেস্টে দশ উইকেট শিকারিদের নাম উঠানো হয়।বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে সেই অনার্স বোর্ডে নাম উঠিয়েছিলেন শাহাদাত হোসেন রাজিব এবং এরপরই নাম উঠান তামিম ইকবাল। মজার বিষয় এত বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র একবার বল ঢুকেছে প্যাভিলিয়নে। সেটি ছিল ১৮৯৯ সালের ৩১শে জুলাই। মন্টি নোবেলের বলে আলবার্ট ট্রট একমাত্র ক্রিকেট হিসেবে সেদিন প্যাভিলিয়নে বল ঢুকিয়েছিলো।
—
লর্ডসের গ্যালারি কথনঃ- মোট আটটি গ্যালারি নিয়ে নির্মিত হওয়া লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের অধিকাংশ গ্যালারিই পুনঃনির্মাণ করা হয় বিংশ শতাব্দীতে। লর্ডস গ্রাউন্ডের ৮ গ্যালারি হলো।
১. গ্রান্ড স্ট্যান্ড।
২.ওর্য়ানার স্ট্যান্ড।
৩.কম্পটন স্ট্যান্ড।
৪.প্যাভিলিয়ন।
৫. এ্যালান সেন্টার।
৬.এডরিচ স্ট্যান্ড।
৭.ট্যাভার্ন স্ট্যান্ড।
৮. মাউন্ড স্ট্যান্ড।
১৯৮৭ সালে মাউন্ড স্ট্যান্ডের ডিজাইন করেন স্যার মাইকেল হপকিন্স। ১৯৯৬ সালে নিকোলাস গ্রিমশয়ের নকশায় বানানো হয় গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড। লর্ডস মিডিয়া সেন্টার নির্মানের জন্য ১৯৯৯ সালে “ রয়্যাল ইন্সটিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট ” হতে স্টার্লিং পুরষ্কার লাভ করে। আর এই মিডিয়া সেন্টার তৈরি করা হয় ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে।
—
লর্ডসে যে শুধু স্টেডিয়াম আছে তা নয়। স্টেডিয়ামের সাথে একটা ক্রিকেট মিউজিয়াম আছে। ১৯৫৩ সালে এইচআরএইচ ডিউক অব এডিনবরা লর্ডসে মেরিলেবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৬৪ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের সবধরনের ক্রিকেটের সংগ্রহশালা এই মিউজিয়াম। তবে এই মিউজিয়ামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ “ দ্যা এশেজ”। আর এটি দেখার জন্য অনেক দর্শনার্থীরা আসে এইখানে। এই জাদুঘরে রয়েছে ডন ব্র্যাডম্যান, ভেক্টর ট্রাম্পার, জ্যাক হবস, শেন ওয়ার্নের মত সেরা প্লেয়ারদের স্পোর্টস কিট৷ আর একমাত্র বাংলাদেশী প্লেয়ার হিসেবে আমিনুল ইসলামের ব্যাট জায়গা পেয়েছে লর্ডসের জাদুঘরে৷ যেই ব্যাট দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন।
—
মিউজিয়ামের পাশাপাশি ক্রিকেট প্রেমীদের জন্য রয়েছে লাইব্রেরিও। ক্রিকেটের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত লেখা ১৭০০০ এর অধিক বই আর ম্যাগাজিনের সংগ্রহ রয়েছে এই লাইব্রেরিতে। আপনি যদি ক্রিকেট নিয়ে কোনো লিখে সেটা লর্ডসের লাইব্রেরিতে উপহারস্বরুপ প্রেরণ করেন তাহলে সেটা তারা গ্রহণ করবে৷ এমসিসি মেম্বারদের জন্য ম্যাচের দিন খোলা থাকে এটি আর অন্যান্য দিন গবেষণার জন্য খোলা রাখা হয় এই লাইব্রেরি।
—
এইতো গেল স্টেডিয়ামের ইতিহাস। এইবার দেখে আসি লর্ডসের বিখ্যাত কিছু ম্যাচের ঘটনা এক লাইন করে।
১৮৮৪: ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচ আয়োজিত হয় এই লর্ডসে। যেখানে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া।
১৯৩০: অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি ডন ব্রাডম্যান এই মাঠেই খেলেছিলেন মহাকাব্যিক ২৫৪ রানের ইনিংস।
১৯৩৪: ইংলিশ বোলার হেডলি ভেরাইটি টেস্টের একদিনে প্রতিপক্ষের ১৪টি উইকেট নিয়েছিলেন লর্ডসে।
১৯৭২: লর্ডসের মাঠে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে আয়োজিত হয়। যেখানে স্বাগতিক ইংলিশদের প্রতিপক্ষ ছিল অস্ট্রেলিয়া।
১৯৭৫: বিশ্বকাপের প্রথম আসরে এই লর্ডসেই ফাইনালটি হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
১৯৭৯: দ্বিতীয় বিশ্বকাপের আসরও বসে ইংল্যান্ডে আর ফাইনালটি হয় এই লর্ডসেই। সেবারও চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে, সেবার প্রতিপক্ষ ছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ড।
১৯৮৩: তৃতীয় বিশ্বকাপের আসরটিও বসেছিল ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ডে। সেবারের ফাইনালটিও যথারীতি লর্ডসে। কপিল দেবের নেতৃত্বে খেলতে যাওয়া ভারত সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেবারও ফাইনালে উঠলেও স্বাগতিক ইংল্যান্ডের শিরোপা জেতা হয়নি।
১৯৯০: ইংলিশ কিংবদন্তি গ্রাহাম গুচ এই লর্ডসে ভারতের বিপক্ষে টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৩৩৩ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন ১২৩ রান।
১৯৯৩: নারী বিশ্বকাপের ফাইনাল আয়োজন করেছিল লর্ডস। নিউজিল্যান্ডকে সেবার হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল স্বাগতিক ইংল্যান্ড।
১৯৯৯: আবারো ইংল্যান্ডের মাটিতে বসেছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপের আসর। লর্ডসে ফাইনাল খেলতে নামে পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া। পাকিস্তানকে হারিয়ে সেবার শিরোপা জিতে অস্ট্রেলিয়া।
২০০০: লর্ডস আয়োজন করে ক্রিকেট ইতিহাসের ১০০তম টেস্ট ম্যাচ।
২০০৯: আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল হয়েছিল লর্ডসে। সেবার শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল পাকিস্তান।
২০১৪: ক্রিকেটের মক্কা খ্যাত লর্ডস তার ২০০ বছর পূর্ণ করে।
২০১৫: লর্ডসে টেস্ট ইতিহাসের দ্রুততম সেঞ্চুরি হাঁকান ইংলিশ অলরাউন্ডার বেন স্টোকস।
২০১৭: নারী বিশ্বকাপের সেই আসরের ফাইনালটি আয়োজিত হয় এই লর্ডসে। যেখানে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জেতে স্বাগতিক ইংল্যান্ড।
২০১৯: বিশ্বকাপের পঞ্চমবারের মতো ফাইনালের আয়োজিত হয় লর্ডসে। যেখানে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড। আর সেই উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে জয়লাভ করে বিশ্বকাপকে তার ঘরে ফেরান ইংল্যান্ড।
—
লন্ডনের সেন্ট জন উডসে অবস্থিত এই স্টেডিয়াম। বর্তমানে এই মাঠের মালিকানায় রয়েছে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব। আর এই মাঠের নামকরণ করা হয় প্রতিষ্ঠাতা টমাস লর্ডের নামানুসারে। মিডলসেক্স কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব, ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি), ইউরোপীয় ক্রিকেট কাউন্সিলের (ইসিসি) সদর দফতর এখানেই অবস্থিত। আগস্ট, ২০০৫ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) সদর দফতর এখানে ছিল।
—
বয়স এখন তার ২০৬ বছর। ২০১৪ সালে পূর্ণ হয়েছিলো ২০০ বছর। সেবছরের ৫ জুলাই, লর্ডসের ২০০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব আর বহিঃবিশ্ব একাদশ একটি লিস্ট-এ ম্যাচ খেলেন ৫০ ওভারের। একদলের ক্যাপ্টেন ছিলেন শেন ওয়ার্ন আরেকদলের ছিলেন শচিন টেন্ডুলকার। সেই ম্যাচে এরন ফিঞ্চের অপরাজিত ১৮১ রানের কল্যাণে বহিঃবিশ্ব একাদশকে ৭ উইকেটে হারায় মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব।
—
লর্ডসের নাম শুনলেই ক্রিকেট প্রেমীদের মাঝে কেমন এক উত্তেজনা শুরু হয়। যেন প্রাচীন কোনো এক মাঠে বসে খেলা দেখছেন আপনি। টিভি পর্দাতেও যেন এর জৌলুশ চোখে পড়ে। আমার জীবনে খুব ইচ্ছা কোনো একদিন লর্ডসে বসে অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের এশেজ সিরিজ দেখা। তখন হয়তো বলতে পারবো, আমি “ হোম অফ ক্রিকেট ” থেকে বলছি।