২৪শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

প্যাকারের সার্কাসঃ ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট

প্রতিবেদক
Mehrab Elahi
শনিবার, ৩০ মে , ২০২০ ৫:৪৭

১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯, অস্ট্রেলিয়ান ধনকুবের আর নাইন নেটওয়ার্কের মালিক ক্যারি প্যাকার এর ব্যবস্থাপনায় শুরু হয় “ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট বা ডব্লিউ এস সি ” নামক এক প্রতিযোগিতা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সংস্থা ছিল এই প্রতিযোগিতার সম্পূর্ণ বিরোধী। আর এই সিরিজের ফলে বিশ্ব ক্রিকেটে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

১৯৭৬ সালে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ড তাদের টেস্ট খেলা গুলো সম্প্রচার করার জন্য চ্যানেল নাইনের দরপত্র প্রত্যাখ্যান করে। ফলে, নাইন নেটওয়ার্কের মালিক ক্যারি প্যাকার ক্ষুব্ধ হয়ে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের শীর্ষ খেলোয়াড়দের মাঝে গোপন চুক্তি করে এবং নিজস্ব সিরিজ আয়োজনে অগ্রসর হয়। প্যাকার নিজের সহযোগিতার জন্য তার সাথে নিয়োগ দেয় আরো দুই ব্যবসায়ী জন কর্নেল আর অস্টিন রবার্টসনকে। আর প্লেয়ারদের মাঝে তার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় টনি গ্রেগ, ইয়ান চ্যাপেল, ক্লাইভ লয়েড, ইমরান খান ও ইয়ান চ্যাপেল।

১৯৭৭ সালের শুরুতে প্যাকার সাহেব তালিকা ধরে অস্ট্রেলিয়ান প্লেয়ারদের সাথে চুক্তিতে অগ্রসর হন। এবং প্রথমেই সদ্য অবসর নেয়া অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেলকে। এরপর ইংলিশ টনি গ্রেগের সাথে চুক্তি করে বিশাল লাভ করেন। সেই বছর মার্চে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড। আর সেসময় দুইদলের অনেক প্লেয়ার গোপনে চুক্তি করেন প্যাকারের সাথে৷ খেলা কোন মাঠে হবে, কখন হবে সবই গোপন ছিল প্লেয়ারদের কাছ থেকে তবুও তারা চুক্তিতে যান।

মে,১৯৭৭- অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলো ইংল্যান্ড সফরে। সেই সফরে অজি ১৩ ক্রিকেটার চুক্তি করেন প্যাকারের সাথে। অস্ট্রেলিয় সাংবাদিকদের কাছে কিভাবে যেনো ডব্লিওএসসি এর তথ্য ফাঁস হয়ে যায় এটি নিয়ে তারা মে এর ৯ তারিখ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যা পরে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট প্রচুর সমালোচিত হয়। ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোদ্ধারা এটিকে “প্যাকারের সার্কাস” নামে অভিহিত করে।

অধিকাংশ মানুষের কাছে অপরিচিত প্যাকার সেই বছরের মে তে ইংল্যান্ড যান। এই সফরে তার তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল খেলা আয়োজকদের সাথে সাক্ষাৎ করা এবং কিছু বিষয়ে সমঝোতা করা। তিনি রিচি বেনোকে তার উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন এতে প্যাকার সাহেব খেলার রাজনীতিতে নিজের শক্ত অবস্থা তৈরি করে।

শুরুতে এই সমস্যা অস্ট্রেলিয়া ঘরোয়া সমস্যা হিসেবে ছিলো। পরে আইসিসি এই সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে৷ তারা ২৩শে জুন প্যাকার, বেনো আর তার দুই সহকারীকে লর্ডসে আমন্ত্রণ জানায় এবং ডব্লিউএসসি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে। ৯০ মিনিটের এই আলোচনায় উভয়পক্ষ সমঝোতার দিকে অগ্রসর হয়। এক পর্যায়ে ক্যারি প্যাকার আইসিসিকে ১৯৭৮-৭৯ মৌসুমের অস্ট্রেলিয় টেলিভিশনের সম্প্রচারস্বত্ত্ব প্রদানের দাবি জানান। আইসিসি এই ধরনের কোনো কিছুর ক্ষমতা রাখেনা বলে জানালে প্যাকার রেগে সভা থেকে বের হয়ে চলে আসেন এবং বলেন – “ যদি আমি টিভি স্বত্ত্ব পাই তাহলে আমি এ ঘটনা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেব এবং বোর্ডের হাতে ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যেতে দেব। আমি কাউকে কোন সাহায্যের জন্যে কোন পদক্ষেপ নেব না। বিষয়টি প্রত্যেকের জন্যে ও প্রেতাত্মাই পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। ”। –

এই বক্তব্য এর পর চুক্তিবদ্ধ প্লেয়াররা সতর্ক হয়ে যায়। প্যাকারের বক্তব্য মোকাবেলার জন্য আইসিসি এক মাস পর তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। এবং সেটি ছিলো – প্যাকারের আয়োজিত কোনো খেলাকে প্রথম শ্রেনীর মর্যাদা দেয়া হবে না এবং এতে অংশগ্রহণ করা প্রতি খেলোয়াড়কে টেস্ট ও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট হতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে।

জেফ থমসন ও আলভীন কালীচরণ চুক্তিছিন্ন করে প্যাকারের সাথে। এছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন চুক্তি ছিন্ন করার চিন্তা করে। ক্যারি প্যাকার দ্রুত খেলোয়াড়দের সাথে বৈঠক করে এবং চুক্তিভঙ্গকারী খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়। প্রস্তাবিত নিষেধাজ্ঞাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনে টনি গ্রেগ, মাইক প্রোক্টর আর জন স্নোকে নিয়ে উচ্চ আদালতে যান তিনি। ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭ এ মামলাটি শুরু হয়। দুই পক্ষের সব কিছু শোনার পর সাত সপ্তাহ পরে মামলার রায় আসে।

বিচারপতি স্যার ক্রিস্টোফার স্লেড রায়ের আগে নয়টি বিষয় বিবেচনায় আনেন –

১. ডব্লিউএসসি ও তাঁর খেলোয়াড়দের চুক্তি অকার্যকর কি-না?

২. ৩ আগস্ট ডব্লিউএসসি প্রতিষ্ঠা হয়েছে কি-না ও বিষয়টি ১৯৭৪ সালের সংবিধিবদ্ধ নিরাপত্তাবিষয়ক ধারার সাথে সংশ্লিষ্ট কি-না? আইসিসিভিত্তিক প্রবর্তিত চুক্তির ধারার তুলনায় গৃহীত পদক্ষেপ উপযুক্ত ও ক্ষতির কারণ কি-না?

৩. ৩ আগস্ট ডব্লিউএসসি প্রতিষ্ঠা ও উপরোক্ত বিষয়াবলী টিসিসিবিভিত্তিক একই মাঠে অন্যায্যভাবে আয়োজন করা উপযুক্ত কি-না?

৪. ১৯৭৪ সালের ধারায় আইসিসির নতুন নিয়ম শ্রমিকদের দমন করছে কি-না?

৫. উপরোক্ত বিষয়ে টিসিসিবির প্রস্তাবিত নতুন নিয়ম শ্রমিকদেরকে দমন করছে কি-না?

৬. ১৯৭৪ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী আইসিসি শ্রমিক সংঘ কি-না?

৭. টিসিসিবি কি শ্রমিক সংঘ?

৮. যদি আইসিসি বা টিসিসিবি বা উভয়ই শ্রমিক সংঘ হয়ে থাকে তবে, কেউ চলে যেতে চাইলে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত আরোপ করে?

৯. এর স্বপক্ষে (ক) বাদী ও (খ) ডব্লিউএসসি কি ধরনের সাহায্য করতে পারে?

বিচারপতি স্লেড রায় প্রদানকালে বলেন যে, পেশাদার ক্রিকেটারদের জীবনধারনের জন্যে অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। আইসিসি কেবলমাত্র নিজেদের প্রয়োজনে তাদেরকে ব্যবহার করছে ও তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। আইসিসি বিশ্বাস অর্জনের জন্য তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করেছে।খেলোয়াড়দের গোপন চুক্তির ফলে সমালোচনা করা উচিত নয়। তারা ডব্লিউএসসির কাছ থেকে অধিক উপার্জনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ও কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়ার ভয়ে গোপনে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

এই রায়ের পরে আইসিসির আঁতে ঘা লাগে, অপমানিত হয় তারা। আদালতের যাবতীয় ব্যয় বহন করা লাগে। কাউন্টি ক্রিকেটের দলগুলো তাদের প্লেয়ারদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে আর প্যাকারের সাথে চুক্তি করা প্লেয়াররাও খেলার অনুমতি পান।

মতামত জানান :