‘ মুশফিকুর রহীম ’
বিশ তম ওভারের দ্বিতীয় বলটা করবার আগে অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনির সাথে দীর্ঘ একটা আলোচনা, প্রয়োজন পাঁচ বলে দশটি রান। অফস্টাম্পের অনেক বাইরের বলটি সজোরে ঠেলে দিলেন অফসাইডে, সিমানা ছাড়া হতেই সমিকরণ আরো সহজ হয়ে গেলো। বাংলাদেশের প্রয়োজন চার বলে ছয়টি রান। তৃতীয় বলটি করার আগে হার্দিক পান্ডিয়ার কাধে হাত রেখে গুন গুন করে কিছু একটা বললেন। বল করতে স্কুপ শট এবং চার রান, ব্যাটসম্যান উল্লাস। উল্লাসে মেতে উঠাটাই স্বাভাবিক, জয়ের জন্য প্রয়োজন তিন বলে দুই রান। থমথমে হয়ে যাওয়া চেন্নাসোয়ামি স্টেডিয়ামে হঠাৎ বাধ ভাঙ্গা উল্লাস, জয়ের দ্বারপ্রান্তে হঠাৎ নতুন নাটকীয়তা। শিখর ধাওয়ানের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়েছেন ব্যাটসম্যান… নায়ক থেকে মূহুর্তে খলনায়কে পরিণত হয়ে গেলেন ব্যাটসম্যান। হ্যা বলছিলাম ২০১৬ টি২০ বিশ্বকাপে ভারত বনাম বাংলাদেশ ম্যাচের নাটকীয় শেষ ওভারের কথা, বলছিলাম মুশফিকুর রহীমের কথা।
মুশফিকুর রহীম, বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন তিনি। বাংলাদেশের মিডলঅর্ডারের স্তম্ভ বলা যায় তাকে। দলের বিপদে যেকোন জায়গায়, যে কোন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে রান করতে পারার কারণেই হয়তো এদেশের ক্রিকেট ভক্তরা তাকে মিস্টার ডিপেন্ডেবল বলে ডাকেন।
১৯৮৭ সালে ৯ই জুন বগুড়ায় বাবা মায়ের কোল আলো করে জন্মগ্রহন করে মিতু। পড়াশোনায় মেধাবী মুশফিকের শিক্ষার যাত্রা শুরু বগুড়া জিলা স্কুলে। এরপর বিকেএসপিতে নিয়েছে ক্রিকেটের দিক্ষা, সেখানেও সমান তালে চালিয়ে যায় নিজের লেখা পড়া। ছোট থেকেই পরিশ্রমী মুশফিক নিজের নেতৃত্ব গুনে হয়েছিলো বয়স ভিত্তিক দলের অধিনায়ক। বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটে তার অধীনে খেলেছে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব, ওপেনার তামিমের মতো ক্রিকেটারেরা। তার নেতৃত্বে ২০০৬ সালের অ-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পৌঁছায় কোয়ার্টার ফাইনালে। এর আগেই ২০০৫ সালে, খালেদ মাহমুদ পাইলটের অনুপস্থিতির কারণে জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। তবে ইঞ্জুরির কারণে বাদ হয়ে যান এক ম্যাচ খেলেই, এরপর আবার জাতীয় দলে ফেরেন ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে। তখন থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক নির্ভরতার নাম মুশফিকুর রহীম।
টি২০ ক্রিকেটে মুশফিক ঠিক নিজেকে মেলে ধরতে পারছিলো না। দলের নিয়মিত সদস্য হলেও নিজের প্রথম ম্যাচ সেরা হন ২০১১ সালে ওয়েষ্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। শের এ বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেদিন মুশফিকের ২৬ বলে অপরাজিত ৪১ রানের ইনিংসের উপর ভর করেই ক্যারিবিয়ানদের দেয়া ১৩২ রানের লক্ষ্য জয় করে বাংলাদেশ। এরপর আবারো দীর্ঘ ব্যর্থতার গল্প, অভিষেকের আট বছরের ও বেশি সময় অতিবাহিত হবার পর নিজের প্রথম অর্ধশতকের দেখা পায় মুশফিক, কিউদের দেয়া ২০৪ রানের লক্ষে ব্যাট করতে নেমেছিলো বাংলাদেশ, মুশফিকুর রহিমের সংগ্রহ ছিলো দলীয় সর্বোচ্চ ২৯ বলে ৫০ রান। কোরি এন্ডারসনের শিকার হয়ে ফিরেছিলেন প্যাভিলিয়নে। মুশফিক শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকলে হয়তো ম্যাচের ফলাফল অন্যরকম হতো।
পরিসংখ্যানের বিচারে মুশফিকুর রহীমের টি২০ ক্যারিয়ার অতি সাদামাটা। এখন পর্যন্ত ৮২ ইনিংসে পাঁচ বার অর্ধশতকের দেখা পেয়েছে মুশফিকুর রহীম। এর চারটিই এসেছে ২০১৮ সালের পর। নিজের খেলায় যথেষ্ট পরিবর্তন এনেছে মুশফিক। নিদিহাস ট্রফিতে পর পর দুই ইনিংসে ৭২ রানের ইনিংস বাংলাদেশকে সেই টুর্নামেন্টে ভালো করতে সাহায্য করে ছিলো।
১১ নভেম্বর, ২০২০। দিল্লিতে মুখোমুখি হয়েছিলো বাংলাদেশ – ভারত। ম্যাচটি ছিলো এক হাজার তম আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচ। সেই দিন মুশফিকের অনবদ্য ৬০ রানের সুবাদে ম্যাচ নিজের করে নিয়েছিলো বাংলাদেশ। এটিই ছিলো ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টি২০ ম্যাচ জয়। যেই ভারতে নিজেকে সবার সামনে খলনায়ক বানিয়েছিলো মুশফিক সেই ভারতেই মুশফিকের ব্যাটে ভর করে প্রথম ভারত বধ, ম্যাচ শেষ মুশফিক বলেছিলো “We were playing in front of a huge crowd, so that feels special. Me and Soumya had a chat, we thought maybe we could drag the game deep. Luckily we had a big over but I think Soumya played his role really well. Naim too and as did the bowlers. I am doing my level best to improve as a cricketer, and hopefully do well for Bangladesh in each and every game.”
ম্যাচ সংখ্যার হিসেবে আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ও অন্য সব দল মিলিয়ে এগারোতম স্থানে রয়েছেন মুশফিকুর রহীম। ওয়ানডে ও টেষ্ট ক্রিকেটের এই ভরসার প্রতিক টি২০ ক্রিকেট অনেকের মতে দলের জন্য গলার কাটা। টি২০ তে মুশফিকুর রহীমের গড় ১৯! স্ট্রাইকরেট ১১৫! দলের সেরা ব্যাটসম্যানের এমন পরিসংখ্যান হলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য।
পরিসংখ্যান বলে বাংলাদেশ দলের ১০% রান আসে মুশফিকের ব্যাট থেকে। এখন পর্যন্ত নয় ইনিংসে দলীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। অপরাজিত থেকে ম্যাচ শেষ করেছে ১৫ বার। দশ রান করার আগেই আউট হয়েছেন ৩৬ বার! ম্যাচ সেরা হয়েছে মাত্র চার বার, এর মাঝে রয়েছে আফগানিস্তানের সাথে হেরে যাওয়া ম্যাচটিও। মুশফিকের অন্যতম বড় দূর্বলতা সে হুটহাট ক্যাচ তুলে দিয়ে প্যাভিলিয়নের পথে হাটা ধরেন, ক্যারিয়ারের ৫৩% বার আউট হয়েছেন নিজের ভুলে ক্যাচ তুলে দিয়ে।
এখন পর্যন্ত টি২০ বিশ্বকাপে মুশফিক ২০ ইনিংস ব্যাট করে রান করেছেন ২৫৮। অপরাজিত থেকেছে চার ইনিংস, স্ট্রাইকরেট ১০৪! নেই কোন অর্ধ শতক। বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চেও টি২০ ক্রিকেটে ব্যর্থ মুশফিক। এক মাত্র চল্লিশোর্ধ্ব রানের ইনিংসটি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে।
সম্ভবত নিজের শেষ টি২০ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে মুশফিকুর রহীম। তাই সে নিজেও চাইবে তার সেরাটা দিতে। পজিশনের হিসেবে মুশফিক সব থেকে ভালো ব্যাটিং করে চার নাম্বারে। পাঁচ অর্ধশতকের চারটিই এসেছে এই পজিশনে ব্যাট করে। এই পজিশনে মোট ৪১ ইনিংস ব্যাট করে রান করেছে ৮৫৩, ক্যারিয়ারের সব থেকে বেশি স্ট্রাইকরেটও এখানেই। তবে এবারের বিশ্বকাপেও এই পজিশনেই দেখা যেতে পারে মুশফিকুর রহীমকে। ইউএইতে এর আগে এশিয়াকাপে খেলায় সেখানকার পরিবেশ ও মাঠ সম্পর্কে ভালো ধারণা রয়েছে মুশফিকের, সেবার ভালো ব্যাট করায় আশা করা যায় এবারও নিরাশ করবেন না তিনি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুশফিকের পরিসংখ্যান ও অন্যদের পরিসংখ্যানের পার্থক্য অতি সূক্ষ। দলের নিয়মিত সদস্য হওয়ায় বিশ্বকাপেও নিয়মিতই দেখা যাবে তাকে, কিপিং সোহান করায় মুশফিকের সুযোগ রয়েছে শুধু ব্যাটিং এ মনযোগী হবার। এই বিশ্বকাপে তামিম নেই, তাই দলের সিনিয়র ব্যাটসম্যান হিসেবে মুশফিক থেকে আরো বেশি ভালো খেলা আশা করবে দর্শকেরা।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে প্রথমে খেলতে হবে বাছাই পর্ব, সেখানে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ওমান, পাপুয়ানিউগিনি, স্কটল্যান্ড। গ্রুপ পর্বে যদি বাংলাদেশ। চ্যাম্পিয়ন হয় তবে বাংলাদেশকে খেলতে হবে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। এই সব গুলো দলের বিপক্ষেই মুশফিকুর রহীমের পারফর্মেন্স যথেষ্ট ভালো হওয়ায় তার থেকে ভালো কিছু আশা করা যায়। তবে যদি মুশফিক ভালো করতে চায় তাহলে তাকে নজরে রাখতে হবে তার পূর্বের ভুল গুলোর দিকে। গত বিশ্বকাপে করা ভুলের পুনরাবৃত্তি না হলেই খুশি বঙ্গদেশের সাধারণ দর্শকেরা