গুগল করে কিংবা ইউটিউবে ভিডিও দেখে ম্যাচের বিস্তারিত কিছু মনে করতে চাই না, পচেফেস্ট্রমে সেই টি-টোয়েন্টি ম্যাচের পর সেখানে বাংলাদেশ দল অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জিতে নতুন এক ইতিহাসের সৃষ্টি করেছে এর পরে। তারপরও হয়তো মোহম্মদ সাইফুদ্দীনের মনে সেই দুঃসহ স্মৃতি চিরকাল বয়ে থাকবে। সেদিনের সেই সুন্দর রাত্রটা তার কাছে হয়ে থাকবে কিনা সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় হয়ে থাকবে তার উত্তর সাইফুদ্দীনের কাছেই হয়তো ভালো থাকবে। আর সেই জবাব আমরা দেখতে পারবো তার মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে।
২০১৭ সালে সাউথ আফ্রিকা সিরিজের পর সাইফুদ্দীন অবধারিতভাবে বাদ পড়ে। তারপর জিম্বাবুয়ে সিরিজে আবার দলে ব্যাক করে। প্রথম ম্যাচে ফিফটি করে জানান দেন তার ব্যাটিং সামর্থ্যের। পরের ম্যাচে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হন বোলিং সামর্থ্য দিয়ে। ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে দলে নিজের জায়গা করে নেন। কাগজে কলমে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হলেও ইমপ্যাক্ট বিবেচনায় তার উইকেটগুলোই এগিয়ে থাকবে। ভারতের বিপক্ষে ব্যাট হাতে ফিফটি করে ম্যাচটা প্রায় বের করে ফেলেছিলো সাইফুদ্দিন। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি, সাথে বিশ্বকাপে শুনতে হয়েছিলো বড় প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে ভয় পান তিনি। যেই বিশ্বকাপের আগে তার জায়গা নিয়ে ছিলো সংশয়, বিশ্বকাপের পর তিনি হয়ে যান দলের অপরিহার্য সদস্য। সাকিব আল হাসানের পর হন দলের সেরা অলরাউন্ডার। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের পর তাকে দেশসেরা বলেও অভিহিত করা যায়।
১৯৯৬ সালের ১ নভেম্বর, ফেনীর মোহম্মদ আব্দুল খালেক আর জোহরা বেগমের কোল আলোকিত করে জন্ম হয় মোহম্মদ সাইফুদ্দীনের। অল্প বয়সে বাবাকে হারান তিনি, তবে অল্প বয়সেই টেপ টেনিস বলে দাপিয়ে বেড়াতে থাকেন আশেপাশের এলাকায়। তারই ফলশ্রুতিতে আসেন বয়সভিত্তিক দলের ক্যাম্পে, সেখান থেকে অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ পান সাইফুদ্দীন। অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সাকিবের ৭৫ নম্বর জার্সি পড়ে ডানহাতি মিডিয়াম পেস এবং শেষের দিকে ঝড়ো ব্যাটিংএ নিজের জাত চিনান। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ২০১৬ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে দারুণ পারফরম্যান্স করলেও দলকে শিরোপা এনে দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত দল হয় তৃতীয়, আর বিশ্বকাপের সেরা একাদশে অন্তর্ভুক্ত হয়ে শেষ হয় তার অনূর্ধ্ব ১৯ ক্যারিয়ার।
লক্ষ্য এবার জাতীয় দল, সেই অনুযায়ী ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম্যান্স করলেও বোলিং একশনে তার সমস্যা ধরা পড়ে৷ সেই একশন ঠিক করে আবার ধারাবাহিক পারফর্মেন্স করতে কিছুটা সময় লাগলেও ২০১৭ সালে তার অভিষেক হয় জাতীয় দলে। প্রথম দিকে ধারাবাহিকতার অভাব থাকলেও একজন তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ঠিক পথেই ছিলেন। ২০১৭ সালে যান সাউথ আফ্রিকা সিরিজে, সেখানে টি-টোয়েন্টি সিরিজে ডেভিড মিলার তার এক ওভারে পাঁচটি ছয় মারে। তারপর দল থাকে বাদ পড়েন, সেখান থেকে আবারো দলে ডোকেন। বলা যায় তার দলে কামব্যাক করাটা আরও শাণিতভাবে হয়েছে। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর তিনি দল থেকে বাদ পড়েছেন হয় ইনজুরি কিংবা দলীয় কম্বিনেশনের কারণে। পারফরম্যান্স এর কারণে তার দল থেকে বাদ পড়া ঐ ২০১৯ সালের পর একবারও হয়নি।
একজন ব্যাটার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে সাইফুদ্দীনের অনেক খুঁত বের করা যাবে। প্রথমত তিনি যে জায়গায় ব্যাট করে থাকেন সেখানে ব্যাটারদের কাছে প্রধান চাওয়া হলো ব্যার চালানো। সাইফুদ্দীন এলোপাতাড়ি ব্যাট চালাতে পারেন না। তাকে কিছুটা সময় দিতে হয়। যদিও দলের প্রয়োজনে তার কমফোর্ট জোনের বাইরেও তিনি ব্যাট চালান। অবশ্য, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে তাকে এই রকম কোন সময় দেখা যায় নি তবে ওয়ানডেতে স্লগ ওভারে তার কাছে টি-টোয়েন্টির স্বভাবমত ব্যাটিং হরহামেশাই দেখা যায়।
বল হাতে সাইফুদ্দিন এর কাছে অনেক ধরনের ভ্যারিয়েশন দেখা যায়। বল ওপেন করতে আসলে নতুন বলে তিনি বেশ খানিকটা সুইং আদায় করতে পারেন। নতুন বলে উইকেটও পান বেশ। তবে বিশ্বকাপে নতুন বল হাতে তাকে দেখার সম্ভাবনা খুব কমই। তার আরেকটা বিশেষ গুণ হলো তিনি বেশ ভালো ইয়র্কার দিতে পারেন। স্লোয়ার এবং নরমাল পেসে ইয়র্কার দুটোই দিতে পারেন। সাথে নাকল বলও করতে পারেন। পেস ভ্যারিয়েশনের কারণে ডেথ ওভারে সে একজন কার্যকরী বোলার তবে হিটিং ল্যান্থে বল দিয়ে মার খেলে তার লেংথ গুলিয়ে ফেলেন। মিডল ওভারে সে উইকেট তুলতে পারে। এসব ছাড়াও সে একজন ফিল্ডার হিসেবে বেশ ভাল। গ্রাউন্ড ফিল্ডিং এবং ক্যাচিং উভয় জায়গাই নিজের সেরাটা দিতে তিনি সবসময় চেষ্টা করেন।
একনজরে মোহম্মদ সাইফুদ্দীনের আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার,
ম্যাচঃ ২৫
ইনিংসঃ ১৪
অপরাজিতঃ ০৪
রানঃ ১৭২
বলঃ ১৬১
অ্যাভারেজঃ ১৭.২০
স্ট্রাইকরেটঃ ১০৬.৯
৩০+ঃ ২
সর্বোচ্চঃ ৩৯*
বোলিং ইনিংসঃ ২৫
বল করেছেঃ ৫১০
রান দিয়েছেঃ ৭২১
উইকেটঃ ২৬
বোলিং অ্যাভারেজঃ ২৭.৭৩
স্ট্রাইক রেটঃ ১৯.৬০
ইকোনমি রেটঃ ৮.৪৮
সেরা বোলিংঃ ৪-৩৩
ক্যাচঃ ০৭
সাইফুদ্দিন যেই ধরনের ক্রিকেটার তাতে বলা যায় বিশ্বকাপে তার ভালো পারফরম্যান্স বাংলাদেশ দলকে ভালো করতে সহায়তা করবে। ব্যাট হাতে তার ভালো পারফরম্যান্স কিংবা বল হাতে ভালো স্পেল দিয়ে যদি তিনি দলকে জিতাতে পারেন তাহলে বিশ্ববাসী সাকিবের পর বাংলাদেশ থেকে আরো একজন ভালোমানের অলরাউন্ডার দেখতে পারবে। আর বাংলাদেশ পাবে নতুন এক ম্যাচ উইনার।
সাইফুদ্দিন কি পারবে সেই আশা পূরণ করতে!