ক্রিকেটের বহুল ব্যবহৃত শব্দগুলো আপনাকে কুইজে জিজ্ঞেস করা হলে আপনি নির্দ্বিধায় উইকেট, বেইল, মেইডেন, ইয়র্কার, আম্পায়ার, হ্যাট্রিক, পপিং ক্রিজ এগুলোর নাম বলে দেবেন। কিন্তু এই শব্দগুলোর উৎস বা অরিজিন যদি আপনার কুইজের প্রশ্ন হয়, তাহলে আপনার মগজের উপর চাপ পড়বে বৈকি। কোটি টাকার কুইজের কথা বাদ দিয়ে একবার ভাবুন তো, ক্রিকেটের এই প্রচলিত টার্মগুলো কোথা থেকে উদয় হল? কেন উইকেট কে উইকেট বলা হয়, কেন ওই বিশেষ জায়গায় পিচ করা বলটাকে ইয়র্কার বলা হয়? জানার আগ্রহ থাকলে চলুন নেমে পড়ি শেকড়ের সন্ধানে।
#উইকেট – উইকেট শব্দটা এসেছে খুব পুরাতন ব্রিটিশ ডিকশনারি থেকে। ক্রিকেট খেলাটির উদ্ভাবনের সাথে তদানিন্তন মেষপালকদের একটা মিলবন্ধন রয়েছে। ধারনা করা হয়, ওই মেষপালকরা ভেড়া চড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে ক্রিকেট খেলত। ভেড়ার খোঁয়াড়ে একটা ছোট্ট গেট থাকত যেখান দিয়ে ভেড়াদেরকে বের করা এবপং ঢোকানোর কাজ করা হত। ওই ছোট্ট গেটটাকে উইকেট বলা হত। তো, বল করার জন্য ওই উইকেটকে (ছোট্ট গেট) লক্ষ্য হিসাবে ধরা হত। সেখান থেকেই উইকেট শব্দটি ক্রিকেটে প্রবেশ করে, যেটাকে এখন আমরা তিনটা ষ্ট্যাম্প নামে চিনি।
#বেইল – এটা মূলত একটা ফ্রেঞ্চ শব্দ, যেটার মানে হচ্ছে ভেড়ার খোঁয়াড়ের গেটের উপরের অংশ। খামারের গেটকে উইকেট নামে ডাকা হত, এবং ওই উইকেটের উপরের অংশকে বেইল। সেখান থেকেই উইকেটের উপরে যে দুটি বস্তু আড়াআড়ি অবস্থান করে তাকে বেইল নামে ডাকা হয়।
#মেইডেন_ওভার – প্রথাগত ভাবে মেইডেন শব্দের অর্থ হচ্ছে অবিবাহিতা নারী অথবা ভার্জিন নারী। মূল ব্যাপার হচ্ছে, যে নারী এখনো সন্তান দেননি তাকে মেইডেন ধরা হয়। অনেকটা এমন অর্থের ভিত্তিতেই মেইডেন শব্দটি ক্রিকেটে এসেছে। আনপ্রডাক্টিভ ওভার, মানে হচ্ছে যে ওভার থেকে কোন রান আসেনি, যেমনটা যে নারী থেকে কোন সন্তান আসেনি।
#ইয়র্কার – ইয়র্কার শব্দের উৎস হিসাবে বেশ কিছু গল্প প্রচলিত রয়েছে। তবে সবথেকে বিশ্বাসযোগ্য গল্প হচ্ছে, আঠারো শতকে ইয়র্কশায়ারে টম এমেট নামে একজন বোলার ছিলেন, যিনি স্ট্রাইকার প্রান্তের ব্যাটসম্যানের পায়ের কাছে বল পিচ করাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তো, যে ব্যাটসম্যানরাই ইয়র্কশায়ারে খেলতে যেতেন তাদেরকেই এই বলগুলো সামলাতে হত। তাই ওই ডেলিভারির নাম হয়ে যায় ইয়র্কার।
#আম্পায়ার – আম্পায়ার শব্দটা মধ্যযুগীয় ইংলিশ ‘নমপের (nompere) থেকে এসেছে, যার বর্তমান ইংলিশ অনেকটা অড ম্যান বা থার্ড পার্টি। ওই সময়টায় কোন সমস্যা সমাধানে তৃতীয় পক্ষের (নমপের) শরনাপন্ন হতে হত। যেমনটা আম্পায়াররা করে থাকেন একটা খেলায়। আম্পায়ার শব্দের উদ্ভবও ওই নমপের শব্দ থেকে।
#রাউন্ডআর্ম_বল – এই টার্মটার সাথেও জড়িয়ে আছেন এক নারী। একটা সময় ক্রিকেট খেলায় বল করা হত আন্ডারআর্ম স্টাইলে। কিন্তু উনিশ শতকের শুরুতে ক্রিস্টিনা উইলস নামের এক নারী রাউন্দআর্ম বোলিং এর কৌশল আবিষ্কার করেন, যদিও নিজের তাগিদেই। আন্ডারআর্ম বোলিং করার সময় ফোলানো স্কার্টে হাত আটকে যেত ক্রিস্টিনার। সমাধান হিসাবে রাউন্ডআর্ম বোলিঙয়ের কৌশল হাসিল করেন তিনি।
#পপিং_ক্রিজ – প্রথমদিকের ক্রিকেট আইন বর্তমান পরিস্থিতি থেকে দেখলে একটু অদ্ভুতই মনে হবে। কারন তখনকার সময়ে রান সম্পন্ন করার জন্য ব্যাটসম্যানকে একটি গর্তের মধ্যে ব্যাট প্রবেশ করাতে হত। আর ফিল্ডার বা কিপার যদি ব্যাটসম্যানকে আউট করতে চায়, তাহলে বলটাকে ওই গর্তের ভেতর রাখতে হত। কে আগে রাখতে পারে তার উপর রান এবং আউট নির্ধারিত হত। এতে করে ফিল্ডার বা কিপার প্রতিনিয়তই ইনজুরির শিকার হতেন। দেখা গেল, কিপার মাত্রই বল সমেত তার হাতটা গর্তে ঢুকিয়েছেন, প্রায় সেই সময়ে ব্যাটসম্যানও তার ব্যাট দিয়েছে ঢুকিয়ে! ব্যাস, ভাঙ্গা হাত অথবা আঙুল নিয়ে সোজা ডাক্তারের চেম্বারে। ওই গর্তটাকে পপিং হোল বলা হত, যেখানে পপ করে ব্যাট/বল প্রবেশ করাতে হয়। এই ইনজুরি ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে আম্পায়ারের হাতে একটা লাঠি ধরিয়ে দেয়া হয়, যেটা স্পর্শ করলে রান/আউট হবে। কিন্তু এই বুদ্ধিও তেমন কার্যকরী হচ্ছিল না। পরবর্তীতে মাঠের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ঘাস চেঁছে ফেলে একটি জায়গা তৈরি করা হয়, যেখানে পৌঁছাতে পারলেই রান সম্পন্ন হবে। ওই নির্ধারিত জায়গাকেই পপিং ক্রিজ বলা হয়। পপিং হোল আউট, পপিং ক্রিজ ইন।
#নেলসন – নেলসন বা নেলসন নাম্বার ক্রিকেটে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। কোন দলের বা প্লেয়ারের রান যখন ১১১ হয়, তখন আমরা এটাকে নেলসন নাম্বার বলে ডাকি। কিন্তু কেন? ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল হেরাশিও নেলসন যিনি একজন ডিউক ছিলেন, যুদ্ধে তার একটি চোখ, একটি হাত এবং একটি পা হারান। এক এক এক সংখ্যাটি সেখান থেকেই প্রবর্তিত হয়। তবে আমি অবশ্য এই ১১১ সংখ্যাটিকে থ্রি ডাণ্ডা নামে ডাকি।
#হ্যাট্রিক – শব্দটি ক্রিকেটে আসে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তার আগে অবশ্য পরপর তিন বলে উইকেট নিলে আলাদা কোন নামে ডাকা হত না ব্যাপারটাকে। তবে, এই গৌরব কেউ অর্জন করলে তাকে নতুন হ্যাট দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর নিয়ম প্রচলন ছিল। হ্যাট – ট্রিক থেকেই পরবর্তীতে হ্যাট্রিক শব্দটি প্রচলন পায়।
ক্রিকেটের প্রায় প্রতিটি টার্মের পেছনেই রয়েছে একটা গল্প। প্রথম পর্বে সেটার কিছুটা অংশ তুলে ধরলাম। বাকি পর্বগুলোতে আরও কিছু উৎস নিয়ে হাজির হব।