২৮ এপ্রিল ২০০৭; আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। প্রতিদিনকার রুটিনে সন্ধ্যায় পড়তে বসার তাড়া থাকলেও সেদিনকার পড়া আমি বিকেলের মধ্যেই শেষ করে ফেলেছি। শীত টা কেবল জেঁকে বসেছে- এরই ফাঁকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির গতিকে ঘুম ঘুম চোখে বাসার টিভি সেটের সামনে বসে রয়েছি। ভাইয়ার চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনাল ম্যাচ দেখার৷ ফাইনাল দেখার চেয়েও অধীর আগ্রহে বসে ছিলাম সেই ছোট্ট আমিটার প্রিয় বনে যাওয়া মানুষটাকে দেখার জন্য।
আমাদের এখানে যখন সন্ধ্যে সাতটা বাজে বার্বাডোসে তখন কেবল সকাল ন’টা। বাংলাদেশের গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি যেনো বার্বাডোসে গিয়ে রীতিমতো ভারী বর্ষণের শুরু হয়েছে। সকাল ন’টায় শুরু হওয়া ম্যাচ শুরু হতে হতে দুপুর বারোটা- আমার তখন প্রায় রাতের একভাগ শেষ। ছোট্ট মানুষের চোখগুলো কখন যে লেগে এসেছে টেরই পেলাম না। ফজরের আজান শুনে চোখে মেলে দেখি ভাইয়া তখনো টিভিসেটের সামনে বসে আছেন। ঘুম ঘুম চোখের পাতা মেলে দেখি মানুষটা বাউন্ডারি লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে চিরাচরিত ভঙ্গিতে ডানহাত মুখে পুড়ে নখ কামড়াচ্ছেন। ভাইয়া বলতেন, যারা রং পেন্সিল দিয়ে কাগজে, দেয়ালে তুলির আঁচড় দেয় তাদেরকে শিল্পী বলে। আর বাইশগজে ব্যাটের সাহায্যে যিনি ক্রিজের চারপাশে শুনশান তরবারির মতো করে ব্যাট চালান তিনি হচ্ছেন ক্রিকেট মাঠের শিল্পী। যাকে আমি তখনো পুরোপুরি চিনে উঠতে পারিনি, জার্সির পেছনে অতবড় নাম পড়তে যখন দাঁত আটকে যেতো আমার ভাইয়া তখন বলতেন তিনি মাহেলা- পুরো নাম মাহেলা জয়াবর্ধনে!
২৩ জানুয়ারি ১৯৯৯;
লঙ্কান গ্রেট অর্জুনা রানাতুঙ্গা তখন তার দলবল নিয়ে ইংরেজ মুল্লুকে। সে-বছরের ২৩ জানুয়ারি দিনটা ক্রিকেট ইতিহাসের ঐতিহাসিক দিনগুলোরই একটি। এই সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ, যে ম্যাচে মুরালিকে বারবার নো বলের দায়ে অভিযুক্ত করার প্রতিবাদে মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো রানাতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা। আম্পায়ার রস এমারসনের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, ইংরেজদের অভিযোগ সবকিছু ছাপিয়ে অ্যাডিলেড ওভালে শেষপর্যন্ত ইংলিশরা সেদিন দাঁড় করায় ৩০২ রানের বিশাল এক সংগ্রহ। কিন্তু পাঁচ নম্বরে খেলতে নামা মাহেলা জয়াবর্ধনে নামের একুশ বছরের ছেলেটার ১১১ বলে ১২০ রানের অসাধারণ এক কাউন্টার অ্যাটাকিং ইনিংসে বিশাল এই সংগ্রহ শ্রীলঙ্কা টপকে যায় এক উইকেট হাতে রেখে- ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও পান মাহেলা। সেদিনের মাহেলা যতটা না দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়েছেন তারচেয়ে বেশি শিখেছেন রানাতুঙ্গার থেকে- দলকে একসুঁতোয় গেঁথে রাখার মন্ত্র!
…..….
ক্রিকেটের শুরুটা তার ভাইয়ের সাথেই শুরু করেছিলেন। ভাই ধীশালের সাথে ছোটবেলায় একসাথে খেলতেন। স্বপ্ন দেখতেন দুইভাই একসাথে জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন! জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নটা ধীশালেরই বেশি ছিল। ধীশালের ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে অঙ্কুরেই- মরণব্যাধি ক্যান্সারের সাথে পেরে উঠেননি ধীশাল। ক্যান্সার যখন ধীশালকে কেড়ে নিলো তখন মাহেলা একাই দুই ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণে নামলেন। ১৯৯৭ এর রান প্রসবনীর টেস্টে লংকান ক্রিকেটের ভবিষ্যত তকমা নিয়েই অভিষেক। অভিষেকের আলোটা মাহেলা থেকে পুরোই কেড়ে নিলেন জয়াসুরিয়া আর মহানামা। ইতিহাস ভেঙে ৫৭৬ রানের সর্বোচ্চ জুটি আর ৯৫২ রানের দলীয় সর্বোচ্চ ইনিংস। সেই ইনিংসে মাহেলারও ৬৬ ছিল। কে জানতো! সেদিনের ৬৬ করা ছেলেটাই জন্ম দিবেন আরেকটা অমর রেকর্ডের। অভিষেকের প্রায় দশবছরের মাথায় ছোটবেলার বন্ধু সাঙ্গা কে নিয়ে গড়েন এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের জুটি। শুধুমাত্র টেস্ট ক্রিকেটেই নয়, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটেও এক জুটিতে এত রান করার রেকর্ড আর কারো নেই!
ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচ যখন খেলছেন, তিনি যখন ক্রিজে, তখনই আগের বিশ্বরেকর্ড ইংল্যান্ডের ৯০৩ পার করেছিলো শ্রীলংকা। কেউ খেয়াল করেনি বোধহয়। প্রথম ১০ ইনিংসের মধ্যেই কিউইদের সাথে ১৬৭ আর ভারতের সাথে ২৪২! টেস্টে ক্যারিয়ারের শুরুতেই দুটা সেঞ্চুরি, একটা ডাবল- চোখ কপালে উঠার মতোই তাঁর শুরু। এ যেনো এক বিশ্বজয়ীর আগমনী বার্তা শুনতে পেয়েছিলো বিশ্ব।
নিন্দুকেরা সবসময়ই প্রশ্ন তুলেছেন তার ধারাবাহিকতা নিয়ে। প্রশ্ন তোলাটাই স্বাভাবিক- অভিষেকের পরের তিনবছরের মধ্যে তার নেই কোন টেস্ট সেঞ্চুরি। ধারাবাহিকতা নিয়ে সমস্যাটা তার পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই ছিলো। কিন্তু বড় ম্যাচের খেলোয়াড় খ্যাত তিনি যখনই ব্যাট হাতে বাইশগজে নেমেছেন ক্রিকেটমোদী মানুষদের নিরাশ করেননি। দরকারের সময়ে প্রতিপক্ষ ক্যাপ্টনের বড় চিন্তার নাম ছিলেন মাহেলা নামের নিপাট এই ভদ্রলোক!
…….
৯৯- বিশ্বকাপে প্রথম বড় কোন আসরে নিজেকে প্রমাণ করার পালা। ক্যারিয়ারের প্রাথমিক পর্যায়ে তখন- ডিপেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন লঙ্কানদের শিরোপা ধরে রাখার মিশনে পুরো দলের সাথে ব্যর্থ হলেন তিনিও। নিজের দল শ্রীলঙ্কার জন্যও আসরটি ছিল ব্যর্থতায় মোড়া, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে এসে গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিতে হয় লঙ্কানদের। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে করা ৪৫ রানের ইনিংসটাই ছিলো আসরের তার সেরা ইনিংস।
বিশ্বকাপে ব্যর্থতার রেশ ধরে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন রানাতুঙ্গা। লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড দায়িত্ব তুলে দেয় অভিজ্ঞ জয়সুরিয়ার হাতে- তার ডেপুটি তরুণ মাহেলা৷ মাত্র ২২ বছর বয়সী মাহেলাকে সহ অধিনায়ক করে বোর্ড একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে দেয় আর তা হলো ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বটা মাহেলার উপরেই বর্তাবে। তবে এত অল্প বয়সে সহ অধিনায়কত্বের চাপ এসে পড়ায় মাহেলার পারফর্মেন্স গ্রাফ কিছুটা নিচে নেমে যায়। নিয়মিত বিরতিতে বড় ইনিংসের দেখা পেলেও বড় ইনিংসগুলোর মাঝে ধারাবাহিক পারফর্ম না করায় ওয়ানডেতে মাহেলার গড় ৩০ এর আশেপাশেই ঘুরতে থাকে।
২০০৩ বিশ্বকাপ; মাহেলা তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিষ্ঠিত এক নাম। বোর্ড, সমর্থক থেকে শুরু করে দলের সদস্যরাও মাহেলার উপর প্রত্যাশার পারদ বেশ উঁচুতে রেখেছেন। কিন্তু হায়! পুরো বিশ্বকাপটা দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়াবহ কাটে মাহেলা জয়াবর্ধনের জন্য। ১, ৫, ৯, ১, ০, ০ ও ৫ – নাহ এগুলো কোনো মোবাইল নাম্বারের ডিজিট নয়, ২০০৩ বিশ্বকাপের সাত ইনিংসে এগুলোই ছিল মাহেলার রানসংখ্যা! একবারের জন্যও দুই অঙ্কের রান দূরে থাক, ৫ রানের বেশিই করতে পেরেছেন কেবল একবার! গড় ছিল মাত্র তিন। যদিও শ্রীলঙ্কা সেবার সেমিফাইনাল খেলেছিল, কিন্তু এমন জঘন্য পারফর্মেন্সের জন্য ওয়ানডে দল থেকেই বাদ পড়ে যান মাহেলা। অথচ বিশ্বকাপের কিছুদিন পরেই জয়াসুরিয়া অধিনায়কের পদ থেকে সরে যাওয়ায় অধিনায়কের দায়িত্বটা মাহেলারই পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেই দায়িত্ব পেয়ে যান মারভান আতাপাত্তু। সবমিলিয়ে এক ২০০৩ বিশ্বকাপ মাহেলাকে একধাক্কায় অনেক দূর পিছিয়ে দেয়।
অধিনায়কত্ব পাওয়া দূরের কথা দলে নিজের জায়গা নিয়েই প্রশ্নের মুখোমুখি মাহেলা- স্বভাবতই বাদ পড়লেন দল থেকে। নিজেকে প্রমাণ করে যখন দলে ফিরেছেন ততদিনে সাগর দ্বীপের দেশটার ক্যাপ্টেন্সির ভার বর্তায় মারভান আতাপাত্তুর কাঁদে। দায়িত্ব পেয়েই আতাপাত্তু পেয়ে গেলেন আইসিসির বর্ষসেরা অধিনায়কের খেতাব। মাহেলার অপেক্ষার প্রহর বাড়তেই থাকলো। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সফর দিয়েই মাহেলার আনুষ্ঠানিক ক্যাপ্টেন্সির শুরু। ভবিষ্যৎ ক্যাপ্টেনের হাতে দলের দায়িত্ব বুঝে দিতেই নাকি সেবছর আতাপাত্তু কে বিশ্রামে রেখে মাহেলা কে দায়িত্ব দেয়া। বাংলাদেশে এসে একটা ওডিয়াই হারা, ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ও ওডিয়াই সিরিজ হারা ক্যাপ্টেন মাহেলার শুরুটা মোটেও সুবিধার ছিলো না।
তবে মাহেলা ইংল্যান্ড সফরে বিশাল এক বাজিমাত করে ফেলেন! লর্ডসে প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কা ফলো-অনে পড়লেও দ্বিতীয় ইনিংসে মাহেলার অনবদ্য সেঞ্চুরিতে ম্যাচ ড্র করে শ্রীলঙ্কা, ম্যাচসেরার পুরষ্কারটাও পান মাহেলা। দ্বিতীয় টেস্টে লঙ্কানরা ছয় উইকেটে হারলেও শেষ টেস্টে মুরালি ম্যাজিকে ১৩৪ রানে ম্যাচ জিতে সিরিজ ড্র করে শ্রীলঙ্কা। আর ওয়ানডেতে তো ইংলিশরা দাঁড়াতেই পারেনি, পাঁচ ম্যাচ সিরিজের সবক’টাতে জিতে ঘরের মাঠে ইংলিশদের ধবল ধোলাইয়ের স্বাদ দেয় মাহেলার দল। এরমধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ ওয়ানডেতে টানা দুটি সেঞ্চুরি করে দলের এই ৫-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়ে বড় অবদান রাখেন মাহেলা নিজেই। অধিনায়ক হিসেবে মাহেলার ভিতটা মজবুত হয়ে যায় এই সফরের পরপরই।
বড় ম্যাচে ক্যাপ্টেন মাহেলার ব্যাট সবসময়ই হেসেছে; সেটা সিরিজ নির্ধারনী কোন ম্যাচ বা বিশ্বমঞ্চের কোন হাইভোল্টেজ ম্যাচ। ২০০৭ বিশ্বকাপে দলকে একা হাতেই নিয়ে গেছেন স্বপ্নের ফাইনালে। ৬০.৮৯ গড়ে ৫৪৮ রান করে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন মাহেলা। সেমিফাইনালে কিউইদের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে শিরোপার কাছ থেকে ফিরে এসেছেন গিলক্রিস্ট নামের এক অতিমানবের বদৌলতে। সন্ধ্যার গোধূলি আলোতে অজিরা যখন হ্যাট্রিক শিরোপা উৎসবে মত্ত মাহেলা তখন বাউন্ডারি লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে মুখে আঙ্গুল পুড়ে নখ কাটতেই ব্যস্ত! শৈশবের হিরো মাহেলার আইসিসির কোন শিরোপার আক্ষেপের শুরু সেখান থেকেই।
বছর দুয়েকের মাথায় ক্যাপ্টেন্সির হাতবদল করেন বন্ধু সাঙ্গাকারার কাছে৷ ততদিনে ক্রিকেট বিশ্ব মেতেছে টি-টুয়ান্টি নামের মারকাটারি ক্রিকেটে। টেস্ট ক্রিকেটে সলিড মাহেলা বা ওডিয়াইতে ব্যাকরণিক মাহেলা ক্রিকেটের শর্টার ভার্সনেও কম যাননি। টি-টুয়ান্টি ক্রিকেটে তার ব্যাটিং নিয়ে সন্দেহের অবকাশ ছিলো না। মারকাটারি ব্যাটিংয়ে ভালো স্ট্রাইক রেটে রান তোলা তার জন্য চ্যালেঞ্জিং ও বটে। সাবকন্টিনেন্টাল আর সবার মতোই শারীরিক গঠন, গায়ের জোর বা রিস্টের পাওয়ার তার কখনোই ছিলো না। উনার সব শট কেবলই ব্যাকরণ সম্বৃদ্ধ ছিলো না, মাঠের চারপাশে শট, গ্যাপ খুজে খুজেও একশোর উপরে স্ট্রাইক রেটে রান করা যায় সেটা সর্বপ্রথম মাহেলাই প্রমাণ করেছেন। শর্টার ফরমেটে মাহেলার স্ট্রাইকরেট ১৩৩.২। যা কিনা বর্তমান সময়ের কথিত অনেক হার্ড হিটার ব্যাটসম্যানের চেয়েও বেশি! জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬৪ বলে ১০০ রানের ইনিংস খেলে ক্রিকেটের সকল ফরমেটে সেঞ্চুরি করার বিরল রেকর্ড করেন মাহেলা। ২০০৯ টি-টুয়ান্টি ওয়ার্ল্ডকাপে আবারও দলকে নিয়ে গিয়েছেন ফাইনালে। সেখানেও আফ্রিদি নামক এক ঘাতকের আঘাতে শিরোপা বঞ্চিত হলেন তিনি৷
.…..
৪ এপ্রিল ২০১১
মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে শ্রীলঙ্কা। আগেরবার ক্যাপ্টেন হিসেবে ফাইনাল খেললেও এবার তিনি দলের সিনিয়র ব্যাটসম্যান। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ খেলে আসা শ্রীলঙ্কার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ স্বাগতিক ভারতকে হারানো। ভারতীয় দলের ব্যাটিং লাইন আপের সঙ্গে তাদের প্রিয় ফ্ল্যাট উইকেটের সুবিধা। টসে জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নিলেন লঙ্কান অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা। কিন্তু শুরুতেই জহির খানের নিয়ন্ত্রিত বোলিং সাথে ভারতীয় ফিল্ডারদের অসাধারণ ফিল্ডিং এ শুরুতেই বেশ চাপে পড়ে যায় শ্রীলঙ্কা। মুম্বাইর ফ্ল্যাট পিচে যেখানে বড় সংগ্রহের দরকার ছিল সেখানে পাওয়ার প্লের দশ ওভারে লঙ্কানদের রানরেট ছিল ওভারপ্রতি ৩ রান! মাহেলা জয়াবর্ধনে যখন ক্রিজে আসেন তখন শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ওভারে ৫৬/২। তখন মাহেলার উপর একইসাথে দুইটা দায়িত্ব, রানের গতি বাড়ানো সাথে নিজের উইকেট বিলিয়ে না আসা। মাহেলা জয়াবর্ধনে দুইটা দায়িত্বই বেশ ভালোভাবে সামলালেন, অপরপ্রান্তের কোনো ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে সেভাবে সমর্থন না পেলেও মাহেলা একাই বুক চিতিয়ে লড়ে গেলেন, খেললেন মাত্র ৮১ বলে ১০৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস।
পরিস্থিতি আর পারিপার্শ্বিক চাপের কথা বিবেচনা করলে এই ইনিংসটাকে সহজেই বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে সেরা তিন ইনিংসের তালিকায় রাখা যায়। মাহেলার এই অসাধারণ ইনিংসে ভর করেই সেদিন শ্রীলঙ্কা ২৭৪ রানের লড়াকু সংগ্রহ পায়। অথচ সেদিন যদি আরেকজন ব্যাটসম্যান মাহেলাকে ঠিকভাবে সাপোর্ট দিতে পারতেন, তাহলে হয়তো সেদিন লংকানদের সংগ্রহ ৩০০ ছাড়িয়ে যেতো। আর ২০-৩০ টা রানের আক্ষেপ বাড়িয়ে আটাশ বছর পর বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরেন ধোনীর ভারত। মাহেলা জয়াবর্ধনের ওয়ার্ল্ডকাপ জেতাটা সেদিনও হলো না।
২০০৭-২০১২ ওডিয়াই-টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে চারটা ওয়ার্ল্ডকাপের ফাইনালে হারার দুঃসহ স্মৃতি মাহেলার সঙ্গী। অবশেষে সে আক্ষেপ ঘুচেছে ২০১৪ বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় টি-টুয়ান্টি ওয়ার্ল্ডকাপে। সেবার বন্ধু সাঙ্গাকারার সাথে সেই স্বপ্ন পূরণ হলো তার। টি-টুয়ান্টি বলেই কিনা চেয়েছিলেন ওডিয়াই ওয়ার্ল্ডকাপের ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে৷ টেস্ট কে বিদায় বলেছিলেন আগেই, ক্যারিয়ারের শেষ লগ্নে এসে ২০১৫ ওয়ার্ল্ডকাপ খেলতে নামার আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন পুরোপুরি অবসরের৷
……..
২০১১ বিশ্বকাপের পর লঙ্কানদের অধিনায়ক হোন দিলশান। কিন্তু দায়িত্ব পেয়ে যেনো তিনি খেলাই ভুলে গেলেন। ত্রাতার ভূমিকায় আবারও ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড পড়ে নেন মাহেলা। ক্যাপ্টেন হিসেবে মাহেলা কেমন ছিলেন? তাকে মানা হয় আধুনিক ক্রিকেটের সেরা স্ট্র্যাটেজিস্টদের একজন। ব্যাটসম্যানের মন পড়তে পারতেন। সে অনুযায়ী ফিল্ডিং সাজাতেন। আর ছিলেন দলের নেতা। ২০০৭ বিশ্বকাপের সুপার এইটে ইংল্যান্ডের সঙ্গে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ তখন। সেমিতে যাওয়ার জন্য শেষ বলে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন কেবল তিন রান। ক্রিজে ইনফর্ম ব্যাটসম্যান রবি বোপারা আর বোলিং এ দিলহারা ফার্নান্দো। ফার্নান্দো শেষবল করতে যাবে এমন সময়ে হুট করে মাহেলা ফার্নান্দোকে থামিয়ে বলেন “বোপারা কিন্তু স্লো বলের আশায় আছে, তুমি ভুলেও স্লো বল করো না বরং ফাস্ট একটা বল করো।” ফার্নান্দো আসলেই তখন স্লো বল করার কথা ভাবছিলেন, কিন্তু অধিনায়কের নির্দেশমতে সে কুইকার ডেলিভারিই করলো, আর স্লো বলের আশায় থাকা বোপারা দেরিতে ব্যাট চালানোয় হয়ে গেলেন বোল্ড! শুধুমাত্র মাহেলার ট্যাকটিকাল ব্রিলিয়ান্সের জন্য হারা ম্যাচ জিতে যায় লঙ্কানরা।
২০০৬ সালে হয়েছিলেন আইসিসির ‘ক্যাপ্টেন অফ দ্যা ইয়ার’। তার নেতৃত্বেই ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আবার ফাইনালে উঠলো শ্রীলংকা। কিন্তু এবারও হার! ক্যাপ্টেন হিসেবে জেতা হলো না বৈশ্বিক কোন শিরোপা।
ওয়ানডেতে ৩৩.৩৮ বা টেস্ট ক্রিকেটে ৪৯.৮৫ গড় সত্যিকারভাবে তার প্রতিভার সাথে মানানসই নয়৷ কিন্তু একজন ক্যাপ্টেন মাহেলা, শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটে তার অবদান সবকিছু কিন্তু পরিসংখ্যানে প্রকাশ পায় না৷ মাহেলা কখনোই নির্দিষ্ট কোন পজিশনে ব্যাট করার সুযোগ পাননি। কখনো ওপেনিংয়ে তো কখনো মিডল অর্ডার। আবার নতুনদের সুযোগ করে দিতে নিজের পছন্দের জায়গা ছেড়ে দেয়ার নজিরও কম না৷ তরুণ চান্দিমাল যখন দলে এসেছেন তখন তাকে সুযোগ করে দিতে ছেড়েছেন নিজের পছন্দের চার নাম্বার পজিশন। ওপেনিংয়ে শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গড় থাকা স্বত্তেও তিনি কেবল ৩৪ ম্যাচ ওপেনিংয়ে খেলেছেন৷ দিলশান যখন দলকে নেতৃত্ব দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন দলের কান্ডারী হয়ে আবারও ফিরে এসেছিলেন খাদের কিনারে থেকে দলকে টেনে তুলতে। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে একজন মাহেলার অবদান ঠিক কতখানি ছিলো সেটা তার অবসর পরবর্তী সময়ে লঙ্কান ক্রিকেটের ছন্নছাড়া অবস্থা দেখলেই অনুমান করা যায়।
মাহেলা শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দলের তো বটেই পুরো ক্রিকেট বিশ্বেই এক লিজেন্ডারি নাম। ৬০০ এর অধিক আন্তর্জাতিক ম্যাচে ২৫০০০ প্লাস রানের সঙ্গে ৫৪ সেঞ্চুরি ও ১৩৬ হাফসেঞ্চুরি তারই প্রমাণ দেয়। ক্রিকেটের তিন ফরমেটেই তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। টিভিসেটের সামনে বসে মাহেলার ব্যাটিং দেখা ছিলো ক্রিকেটপ্রেমী মানুষদের জন্য অনেক বেশি উপভোগের বিষয়।
ব্যাটিং নামক শিল্পের ধ্রুপদীতম শিল্পীর নাম মাহেলা জয়াবর্ধনে। দীর্ঘদিন পরে প্রেমিকাকে প্রথম দেখার সময় প্রেমিকের চোখে যে আনন্দের পরশ দেখা যায় মাহেলা জয়াবর্ধনের ব্যাটিং ক্রিকেট প্রেমিকের জন্য সেরকমই আনন্দদায়ী! প্রেমিকার জন্য যেমন পৃথিবী ঘুরে একশ আটটা নীলপদ্ম খুঁজে বের করা যায়, মাহেলার ব্যাটিং দেখবার জন্যেও মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া যায়। ভদ্রলোক একটা শট খেলার সময় যেন বলটাকে আদর করে বলতেন, আবার এসো কেমন? স্পিনারের বল যখন উইকেটকিপারের গ্লাভসে প্রায় জমা হয়ে গেছে ঠিক তার পূর্বমুহূর্তে মাহেলার ব্যাট নেমে আসতো বুলেট গতিতে। লেট কাট শটটা তার মতো ‘লেট’ করে বোধহয় ক্রিকেটে কেউ খেলেনি। পিচের চারপাশে ব্যাটটাকে তুলি বানিয়ে যে ছবি আঁকতেন আধুনিক ক্রিকেটে এক মার্ক ওয়াহই এমনটা করতে পারতেন।
তার ব্যাটিং নিয়ে বলতে গিয়ে দীর্ঘদিনের সঙ্গী সাঙ্গাকারার বক্তব্য; ‘“সেই স্কুলক্রিকেট থেকেই মাহেলাকে দেখে ভিতরে ভিতরে কিছুটা ঈর্ষান্বিত হতাম, ব্যাটে-বলে টাইমিং করার ব্যাপারটা মাহেলা এতটা অনায়াসে করতো যে সেটা দেখে অবাক না হয়ে পারা যেত না। আমরা যেসব শট খেলতে নেটে কঠোর পরিশ্রম করতাম সেগুলো মাহেলা সেই বয়সে অহরহ করে দেখাতো।”
মাহেলার ক্যাপ্টেন্সি, ব্যাটিং আর সারল্য মাখা মুখাবয়ব তাকে ভালবাসার জন্য যথেষ্ট। আর যদি ক্রিকেটপ্রেমী হোন তবে তার ব্যাটিং শিল্প দেখে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। ক্যারিয়ার জুড়েই ছিলেন ভদ্রতার প্রতিমূর্তি। ২০১৩ সালে আইসিসি ‘স্প্রিরিট অফ দ্য ক্রিকেট অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে তারই স্বীকৃতি দিয়েছে।
২০১৫ বিশ্বকাপে খেলতে নামার আগেই যখন ঘোষণা দিয়েছিলেন ব্যাট প্যাড তুলে রাখবেন এবার। দীর্ঘ আঠারো বছর যে মানুষটা বাইশগজে ব্যাটের কারিকুরিতে মুগ্ধ করেছেন গোটা বিশ্বকে সে মানুষটাকে অবসর পরবর্তী সময়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন প্রশ্ন করা হয় তখন তার উত্তর, ‘ভাইয়ের নামে তৈরি হাসপাতালেই কাটবে তার বেশিরভাগ সময়।’ ১৮ বছরের ক্রিকেট জীবনে মাঠে যার কাজ ছিল দর্শকদের আনন্দ দেয়া তিনি এখন শান্তি খুঁজবেন হাসপাতালে রোগীর সারল্যমার্কা হাসিতে। সেখানে ধীশালকে খুঁজে বেড়াবেন। শিল্পীদের মন বড় না হলে তো তারা আর অন্যদের চেয়ে আলাদা হন না। দেনাগামাগে প্রবোথ মাহেলা ডি সিলভা জয়াবর্ধনে মানুষ হিসেবে মাঠের চেয়েও বড় শিল্পী। জীবনের হাসি-কান্না মাখা শিল্পের এক বড় আঁকিয়ে! যে শিল্পীর প্রেমে পড়েই কিনা তাকে ভালবাসতে শুরু করা।
দীর্ঘ আঠারো বছরের ক্যারিয়ারে ক্রিকেটমোদী মানুষদের শিল্পের কারিকুরিতে মুগ্ধ করে যাওয়া জয়াবর্ধনে কে আপনি ঠিক কোন নামে চেনেন! “মাহেলা” নাকি তার ডাকনামের মতোই তিনি আস্ত একটা “মায়া!”