চট্রগ্রামের সানশাইন স্কুল এন্ড কলেজের সেই দুষ্ট প্রেমিক ছাত্র, চাচার জোরে জাতীয় দলে খেলা প্লেয়ার, ম্যাগি নুডুলস বা ডানো খেয়ে মাঠে খেলতে নামা সেই ভুড়িওয়ালা তামিম থেকে দেশসেরা ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল হয়ে উঠা।
২০০০ সালের পরের কথা, খুব ছোট ছিলাম। বয়স আর কতো হবে! ছয় কি সাত। ক্রিকেট খেলাটা দেখা শুরু করেছি মাত্র। ক্রিকেট খেলা দেখা বলতে বাংলাদেশের খেলাই দেখা হতো। বাড়িতে টিভি ছিলোনা। গ্রামের দোকানেও খুব একটা টেলিভিশন দেখা যেতোনা। বাড়ির পাশেই একটা দোকানে সাদাকালো একটা টেলিভিশন ছিলো। বাংলাদেশের খেলা আছে শুনলেই সেখানে গিয়ে খেলা দেখতাম।
মাঝেমধ্যে এমন হতো, খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে ৫-১০ ওভারও শেষ। বাংলাদেশ দলের স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়ে কান্না চলে আসতো আমার। স্কোরবোর্ডে এমনই থাকতো, ২০/৪ বা ৩৫/৬। ২০০৩ সালের সাউথ আফ্রিকা ওয়ার্ল্ডকাপে চামিন্ডা ভাসের সেই অবিশ্বাস্য স্পেল এখনো ঝাপসা ঝাপসা চোখে ভেসে উঠে।
ইনিংসের প্রথম ওভারেই হ্যাট্রিক সহ চার চারটি উইকেট নিয়েছিলেন সেদিন। বাংলাদেশের টপ অর্ডার তখন কতটা ভঙ্গুর ছিলো এই একটা ম্যাচের দিকে তাকালেই বুঝা যেতো। এমন না যে ওইদিনটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। বাংলাদেশের প্রতিটা ম্যাচেই এরকম দৃশ্যের দেখা মিলতো।
ওপেনিং ব্যাটসম্যানরা মাঠে নামতেন আর ওয়ান ডাউন টু ডাউনে খেলতে নামা ব্যাটসম্যানরা ওয়াশরুমে যাবার সময়টুকুই পেতেন না। বিপক্ষ টিম যেখানে ২৫০-৩০০+ রান করতো সেখানে বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুতেই টপাটপ কয়েকটা উইকেট পড়বে, মিডল অর্ডারে পাইলট, খালেদ মাহমুদরা এসে ঠুকঠুক করে কয়েকটা রান করবে আর শেষ দিকে এসে রফিকের মারকাটারি ব্যাটিংয়ে রান ১৫০-২০০ এর মধ্যেই থাকতো। সমস্যা কোথায়.? সমস্যা ওপেনিংয়ে। ক্রিজে যাওয়ার সাথে সাথে দুয়েকটা উইকেট শেষ, ওয়ান ডাউন টু ডাউন খেলতে নামা ব্যাটসম্যানরা প্যাডাপ করার টাইমও পেতো না। মোহাম্মদ রফিক একাদশ ব্যাটসম্যান থেকে সোজা ওপেনিংয়ে চলে আসলেন। বিশ পঁচিশ ম্যাচ পর একটা ফিফটি করতেন আর বাঙ্গালী জাতী তখন কোমরে লুঙ্গি তুলে নাচে।
খালেদ মাসুদ পাইলট থেকে শুরু করে আকরাম খান, সুজন, মণি, ফারুক নান্নু পর্যন্ত ওপেন করেছেন। ফলাফল যেই লাউ সেই কদুই রয়ে গেলো। জাবেদ ওমর বেলিম আসলেন, ক্রিজে আকপাশ আগলে রেখে খেলা শুরু করলেন তো অপর পাশের ব্যাটসম্যানদের আসা যাওয়া শুরু হলো। তখন গিলক্রিস্ট শেভাগ জয়সুরিয়াদের যুগ। ক্রিজে নামলেই বিপক্ষ টিমের বোলারদের বেধড়ক পিটিয়ে ইনিংস শুরু করতেন৷ ওপেনিংয়ে এরা নামলে বিপক্ষ টিমের বোলাররা এরে ওরে বল নিয়ে ঠেলাঠেলি শুরু করতো। ১৫ ওভার পাওয়ার প্লের পুরো ফায়দাই তারা উঠাতেন। বলে বলে ডাউন দ্যা উইকেট, ওভার দ্যা ফিল্ডার দিয়ে সীমানা ছাড়া করতেন। আর আমাদের ছিলেন জাবেদ ওমর বেলিমের মতো ব্যাটসম্যান। আমরা তারে গালি দেই, একে অপরকে কটাক্ষের সুরে জাবেদ ওমর বলি! কিন্তু তখন একজন জাবেদ ওমর বেলিমই আমাদের দরকার ছিলো৷ যেই টিম পুরো ৫০ ওভার খেলতে পারেনা, সেই টিমে গিলক্রিস্ট, শেভাগ বা জয়সুরিয়ার প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন ছিল আসলে এগারোজন জাবেদ ওমরের।
জাবেদ ওমর ঠিকি ঠুকঠুক করে একপাশ আগলে রেখে খেলে গেলেন, কিন্তু অন্যপাশে? শুরু হলো চমৎকার সব দৃশ্যের, আজ এ তো কাল সে, পড়শু অমুক। রাজিন সালেহ ওপেনার, অলক কাপালি ওপেনার, অকালে ঝড়ে পড়া বাংলাদেশ ক্রিকেটাশের ছোট্ট নক্ষত্র মাঞ্জারুল ইসলাম রানাও ওপেনার। যিনি মোটরসাইকেল এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন। হাবিবুল বাশার সুমনও দুয়েকটা ম্যাচে ওপেন করেছেন, পাইলট, সুজন, রফিক, নাঈমুর রহমান দুর্জয়ও ওপেন করেছেন। উঁহু, ফলাফলে কোনধরণের পরিবর্তন আসেনি, স্কোরবোর্ডে সেই শূন্য রানে দুই উইকেট, একরানে তিন উইকেট, তিন রানে পাচ উইকেট, পচিশ রানে ছয় উইকেট এসব রেগুলার দৃশ্য। বাংলাদেশ তারপরও ১৩০-১৫০ রান করে টেলএন্ডারদের দৃঢ়তায়।
এক সময়ে আলোর ঝলকানি দেখিয়ে এসেছিলেন তামিম ইকবালের বড় ভাই নাফিস ইকবাল। তিনিও হারিয়ে গেলেন। আসলেন শাহরিয়ার নাফিস, সোনালী সময়ে আইসিএলে গিয়ে বারোটা বাজিয়েছেন নিজের ক্যারিয়ারের। তা না হলে দেশসেরা ব্যাটসম্যানের লিস্টে তার নামটা উপরের দিকেই থাকতো। আশরাফুল এলেন, দশ পনের ম্যাচ পরপর একটা ৩০-৪০ রানের ইনিংস বা একটা ফিফটি। নাইম ইসলাম থেকে শুরু করে জুনায়েদ সিদ্দিকী কেউই টিকতে পারলেন না ওপেনিংয়ে। আমরা অপেক্ষা করতাম পাইলট রফিকের ব্যাটিং দেখার জন্য। তারা ব্যাটিংয়ে এসে কয়েকটি বড় বড় শট খেলে কিছু রান করে আমাদের মতো দর্শকদের মন জয় করে নিতেন। পুনরায় সেই দৃশ্য, পাঁচ দশ ওভার পর টিভি সেটের সামনে গিয়ে বসতাম৷ যেদিন ওপেনিং পার্টনারশিপ ৩০/৪০ রান হতো সেদিন ঈদের মতো আনন্দ হতো। ওপেনিং ব্যাটসম্যান পেয়েছি বলে বলে তাদের মাথায় উঠিয়ে নাচতাম। একম্যাচ পরেই সেই আগের দৃশ্য গুলোর পুনরাবৃত্তি। আমরা একটা ওপেনিং ব্যাটসম্যান পেলাম না!
সেই আমরাই আবার টিভিসেটের সামনে গিয়ে বসলাম বর্তমান উইন্ডিজ বিশ্বকাপের ভারত বনাম বাংলাদেশের ম্যাচ দেখতে। শচীন থেকে শুরু করে সৌরভ গাঙ্গুলি, শেভাগ, দ্রাবিড়, জহির খানদের নিয়ে গড়া দল ভারত। বিশ্বকাপের হট ফেভারিট। রাত জেগে দেখা ম্যাচে দেখা মিললো নতুন এক বাংলাদেশের। স্পেসিফিক বলতে গেলে নতুন একটা ছেলের যে কিনা মুনাফ প্যাটেল, অজিত আগারকার, জহির খানদের বারুদের গোলার মতো একেকটা বল আঁছড়ে ফেলছে গ্যালারিতে। ছেলেটির নাম কি! বড় বড় চোখ করে যে তাকায়। ফার্স্ট বোলাররা নতুন বলে বাউন্স দিলো, ছেলেটা ডাক করলো না। চিতকাইত হয়ে ক্রিজে শুয়ে পড়লো না। বাতাসে চাবুক চালানোর মতো করে পুল করল, বল চলে গেলে, কে এই ছেলে! ক্রিজের মাঝখানে এসে বোলারের রুক্ষমূর্তি ভরা দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলো। পরের বলে বাউন্সারটাও সীমানা পার করে সোজা গ্যালারিতে। প্রথম ১৫ ওভারে ডাউন দ্যা উইকেট, কাভার ড্রাইভ, লফটেড শট কি ছিলোনা সেই ইনিংসে! কে এই ছেলে বাংলাদেশ দলে ওপেনিং করে!! কে?
তামিম ইকবাল!!
টানা চারবছর তিনি কাঁপিয়ে দিলেন বাংলাদেশের ওপেনিং ব্যাটিংয়ের সব রেকর্ড। ২০০৭ সালের সেই ৫১ রানের ইনিংস ভেঙ্গে দিলো পুরো ইন্ডিয়ার বিশ্বকাপ স্বপ্ন। জহির খান তেড়ে এলেন, তিনি বলটাকে ছুঁড়ে দিয়ে ইশারায় পপিং ক্রিজ দেখিয়ে বললেন, যাও বল করো৷ জহির খান বল করলেন বাউন্সার, লং অন দিয়ে তিনি পাঠিয়ে দিলেন সোজা গ্যালারিতে। ইংল্যান্ডে গেলেন, যেখানে হালের ধোনি, কোহলি রান করতে হাপিত্যেশ করে সেই ইংল্যান্ডের মাটিতে টেস্টে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি, লর্ডসে সেঞ্চুরির পর সেই ক্ষ্যাপাটে উদযাপন, অনার্সবোর্ডে প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেবে নাম উঠানো সেই তামিম ইকবাল খান। হারারাতে জিম্বাবুয়ে ৩১৩ রানের বিশাল পাহাড় দাড় করালো। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এত রান তাড়া করার রেকর্ড ছিলো না তখনো। ছেলেটা ক্রিজে গেলো, ১৫৪ রানের মহাকাব্যিক সেই ইনিংসে জয়ের বন্দরে পৌছায় তার দল৷ ২০১৫ এর বিশ্বকাপে স্কটিশদের বিপক্ষে ৯৫ রানের ইনিংস, খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০৬ রানের ইনিংস, ওমানের বিপক্ষে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণেও সেঞ্চুরি। কোন ইনিংসটি কে আপনি অস্বীকার করবেন!
তামিম ইকবাল বাংলাদেশ ক্রিকেটের ওপেনিংয়ের সংজ্ঞা বদলে দেয়া নাম। আর আমরা তাকে ভাতিজা কোটার খেলায় বলে গলাফাটাই। কি করেছে তামিম ইকবাল, কয়েকটা ম্যাচ রান পায়নি এইতো! অফফর্মে থাকায় ২০১২ সালের এশিয়া কাপের কথা মনে পড়ে? টানা চার ইনিংস পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলে আঙ্গুলের ইশারায় জবাব দেয়ার দৃশ্যটা দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের একটা অংশ হয়েই দাঁড়িয়েছে। একসময়ের মারকাটারি ব্যাট করা তামিম হয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপের স্তম্ভ। তার কাভার ড্রাইভ বর্তমান বিশ্বের যেকোনো ব্যাটসম্যানের চেয়ে চোখের প্রশান্তি যোগায়।
একটা সময়ে আমরা শেভাগ, জয়সুরিয়ার মতো এটাকিং ওপেনারের জন্য হাপিত্যেশ করেছি। ইনিংসের শুরুতেই প্রতিপক্ষ টিমের বোলারদের লাইন লেংথ দুমড়েমুচড়ে ফেলা ব্যাটসম্যানের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম বহুদিন। তামিম ইকবাল এসে অবসান ঘটিয়েছেন আমাদের সেই অধীর অপেক্ষার।
ক্রিকবাজ স্টাফ রাইটার অভিনন্দ রাঘাভন্দ্র তার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
When the world talks about sub-continental openers, they talk about the aggression factor. Virender Sehwag, Sanath Jayasuriya and Sachin Tendulkar have ruthlessly destroyed the bowling over the years. However, an opener from Bangladesh soon joined the list and made the world take notice.
২০১৫ বিশ্বকাপের পর মারমার কাটকাট থেকে নিজেকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে ফেলা তামিম ইকবাল হয়েছেন তিন ফরমেটে সেঞ্চুরি করা একমাত্র এশিয়ান ব্যাটসম্যান। দেশের হয়ে করেছেন ১২৪০০ আন্তর্জাতিক রান, ২১ সেঞ্চুরির মালিক। দীর্ঘ একযুগ ধরে সামলাচ্ছেন ক্রিজের একপাশ। টেস্ট খেলুড়ে সবগুলো দেশের বিপক্ষেই আছে তার পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস।
ধীরেধীরে নিজেকে গড়ে তুলেছেন দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ের মূর্ত প্রতীক হিসেবে। জহির খানকে সেই ছক্কা দিয়ে যে শুরু এরপর কতবার আমাদের হাঁসিয়েছেন। দুঃসহ সব স্মৃতিকে পিছনে ফেলে হয়ে উঠেছেন তরুনদের আদর্শ।নিজের কাভার ড্রাইভের জাদুতে মুগ্ধ করেছেন নিন্দুকদেরও। বিশ্বের কোনো ক্রিকেটারের কাভার ড্রাইভই আমার কাছে আপনার কাভার ড্রাইভের চেয়ে সুন্দর লাগে না। এইতো কিছুদিন পরেই শুরু হবে ক্রিকেট বিশ্বের মহাযজ্ঞ খ্যাত বিশ্বকাপ। এদেশের হাজারো ক্রিকেট প্রেমী টিভিসেটের সামনে বসে পড়বে লর্ডসে আরেকবার আপনার সেই সেঞ্চুরি উদযাপনের চিরচেনা দৃশ্য দেখার নেশায়।
আপনার ব্যাটিং দেখতে স্কুল কামাই করা ছেলেটা, অফিস ফাঁকি দেয়া বসের বকুনি খাওয়া আপনার এক ক্ষুদ্র ভক্ত বলছি। আপনি যেভাবে ব্যান্ডেজ হাতে নিয়ে নেমে যান আমরা তার এক শতাংশ ডেডিকেশন নিয়েও দেশের জন্য কিছু করিনি। তাই আমাদের কথায় পাত্তা না দিয়ে আপনি আরো সহস্র বার আমাদের মুখে হাঁসি ফুঁটান, আমাদের মুগ্ধ করতে থাকুন আপনার কাভার ড্রাইভের জাদুতে!
দ্যা ড্যাশিং ওপেনার, দেশসেরা ব্যাটসম্যান, একজন প্রেমিক পুরুষ, একজন আদর্শ বাবা, সর্বোপরি একজন যোদ্ধা।
শুভ জন্মদিন খান সাহেব ❤❤