মাশরাফিকে বলা হয় ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’; ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’ নামে সারাবিশ্বে পরিচিত শোয়েব আখতার। ডেল স্টেইন পরিচিত ‘দ্য স্টেইন গান’ নামে। কিন্তু দ্য বিঙ্গা; এই নামটি আবার কার? উত্তরে আপনি যাকে খুঁজে পাবেন সে তো ছিলেন বাইশ গজের অদম্য এক লড়াকু স্বপ্নবাজ; শতভাগ ফিট না হয়েও ১৩ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে যাওয়া এক দুঃসাহসিক এক বোলার; নাম ব্রেট লি।
বড় ভাইয়ের সংস্পর্শে ক্রিকেটের পথচলা শুরু; সেই ছোট্টবেলা থেকেই বলের প্রতি যেনো একটা মায়া জন্মেছিলো ব্রেট লির! সেই থেকেই সাড়ে পাঁচ আউন্সের বলটিকে যেনো নিজের স্বপ্নের টার্গেট বানিয়েছিলেন তিনি। বড় ভাইকে বল করেই বড় হতে থাকে লি! সময় গড়াতে থাকে, ঘড়ির কাঁটা জানান দেয় আগমনী বার্তা। ব্রেট লি এবার পৌঁছে যায় আট বছর বয়সে….
ততোদিনে ক্রিকেট নামক নেশাটা তাকে আঁকড়ে ধরেছিলো। ব্রেট লির সামনে সুযোগও হয়ে যায় প্রতিযোগীতামূল ক্রিকেটে বাইশ গজ মাতানোর। আট বছর বয়সে অনূর্ধ্ব-১০ দলের হয়ে সুযোগ পাওয়া ব্রেট লি সেদিন বিপক্ষের ব্যাটারদের কান্নায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সেটিও বল হাতে নিজের প্রথম কোনো প্রতিযোগীতামূলক ক্রিকেটে ছয় বলে ছয়টি উইকেট নিয়ে! যেখানে ছয়জনকেই করেছিলেন বোল্ড! কি দুরন্ত, কি দুর্দান্তই না ছিলেন সেই ছোট্ট ব্রেট লি।
সময় কেটে যায়; ব্রেট লি বড় হতে থাকে। বয়সটা এবার বেড়েছে। ততোদিনে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটেও ব্রেট লি নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেছে। আকাশে লক্ষ্য তারার মাঝে কখনও কখনও একটি তারার দিকেই যেমন লক্ষ্য করা হয় তেমনি ব্রেটলিও যেনো ঐ একটা তারা হয়ে হাজির হয়েছিলেন। বয়সটা ২৩ এর ঘরে। ব্রেট লি গায়ে জড়িয়েছেন স্বপ্নের জার্সি; স্বপ্নের ব্যাগি গ্রিন! কি অসাধারণ এক মূহুর্ত; যেটি এতোদিনের স্বপ্ন ছিলো সেটি এখন বাস্তবে ধরা দিয়েছে। ব্রেট লি তখনও যেনো একটু খানি অপেক্ষায়.. অপেক্ষায় বাইশ গজে বল হাতে ঝড় তুলবার। এমসিজিতে বক্সিং ডে টেস্টেই অভিষিক্ত ব্রেট লি তুলেছিলেন ঝড়; গতির ঝড়। সেই কি এক তুখোড় ঝড়! যেই ঝড়ের শুরুটা হয়েছিলো ভারতীয় ওপেনার রমেশকে দিয়েই। এরপর একে একে চার ব্যাটারকে সাজঘরের পথ দেখানো ব্রেট লি মেতেছিলো উল্লাসে; সে এক রোমাঞ্চকর উল্লাস।
এইতো শুরু…এর পরের গল্পে ব্রেট লি নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন; ইনজুরিকে সঙ্গী করে লড়াই করেছেন। নয় বছর বয়সে দেখা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। তবুও ব্রেট লি যেনো কিছুই করেননি।
এবার ২০০৩ বিশ্বকাপ; ব্রেট লি প্রথমবারের মতো বিশ্বমঞ্চে। তাই বলে নিজের প্রথম বিশ্বকাপেই বাজিমাৎ করতে হবে তাকে? ব্রেট লি যে এমনি, যিনি মানেনি কোনো বাঁধা, করেনি কারো তোয়াক্কা! ব্রেট লি চলছে নিজের মতো, বাইশ গজে চালিয়েছেন তাণ্ডবলীলা। ভারতের বিপক্ষে ৩ উইকেট শিকারী ব্রেট লি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পকেটে পুড়েছিলেন পাঁচ উইকেট। তবুও ক্ষান্ত হননি; এবার কেনিয়ার বিপক্ষে ইতিহাস লিখে ফেললেন তিনি। সময়টা ১৫-ই মার্চ ২০০৩ সাল; কেনিয়ার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে বসেছিলেন ব্রেট লি। যেখানে প্রথম বলটি ব্যাটারের কনুইয়ে আঘাত করেও রেহায় পাননি তিনি। বলের গতি এতোটাই ছিলো যে উপড়ে গিয়েছিলো স্ট্যাম্প! পরের দু’টি বল যেনো বুলেট; হ্যাটট্রিক বলটি ছিলো ১৫৫.৫ কিলোমিটার বেগের। দুর্দান্তই বটে।
এরপরের গল্পটা যে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার; নয় বছর বয়সে বাবা মাকে বলা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার। সময়টা ২০০৫ সাল; প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। এবার বল হাতে ব্রেট লি ছুড়লেন বুলেট; ১৬০.৮ কিলোমিটার গতির বুলেট! এবার ব্রেটলি ফিরে গেলেন নয় বছর বয়সে। যেখানে তিনি বাবা মাকে বলেছিলেন, একদিন অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে মাঠে নেমে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে বল করবেন তিনি!’ ব্রেট লি ঠিকই পেরেছে; কেননা ব্রেট লিকে পারতেই হতো। স্বপ্নবাজরা তো সঠিক স্বপ্নই দেখে!
বিশ্বকাপ মানেই যেনো ব্রেট লির হ্যাটট্রিক; কি অবাক হচ্ছেন? আসলে অবাক হওয়ার যে কিছুই নেই। ২০০৩ সালে নিজের প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিকের দেখা পাওয়া ব্রেট লি ২০০৭ টি-২০ বিশ্বকাপে এসে করেছিলেন হ্যাটট্রিক; যেটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তো প্রথম বটেই, আন্তর্জাতিক টি-২০ ক্রিকেটেও প্রথম হ্যাটট্রিকের রেকর্ড। যেটার সাক্ষী হয়ে আছেন বাংলাদেশের সাকিব, মাশরাফি ও অলক কাপালী। আহ ব্রেট লি; অসাধারণ।
ব্রেট লি যেনো এক যোদ্ধা; লড়াকু স্বপ্নবাজ। যদি তাই না হতো তাহলে ছয় ছয়বার ছুরির নিচে গিয়েও বাইশ গজে ফেরার তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে না। সরিয়ে ফেলতেন না পায়ের পেছনের দিকের বাড়তি অংশ। ব্রেট থেমে যেতেন; এলোমেলো শরীর নিয়ে ছুটটেন না বাইশ গজে। কিন্তু ব্রেট লি যে অদম্য; ব্রেট লি যে এক লড়াকু মানুষ। তিনিও তো রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষ।

(Photo by Matthew Lewis/Getty Images)
ব্রেটলির সাফল্যের গল্পটা বিশাল; ইয়েবড়ো। কিন্তু ব্রেট লি সাধারণ; বড্ড সাধারণ। ব্রেট লি লড়াকু, ব্রেট লি গতির ঝড় তোলা এক বোলার। এই ব্রেট লি বল হাতে অজিদের দিয়েছেন সেরাটা। কখনোবা ব্যাট হাতেও ছিলেন দলের কান্ডারী। ব্রেটলির ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে যা পাওয়া যায় সেগুলোর কিছু স্মৃতি দিয়েই যে মহাকাব্য লেখা সম্ভব। রক্তাক্ত শরীর নিয়েও বাইশ গজে ছুটে চলা, অদম্য মনোবল ছাড়া কি সম্ভব? কখনোই না।
এভাবেই কেটে যায় সময়; ব্রেট লিও পৌঁছে যান ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে। যেখানে নামের পাশে যুক্ত করেন ঠিক ৭১৮ আন্তর্জাতিক উইকেট; পৌঁছে যান কিংবদন্তিদের কাতারে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বললেও ছাড়তে পারেননি তখনও ক্রিকেটের মায়া। খেলে চলছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেট। মাতিয়েছেন আইপিএল; ২০১৫ সালে যখন ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শেস ম্যাচটি খেলতে নেমেছিলেন ব্রেট লি তখন তার বয়স ঠিক ৩৯ বছর। দল শিরোপার দৌড়ে…শেষ ওভারে দলকে বাঁচানোর দায়িত্ব ব্রেটলির কাঁধেই উঠেছিলো। সেদিন রোমাঞ্চ জাগিয়েও ব্রেট লি পারেনি দলকে জয় অনে দিতে, তবে জয় করেছিলেন কোটি ভক্তের মন। জায়গা নিয়েছিলেন হৃদয়মাঝে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭১৮ উইকেট শিকারী ব্রেট লি ছিলেন গতি তারকার একজন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ছিলেন উজ্জ্বল নাম। পকেটে পুড়েছেন প্রায় এক হাজার উইকেট। দিনশেষে এইসব কিছু ব্রেট লিকে নিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। তবুও দিনশেষে ব্রেট লির ভক্তরা চেয়ে থাকে ঐ একটি ট্রেডমার্ক উদযাপন দেখবে বলে!

(Photo by Hamish Blair/Getty Images)
এখানেই শেষ করতে পারতাম কিন্তু একটা কথা যে বলতেই পারলাম না। বোলার ব্রেটলি যে ব্যাট হাতেও কম ছিলেন না সেটির প্রমাণও রেখেছেন তিনি। স্লগ ওভারে ব্রেট লি যে বিপক্ষের বোলারদের গলার কাঁটা হয়ে ছিলেন সেটি বলতেই হয়। তকমাও পেয়েছিলেন ‘স্লগার’ ব্রেট লির। ১২ তে ক্রিকেটের মায়া ছাড়লেও ব্রেট লি এখনো ধারাভাষ্যকার কক্ষে গলার স্বরে মাতিয়ে রাখেন। গতি কিংবা স্লগের সেই পুরোনো অতিত মনে করিয়ে দেয়। ব্রেট লি যেনো এখনো খেলে চলছেন ভক্তদের চোখের আড়ালে।
জন্মদিনে শুভেচ্ছা দ্য বিঙ্গা এক্সপ্রেস!