১৩ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
আজকের সর্বশেষ সবখবর

একজন মতিন সাহেবের গল্প

প্রতিবেদক
Arfin Rupok
শনিবার, ৩০ মে , ২০২০ ৬:১২

ক্রিকেটের প্রতি নেশাটা তখন সবে মাত্র জাগতে শুরু করেছে। ক্রিকেট কি তখনো ভালো ভাবে বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু, বাংলাদেশের খেলা হলে কেমন জানি বাড়তি একটা আগ্রহ জমতো। কি আর করার? স্কুল ফাঁকি দিয়ে খেলা দেখার মজাটা যে একদম অন্যরকম। অনেক বেশী মজার।

সময়টা ২০১৪ সালের দিকের। বাংলাদেশের খেলা, যে করেই হোক ম্যাচটি দেখতে হবে। সকাল সকাল রওনা দিলাম স্কুলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিলো যে করেই হোক স্কুল পালাতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ! বাংলাদেশের খেলা দেখার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম মতিন মামার চায়ের দোকানে।

বাংলাদেশের খেলা হলে সাধারণত মতিন মামার দোকানেই লাইভ দেখা হয়। কিন্তু সেদিনের অভিজ্ঞতা একটু বেশীই ইন্টারেস্টিং ছিলো। খেলা শুরু হবে ১২ টায়, মোটামুটি ২ ঘন্টা কিভাবে কাটাবো, এইসব ভাবতে ভাবতেই পিছন থেকে এক চাচা এসে কাঁধ চাপড়ে পাশে এসে বসলেন। কৌতুহলী হলাম, আবার ভয়ও পেলাম।

কিন্তু… ভয়টি বেশীক্ষণ স্হায়ী হলো না। চাচা আমাকে জিজ্ঞেসা করলো বাংলাদেশের প্রথম সুপার স্টার কে? আমি উত্তর দিতে পারলাম না। কারণটা অজানা নয়, সেই সময় বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলো না আমার। এবার চাচা এক কাপ চা হাতে নিয়ে আমাকে একটা সুপার স্টারের গল্প শোনাতে লাগলো।আসুন গল্পটা শুনতে থাকি।

সময়টা ১৯৮৪ সাল, বাংলাদেশ তখনো ক্রিকেট বিশ্বের কাছে অপরিচিত এক নাম। সেই সময় ঢাকায় জন্ম নেয় এক শিশু। বাবা মা তাকে আদর করে মতিন বলে ডাকে। মতিন মামার দোকানে বসে আরেক মতিনের গল্প শোনার মজাটা তখনো সেভাবে পেতে শুরু করিনি। চাচার মুখে মতিন নামটি শুনে মনে করতে চেষ্টা করলাম বাংলাদেশ দলে এই নামে কোনো ক্রিকেটার খেলেন কি না! কিন্তু উত্তরটা পেলাম না। এরপর চাচার থেকে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিলাম।

অনেকটা সময় পার হয়ে গেলো। চাচা মতিনের সম্পর্কে আরো অনেক কিছু বলতে থাকলেন। শুরুতে বললো উঠে আসার গল্প! এই মতিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা হয়েছিলো রুপকথার মতো। বাংলাদেশ তখন বিশ্বের সামনে অনেকটা অচেনা একটি দল৷ সেই দলের হয়ে অভিষেক হয়ে গেলো ছোট্ট মতিনের। সময়ের সাথে সাথে তিনি উঠে উঠেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সুপার স্টার। খুব অল্প সময়েই মন জয় করে নিয়েছিলো এদেশের হাজারো ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়ে। কিন্তু দিন শেষে ভক্তদের আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি মতিন!

১২ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে নামের পাশে যুক্ত করেছেন অসংখ্য রেকর্ড, সাক্ষী হয়ে আছেন অনেক স্মরণীয় জয়ের। কতো স্মৃতি লুকিয়ে আছে ২২ গজে, কতো কাব্য রচনা হয়েছে মতিনের ব্যাটে, কতো ইতিহাসের নায়ক বনে গেছেন তিনি। যেখানে আজ নামের পাশে যুক্ত হতো শতশত রেকর্ড, নিজেকে নিয়ে যেতেন সেরাদের কাতারে, কিন্তু আফসোস! সামান্য ভুলে শেষ হয়েছে মতিনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। শেষ হয়ে ১২ বছরের লম্বা পথচলা।

এইসবের পর চাচা আমাকে জিজ্ঞেস করলো, প্লেয়ারটি কে? আমি অনেক সময় থেকে ভাবার পরেও উত্তরটা পেলাম না। এরপর চাচা আমাকে আরো কিছুু গল্প শোনালো। বলতে থাকলেন, এই মতিনের হাত ধরে এসেছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম জয়, জড়িয়ে আছেন কার্ডিফ স্মৃতিতে, আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে জয়ের সাক্ষী হয়ে আছেন তিনি৷ নামের পাশে রয়েছে আন্তর্জাতিক তিন ফরম্যাটেই দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড! টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে রয়েছে সেঞ্চুরির রেকর্ড। এবার বলো প্লেয়ারটি কে?

কিছুক্ষণ ভাবার পর এবার অনেকটা ধারণা পেয়ে গেলাম। চাচাকে উত্তর দিলাম এটা মোহাম্মদ আশরাফুল হবে! চাচা কাঁধ চাপড়ে বললেন হ্যা, আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটের আশার ফুল হয়ে আশা আশরাফুলের কথায় তোমাকে বলছি। মিস্টার ৯৮ এ রচিত হয়েছে অনেক ইতিহাস, কিন্তু ১২ বছরের ক্যারিয়ারের শেষটা হয়েছে একবারে খলনায়কের চরিত্রে! ফিক্সিং ইস্যুতে হারিয়ে ফেলেছেন নিজেকে। কিন্তু এর আগেই জয় করেছিলো কোটি ভক্তের মন।

গল্পটা শেষ হতেই বাংলাদেশের খেলা শুরু হয়ে গেলো। হঠাৎ স্কোরের দিকে তাকিয়ে দেখি ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের ছন্দপতন। তখনি পাশ থেকে চাচা বলে উঠলেন আজ যদি মতিন ছেলেটা থাকতো! তাহলে বাংলাদেশ আরো অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতো।

চাচার মুখে এইসব শোনার পর আমার মতিনের সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে গেলো। কিন্তু তাকে নিয়ে বিস্তারিত কিভাবে জানবো? এভাবে কেটে গেলো প্রায় ২ বছর। তখন আমি ক্রিকেট বিষয়ে কিছুটা হলেও বুঝতে শিখেছি। চেষ্টা করতে থাকলাম একজন মতিনকে জানার। অবশ্য আমি এক্ষেত্রে সফল, আমি পেরেছিলাম একজন আশার ফুলকে জানতে। আসুন সেই আশার ফুলের কিছু স্মরণীয় স্মৃতি দেখে নেওয়া যাক:

সর্বকনিষ্ঠিয়ান সেঞ্চুরিয়ান:
বাংলাদেশ ক্রিকেটের আশার ফুল হয়ে আসা এই ক্রিকেটার খুব সহজেই মন কেড়ে নেন ভক্তদের। টানা অফ ফর্মেও পরেও তাকে নিয়ে সবাই দেখতো আশার আলো। নিজের দিনে যেকোনো বোলারই হয়ে যায় দিশেহারা। সেদিনও হয়েছিলো তাই। নিজের অভিষেক টেস্টে শক্তিশালী শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান মোস্তাক মোহাম্মদ ১৭ বছর ৭৮ দিনে করা সেঞ্চুরির রেকর্ডটি ১৭ বছর ৬১ দিনেই নিজের করে নেন মতিন। সেদিন ১১৪ রানের ঝলমলে ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন ভক্তদের।

ভারতের বিপক্ষে বীরত্ব গাঁথা ইনিংস:
সময়টা ২০০৪ সাল, প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ভারত। পাঠান, জহির খান, হরভজন সিংদের মতো বিশ্বসেরা বোলারদের বিপক্ষে ২২ গজে ব্যাট হাতে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। সেদিন নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে খেলেছিলেন ১৫৮* রানের অপরাজিত এই ইনিংস! এমন তরুণ বয়সে জহির খান, পাঠানদের মতো বোলারদের তুলোধুনো করে এমন ব্যাটিং যে সত্যিই মনোমুগ্ধকর।

অস্ট্রেলিয়া বধের নায়ক:
মনে পড়ে কার্ডিফ স্মৃতি? হ্যা, মনে পড়ারই কথা। কারন সেদিন রচিত হয়েছিলো ইতিহাস, নায়ক বনে গিয়েছিলেন আশার ফুল হয়ে আসা মতিন সাহেব! অস্ট্রেলিয়া দেওয়া ২৫০ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে শক্তিশালী বোলিং লাইনআপের বিপক্ষে খেলেছিলেন ১০০ রানের ম্যাচ উইনিং ইনিংস! যা তাকে আলোচনায় নিয়ে আসতে বাধ্য করে।

এমন অনেক স্মৃতি লুকিয়ে আছে অ্যাশের নামের পাশে। সবটা তো বলে শেষ করা সম্ভব নয়। তবে একটা দিক দিয়ে আশরাফুলকে অনেে ভাগ্যবান বলায় যায়! কেননা প্রায় ১২ বছরের লম্বা ক্যারিয়ারে ওয়ানডেতে ২২.২৩ গড় আর টেস্টে ২৪.১ গড়ে রান করে যাওয়ার পরেও তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম সুপার স্টার তকমা। বাজে ফর্ম তাকে খুব বেশী আলোচনায় নিয়ে আসেনি, তবে নিজের দিনে যেকোনো পরিস্থিতিতে দলকে জেতানোর জন্যই অনেকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের প্রথম জয়ের ম্যাচে আশরাফুলের পারফরম্যান্স গুলো একনজরে দেখে নেওয়া যাক:

▪সময়টা ২০০৪ সাল, প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাত্র ৩২ বলে ৫১* রানের ম্যাচ উইনিং ইনিংস উপহার দিয়ে দলকে এনে দিয়েছিলো জিম্বাবুয়ে বিপক্ষে প্রথম জয়ের স্বাদ।

▪কার্ডিফ জয়! প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার বোলারের গুড়িয়ে দিয়ে খেলেছিলেন ১০০ রানে ম্যাচ উইনিং ইনিংস, সাথে লাল-সবুজের দেশকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম জয় এনে দিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।

▪২০০৬ সালের ঘটনা, শক্তিশালী শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশ পেলো প্রথম জয়ের দেখা। অ্যাশ উপহার দিলেন ৫১ রানের ইনিংস!

▪কানাডার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়ে ম্যাচে লাল-সবুজের জার্সিতে খেলেছিলেন ৬০ রানের মূল্যবান একটা ইনিংস।

▪বিশ্বমঞ্চে আফ্রিকা বধ! প্রথম বারের মতো বড় আসরে আফ্রিকাকে হারিয়ে ইতিহাস রচনা করলো টাইগাররা। আশরাফুল খেললেন এবং হলেন ম্যাচসেরা। উপহার দিয়েছিলেন ৮৭ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস।

▪২০০৭ সাল, প্রতিপক্ষ টি-২০ রাজা খ্যাত ওয়েষ্ট ইন্ডিজ! সেদিন ব্যাট হাতে ৬১ রানের ইনিংসের সাথে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিলো ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে প্রথম টি-২০ জয়ের স্বাদ!

▪২০০৮ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয়ের ম্যাচে খেলেছিলেন ৬৪* রানের ইনিংস!

▪একই বছর তথা ২০০৮ এ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয়ের ম্যাচে ব্যাট হাতে উপহার দিয়েছিলেন ৬০* রানের ম্যাচ উইনিং ইনিংস।

▪২০০৯ সালে আরব আমিরাতে বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে দেশকে এনে দিয়েছিলো আমিরাতের বিপক্ষে প্রথম জয়ের স্বাদ।

এছাড়াও অনেক জয়ী ম্যাচের সাক্ষী হয়ে আছেন আশরাফুল। রয়েছেন কোটি ভক্তের হৃদয় মাঝে। আশরাফুল যে দেশের ক্রিকেটের প্রথম ভালোবাসা, তাকে কি সহজে ভুলতে পারে ক্রিকেটপ্রেমীরা? হয়তো পারেনা।

এই আশরাফুল দেশের পক্ষে অনেক রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন, জায়গা করে নিয়েছেন রেকর্ড পাতায়। নামের পাশে যুক্ত করেছেন সর্বকনিষ্ঠিয়ান টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান তকমা। রয়েছে দেশের পক্ষে তিন ফরম্যাটেই দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড।

▪টেস্টে ২৬ বলে ফিফটি প্রতিপক্ষ ভারত, ২০০৭ সাল।
▪ওয়ানডে ক্রিকেটে ২১ বলে ফিফটি, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ২০০৫ সাল।
▪টি-২০ তে ২০ বলে ফিফটি, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ২০০৭ সাল।

ব্যাটের পাশাপাশি বল হাতেও নিজেকে চিনিয়েছেন বহুবার। নামের পাশে যুক্ত করেছেন কিছু নামীদামী উইকেট। দিনশেষে আশরাফুলকে নিয়ে বলতে গেলে লিখতে হবে মহাকাব্য! কিন্তু এই মহাকাব্যের একটা জায়গায় শূন্য রয়ে যাবে তাইতো শেষ করেও শেষ করা যায়না আশরাফুলে কাব্যগ্রন্থটি!

হয়তোবা আশরাফুল আজ হতে পারতো দেশের পক্ষে সর্ব্বোচ রানসংগ্রাহক, হতে পারতো দেশের পক্ষে সর্ব্বোচ সেঞ্চুরিয়ান, হতে পারত অনেক ম্যাচ জয়ের নায়ক, হয়তে পারতো একজন সফল ক্রিকেটার। যাকে নিয়ে গর্ব করতো বাংলাদেশ।

কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি, বিপিএলে ফিক্সিং করে যেতে হয়েছে নিষেধাজ্ঞায়। ভক্তদের চোখে বনে গেছেন খলনায়ক। তবে আর যাই হোক, একজন আশরাফুলকে এখনো মিস করে এদেশের হাজারো ভক্ত।

ভালো থেকো আশার ফুল! তোমার আগামীর জন্য শুভকামনা।

মতামত জানান :