সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।বিকেল থেকেই মেঘেরা ছুটোছুটি করছে আকাশের বুকে।ধূসর কালো মেঘে ছেয়ে গেছে পুরো আকাশ।ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে।চারিদিকে গভীর অন্ধকার নেমে আসছে।ঝাঁক বেঁধে পাখির দল নীড়ে ফিরছে, উড়ে যাচ্ছে।সেই সাথে উড়ে যাচ্ছে কারো কারো স্বপ্ন,মিশে যাচ্ছে ঐ কালো বিষাদমাখা মেঘমালায়।
~
চৌদ্দ বছর আগের এক তপ্তরোদ মাখা দুপুরে স্কুলের মাঠে আন্তঃস্কুল ক্রিকেট টূর্ণামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ চলছে।চারদিকে তুমুল উত্তেজনা।স্কুলের রেজিস্টার হারুন সাহেব ভাষ্যকারের ভূমিকা পালন করছেন।উচ্চস্বরে গলা ফাঁটিয়ে বিরতিহীনভাবে কথা বলে যাচ্ছেন।অবশ্য ভাষ্যকারকে বিরতি নেওয়ার সুযোগই দেয়নি ইমতিয়াজ।একের পর এক কাভার ড্রাইভ,হুক,পুল,ফ্লিক সহ প্রায় সব ধরণের দূর্দান্ত সব শট খেলে সেদিন দলকে একা হাতেই জিতিয়েছিলো ইমতিয়াজ।স্কুল পড়ুয়া ছাত্রও এত ভালো ক্রিকেট খেলতে পারে! অনেকেরই জানা ছিলনা,অনেকেই হয়েছিলেন বিস্মৃত! চারদিকে প্রশংসা বাণীর ভীড়ে আলাদা করে সেদিন ক্রীড়া শিক্ষক তারেক স্যার ইমতিয়াজের পিঠ চাপড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন,’বড় হয়ে কি হতে চাসরে ব্যাটা’? ‘ইস বড় হয়ে যদি বুলবুল,আশরাফুল,মাশারাফিদের মত ক্রিকেটার হতে পারতাম স্যার’,বলেছিল ইমতিয়াজ।আমাদের শৈশবে শচীন,লারা,পন্টিংদের মাঝেও আলাদাভাবে বেঁচে থাকতো বুলবুল,আশরাফুল,মাশরাফিরা।যারা নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শিখিয়েছিলো আমাদের তরুনদের।
~
আজ চৌদ্দ বছর পর ইমতিয়াজ গ্র্যাজুয়েট বেকার হয়ে বসে আছে।আজ চৌদ্দ বছর পরেও ইমতিয়াজের সেই স্বপ্নগুলো পূরণ হয়নি।হওয়া হয়নি আশরাফুলদের মত ক্রিকেটার,গাঁয়ে জড়ানো হয়নি লালসবুজের জার্সি।ইমতিয়াজের স্বপ্ন গুলো পিষ্ট হয়েছে এই শহুরে পিচঢালা রাস্তায়।ইমতিয়াজের স্বপ্নগুলো আটকে গেছে মধ্যবিত্ত পরিবারের কড়া ট্যাকেলে,মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেদের স্বপ্নগুলো এভাবেই চাপা পড়ে যায় অভিভাবকদের চাপিয়ে সাইন্স,কমার্স কিংবা বিসিএস প্রস্তুতির পেটমোটা বইয়ের মাঝে।হতাশায় ডুবে থাকা ইমতিয়াজ তাই এখনো অন্ধকার ঘরে বসে মাঝেমাঝে বলে উঠে,চৌদ্দ বছর আগে বলা সেই কথা “ইশ বুলবুল,আশরাফুল,মাশরাফিদের মত ক্রিকেটার যদি হতে পারতাম”……..
♦দুই
চাকরি নেই।বেকারের ভিড়ে হাঁসফাস করছে শহরগুলো।রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো ধুঁকছে।কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে।একদিকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ অন্যদিকে প্রকৃতির রোষানোল থেকেও ছাড় পাচ্ছেনা কেউ।একপাশে পাহাড় ধ্বংস করছে রোহিঙ্গারা অন্যপাশে উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ শুরু হয়ে গেছে,খরা,অতিরিক্ত বন্যা পিছু ছাড়ছে না দেশের।কর্কটক্রান্তির দেশে সবুজাভ পরিবেশ ফিকে হয়ে আসছে রাজনৈতিক হিংস্রতার দাবানলে পুড়ে।
চারদিকে হাহাকার,অস্থিরতা,বিদ্বেষেভরা পরিবেশ থেকে একটুখানি দূরে থাকতে চায় ইমতিয়াজ।ইতিমধ্যে সে ফেসবুকে খুুঁজে পেয়েছে তার সমমনা কিছু মানুষদের গ্রুপ।যার নাম “ক্রিকেটখোর”।এখানকার মানুষরা ‘ডাল ভাতের সাথে ক্রিকেট খায়,টাইগারদের জন্য গলা ফাটায়’।এখানে ক্রিকেটের নানা দিক নিয়ে চলে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা,সমালোচনা।ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত মানুষজন এতটা ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারে দেখে অবাক হয় ইমতিয়াজ! এ যেন পরিবারের বাইরে আরেক পরিবার!
~
সপ্তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ক্রিকেটখোর গ্রুপে আয়োজন করা হয়েছে রাইটিং কম্পিটিশনের।সেখানে লিখতে হবে ১৯৭০ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে।একাত্তরের বীর যোদ্ধা জুয়েল,জয় বাংলা স্টিকার ওয়ালা ব্যাট নিয়ে খেলতে নামা সাহসী যুবক রকিবুলের বীরত্বগাঁথা,১৯৭৬ সালে প্রথমবার এমসিসির বাংলাদেশে খেলতে আসা,১৯৭৭ সালে আইসিসি ট্রফিতে খেলতে গিয়ে ফিজির বিপক্ষে প্রথম জয় পাওয়া,১৯৯৭ সালে কুয়ালালামপুরে আকরামদের গড়া ইতিহাস,প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে পরাশক্তি পাকিস্তান কে হারিয়ে দেওয়া- লিখার জন্য এইসব কতশত ঘটনা মনে যায় ইমতিয়াজের।কিন্তু ইমতিয়াজ লিখতে চায় বাবার হাত ধরে জীবনে প্রথমবার স্টেডিয়ামে গিয়ে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট ম্যাচ দেখার গল্প,লিখতে চায় বহুুবছর আগে বাবার কাছে শোনা বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পিছনের ইতিহাস,আরো লিখতে চায় টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার এত বছর পরেও বারবার মুখ থুবড়ে পড়ার করুণ উপাখ্যান।
♦তিন
লিখতে বসে ইমতিয়াজের স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে ওঠে সেই ২০০০ সালের ২৬শে জুন বিকেলের কথা।বাইরে হৈ-হুল্লোড় হচ্ছে,যুবক যুবতীরা রাস্তায় বের হয়ে রং মাখছে,আনন্দ মিছিল বের হয়েছে,পটকা আতশবাজি ফুটছে ভীষণরকম।হঠাৎ করে এই আনন্দ উৎসবের কারণ কি বুঝে উঠতে পারেনি পিচ্চি ইমতিয়াজ তাই দ্রুত বাবার কাছে গিয়ে জানতে চায় মানুষের এই আনন্দ উৎসবের কারণ সম্পর্কে।বাবা বলে বাংলাদেশ আজ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে গেছে তাই এত আনন্দ উৎসব।বুঝতে পারেনা ইমতিয়াজ তাই মাথা চুলকে আবারো জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা বাবা এই টেস্ট স্ট্যাটাসটা আবার কি? এটা পেলো কিভাবে”? গল্পপটু বাবা তখন খুলে বসেন তার গল্পের ঝাঁপি।আচ্ছা চলো তাহলে আজ তোমাকে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার গল্প শুনাই।
বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পিছনের ঘটনা দিয়ে রীতিমত থ্রিলার সিনেমা তৈরি করা যাবে।১৯৯৬ সালে বিসিবি সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সাবের হোসেন চৌধুরী প্রথম মিটিংয়েই টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার জন্য নিজের লক্ষ্যের কথা জানান।এ কথা রীতিমত হাস্যরসের খোরাক হয় সকলের জন্য।হবেই না কেন বাপু যে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেট বলে কিচ্ছু নেই,ওয়ানডে ক্রিকেটেইও ঠিকমত থিতু হতে পারেনি তারা কিনা স্বপ্ন দেখতে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার! এতো রীতিমত মামার বাড়ির আবদার!
~
১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটের গতিপথটাই পাল্টে দেয়।আকরাম খানের নৈপুন্যে কেনিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ পায় ওয়ানডে স্ট্যাটাস ও ১৯৯৯ বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ।ওই জয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক ক্রিকেট উন্মাদনা সৃষ্টি হয়।আইসিসি ট্রফির ফাইনালে ইউনির্ভাসিটি অব মালয়েশিয়ার বাংলাদেশী প্রবাসী ছাত্ররা হাজির হয়েছিল,’BANGLADESH,NEXT TEST PLAYING NATION’ লিখা বিশাল আকৃতির ব্যানার নিয়ে।সবাই হাসাহাসি করলেও সাবের হোসেন চৌধুরী তার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন।আইসিসি ট্রফি জিতে আসার সময় আইসিসির তৎকালীন সিইও ডেবিড রিচার্ডকে জানিয়ে আসেন,’We are going for test status’।
~
বাংলাদেশের পূর্বে তখন টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিল জিম্বাবুয়ে।জিম্বাবুয়ে তাদের টেস্ট স্ট্যাটাসের দাবিতে জানিয়ে ছিল, তিনটি আইসিসি ট্রফি জেতা এবং ১৯০৫ সালে শুরু হওয়া ঐতিহ্যবাহী ‘লগন ট্রফি’ নামের প্রথম শ্রেণীর লীগ থাকা সত্বেও টেস্ট স্ট্যাটাস না পেলে তাদের দেশে ক্রিকেটের জয়প্রিয়তা হ্রাস পাবে এমনকি কিছু ক্রিকেটার টেস্ট স্ট্যাটাস না থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যাচ্ছে।এরপরেই জিম্বাবুয়েকে টেস্ট স্ট্যাটাস দেওয়া হয়।জিম্বাবুয়ের তবুও বলার মত কিছু ছিলো বাংলাদেশের সেটাও ছিলোনা।বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর লীগ নেই,ঘরোয়া অবকাঠামো ঠিক নেই,ওয়ানডে ক্রিকেটেও আহামরি কিছু করেনি তাহলে তারা টেস্ট স্ট্যাটাসের দাবি করবে কিভাবে?
টেস্ট স্ট্যাটাস দাবি করার আগে তো কিছু করে নিতে হবে তাই ৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর বাংলাদেশের প্রথম লক্ষ্য ছিলো ঘরের মাটিতে কোন বড় টুর্ণামেন্ট আয়োজন করা।এটার প্রথম ধাপ হিসেবে ১৯৯৮ সালে স্বাধীনতা কাপ আয়োজন করা হয় স্বাধীনতার ২৫ বছর উপলক্ষ্যে।সেই টুর্ণামেন্টে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ,পাকিস্তান এবং ভারত।বেস্ট থ্রি ফাইনালে ভারত পাকিস্তান প্রথম দুই ফাইনালে এক বার করে জেতার পর ৩য় এবং চ্যাম্পিয়ন নির্ধারনী ফাইনালে ভারত জয় পায়।তারপর বাংলাদেশে আয়োজন করাহয় প্রথম আইসিসি নকআউট বা মিনি বিশ্বকাপ (যেটা বর্তমানে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি)।আট দলের সেই টুর্ণামেন্টে বাংলাদেশ খেলেনি, প্রথম আট দল খেলেছিলো।মূলত এই টুর্নামেন্ট প্রমান করে দেয় বাংলাদেশ পূর্ন মর্যাদা পাবার যোগ্যতা রাখে।মাঠভর্তি দর্শক খেলাটার আর্থিক বিষয়গুলা ফুটিয়ে তোলে। আইসিসির এই হোস্ট বানানোর সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য বিরাট এক আশীর্বাদ ছিলো, হোস্ট না হলে ক্রিকেটের জন্য বাংলাদেশ কতখানি উপযুক্ত সেটা বুঝতে হয়ত অনেক দেরি হয়ে যেত ক্রিকেটবিশ্বের।
~
১২-১৫ মার্চ ঢাকায় নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালে পাকিস্তান এবং শ্রীলংকার টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।ওই টেস্ট শেষে পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে একটা ওয়ানডে ম্যাচ খেলে।তারপর মে মাসে ভারত বাংলাদেশ এবং কেনিয়াকে নিয়ে একটা ট্রাই নেশন কাপ খেলে।এই টূর্ণামেন্টেই বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডেতে জয়লাভ করে কেনিয়াকে ৬ উইকেটে হারিয়ে।তারপরেও চার ম্যাচের তিন ম্যাচে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় বাংলাদেশ।১৯৯৯ বিশ্বকাপের আগে ঢাকায় আয়োজন করা হয় মেরিল কাপ। জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া এবং বাংলাদেশ অংশ নেয় এতে।বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বের চার ম্যাচই হেরে যায়।যদিও বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরীর দেখা মিলে এই টূর্ণামেন্টেই।এরপর ১৯৯৯ বিশ্বকাপ।সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তান ও স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে ক্রিকেটবিশ্বকে রীতিমত অবাক করে দেয় বাংলাদেশ।
~
মূলত ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মিনি বিশ্বকাপ চলাকালীন আইসিসি সভাপতি জাগমোহন ডালমিলার সাথে বৈঠকে সাবের চৌধুরী ও সৈয়দ আশরাফুল হক তাকে বুঝাতে সক্ষম হোন বাংলাদেশের ক্রিকেট ক্রেজ সম্পর্কে।বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেলে এদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে সাথে আইসিসির ব্যবসায়িক ক্ষেত্রও বৃদ্ধি পাবে।৯৯’বিশ্বকাপে ভালো পার্ফমেন্সের পর সাবের চৌধুুরী ডালমিয়াকে অনুুরোধ করেন ভোটাভুটি আয়োজনের।ডালমিয়া সাবেরকে বলেন,’এই মূহুর্তে ভোট হলে তোমরা বড়জোর ভারত,পাকিস্তান,শ্রীলংকার ভোট পেতে পারো কিন্তু টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে ভোট লাগবে ৭ টি।তাই যেভাবেই হোক আগে দক্ষিণ আফ্রিকা,অস্ট্রেলিয়াকে রাজি করাও’।
~
এরপর ডালমিয়ার পরামর্শ মতো সাবের চৌধুরী বিভিন্ন বোর্ডের সাথে আলোচনা করতে থাকেন।১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের কোচ কাম ডিরেক্টর হয়ে আসেন দক্ষিণ আফ্রিকান এডি বারলো।এডি বারলোর সহযোগীতায় দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি আলি বুখারকে রাজি করানো হয়।বিসিবি সভাপতি নিজে দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্টেলিয়া সফর করেন ভোট দেওয়ার জন্য রাজি করাতে।এছাড়া নিউজিল্যান্ড বোর্ডকে আগেই রাজি করানো হয়েছিল ১৯৯৮ সালে তাদের দেশে ফার্স্ট ডিভিশন ক্রিকেট খেলতে জাতীয় দলের সফরের সময়।১৯৯৯ সালে ওয়েস্টইন্ডিজ দলে ভারত সফরের প্রস্তুতি হিসেবে কিছু আনঅফিসিয়াল ম্যাচ খেলে বাংলাদেশে। একটা ম্যাচে এনামুল হক মনি পাঁচ উইকেট নেন।সেসময় ইয়ান বিশপ মন্তব্য করেন বাংলাদেশ টেস্ট খেলার যোগ্য। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইয়ান বিশপকে বলা হয় তিনি যেন ফিরে গিয়ে ওয়েস্ট বোর্ডের প্রধান প্যাট রসুকে অনুরোধ করেন বাংলাদেশের পাশে থাকার।বিশপ কথা রেখেছিলেন। আর জিম্বাবুয়ের প্রধান পিটার চিকোগাকে রাজি করানো হয় মেরিল কাপ চলার সময়।
এছাড়াও আইসিসির মিটিংয়ের আগেরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে ফোন দিয়ে অনুরোধ করেন বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য।২০০০ সালের ২৬শে জুন আইসিসির মিটিংয়ে বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন ৪৫মিনিট সময় নিয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করেন ও নানা প্রশ্নের জবাব।এরপর চূড়ান্ত ভোটের প্রস্তাব দেন আইসিসি সভাপতি জাগমোহন ডালমিয়া।বাংলাদেশ আশা করেছিলো চূড়ান্ত ভোটে সাতটি ভোট পাওয়ার কিন্তু আকস্মিকভাবে সবগুলো ভোটই পেয়ে যায় বাংলাদেশ।আর তখনই নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি।সূচনা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন দিগন্তের।
♦চার
২০০০ সালের ২৬শে জুন টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে,টেমস নদীতে বহু জল গড়িয়েছে,বুড়িগঙ্গার পানি হয়েছে আরো বেশি দূষিত,ঢাকার বুকে দাঁড়িয়ে গেছে দৈত্যকার সব ফ্লাইওভার,সেই সময়ে বাবার কাছে টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার গল্প শোনা পিচ্চি ছেলে ইমতিয়াজ এখন পরিপক্ব যুবক যে কিনা বেকারত্ব গোঁছাতে জীবন যুদ্ধে লিপ্ত।বিশ বছরের লম্বা এই সময়ে কতকিছু বদলে গেছে! বদলায়নি শুধু বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের চিত্র।সেই শুরুর দিন যেমন ছিলো আজ বিশ বছর পরেও একই ছন্নছাড়া বেহালদশা।ইমতিয়াজ তাই মাঝেমাঝে আক্ষেপ করে শূণ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে তবে কি ভুল সময়ে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিল বাংলাদেশ? অপরিণত অবস্থায় টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েই কি বিগড়ে গেলো দেশের টেস্ট ক্রিকেট? লবিংয়ের জোরে অতি সস্তায় টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়ে কি আমরা ক্রিকেটের রাজকীয় ফরম্যাটের মূল্যটাই বুঝলাম না! এই সবের দায় কার? প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলেনা।অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর মিলানের জন্য রকেট সাইন্স জানতে হয়না।চোখ কান খোলা রাখলেই বুঝা যায় সব।
ইমতিয়াজও তাই বুঝতে পারে টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার এত বছর পরেও টেস্ট ক্রিকেটে থিতু হতে না পারা,এত বছরেও ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নতি করতে না পারা,ঘরোয়া ক্রিকেটকে দূর্নীতির আখড়া বানানো এইসব কিছুর দায় একমাত্র বিসিবির।
একদা জীবনানন্দ লিখেছিলেন, “নারীর হৃদয়, প্রেম-শিশু, গৃহ নয় সবখানি অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়। আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে।আমাদের ক্লান্ত, ক্লান্ত করে”।
কি ছিল জীবনানান্দের জীবনের সেই বিপন্ন বিস্ময়? যা নারীর হৃদয়, অর্থ, কীর্তি কেও উপেক্ষা করে মানব হৃদয় কে ক্লান্ত করে তা আমাদের জানা নেই।তবে আমাদের ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকদের ক্লান্ত হওয়ার কারণটা আমরা জানি।আমাদের রক্তে মিশে গেছে যে ক্রিকেট সেই ক্রিকেটের ভগ্নদশা দেখতে দেখতে আমরা এখন ক্লান্ত।সত্যিই আমরা ক্রিকেটের এই ছন্নছাড়া ভগ্নদশা আর দেখতে চাইনা।জীবনানন্দ সেই শতবছর আগেই প্রশ্ন রেখে গেছেন,”মানুষটা মরে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি কেউ দেয়__বিনি দামে__তবে কার লাভ”? মানুষ মরে যাওয়ার আগেই যেমন ওষুধ সেবন করিয়ে প্রতিকার করতে হয় তেমনি ক্রিকেটের এই দূর্বস্থা থেকে বের করার জন্য ক্রিকেটকে করতে হবে দূর্নীতিমুক্ত,তৃণমূল থেকে তুলে আনতে হবে প্রতিভা,ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামোকে করতে হবে উন্নত।কিন্তু এইসব যাদের করার কথা সেই বিসিবির কি হুঁশ আছে আদৌ?
একদিন নিশ্চয়ই হুঁশ ফিরবে বিসিবির।’দিনেদিনে বাড়িয়াছে বহু দেনা,শুধিতে হইবে ঋণ’ – এসিরুমে আরাম কেদারায় বসে বিলাস যাপন করা বিসিবির কর্তাব্যক্তিদের অবশ্যই একদিন সব হিসাব চুকাতে হবে।অন্ধকারচ্ছন্ন কালো মেঘ কেঁটে গিয়ে একদিন নিশ্চয়ই নতুন ভোরের ঊষার আলোয় উদ্ভাসিত হবে আমাদের ক্রিকেটাঙ্গন।সেই দিনের জন্য আঙ্গুলের কড় গুনে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে আমাদের মত সাধারণ ক্রিকেট দর্শকদের! চলুন তাহলে শুরু করি আঙ্গুলের কড় গোনা………
এইতো ভালো দিন এলো বলে!