এইটা এমন কি বোর্ড? যে বোর্ডে নাম লেখানোর জন্য এত্তো স্বপ্ন লালন করে ক্রিকেটাররা? কি এমন আছে এই বোর্ডে? এই প্রশ্নগুলোই মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো তামিম ইকবাল খানের। তাই হয়তো তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন অর্ধশতক করলে এই বোর্ডে নাম লেখা হয়না? এটেন্ড্যান্টের সাফ জওয়াব না! এখানে শুধুমাত্র যারা শতক ও ৫ উইকেট পায় তাদের নাম লেখা হয়। তামিম দীর্ঘশ্বাসের সহিত উত্তর দিলেন আচ্ছা!
কারো কাছে ক্রিকেটের “তীর্থভূমি কিংবা কারো কাছে ক্রিকেটর ‘মক্কাখ্যাত’ কিংবা ‘বাইবেলখ্যাত’ লর্ডস “! সেই ১৮৮৪ সালে লর্ডসের প্রথম যাত্রা, আজও প্রতি প্লেয়ারদের স্বপ্নের খোরাক সেই ‘লর্ডস’! প্রতিটি প্লেয়ার চায় এখানে এসে নিজের জাত চেনাতে! নিজেকে মূর্তি হিসেবে রাখুক, ইতিহাসের বুকে তাকে স্মরণ করুক। তাই হয়তোবা এতো বেশি মর্যাদা এই লর্ডসের।
লর্ডস হতে লাখো কিলোমিটার দূরে থেকেও তামিম স্বপ্ন দেখছিল ঐ বোর্ডে নাম লিখানোর। কেনই-বা-নয়, বড় ভাই নাফিস যে সে টকবগে যুবককে বলেছিল- এখানে একটা বোর্ড আছে, যেখানে ক্রিকেট রতী-মহারথীদের নাম চকচক করে। ব্যাস, ছেলেটা পণ করে বসে আমিও এখানে নাম লেখাবো। আমিও ইতিহাস হয়ে থাকবো লর্ডসের ওই অনার্স বোর্ডে। আমাকেও মানুষ আজ থেকে পাঁচশো বছর পর স্মরণ করবে।
ক্রিকেটের এই তীর্থভূমির সাথে টিম টাইগার্সের প্রথম পরিচয় ২০০৫ সালে। ক্রিকেটের সবচেয়ে আদিম ফর্মেটে খেলতে নেমে কোনো ক্রিকেটারের ইনিংসই সেইদিন অর্ধশতক পেরুতে পারেনি। বোলিংটাও ছিল আরও হতাশার। এরপর আর এইখানে নামার সুযোগ হয়নি বাংলাদেশের।
এর ঠিক ৫ বছর পর আসে দ্বিতীয় সুযোগ। উপরে বলেছিলাম স্বপ্নে বিভ্রম এক যুবকের কথা, সে কিন্তু এইবার সুযোগ পেয়ে যায় লর্ডসে খেলার। তাকে যে এইবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতেই হবে। দেশের হয়ে যে আর কেউই এখানে এর আগে নাম লেখাতে পারেনি। এইবার তিনি আকাশের পানে সে স্বপ্নটা উড়িয়ে দিবে।
টস ভাগ্যে জিতে সাকিব বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়াই অপেক্ষাটা একটু বেড়েই গেলো ছেলেটার। ইংরেজরা দেড় দিন (১২৫ ওভার) ব্যাটিং করে সবকয়টি উইকেট হারিয়ে স্কোরবোর্ডে জমা করেন ৫০৫ রান। বল হাতে ২৮ ওভারে ৩ মেইডেনে ৯৮ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের হয়ে সর্বপ্রথম অনার্স বোর্ডে নাম লেখান পেসার শাহাদাত হোসেন রাজীব। এইবার সুযোগ এসেছে তামিম ইকবালের, স্বপ্নটা এইবার সত্যি করার পালা। একে তো অচেনা কন্ডিশন, তার উপর ফিন, অ্যান্ডারসন আর ব্রেসনানের মতো বোলিংদের মুখোমুখি তামিম ইকবাল। এদের তুলোধুনো করে মাত্র ৫৯ বলে ৭টি বাউন্ডারির সাহায্যে নিজের অর্ধশতক তুলে নেন তামিম। কিন্তু ইনিংস বড় করতে পারেননি, ৫৫ রানের মাথায় রানআউটে কাটা পড়ে হতাশাগ্রস্ত মন নিয়ে প্যাভিলিয়নের দিকে হাটতে থাকেন।
টপ অর্ডারের দূরন্ত সূচনার পরেও ফলোঅনে পড়ে বাংলাদেশ। আবারও ব্যাটিং করতে নামে বাংলাদেশ, ইনিংস ব্যবধানে হার কিন্তু তখন বাংলাদেশকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। শুরুতে তামিম ও কায়েস দেখেশুনে খেললেও স্টিভেন ফিনকে পেয়ে তামিমের আর তর সইলো না। ফিনকে হ্যাট্রিক বাউন্ডারি হাকিয়ে আবারও অর্ধশতক তুলে নিলেন খান সাহেব। এইবার কি করবেন তিনি? প্রথম ইনিংসে তো রানআউটে কাটা পড়েছিলেন, এইবারও কি তাই হবে? এইবারের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলো লর্ডসে কবে খেলার সুযোগ পাবো তা জানা নেই, আর পেলেও তখন অনার্স বোর্ডে নাম লেখাতে পারবো কিনা এইসব চিন্তা তখন খান সাহেবের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। তারপর সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে চোখ বন্ধ করে ইংরেজ বোলারদের উপর তলোয়ার চালানো শুরু করলেন তামিম।
অর্ধশতকের পর গ্রায়েম সোয়ানের এক ওভারে এক চার ও দুই ছক্কায় অডিয়েন্সদের বুঝতে দেরি হলোনা যে তামিম আজ আটকানোর জন্য মাঠে নামেননি। আজ যে সে বোর্ডে নিজের নাম লেখাবেই।
তাইতো তিনি ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন। স্বপ্ন থেকে খুব একটা দূরে নয় সে। তামিমের নামের পাশে তখন রান সংখ্যা ৮৭, এরপর ইতিহাস রচনা করতে সময় নেন মাত্র ৪ বল। হয়তো নার্ভাসনেস কাটানোর জন্যই তার এগ্রেসিভ হয়ে উঠা। টিম ব্রেসনানকে লং অন দিয়ে উড়িয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে উদযাপন করার সময় পিঠ দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেন ঐ এটেন্ড্যান্টকে-
” নাও, এবার আমার নাম লিখো “।
তামিমের এই ইনিংস বদলে দেয় বাংলাদেশের চিত্র। দেশীয় গণমাধ্যম তো বটেই, পরের দিন বড় বড় ইংলিশ পত্রিকাগুলোও মুখরিত ছিলো তামিম বন্দনায়। দেশের হয়ে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে করে ফেলেন “অনার্স পাশ”।
তামিমের এই শতকের পেছনে মজার একটা ব্যাপার আছে। আর তা হলো- এই লর্ডসে অনেক শতকই কিন্তু আছে, যার দরুন এইখানে অনেক রথী-মহারথীদের নামও লেখা আছে। তবে তামিমের মতো কিন্তু আর কেউই নেই। স্বয়ং ঐ এটেন্ড্যান্ট তামিমকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে- তুমিই প্রথম ক্রিকেটার, যে কিনা বলে কয়ে শতক করেছো।
এখনো সেই ইনিংস লর্ডসে ঝলমল করে, গৌরবের সে ইনিংস আজও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ঐ লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। এখনো ইংরেজ বোলারদের উপর স্টিম রোলার চালিয়ে যাওয়া তামিম ইকবালের শতক তাঁরা মনে রেখেছে।