(Photo by Hannah Peters/Getty Images)
মাউন্ট মঙ্গানুইতে বছরের শুরুটা ছিলো রোমাঞ্চকর। টস ভাগ্যে জয়ী টাইগার কাপ্তান বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে যে ভুল করেননি সেটি বোলাররা প্রমাণ করেছিলো ২১ তম বলেই। তরুণ শরিফুল ততক্ষণে উল্লাসে মত্ত, বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিলো স্বপ্নের মতোই। কিন্তু, পরের গল্পে ইয়ং-কনওয়ে বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো গলার কাঁটা। শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে কিউইরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলো ইয়ংয়ের ফিফটি ও কনওয়ের সেঞ্চুরির উদযাপনে। যেখানে বাংলাদেশের সামনে উঁকি দিচ্ছিলো আরও একটি হার; লজ্জাজনক হার!
কথায় আছে, “সবসময় যেটি ধারণা করা যায় সেটি ঘটে না, কখনো কখনো ধারণা ভুল প্রমান হয়!” হয়েছেও তাই। তরুণ শরিফুলের সাথে দুর্দান্ত ছিলেন এবাদতও। স্পিনার মিরাজের সাথে মুমিনুলও যেনো মেতেছিলেন উল্লাসে। ততক্ষণে কিউইরা অলআউট ৩২৮ রানেই।
SENA দেশগুলোর বিপক্ষে বাংদেশের অতীত যাচ্ছেতাই! কিউইদেশে টাইগারদের পুরোনো অতীতে প্রাপ্তির ঘর তখনও শূন্যে! ৩২৮ রানকে সামনে রেখে সাদমান-জয়ের সাবধানী শুরু। এটিকে চ্যালেঞ্জিংও বলা যায়। যেখানে বোল্ট, সাউদির সাথে জেমিসন ওয়াগনাদের বেশ ভালোভাবে মোকাবিলা করেছিলে দুই ওপেনার। দলীয় ৪৩ রানে সাদমান ফিরলেও দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে কিউইদের বিপক্ষে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের জুটি গড়ে জয়-শান্ত। অ্যাওয়ে সিরিজে শান্ত যেনো নিজেকে প্রমাণ করেই চলছিলেন বেশ। সেখানে জয়ও যেনো অ-১৯ এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কিউইদের মাটিতে প্রথম টাইগার ওপেনার হিসেবে মোকাবিলা করেন ২০০ বলের মাইলফলক!
দ্বিতীয় দিন শেষে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখেন জয় ও কাপ্তান মুমিনুল। তৃতীয় দিনের সকালটি জয়ের জন্য সুখকর ছিলোনা, ছিলোনা বাংলাদেশের জন্যও। এরমাঝে মুশফিকও ফিরেছিলেন অল্প রানেই। ততক্ষণে আবারও পিছিয়ে পড়ার শঙ্কায় বাংলাদেশ। সেই শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়েছেন ধারাবাহিকতা ধরে রাখা লিটন দাস, সাথে নিজের নামের পাশে চট্টগ্রাম স্পেশালিষ্ট তকমা বয়ে বেড়ানো মুমিনুলও হয়ে উঠেন দুর্দান্ত! দিনশেষে মুমিনুল – লিটন দু’জনই সেঞ্চুরির উদযাপনে মাতার আগেই একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরেছেন সাজঘরে..
এমন দিন এশিয়ার বাহিরে টাইগারদের এসেছিলো কখনো? হয়তো না! বলছি চতুর্থ দিনের কথা। সকালটা নিজেদের করে নিতে চেয়েছিলো মিরাজ – ইয়াসির। এমন লক্ষ্যে এগুচ্ছিলেনও বেশ। কিন্তু এগিয়ে নিতে পারেননি খুব একটা। তবে যেটুকু নিয়েছেন সেটিই বা কম কিসে? কিউইদেশে বোল্ট, জেমিসন, সাউদিদের বিপক্ষে এমন ব্যাটিং যে আপনাকে তৃপ্তি দিবে, মাতিয়ে তুলবে উন্মাদনে! এরমাঝে মিরাজ ফিরেছে একরাশ হতাশা নিয়ে, ততক্ষণে তৃতীয় বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে ১ হাজার রান ও ১০০ উইকেটের মাইলফলকে নিজের নামটি লিখেছিলেন নিশ্চয়ই। বাংলাদেশ এগিয়ে ১৩০ রানে.. এশিয়ার বাহিরে ম্যাচে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং করে এগিয়ে যাওয়ার ঘটনা টাইগারদের স্মৃতিতে এবারই প্রথম!
১৩০ রানে এগিয়ে স্বস্তিতে নেই টাইগার সমর্থকরা। টাইগারদের অতীত যে আশার মাঝে ভয়ের কারণ। কিউইরাও এবার বাইশ গজে নেমেছে, কিন্তু এক অজানা ভয়কে সাথে নিয়ে। সেই ভয় আরও বাড়িয়ে দেন উদ্যোমী তাসকিন; দারুণ ডেলিভারিতে ভেঙে দেন টম লাথামের স্ট্যাম্প! পরের গল্পটা আরও একবার নিজেদের করতে চেয়েছিলেন কনওয়ে – ইয়ং। গল্পের শুরুটাও ছিলো তাদেরই পক্ষে। কিন্তু….
এবাদতের জোড়ালো আবেদন মন গলাতে পারেনি আম্পায়ারের, মুমিনুলও নিয়ে নেন সাহসী সিদ্ধান্ত। রিভিউয়ে শেষ হাসি হাসেন এবাদত, মাতেন তার চিরচেনা সেলিব্রেশনে। ততক্ষণে ইএসপিএনে এক প্রকার মজার একটা কথাও ভেসে উঠেছিলো, যেখানে দুই বছর আগে কোহলিকে আউট করে সেলিব্রেশনের কথা তুলে ধরে শুভ কামনা জানানো হয় বাবর আজম ও কনওয়কে!
ততক্ষণে আরও একবার যেনো ম্যাচে ফিরেছিলো বাংলাদেশ। কিন্তু সেই স্বস্তি রইলো না বেশিক্ষণ। অভিজ্ঞ টেইলর যেনো৷ ইয়ংকে দিচ্ছিলেন ভরসা। ইয়ংও দলকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন, স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন বড় সংগ্রহের। এরমাঝে ফিফটির উদযাপনও করেছেন ইয়ং। বাংলাদেশের ১৩০ রান টপকে কিউইরা লীড নিয়েছিলো ৬ রানেই! হাতে তখনও আট উইকেট, বড় সংগ্রহের আশা কে বা দেখবো না? কিন্তু এই বাংলাদেশ যেনো দুর্দান্ত, বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।
তখনও এবাদতকে নিয়ে হাসাহাসি কম হয়নি, এর পেছনে কারণও ছিলো না কম! কিন্তু ব্যর্থতাকে আড়াল করতে বেশকিছু করতে হয়না, টেস্ট ক্রিকেটকে জমিয়ে দিতে হ্যাটট্রিকের প্রয়োজন পড়েনা। তবে এবাদত ঠিকই হ্যাটট্রিক করলেন, তবে টানা তিন বলে ৩ উইকেট নিয়ে নয়, দুই ওভারের ব্যবধানে ৩ উইকেট নিয়েই। যেখানে ইয়ংকে দিয়ে শুরু, দারুণ একটা বলে ইয়ংয়ের স্ট্যাম্প ততক্ষণে তছনছ, পরের উদযাপনে মাততে বলের ব্যবধান মাত্র ২! এবার স্ট্যাম্প ভেঙেছে নিকোলাসের। ততক্ষণে এবাদত যেনো জিরো থেকে হিরো হবার পথে….
পরের ওভারে আবারও উদযাপনে মেতেছিলেন এবাদত। কিউইদের পাঁচ উইকেটের চার উইকেটই তখন এবাদতের পকেটে। দিনশেষে টেইলরের সাথে রবীন্দ্রর ব্যাটে ১৭ রানে এগিয়ে কিউইরা। একদিকে কিউইরা হারের ভয়ে আরেকদিকে টাইগাররা ইতিহাস গড়ার পথে; চতুর্থ দিন শেষে গল্পটা ছিলো এমনই!
জয়ের পাল্লা তখনও টাইগারদের দিকেই হেলে! তবুও কোথাও একটা ভয়, কোথাও একটা শূন্যতা। কিন্তু পঞ্চম দিনের ভোরটা টাইগাররা এতোটা রোমাঞ্চকর করে তুলবে সেটি ক’জনই বা ভেবেছিলো! ভেবেছিলো হয়তো অনেকেই, তবুও একটা ভয় নিয়েই।
মাউন্ট মঙ্গানুইনের সকাল কিংবা হাজার মাইল দূরে বাংলাদেশের ভোর; সবটাই যেনো ছেয়ে গেছিলো এবাদতের একটা বলের গল্পেই! টেইলর ততক্ষণে পথ ধরেছে সাজঘরের। এবাদত বিধাতাকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে সিজদাহ্ করেছেন মাউন্ট মঙ্গানুইনে। আর করবেই না বা কেন? ২০১৩ সালের পর বাংলাদেশী পেসার হিসেবে সংগ্রহ করেছেন পাঁচ উইকেট, এদিকে যে স্বরনালী ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখায় যায়।
পরের গল্পে তাসকিন হয়ে উঠেন দুর্দান্ত, এবাদতও ছাড়িয়ে যান নিজেকে। কিউই শিবিরে শেষ পেরেকটা যতক্ষণে মিরাজ বসিয়ে দিলেন ততক্ষণে দ্বাদশ ক্রিকেটার তাইজুল যেনো ফ্রেমে বন্দী হয়ে রইলেন দুর্দান্ত এক ক্যাচ নিয়ে। কিউইরা অলআউট মাত্র ১৬৯ রানে। বাংলাদেশের সামনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা মাত্র ৪০….
ইতিহাস ডাকছিলো বাংলাদেশকে! এর আগেও কিউইদেশে বহুবার খেলেছে কিন্তু একটা জয়ের দেখা পাননি, এবার পেতে চলছে; সেটিও ক্রিকেটের রাজকীয় ফরম্যাটেই। এমন মধুর স্বাদ কি এর আগে কখনো পেয়েছিলো বাংলাদেশ! হয়তো না।
৪০ রানের জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নামা বাংলাদেশ ভয় পেয়েছিল আরও একবার, শুরুতেই ফিরেছিলো ওপেনার সাদমান! আরেক ওপেনারের বিদা ঘটেছে ইনজুরির মাধ্যমে।সহজ সমীকরণে বাংলাদেশে দুই উইকেট নেই! সেই ভয়কে জয় করলেন মুমিনুল ও শান্ত! দুইজনের দারুণ জুটির পর টেইলরের এক হাতের ক্যাচে শান্ত ফিরলেও জয়কে মুঠোবন্দি করতে পারেনি কিউইরা। মুশির ব্যাটে যতক্ষণে বল সীমার স্পর্শ করেছিলো ততক্ষণে বাংলাদেশ মেতেছিলো উল্লাসে, বিজয়ী পতাকা উড়িয়ে!
লাল-সবুজের দেশে এমন ভোর এসেছিলো কখনো? যেখানে পুরো নিস্তব্ধ শহরে মূহুর্তেই যেনো উল্লাসের জোয়ার। মাউন্ট মঙ্গানুই তো বটেই, বাংলাদেশ কিংবা ক্রিকেট বিশ্ব; ততক্ষণে সবাই মেতেছিলো বাংলাদেশ বন্দনায়। আর এটাই যে পাপ্য বাংলাদেশের।
SENA দেশের বিপক্ষে টানা পাঁচদিন লড়াই করে যাওয়া বাংলাদেশ যে এবারই প্রথম দেখা দিলো। যেই দলে নেই রিয়াদ, তামিম, সাকিবের মতো অভিজ্ঞ মুখ। তারুণ্যে ভরপুর একটা দলই কি না কিউইদের নাভিশ্বাস তুলে নিলো, সেটিও তাদের মাটিতেই।
এমন একটা রোমাঞ্চকর সকাল কি বাংলাদেশ দেখেছিলো কখনো! যেই সকালে টাইগাররা বদলে দিয়েছে ইতিহাস। যেই ইতিহাসে কন্ডিশন ও প্রতিপক্ষ বিবেচনায় এটি বাংলাদেশের সেরা জয়ের তকমা পাবে নিঃসন্দেহে। যেখানে জিরো থেকে হিরো হবার গল্পটা এবাদত লিখেছেন নিজের নামে, নিজের মতো করেই। পুরো টিম যেনো জানিয়ে দিয়েছেন তারা অঘটন ঘটিয়ে নয়, নিজেদের সেরাটা দিয়েই উদযাপনে মেতেছে জয়ের!
টেস্ট ক্রিকেট তো এমনি, যেখানে মূহুর্তেই বদলে যাবে দৃশ্যপট! এবাদতরা এমন একটা স্পেলের জন্যই বনে যাবেন নায়ক। তরুণ জয় কিংবা শরিফুলরা তারুণ্যকে জয় করে বিশ্বকে জানান দিবেন তারাও তৈরি হচ্ছে বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করতে। উদ্যোমী তাসকিন কিংবা একটুখানি আড়ালে থেকে মিরাজও যেনো নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের পথে। কাপ্তান মুমিনুল হয়তো এই একটা জয়ের স্মৃতিতে ফিরে আসবে বারবার। ক্রিকেট সুন্দর; আর সেটি যদি উপহার দেয় বাংলাদেশ তাহলে তো উন্মাদনা একটু বেশীই হবে।
এমন সকালের অপেক্ষায় থাকতে কয়েকটা রাত নিদ্রাহীন কাটিয়ে দিলেন হয়তো আক্ষেপ থাকবে না, থাকবে না শীতের ভোরের ঘুম ত্যাগের কষ্টও! অভিনন্দন টিম বাংলাদেশ। তোমাদের ঐ হাসিমুখ আমরা ফিরে পেতে চাই প্রতিটা ম্যাচেই……
এখন না হয় এই ঐতিহাসিক জয়ের স্মৃতিতেই রয়ে যাই!