ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফুলঝুরি; জাতীয় দলের শুরুটা ছিলো যাচ্ছেতাই! টানা ব্যর্থতা যখন ঘিরে ধরেছিলো তাকে তখনি ফাইনালে জ্বলে উঠেছিল তার ব্যাট। ফাইনালের মঞ্চে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া লিটন এখন ওয়ানডে ক্রিকেটে দেশের পক্ষে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের মালিক। বাইশ গজে ক্লাস দেখিয়ে মুগ্ধ করার পাশাপাশি আশা দেখাচ্ছেন রঙিন দিনের! উত্থান পতনের গল্পে তার ক্লাসিক ব্যাটিংয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছে বিশ্ব ক্রিকেটে। বর্তমান সময়ে সাদা পোশাকে রঙিন সময় কাটানো সেই তিনি রঙিন পোশাকেও নিজেকে খুজে পাওয়ার চেষ্টায়। যাকে নিয়ে আজকের গল্প তিনি লিটন কুমার দাস।
বাইশ গজে ব্যাটের সাথে বলের কি দারুণ স্পর্শ, গ্যাপ লগিয়ে বল ততক্ষণে সীমানার ছোঁয়া পেয়েছে। ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে কি মধুর সব শব্দ ভেসে আসছে। লিটন, ক্লাসিকাল লিটন!
- ক্লাস ব্যাটসম্যান! সত্যিই?
- হ্যা।
আপনি যদি কোহলি-বাবর-রুটদের ব্যাটিং উপভোগ করে শান্তি পেয়ে থাকেন তাহলে লিটনের ব্যাটিং দেখেও মুগ্ধ হতে হবে। ক্রিকেট ব্যকরণ মেনে দারুণ সব শট খেলে মন জয় করেছেন হাজারো ভক্তদের। পুল শট, ড্রাইভ কিংবা ফ্লিক; ক্রিকেটের ব্যকরণের প্রায় সব শটই যেনো তার চেনা। দ্রুতগতির বলটিকে পিওর টাইমিংয়ে সীমানা ছাড়া করার দৃশ্য আপনাকে তৃপ্তি দিতে বাধ্য৷ আপনি একজন লিটনকে নিয়ে হাজারো সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু তার শটগুলো আপনাকে তার প্রেমে ফেলতে বাধ্য করবে। ঐ যে একটা কথা আছে, সবাই ভালোবাসে কিন্তু সবার ভালোবাসা নিতে পারে বা ক’জন! এতো সব মধুর কথা তাকে নিয়ে তবুও কোথায় জানি একটা শূন্যতা বা হতাশার জন্ম নেয়!
- হতাশা! কোথায়?
লিটন বাইশ গজে তার ক্লাস দেখালেও এখনো হয়ে ওঠেনি ধারাবাহিক! রঙিন পোশাকে অধারাবাহিক লিটন অবশ্য সাদা পোশাকে কাটাচ্ছেন রঙিন সময়। লিটনের ক্রিজে আসা, এরপর তার পিওর ক্লাস দেখতে মুখিয়ে থাকতে কয়েকটা মিনিট কাটিয়ে দেওয়া যায়। আপনি লিটনের ব্যাটিং দেখলে একটুও মনে করতে পারবেন না যে লিটন আইট হবে! কিন্তু বাস্তবতা বড্ড কঠিন, যেই শটগুলো আরেকটু জোর দিলে সীমানার ওপারে আঁচড়ে পড়ার কথা ছিলো সেখানে বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ কিংবা হঠাৎই দিক হারিয়ে উইকেট গিফট করা যেনো তার নিত্যদিনের ঘটনা।বাইশ গজে লিটনের আগমনের পর যেটুকু সময় ক্রিজে থাকেন তাতেই মাতিয়ে তুলতে সক্ষম হলেও প্রায় ম্যাচেই হতাশ করে ফিরেন সাজঘরে। যেখানে ক্লাসের মূল্য থাকেনা। থাকে হতাশার গল্প।
অথচ এই লিটনকে নিয়েই ২০১২ সালে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন ইংলিশ কোচ ইয়ান পন্ট! বলেছিলেন, ‘আগামীতে বাংলাদেশ দল এমন একজন ক্রিকেটারকে পেতে যাচ্ছে, যার মধ্যে আমি সুপারস্টার হওয়ার সব লক্ষণই দেখতে পেলাম। তার নাম লিটন দাস।’
পন্টের এই বাণী সঠিক প্রমাণ করতে সময় নেননি লিটন দাস! বছর তিনেক পর জাতীয় লীগে ৫ সেঞ্চুরিতে ৮৩.৩৩ গড়ে ১০২৪ রান করে জানান দিয়েছিলেন নিজের সামর্থ্যের। সেই সাথে নজরে এসেছিলেন জাতীয় দলের নির্বাচকদের। লাল-সবুজের জার্সিতে সুযোগও এসেছিলো, কিন্তু শুরুটা ছিলো হতাশাজনক; বড্ড আশাহত করেছিলেন লিটন।
হতাশাজনক পারফরম্যান্সে জাতীয় দলে জায়গা হারানো লিটন ২০১৭ এ ঘরোয়া ক্রিকেট করে বসেন ডাবল সেঞ্চুরি! সেই সিজনে ১৪ ম্যাচে ৭৫২ রান করে জায়গা করে নিয়েছিলেন ভারতের বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট সিরিজে। এরপর থেকে জাতীয় দলে প্রায় নিয়মিত দেখা গেলেও ধারাবাহিকতায় এখনো নিয়মিত হতে পারেননি এই ক্লাস ব্যাটসম্যান।
- আচ্ছা, লিটন কি শুধু হতাশাতেই ডুবিয়েছেন?
হয়তো না! হতাশাজনক পারফরম্যান্সের মাঝেও লিটন নিজেকে চিনিয়েছেন বেশ কয়েকবার। এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি! বিশ্বমঞ্চে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হার না মানা ৯৪ রানের ম্যাচ জয়ী ইনিংস কিংবা ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে রেকর্ড ব্যাটিং। সেই সাথে তামিম ইকবালকে টপকে দেশের পক্ষে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের মালিক বনে যাওয়া লিটন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে ঝড়ো ব্যাটিংয়ে চিনিয়েছেন নিজেকে। এর পরের গল্প সাদা পোশাকে রঙিন বছরকে ঘিরে। যেখানে সাদা পোশাকে লিটন যেনো নিজের চেনা রূপে দেখা দিয়েছিলেন। ২১ সালের পর ২২ সালে এসেও সাদা পোশাকে লিটনের ধারাবাহিকতা চোখে পড়ার মতো। এর মাঝে কিউই দেশে সাদা পোশাকে সেঞ্চুরির উদযাপনও করেছেন তিনি। এই সবকিছুর কারণে হয়তো কিছুটা ছাড় পেতেই পারেন এই ক্লাসিক ব্যাটসম্যান।
- লিটনের শুরুটা কেমন ছিলো?
ফিরে যাবো অনূর্ধ্ব -১৯ ক্যারিয়ারে। যেখানে লিটন নিজের ক্লাস দেখিয়েছেন ২০১২-১৪ মৌসুমেই। লাল-সবুজের জার্সিতে বাইশ গজে এক ভয়ংকর রূপ ধারণ করা লিটন সর্বোচ্চ ১০২ রানে ৪৭ গড়ে নামের পাশে যুক্ত করেছিলেন ঠিক ৫৬৪ রান। যেখানে অস্ট্রেলিয়া এবং আরব আমিরাতে মাটিতে লিটনের ব্যাটিং গড় ছিলো ৫২.৪০ এবং ৫০.০০! সবমিলিয়ে বলতে গেলে লিটন তার ক্লাস অনেক আগে থেকেই দেখিয়ে আসছেন।
- জাতীয় দলে লিটনের পারফরম্যান্স!
২০১৫ সালে সাদা পোশাকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা শুরু হওয়া লিটন বাংলাদেশের পক্ষে ১৫ তম ব্যাটসম্যান হিসেবে ১০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন ইতিমধ্যেই। সাদা পোশাকে ২৯ ম্যাচে ১১ ফিফটির দেখা পাওয়া লিটন সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছেন ২ টি। বর্তমান সময়ে টেস্টে বাংলাদেশের অন্যতম ধারাবাহিক টেস্ট ব্যাটার এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার।
সাদা পোশাকের গল্প শেষ করে ওয়ানডে ক্রিকেটে নজর দিতেই লিটন মন্দের ভালো হিসেবে প্রমাণ করেছেন নিজেকে। ২৯.৬৭ গড়ে নামের পাশে যুক্ত করেছেন ১৩৩৫ রান; যেখানে ৪ সেঞ্চুরির সাথে রয়েছে ৩ ফিফটি। এছাড়াও এশিয়া কাপের ফাইনালে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে করেছেন সেঞ্চুরির রেকর্ড!
টি-২০ তেও বাইশ গজ মাতিয়েছেন লিটন দাস! এই ফরম্যাটে লিটন নিজের ক্ষুধা মেটাতে পারেননি এখনো। জাতীয় দলের পক্ষে ৪৬ ম্যাচে ১৯.১৮ গড়ে করেছেন ৮৪৪ রান। রয়েছে ৪ ফিফটি।
- ঘরোয়া ক্রিকেটে একজন লিটনের পারফরম্যান্স:
প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ৭৭ ম্যাচে ৪৮.৮৫ গড়ে ১৭ সেঞ্চুরিতে নামের পাশে যুক্ত করেছেন ৫৯৬০ রান! এছাড়াও লিস্ট এ ক্রিকেটের ১২৪ ম্যাচে ১১ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৪৪৪৬ রান। সাথে টুয়েন্টি টুয়েন্টি ক্রিকেটে ১৩৯ ম্যাচে যুক্ত করেছেন ২৮৯৫ রান।
লিটন দাস; বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা ক্লাসিক ব্যাটসম্যান। যেটুকু সময় ক্রিজে থাকেন সেটুকু সময়েই হতাশা বাড়িয়ে দেন কয়েকগুণ। দিনশেষে লিটন নিজের দূর্বলতা গুলো কাটিয়ে উঠে ধারাবাহিক হবেন এমনটাই চাওয়া। একজন লিটনের হাত ধরেই বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়ে যাক অনেকদূর।
শুভ জন্মদিন লিটন দাস।
