(Photo by Charlie Crowhurst/Getty Images for MCC)
বাংলাদেশ ক্রিকেটে আশার ফুল হয়ে আসা আশরাফুলের ক্লাসিক কিংবা বিপক্ষের বোলারদের চোখে চোখ রাঙিয়ে খেলে যাওয়ার দৃশ্য যতোটা মন কেড়েছে, তার চেয়ে কোনো অংশেই কম মন কাড়েনি চিত্রা নদী দাপিয়ে বেড়ানো ম্যাশ কিংবা জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা হাঁকানো তামিম! পিছিয়ে ছিলেন না রিয়াদ কিংবা মুশফিকরাও। ম্যাশ – তামিমে দেশসেরা বোলার কিংবা ব্যাটারের অভাব পূরণ হলেও অলরাউন্ডারের অভাব পূরণ হয় ফুটবলার বাবার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে ক্রিকেটকে বেছে নেওয়া সাকিব আল হাসানের হাত ধরেই।
দেশসেরা অলরাউন্ডার তো বটেই, সাকিব নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন বহু আগেই, ২০০৯ সালে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার হয়েই। গল্পটা শেষ হতে পারতো এখানেই, কিন্তু সাকিব যে নিজের সাথে চ্যালেঞ্জ নেওয়া এক স্বপ্নবাজ তরুণ! যে কি না একই সাথে তিন ফরম্যাটেই বনে গেছিলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। ব্যাটে-বলে বাইশ গজে কতশত গল্পের রচয়িতা সাকিব বনে গেছেন রেকর্ডের বরপুত্র। কি দুর্দান্ত, কি দুরন্ত।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিব পাড়ি দিয়েছে দেড় দশক। পৌঁছেছেন গ্যারি সোবার্স, জ্যাক ক্যালিস, ইয়ান বোথাম, কপিল দেবদের কাতারে; কিছু ক্ষেত্রে তো ছাড়িয়েও গেছেন। কি নেই সাকিবের নামের পাশে? বিশ্বমঞ্চে ব্যাটে-বলে সবার উপরে, নাম্বার ওয়ান! একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট, ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেছে মোটেই তিনবার। এর বাহিরে কতশত রেকর্ড, কতশত কীর্তিতে নিজের নামটি লিখেছেন তার ইয়ত্তা নেই। একজন সাকিব তার স্বপ্নের চেয়েও বড়, যিনি প্রতিনিয়ত ছাড়িয়ে যাচ্ছেন নিজেকে, এগিয়ে যাচ্ছেন সাফল্যের চূড়ায়।
একজন সাকিব, একজন কিংবদন্তি; অন্যতম সেরা, কখনো বা সেরাদের সেরা। যাকে নিয়ে লেখা যাবে বেশকিছু মহাকাব্য। যেখানে ক্যারিয়ারের শুরুর গল্পটি এড়িয়ে গিয়ে মাঝের গল্পতেই শেষ হবে কয়েকটা উপন্যাস। তবে আমি সেদিকে যাচ্ছি না, শুরু থেকে শেষ, জানার চেষ্টা করবো কিঞ্চিৎ পরিমাণে…
৯৭’ এ আকরাম খানের হাত ধরে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন ট্রফি জয়। এরও বেশ আগে ক্রিকেটে মজে যাওয়া সাকিব সেদিন দেখেছিলেন নতুন স্বপ্ন। বাবার স্বপ্নকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সাকিব বেছে নেন ক্রিকেটকে। আজকের বাঁহাতি স্পিনারের শুরুটা হয়েছিলো পেসার হিসেবে। কয়েকটা বছর পাড়ি দেন স্বপ্নকে তাড়া করে, অতঃপর ২০০১ সালে এসে মাগুরায় একটা ম্যাচে সাকিব হয়ে উঠেছিলেন বিধ্বংসী; ব্যাটে-বলে প্রতিপক্ষকে গুড়িয়ে দিয়ে নজর কেড়েছিলেন আম্পায়ার সাদ্দাম হোসেনের। এরপর মাগুরার ইসলামপুর পাড়া স্পোর্টিং ক্লাবে ভর্তি হওয়া, কাচের পরামর্শে পেসার থেকে স্পিনার বনে যাওয়া। পরের গল্পে ভাগ্য বদল, বিকেএসপিতে তৎকালীন ২০ প্রতিভাবানের মাঝে একজন বনে যাওয়, অতঃপর বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাম্পে সুযোগ করে নেওয়া। দিনশেষে বিশ্বসেরা বনে যাওয়ার পথ উন্মোচন, যদিও এর আগে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। সাকিব ছিলেন সেখানেও দুর্দান্ত!
পরের গল্পে হারারেতে ১৯ বছর বয়সী সাকিবের স্বপ্ন পূরণ, মাত্র এক ম্যাচ খেলেই বিসিবির চুক্তিতে আসা কিংবা এক বছরের ব্যবধানে তিন ফরম্যাটে সুযোগ করে নেওয়া, হয়তো সাকিব বলেই সম্ভব! লাল-সবুজের জার্সিতে রঙিন পোশাকে অভিষেক ম্যাচে চিগুম্বুরাকে আউটের পর ৩০ রানে অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়া সাকিবের ১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ওয়ানডেতে ব্যাটিং গড় কখনো নামেনি ৩০ এর নিচে! ক্রিকেট বিশ্বে এমন কৃতিত্ব নেই আরও কারও।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১২০০০ রান ও ৫০০ উইকেট শিকার করেছেন এমন ক্রিকেটারের সংখ্যা মাত্র দু’টি। যার একটি জ্যাক ক্যালিস অপরটি সাকিব। এবার রান একই রেখে উইকেট সংখ্যা ৬০০ করলে যেটি দাঁড়াবে সেখানে একমাত্র নাম সাকিব।

(Photo by Vijayanand Gupta/ Hindustan Times via Getty Images)
সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ফিরলে সাকিব রেকর্ড বয় তকমা পাবে নিরদ্বিধায়। এই ফরম্যাটে কমপক্ষে ৪০০০ রান ও ২০০ উইকেট শিকার করেছেন এমন ক্রিকেটার মাত্র ৬ জন, যেখানে রয়েছে সাকিবের নাম। পরের গল্পে একই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নিয়েছেন মাত্র ৪ জন, যেখানে চতুর্থ নামটি সাকিবের। এছাড়াও একই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ইনিংসে পাঁচ উইকেটের রেকর্ডে রয়েছে সাকিবের নাম। টেস্টে ৯ টি দেশের বিপক্ষে ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন এমন বোলারের সংখ্যা চারটি, যেখানে সাকিব একমাত্র ক্রিকেটার যার ৯ টি দেশের বিপক্ষে ইনিংসে পাঁচ উইকেট ও টেস্ট ক্যারিয়ারে সেঞ্চুরি করেছেন! টেস্টে দ্রুততম ৪ হাজার রান ও ২০০ উইকেট শিকারী ক্রিকেটারও সাকিব।

(Photo by Robert Cianflone/Getty Images)
রঙিন পোশাকেও রঙিন সাকিব, ব্যাটে-বলে এখানেও সেরাদের কাতারে; বিশ্বমঞ্চে তো সেরাদের সেরা। ওয়ানডে ক্রিকেটে ৬০০০ হাজার রান ও ২৫০ উইকেট নিয়েছেন এমন চারজনের মাঝে রয়েছে সাকিবের নাম! একই ম্যাচে সেঞ্চুরির সাথে রয়েছে চার উইকেট, ফিফটির সাথে পাঁচ উইকেট। একই গ্রাউন্ডে রয়েছে ২০০০+ রান ও ১০০ উইকেট, ক্রিকেট বিশ্বে এমন নজির আর কারো নেই! ওয়ানডেতে সাকিবের অভিষেকের পর একই ম্যাচে ৫০+ রান ও কমপক্ষে ২ উইকেট নিয়েছে এমন লিস্টে সাকিব সবার উপরে, এই ফরম্যাটে চার নাম্বার পজিশনে সর্বকণিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ানও মি. সাকিব!

(Photo by Daniel Berehulak/Getty Images)
আন্তর্জাতিক টি-২০ ক্রিকেটেও পিছিয়ে নেই সাকিব, রয়েছে ১৫০০+ রান ও ১০০+ উইকেট; ছেলেদের টি-২০ ক্রিকেটে এমন রেকর্ড শুধুই সাকিবের দখলে। নির্দিষ্ঠ মাঠে কমপক্ষে ৫০০ রান ও ৩০ উইকেট রয়েছে শুধুই সাকিবের। বিশ্বমঞ্চে একই ম্যাচে ৪০+ রান ও ৪ উইকেট শিকারী একমাত্র ক্রিকেটার সাকিব। এছাড়াও অধিনায়ক হিসেবে প্রথমবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকার করেন সাকিব!

এবার বিশ্বকাপে নজর দিলে সাকিব অনন্য। ওয়ানডে বিশ্বকাপের এক আসরে ৫০০ রান ও ১০ উইকেট শিকারী একমাত্র অলরাউন্ডার সাকিব! এছাড়াও এক আসরে সর্বোচ্চ ৭ বার ৫০+ রানের ইনিংস খেলেছে এমন ক্রিকেটার মাত্র দুই জন, যার একটি সাকিব। একই ম্যাচে ফিফটি ও পাঁচ উইকেট শিকারী দুই ক্রিকেটারের একজন সাকিব একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে নির্দিষ্ট কোনো বিশ্বকাপের সবগুলো ইনিংসে খেলেছেন ৪০+ রানের ইনিংস। এছাড়াও বিশ্বকাপে ১০০০ রান ও ৩০ উইকেট শিকারী একমাত্র ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। টি-২০ বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার সাকিব ব্যাটে-বলে নিজেকে নিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়।
এতসব রেকর্ড, ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার বলতে দ্বিধা নেই কারও। কিন্তু একজন সাকিব নিজেকে এমন পর্যায়ে নিয়েছে যে, তিনি শুধুমাত্র বোলার কিংবা ব্যাটার হয়েও দলে সুযোগ পেতে পারতেন নিয়মিত। এতসব রেকর্ড ছাড়াও আর কতশত রেকর্ডে নিজেকে জড়িয়েছে সেটির হিসেব মেলানো কঠিনও বটে। রেকর্ড পাতা আড়ালে রাখলে ভেসে উঠবে কিছু সোনালী স্মৃতি, সেগুলোতে একটু নজর দিলে কি মন্দ হয়?
বাংলাদেশ দল এখন দক্ষিণ আফ্রিকায়। তবে আমি ফিরে যাবো ২০০৮ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথমবার টেস্ট খেলতে নামা সাকিব প্রথম দিনে ২৬ ওভার হাত ঘুরিয়ে উইকেটশূন্য; একবুক হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়া সাকিব গুরু সালাউদ্দিনের একটা টোটকা কাজে লাগিয়ে দ্বিতীয় দিনে বনে গিয়েছিলেন বিধ্বংসী, যেই সাকিব প্রথম দিনে ২৫ ওভার বোলিং করে উইকেট শূন্য, সেই সাকিব দ্বিতীয় দিনে মাত্র ১৩ ওভার বোলিং করে পকেটে পুড়েছিলেন ৫ উইকেট। এই দুর্দান্ত সাকিবকে কিভাবে ব্যখা করা যায় সেটিই বুঝে উঠা মুশকিল!

(Photo by Lee Warren/Gallo Images/Getty Images)
এবার আরেকটু পিছনে ফিরে গেলে বিশ্ব ক্রিকেটে সাকিব পরিচিত ছিলেন পুরোদস্তুর ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবে, পরিসংখ্যান বলে ততোদিনে ৬ টেস্ট খেলে ফেলা সাকিবের ঝুলিতে মাত্র ৩ উইকেট। এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন কোচ সিডন্স জানিয়ে দিয়েছিলেন কিউইদের বিপক্ষে বিশেষজ্ঞ বোলার হিসেবে দেখা যাবে সাকিবকে; সিডন্সের এমন কথায় কিউররা অবাক হলেও সাকিব মোটেও বিচলিত হয়নি। সেই ম্যাচে প্রথম ইনিংসেই পকেটে পুড়েছিলেন ৭ উইকেট; কি দুর্দান্ত…

(Photo by Marty Melville/Getty Images)
সাকিব মাঠে নামবে, সেঞ্চুরির উদযাপন করবে আর রেকর্ড হবেনা তা কি করে হয়? ফেরা যাক ২০০৭ সালে, বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতার দিনে কানাডার বিপক্ষে ১৩৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেছিলেন চার নাম্বারে নেমে। আর এতেই ইতিহাসের পাতয় তুলেছিলেন নিজের নামটি, কেননা টিনএজার হিসেবে প্রথম সেঞ্চুরিয়ান এই সাকিবই। এছাড়াও ওয়ানডে ক্রিকেটে চার নাম্বার পজিশনে সাকিবের চেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরি করতে পারেননি আর কোনো ব্যাটার। আহ সাকিব, ইউ বিউটি।

এবার একটা লাফ দেওয়া যাক, ইয়ে বড়ো এক লাফ; ঠিক যেভাবে ৪ রান থেকে ৫৬ রান অব্দি সিঙ্গেল – ডবলস ছাড়া পৌঁছেছিলেন সাকিব! কি ভাবছেন, এটা আবার কেমন কথা। অবাক হলেও এমনটাই করে দেখিয়েছিলেন সাকিব, সেটিও হ্যামিল্টনে, সাদা পোশাকে নিজের প্রথম সেঞ্চুরির দিনে। সেদিন ৪ রান থেকে ৫৬ রান তথা ৫২ রান নিয়েছিলেন শুধুই বাউন্ডারি থেকে। এখানেই গড়েছিলেন রেকর্ড, কেননা টেস্ট ক্রিকেটে শুধুমাত্র বাউন্ডারিতে একটানা এতগুলো রান সংগ্রহ করতে পারেনি আর কেউই! এবার আপনি বলতেই পারেন সাকিব মাঠে নামে রেকর্ড গড়তেই।
ঘরের মাঠে ব্যাটে-বলে যা করেছেন তাতে সাকিব অনন্য, এই সাকিব যে অবাক করেছে ভিন্ন জায়গায়! সাদা পোশাকে ঘরের মাঠে রাজত্ব চালানো সাকিবের সেরা ইনিংস ও সেরা বোলিং ফিগার কিউইদের মাটিতে, রঙিন পোশাকের গল্পটাও এমনই, ব্যাটে-বলে সেরা ইনিংসই বিদেশের মাটিতে; টি-২০ ক্রিকেটের গল্পটাও এমনি হতে পারতো, যদি সেরা বোলিং ফিগার মিরপুরে না হতো!
সাকিব এগিয়ে যান নিজের মতো; ক্রিকেট পাড়ায় সমালোচনাও হয়না কম। অনুশীলনে অনীহা, করেননা ঘন্টার পর ঘন্টা বোলিং অনুশীলন কিংবা মেতে থাকেন না ব্যাট নিয়ে। কিন্তু ক্রিকেট মাঠে বড্ড সিরিয়াস সাকিব, কখনো স্পিন ঘূর্ণিতে আবার কখনো বা দুর্দান্ত কাট শটে বিপক্ষেকে ডুবিয়ে দেন হতাশায়। কখনো সুযোগ মিস করে ‘ইস’ করে হাত জড়ো করা আবার কখনো উইকেট শিকার করে স্যালুট দেওয়া, দু’হাত মেলে ছুটে চলা। আবার কখনও বা কাপ্তানের ভূমিকায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, খেলোয়াড়দের লিডার হয়ে আন্দোলনে ডাক দেওয়া। কি করেন নি সাকিব, সাকিব যেনো সবকিছুতেই অলরাউন্ডার!
একজন সাকিব, পুরো বাংলাদেশের অহংকার। এক সাকিবে কতো স্মৃতিরই না রচনা, রচিত হয়েছে কতো মহাকাব্য। ঘরের মাঠে কেঙ্গারু বধ, কিংবা ব্রিটিশ মূলকে রূঢ়মূর্তি ধারণ করা; সবটাই করে দেখিয়েছেন সাকিব। বাইশ গজে ব্যাটে-বলে শেষটা রাঙিয়ে দিয়ে সাকিব “সময়ের সেরা” থেকে “সর্বকালের সেরা” হয়ে বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে চাইবেন নিশ্চয়ই। আর এই সাকিবে স্বপ্ন বুনবে হাজারো তরুণ।
মাগুরার ফরসাল থেকে আজকের বিশ্বসেরা কিংবা পেসার থেকে স্পিনার অথবা জেনুইন ব্যাটিং অলরাউন্ডার থেকে পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার বনে যাওয়া সাকিবকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা…
❝শুভ জন্মদিন মি. রেকর্ড আল হাসান ❞